এরাজ্যে বিজেপি’র নতুন নীল নকশা কী?
What is the new blueprint of BJP

আগামী দিনগুলোতে এরাজ্যে বিজেপি’র এগিয়ে চলার গতিপথ কি হবে? এই নির্বাচন থেকে বিজেপি কি শিক্ষা নিয়ে সামনের দিনে নিজের তূণ থেকে বার করবে কোন বিষাক্ত আয়ুধ? তৈরি করবে কি ধরনের নতুন নীল নকশা?

মাত্র ৩টি আসন থেকে ৭৭টি আসনে জয় এবং বিধানসভার অভ্যন্তরে প্রধান বিরোধী হিসাবে আত্মপ্রকাশকে শীর্ষ নেতৃত্ব বিরাট সাফল্য হিসাবে তুলে ধরলেও আরএসএস ও দলের তাত্ত্বিক নেতারা এই ফলাফলে উজ্জীবিত নয়। আবেগ ও উচ্ছ্বাসে না ভেসে তারা বরং চিন্তা করছেন কোথায় নিহিত ছিল এই নেতিবাচক ফলাফলের উৎস? কোন মতাদর্শ-রাজনৈতিক ঘাটতির জন্য ২০১৯’র সাফল্যকে আরও এগিয়ে নিয়ে রাজ্যপাট দখল করা গেল না?একটা জোরালো মত (যেমন মোহিত রায়) হল, ২০১৯’র সাপেক্ষে এবারের ফলাফল নিশ্চিত ভাবেই পরাজয়। তাঁর মতে, “ভোটের শতাংশ বা সংখ্যা দিয়ে আসনের হিসাব সব সময় মেলে না। পশ্চিমবঙ্গে ২০১৯’র তুলনায় বিজেপি’র ভোট কমেছে প্রায় দু’শতাংশ, কিন্তু ২০১৯এ এগিয়ে থাকা আসনের তুলনায় প্রাপ্ত আসন কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ!”

তিনি মনে করেন, ২০১৯’র অভিযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে “বিজেপি’র প্রয়োজন ছিল একটি ভোট বিস্ফোরণ। তা হয়নি।”

আরএসএস’র অঘোষিত মুখপত্র অর্গানাইজার এই ফলাফলকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ‘বিপর্যয়’ বলেই চিহ্নিত করেছে। অর্গানাইজার জানিয়েছে, ২০১৯’র এগিয়ে থাকা ১২২টি আসনের থেকে এবার তা নেমে এসেছে ৭৭-এ। আর, তার পেছনে তিনটি কারণকে চিহ্নিত করা হয়েছে। (১) মমতা সরকার যে কর্মসূচীগুলো নামায় তার প্রভাব জাতপাত ও ধর্মের উর্দ্ধে উঠে প্রায় সমস্ত স্তরকেই প্রভাবিত করেছে, (২) বাছবিচার না করে, ক্ষমতা ও প্রভাব না দেখে তৃণমূল থেকে অনেককে দলে নিয়ে নেওয়াটা ‘খারাপ পরীক্ষা নিরীক্ষা’ (ব্যাড এক্সপেরিমেন্ট) বলা হয়েছে, (৩) শেষের দু’টি পর্যায়ে কোভিড পরিস্থিতি মমতার পক্ষেই গেছে, বিজেপি এই পর্যায়ে খুব খারাপ ফল করেছে। (সূত্রঃ ব্যাড এক্সপেরিমেন্ট ইন বেঙ্গল, নবীন কুমার, অর্গানাইজার, ১৩ মে, ২০২১)

খুব উদ্বেগের সাথে অর্গানাইজার লিখেছে যে, চারটে গুরুত্বপূর্ণ জেলায় বিজেপি খালি হাতে ফিরে এসেছে। জেলাগুলো হল - ঝাড়গ্রাম (৪টি আসন), দঃ ২৪ পরগণা (৩১ আসন), পূর্ব বর্দ্ধমান (১৬টি আসন), কলকাতা (১১টি আসন)। তফশিলি জাতি উপজাতির মধ্যেও বিজেপি যে ভাল ফল করতে পারেনি তা স্বীকার করে ওই পত্রিকা দেখিয়েছে যে জঙ্গলমহলে মোট ৫১টি আসনের মধ্যে সে পেয়েছে মাত্র ১৭টি আসন। এমনকি মতুয়া সম্প্রদায়ের কাছ থেকেও তারা আশানুরূপ সাড়া পায়নি।

কিছুটা আপশোষ করে প্রবন্ধের লেখক লিখেছেন, কংগ্রেস ও বামেরা মিলিতভাবে যদি ২০১৯’র ভোট ধরে রাখতে পারতো, তবে বিজেপি পেত ৯৩ আর তৃণমূলকে ১৮১-তেই আটকে রেখে দেওয়া যেত। জলপাইগুড়ি জেলায় ২৭টি আসনের মধ্যে ২১টি বিজেপি পাওয়ায় অর্গানাইজার সন্তোষ প্রকাশ করেছে।

দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বিজেপি’র প্রাক্তন রাজ্য সভার সাংসদ ও এবার বিধানসভায় বিজেপির পরাজিত প্রার্থী স্বপন দাশগুপ্ত একটি লেখায় বিজেপির ফলাফল বিশ্লেষণ করেছেন। প্রবন্ধের শিরোনাম ‘লেসেন্স লার্ন্ট’। এই লেখায় তিনি দেখিয়েছেন “... মমতা দেখিয়ে দিয়েছেন যে, রাজ্যের সংখ্যাগুরু সম্প্রাদায়ের নির্ণায়ক সমর্থন ছাড়াই নির্বাচনে বিরাট জয় ছিনিয়ে আনা যায়”। তিনি তার ব্যাখ্যার সপক্ষে সিএসডিএস-লোকনীতির পরিসংখ্যান হাজির করে বলেছেন, ২০১৬ সালে তৃণমূল মুসলমানদের ৫১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ শতাংশে। আর, ২০২১এ ৭৫ শতাংশে। হিন্দুদের তুলনায় এবার মুসলমানেদের ভোট দেওয়ার হার ছিল অন্তত তিন শতাংশ বেশি। স্বপন দাশগুপ্তের মতে, এরাজ্যে নিদেনপক্ষে মোট হিন্দুভোটের ৬০ শতাংশ ভোট পেলে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারতো। তবে, সংখ্যাগুরু হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সংখ্যাধিক্য ভোট পেতে হলে, স্বপনবাবুর মতে, বিজেপির দরকার ছিল অন্তত ৬০ শতাংশ হিন্দু ভোট। আর তা পেতে হলে ঠিক যেভাবে মুসলিম ভোট পুরোপুরি সংহত হয়ে তৃণমূলের দিকে গেল, একই ভাবে হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভোটেরও সংহত হওয়া দরকার ছিল। এটাই মোহিতবাবুর পরিভাষায় ‘বিস্ফোরণ’।

হিন্দু ভোটারদের, বিশেষত, গরিব অংশের ভোট মমতা নিজের পক্ষে টেনে বিজেপির সাথে নিজের প্রাপ্য ভোটের ব্যবধান বেশ কমিয়ে এনেছেন – এই বিষয়টা উল্লেখ করে তিনি সিএসডিএস-লোকনীতির পরিসংখ্যান উল্লেখ করে দেখিয়েছেন, শেষ বেলায় মমতা তাঁর সরকারী প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা গরিবদের মধ্যে দ্রুততার সাথে পৌঁছে দিয়ে এমনকি সেই সমস্ত অঞ্চলেও ভোট বাড়িয়েছেন, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা হিন্দুদের তুলনায় বেশ কম। মমতা তাঁর বিভিন্ন সরকারী প্রকল্পের মাধ্যমে বিজেপির গণভিত্তির মধ্যেও যে ভাঙন ধরিয়েছে, তা অর্গানাইজারও স্বীকার করেছে। আর, এবারের নির্বাচনে কোন প্রশ্ন ভোটারদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে - লোকনীতি-সিএসডিএস’র সমীক্ষা অনুযায়ী তা ছিল ‘উন্নয়ন’। মোট ৩৩ শতাংশ মানুষ এর ভিত্তিতেই ভোট দিয়েছেন, আর বলাই বাহুল্য, জাত পাত বা ধর্মীয় বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠে এ রাজ্যের, বিশেষ করে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের একটা ভালো অংশ ভোট দেন মমতার পক্ষে। সবচেয়ে হিন্দু প্রধান জেলাগুলোতেও বিজেপির ভোট ৫০ শতাংশর চৌকাঠ টপকাতে না পারার পেছনে রয়েছে এই সরকারী প্রকল্পের প্রভাব, যা আগামীদিনে কোন রাজনৈতিক দলই উপেক্ষা করতে পারবেনা। স্বপন দাশগুপ্ত তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন, হিন্দুদের সমস্ত অধোবর্গ বা সাব অল্টার্ন সম্প্রদায়, বিশেষ করে আদিবাসিদের মধ্যে তৃণমূল বিজেপির সাপেক্ষে তার আগেকার ভোটের ব্যবধান বেশ কিছুটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে, এমনকি, তাঁর মতে, “অন্যান্য রাজ্যে যে উচ্চবর্ণের ভোটার বিজেপির শক্ত ভিত্তি, সেখানেও বিজেপি ও তৃণমূলের ভোট প্রাপ্তির ব্যবধান যথাক্রমে ৪৬ শতাংশ ও ৪২ শতাংশ, অর্থাৎ মাত্র চার শতাংশ বেশি। এর অর্থ হল, উচ্চবর্ণ হিন্দুদের বেশ বড় একটা অংশ এবারের নির্বাচনে বিজেপির আগেকার প্রভাব থেকে সরে এসেছে তৃণমূলের দিকে।”

কোভিড অতিমারির দ্বিতীয় মারণ ঢেউকে সামাল দিতে নাজেহাল ও নির্লিপ্ত মোদী সরকারের বিরুদ্ধে দেশবাসী যে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন, তা এবারের রাজ্য নির্বাচনেও প্রতিফলিত হল। কোভিডের মারাত্মক আবহের মধ্যেও নির্বাচন কমিশন অবশিষ্ট চারটি পর্যায়কে সংক্ষিপ্ত করে দু’টোতে কমিয়ে আনার প্রস্তাবকে আমলই দিল না। বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ’ও এই সংবেদনশীল প্রশ্নে বিজেপির পক্ষেই দাঁড়াল। দেখা যাচ্ছে, মার্চের মাঝামাঝি রাজ্যে নথিভুক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা ছিল দিনে ১০০, আর মে মাসের গোড়ায় তা দাঁড়ায় দিনে ১৫,০০০! আসল সংক্রমণের হার নিঃসন্দেহে এরথেকে অনেক অনেক বেশি। এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির হার যে বিজেপির বিরুদ্ধে গেছে তা স্পষ্ট। দেখা যাচ্ছে, পঞ্চম পর্যায়ের পর থেকে তৃণমূলের ভোটের হার উল্লেখযোগ্য ভাবে যেমন বেড়েছে, বিজেপির ভোট কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে (সূত্রঃ কার ভোট কোথায় গেল, মৈত্রীশ ঘটক, পুষ্কর মৈত্র, আনন্দ বাজার পত্রিকা, ১৭ মে)। দেখা যাচ্ছে এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের জেদ ধরে বসে থাকাটা তৃণমূলের পক্ষে শাপে বর হয়েছে।

‘সোনার বাংলা’ স্লোগান যা মোদী-অমিত শাহ বারবার সামনে নিয়ে আসে, তা নিয়েও আরএসএস’র মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। পশ্চিম বাংলার মতো এক সীমান্তবর্তী রাজ্যে, যেখানে ‘রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু প্রীতি’ হিন্দুদের অস্তিত্বই বিপন্ন করে তুলেছে, সেখানে ভাবাদর্শগত অবস্থান থেকে সরে এসে নির্বাচনী রাজনীতি সর্বস্ব কিছু উন্নয়নমূলক কর্মসূচীর উপর ভর করে বৈতরণী পার হতে গিয়ে, তারা মনে করেন, পার্টির বড় বিপর্যয় ডেকে আনা হয়েছে। এ প্রশ্নে সবচেয়ে খোলাখুলি সওয়াল করেছেন মোহিত রায়। কি বলেছেন তিনি?

“বিজেপির ভোট বিস্ফোরণ কারা ঘটাতে পারে? হিন্দুরা। বিজেপির জয়যাত্রাকে কারা রুখে দিতে পারে? অবিভাজিত মুসলিম ভোট। মুসলিম ভোট প্রায় পুরোটাই গিয়েছে তৃণমূলে”। কিন্তু “রাজ্যের হিন্দুরা মনে করেননি, তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিজেপির প্রয়োজন আছে”।

তাঁর স্পষ্ট অভিমত, বিজেপি তার নির্বাচনী সংকল্পপত্রে যে ১৩ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেখানে সুশাসন থেকে শুরু করে ‘সবার জন্য প্রাপ্তিযোগের’ কথা থাকলেও যা থাকেনি তা হল ভাবাদর্শ। “বিজেপি কি (এই ভোট যুদ্ধে) বলেছিল যে, তারা ক্ষমতায় না এলে হিন্দুদের বিপর্যয় ঘটবে? পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে? না, বিজেপি এ সব ভাবাদর্শের কথায় মাথা ঘামায়নি।.... সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা কেন ভাবতে যাবেন, তাঁদের ধর্মীয় অস্তিত্বের সমস্যা সমাধানে বিজেপিকেই ভোট দিতে হবে?”

অসম থেকে শিক্ষা নিয়ে এরাজ্যের জন্য মোহিত বাবুর প্রস্তাব, উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির সাথে ভাবাদর্শের জোরালো মিশেল ঘটিয়ে হিন্দু সভ্যতা-সংস্কৃতির লড়াই এখানে চালাতে হবে। আর, তারজন্য প্রচারের যে বিষয়বস্তু তিনি সুত্রবদ্ধ করেছেন তা হল, ইসলামি মৌলবাদীদের জোরালো উপস্থিতি ও ধর্মীয় সন্ত্রাস, পরিবর্তিত ধর্মীয় জনসংখ্যার বিপদ, অনুপ্রবেশের সমস্যা ইত্যাদি।

স্বপন দাশগুপ্ত নির্বাচনী ফলাফলের ‘কাটাছেঁড়া’ করে পার্টির জন্য যে টোটকা হাজির করেছেন তা হল, বিজেপির স্থানীয় শিকড় আরও গভীরে প্রোথিত করতে হবে, আরও নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে সামাজিকভাবে, পাশাপাশি “যে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যগুলো একটা ভাষ্য তৈরি করেছে, তাকে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করার লক্ষ্যে মনোযোগী হতে হবে”।

আক্রমণাত্মক হিন্দুত্ববাদের সাথে উন্নয়নমুখী স্লোগানের মিশেল, হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থানের যে ঘ্রাণ তার সর্বাঙ্গে রয়েছে, তাকে মুছে ক্রমে ক্রমে বাংলা ও বাঙালীর স্বাদ-গন্ধের প্রলেপ লাগিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে নতুন আঙ্গিকে অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শ ওদের তাত্ত্বিক নেতারা দিচ্ছেন। আঞ্চলিক ভাষ্যকে আত্মস্থ করার প্রক্রিয়ায় বিজেপি নতুনভাবে এই রাজ্যে নিজেকে পুনরাবিষ্কার করার জন্য দলকে পুননির্মাণ করার নীল নকশা নিয়ে সম্ভবত এবার আবির্ভূত হবে।

এই বিজেপিকে সর্বাত্মকভাবে, সমস্ত ফ্রন্টে প্রতিহত করতে এরাজ্যে বাম-আন্দোলনেরও পুননির্মাণ দরকার। গতানুগতিকতার জীর্ণ, বহু ব্যবহৃত পথে না হেঁটে উদ্ভাবন করতে হবে নতুন প্রাণচঞ্চল কর্মকান্ড ও রাস্তা। আর, এই চ্যালেঞ্জটা নিতে হবে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিকেই। বিজেপির বিরুদ্ধে নিশানাকে নিবদ্ধ রেখেই রাজ্যবাসীর অপূর্ণ দাবি ও গণতন্ত্রকে প্রসারিত করার লড়াই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

-- অতনু চক্রবর্তী 

খণ্ড-28
সংখ্যা-19