আবেদন
কোভিড গণহত্যা ও বিপর্যয়কর মোদী শাসনের বিরুদ্ধে নকশালবাড়ির বিপ্লবী ঐতিহ্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরুন
Uphold the Spirit of Naxalbari in Today

২৫ মে ১৯৬৭, পৃথিবী প্রথমবার শুনেছিল নকশালবাড়ির কথা। দার্জিলিঙের এক গ্রামে বিপ্লবী জাগরণের আগমনবার্তা ঘোষিত হয়েছিল যা ছিল কৃষক জনগণের অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াই, যাকে দমন করতে এগারোজন নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়, যারমধ্যে ৯ জন নারী, একজন পুরুষ ও দুই শিশুও ছিল। ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় কাঁপন ধরিয়ে নকশালবাড়ির স্ফুলিঙ্গ আসমুদ্র হিমাচলের সর্বাধিক নিপীড়িত ও প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে নিপীড়ন ও অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে ছিল।

এই বিদ্রোহকে দমন করতে তৎকালীন সরকার নির্মম নির্যাতন নামিয়ে আনে। বিদ্রোহের আগুনের মধ্যে গড়ে ওঠা এক নতুন কমিউনিস্ট পার্টি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-কে মুছে ফেলতে তার নেতৃবৃন্দ, সংগঠক, সদস্য এমনকি সমর্থকদের হত্যা ও কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু সিপিআই(এমএল) নতুন প্রাণশক্তিকে সাথে নিয়ে ফিরে আসে। নকশালবাড়ি আজ ভিন্নমত প্রকাশের অদম্য সাহসের এক অভিব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে, ফ্যাসিস্ট শাসনের ভারতে ভিন্নমত পোষণকারী যে কোনো সাহসী মানুষদের আজ ‘শহুরে নকশাল’ (urban naxal) বলে অভিহিত করা হচ্ছে।

ভারতের নিপীড়িত জনগণের দৃঢ়তা প্রদর্শনের গৌরবগাথাকে স্মরণ করার মুহূর্তে বিপুলভাবে পরিবর্তিত ভারতবর্ষের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং আজকের ভারতে নকশালবাড়ির চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। ভারতের খন্ডিত স্বাধীনতালাভের দু’দশক পর ১৯৬৭ সালে সংগঠিত হয়েছিল নকশালবাড়ি, যখন ভারতের নতুন প্রজাতন্ত্র ও নয়া সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দ্বারা প্রতিশ্রুতিভঙ্গের কারণে ভারতজুড়ে হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছিল, সেই সময় কংগ্রেস নির্বাচনের ময়দানে মাটি হারাতে শুরু করেছিল, পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টদের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

চুয়ান্ন বছর পরে, পশ্চিমবঙ্গে এমন একটি নির্বাচন হল যেখানে বিজেপি ক্ষমতায় আসতে না পারলেও দার্জিলিং-এ নির্বাচনে বাকিদের মুছে দিয়েছে এবং বামবিহীন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় একমাত্র বিরোধী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। আমরা যদি ২৫ মে ১৯৬৭ সালের শহীদদের নাম স্মরণ করি তবে এগারো জন শহীদের মধ্যে চারজন ছিলেন (ধনেশ্বরী দেবী, সরুবালা বর্মণ, সোনামতী সিংহ ও ফুলমতী সিংহ) রাজবংশী সম্প্রদায়ের, অন্যরা তপশিলি মেচ ও ধিমাল সম্প্রদায়ের এবং এই সম্প্রদায়গুলি বর্তমানে সংঘ-বিজেপি নেটওয়ার্ক দ্বারা ভীষণই প্রভাবিত। নকশালবাড়ির বিপ্লবী উত্তরাধিকারকে আজকের বাংলার এই কঠিন সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে, রূপান্তর ঘটাতে হবে এবং বাম শিবির পুনর্নির্মাণে নেতৃত্বে আসতে হবে।

নকশালবাড়ির আহ্বান ছিল বিপ্লবের আহ্বান, মানুষের সাথে একাত্ম হওয়ার ও জনগণের সেবা করার আহ্বান। আজকের চ্যালেঞ্জ হল কোভিড ১৯ এবং মোদী২-এর বিপর্যয়কর আঘাত থেকে ভারতকে বাঁচানো। ভারতে সরকারী হিসেবে কোভিডের মৃত্যুসংখ্যা এখন ৩,০০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। গত দু’মাসে এই সংখ্যাটি দ্বিগুণ হয়েছে। ভারতে প্রতিদিনের মৃত্যুসংখ্যা সম্ভবত বাকি বিশ্বের মোট মৃত্যুর চেয়ে বেশি। এক বিপুল পরিসংখ্যান সরকারী গণনা এবং রিপোর্ট এর বাইরে থেকে যাচ্ছে। উত্তরপ্রদেশে গঙ্গায় ভাসমান মরদেহ ও নদীতীরে গণকবরের ঘটনা এবং বিহারে মাত্র একটি গ্রাম থেকে শতাধিকের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে! যদি ধরে নেওয়া যায় আসল পরিসংখ্যান সরকারী গণনার চেয়ে পনেরগুণ তবে আমরা ইতিমধ্যে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ লোককে হারিয়েছি যা ভারতে সারা বছরে মৃতের সংখ্যার অর্ধেক।

২০২০ সালের শুরু থেকে বিশ্ব মারাত্মক কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলায় কার্যকর ভ্যাকসিনের জন্য অপেক্ষায় ছিল। ২০২০’র শেষ দিকে ভ্যাকসিন এসে পৌঁছায় এবং শক্তিশালী দেশগুলি ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী কোভিড ভ্যাকসিনের উৎপাদন এবং সরবরাহের সিংহভাগ কুক্ষিগত করেছে। বিশ্ব ভ্যাকসিনের তীব্র বৈষম্য এবং অন্যায়ের অধীনে চলছে। মোদী সরকার, যা ভারতকে বিশ্বের ফার্মাসি হিসাবে বর্ণনা করে, এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কিছুই করেনি। আত্মনির্ভর ভারত সম্পর্কে বড় বড় কথা বলা সত্ত্বেও যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সার্বজনীন টিকাদান নিশ্চিতকরণ ও প্রয়োজনীয় পর্যায়ে ভ্যাকসিন তৈরি বা সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এরা কিছুই করেনি। এখন পর্যন্ত মাত্র ৩% ভারতীয়কে সম্পূর্ণরূপে টিকা দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের অধীনে একে ‘কোভিড গণহত্যা’ ছাড়া কি নামেই বা অভিহিত করা যায়! নকশালবাড়ির বিপ্লবী চেতনা অবশ্যই এই গণহত্যা প্রতিহত করার লড়াইয়ে আমাদের অনুপ্রেরণা ও দিশা দেবে।

নকশালবাড়ি প্রাথমিকভাবে ছিল এক কৃষক বিদ্রোহ। কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ থেকে কৃষিকে বাঁচাতে ভারতবর্ষ আজ এক ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের মাঝে রয়েছে। দিল্লী সীমান্তে কৃষকদের অনির্দিষ্টকালের ধর্ণা অবস্থান ২৬ মে ২০২১ সালে ছয় মাস পূর্ণ করেছে। কৃষকরা যখন মোদী সরকারের ধ্বংসাত্মক খামার আইন বাতিলের পক্ষে লড়াই করছে তখন শ্রমিকরা বেসরকারীকরণ এবং মোদী সরকারের নয়া শ্রমকোডের মাধ্যমে কর্পোরেট দাসত্ব ও অধিকারগুলো কেড়ে নেওয়ার মোদী সরকারের প্রয়াসকে প্রতিহত করছে। আজকের ভারতবর্ষে যুবক এবং ভারতের প্রথম সারির কোভিড যোদ্ধা – চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, ড্রাইভার, স্যানিটেশন কর্মীদের জন্য রয়েছে কেবলমাত্র অন্যায় ও অনিশ্চয়তা। সারা দেশের অক্সিজেন ও তাজা বাতাসের অভাবে দমবন্ধকরা পরিস্থিতির মতোই এক শ্বাসরোধকারী হিন্দুরাষ্ট্রের প্রকল্প নিয়ে হাজির হয়েছে সংঘ-বিজেপি। জনগণের মোহভঙ্গ ঘটছে, এক জনপ্রিয় বিদ্রোহের জন্য শর্তগুলি পরিপক্ক হচ্ছে। জীবন ও মৃত্যুর এই লড়াইয়ে, সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট কোম্পানিরাজ এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক জনগণের মধ্যকার এই লড়াইয়ে নকশালবাড়ির চেতনা আমাদের উজ্জীবিত করতে থাকবে।

- কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন 

খণ্ড-28
সংখ্যা-19