বাংলার শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকরা বিজেপি’কে প্রত্যাখ্যান করেছেন
Workers have rejected the BJP

বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে শ্রমিক ও হিন্দিভাষী ভোটাররা কোন দিকে ভোট দেবেন রীতিমতো আলোচনার কেন্দ্রেবিন্দুতে ছিল। কারণ গত লোকসভা নির্বাচনে শিল্পাঞ্চলে হিন্দিভাষী শ্রমিকের বেশিরভাগ ভোট বিজেপি পেয়েছিল। চারিদিকে গুঞ্জন হিন্দিভাষী মানেই বিজেপি। ফল বেরোনোর পর বোঝা গেল কলকাতা সহ শিল্পাঞ্চলে হিন্দিভাষী ভোটের সিংহভাগই বিজেপি বিরোধী শিবিরে গেছে। অর্থাৎ তৃণমূল পেয়েছে। শহরের মধ্যবিত্ত ও ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি ও জিএসটি’র কারণে বিজেপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষ কেন্দ্রের জনবিরোধী শিল্পনীতি ও শ্রমনীতির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। গোটা রাজ্যের মতো শিল্পাঞ্চলেও ভোটের শতাংশ হারে টিএমসি ৪৮ শতাংশ, বিজেপি ৩৭ শতাংশ এবং সংযুক্ত মোর্চা ৮ শতাংশ পেয়েছে।

তুলনামূলকভাবে বিহার, ঝাড়খন্ড সীমানা লাগোয়া এলাকায় হিন্দিভাষীদের উপর বিজেপি সামান্য প্রভাব ফেলতে পেরেছে। যেমন, আসানসোল দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে মোট আসন সংখ্যা ৯; তারমধ্যে তৃণমূল ৬টি এবং বিজেপি ৩টি আসন পেয়েছে। টিএমসি’র জেতা আসনগুলোর মধ্যে সরচেয়ে বেশি মার্জিন রয়েছে বারাবনি ও আসানসোল (উঃ) আসন দুটিতে। টিএমসি এখানে বিজেপি’র থেকে ১৪ শতাংশ ও ১১ শতাংশ বেশি ভোট পেয়েছে। টিএমসি’র সবচেয়ে কম মার্জিনে (২ শতাংশ) জেতা আসন পাণ্ডবেশ্বর ও রানিগঞ্জ। বাকি আসনগুলোতে টিএমসি’র জয়ের মার্জিন ৫ থকে ১০ শতাংশ।

কুলটি বিধানসভায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে বিজেপি জিতেছে ৬৭৯ ভোটে। শতাংশের বিচারে উভয় প্রার্থীই ৪৬ শতাংশ করে ভোট পেয়েছেন।

আসানসোল (দঃ) আসনটি বিজেপি তৃণমূলের থেকে ২ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে জিতে নেয়। দুর্গাপুর (পশ্চিম) আসনটিতে বিজেপি ৭ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে টিএমসি’কে হারিয়েছে। আসানসোল দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে সংযুক্ত মোর্চা জামুরিয়া ও দুর্গাপুর (পূঃ) উভয় কেন্দ্রে ১৫ শতাংশ করে ভোট সিপিএম পেয়েছে যা তাদের সর্ব্বোচ্চ। সর্বনিম্ন ২ ও ৩ শতাংশ যা আইএসএফ ও কংগ্রেস পেয়েছে।

দুর্গাপুর-আসানসোল শিল্পাঞ্চলে ইস্পাত কারখানা, কয়লা, রেলওয়ে শেড, চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ প্রভৃতি শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু এখানকার শিল্প পরিস্থিতি বর্তমানে ভয়ঙ্কর রকমের খারাপ। হিন্দুস্তান কেবলস, বার্ন স্ট্যান্ডার্ড, অ্যালয় স্টিল প্ল্যান্ট, এমএএমসি, হিন্দুস্তান ফার্টিলাইজার বন্ধ। ধুঁকছে বার্নপুর ইস্কো সহ রাস্ট্রায়ত্ত ভারী শিল্প। চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানা বেসরকারীকরণের দিকে এগোচ্ছে। এই কারখানা থেকে সিএলডব্লিউ বরাত কেটে বারাণসী ডিএলডব্লিউ’তে চলে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যে ১৬টা কয়লাখনি বন্ধের নোটিশ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক বিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা রায় দিয়েছেন। এখানে প্রায় ৪০ শতাংশ হিন্দিভাষী মানুষ, তাদের বেশিরভাগই জীবন জীবিকার স্বার্থে বিজেপি বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন।

হাওড়া শিল্পাঞ্চল মিশ্র এলাকা। এখানেও বহু হিন্দিভাষী মানুষের বাস। বিজেপি হাওড়া দখলের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ‘যোগদান মেলা’ করে প্রতিদিন টিএমসি’র মন্ত্রী বিধায়কদের বিজেপি’তে যোগদান করাতে থাকে। প্রচার এতো জোরালো ছিল যে মনে হতে থাকে এখানে বিজেপি ছাড়া আর কোন দলের অস্তিত্বই নেই। এদিকে হাওড়ার ঢালাই কারখানা, ইঞ্জিনিয়ারিং, চটকল, ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প বিগত কয়েক বছর ধরেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল। গতবছরের লকডাউনে শ্রমিকদের আর্থিক পরিস্থিতি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। রামনবমী থেকে শুরু করে হিন্দুত্বের জোরালো বিভাজনের প্রচারে বিভিন্ন সময় হাওড়াকে উত্তপ্ত করার চেষ্টা চলেছে। কিন্তু শ্রমিকরা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমনীতির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। বালি, হাওড়া (উঃ), হাওড়া (দঃ), হাওড়া (মধ্য), সাঁকরাইল সবকটি আসনেই বিজেপি হেরেছে। রায় টিএমসি’র পক্ষে গেছে।

হুগলি জেলায় শিল্প মানচিত্রে চটকল, বস্ত্রশিল্প, ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা, চর্মশিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি সহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। পাশাপাশি ডানলপ টায়ার ও হিন্দমোটরের মতো অজস্র কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। হুগলি জেলায় সিঙ্গুরে কৃষি জমিতে টাটার ন্যানো গাড়ি কারখানার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে, যারফলে ২০১১ সালে নির্বাচনে বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। হুগলিতে বিধানসভা আসন ১৮টি। তারমধ্যে আরামবাগ মহকুমার ৪টি আসন দখল করেছে বিজেপি। বাকি ১৪টি আসনে তৃণমূল জিতেছে। অর্থাৎ, এই জেলার বাকি তিন মহকুমা শ্রীরামপুর, সদর এবং চন্দননগর তৃণমূলের পক্ষে গেছে। এই প্রথম হুগলি শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিল বামেদের। ঝুলি শূন্য কংগ্রেসেরও। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে চাঁপদানিতে কংগ্রেস এবং পান্ডুয়ায় সিপিএম জিতেছিল।

শ্রমিক অধ্যুষিত চাঁপদানি, পান্ডুয়া, ভদ্রেশ্বর, কোন্নগর ডানকুনি, ত্রিবেণী, বাঁশবেড়িয়া সব জায়গায় টিএমসি জিতেছে। হুগলির শিল্পাঞ্চলে হিন্দি ও উর্দুভাষীরা বিজেপি’র বিরুদ্ধেই ভোট দিয়েছেন।

দক্ষিণ ২৪ পরগণা হল সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় জেলা। কৃষি, মাছ, বনাঞ্চল থেকে মধু সংগ্রহ, ভ্রমণ এবং শিল্প নিয়ে এখানকার অর্থনীতি গড়ে উঠছে। এখানে চটকল, ইন্ডিয়ান অয়েলের তেল সরবারহ কেন্দ্র, ইঞ্জিনিয়ারিং সহ ছোট মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। ফলতা শিল্প শহর বলে পরিচিত। ফলতায় ২৮০ একর জমির ওপর রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) সূত্রপাত হয়। ২৮০ একরের মধ্যে ১৯৩ একর অর্থাৎ বেশিরভাগটাই ছিল কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের জমি। বাকি ৮৭ একর জমি কৃষকদের বাস্তু ও কৃষিজমি, যা অধিগ্রহণ করা হয়। এই শিল্পাঞ্চল প্রধাণত কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে গড়ে উঠলেও রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তারাই কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ করে, বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করে দুটো গ্রামের অধিবাসীদের অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করে। অতঃপর শিল্পাঞ্চল নিরুপদ্রবে চালনা করার যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করে। ফলতার এই শিল্পাঞ্চলটি ২০০৩ সালের গোড়ায় ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বা ‘এসইজেড’এ রূপান্তরিত হয়। (সূত্র: ফলতা উইকিপিডিয়া) এখানকার শিল্পাঞ্চলে বাংলাভাষী ইসলাম ধর্মালম্বী মানুষের বাস বেশি। এখানে সর্বত্র টিএমসি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছে। সিপিএমের সর্বোচ্চ ভোট ১৭ শতাংশ ও কংগ্রেসের ৭ শতাংশ। একমাত্র বিষ্ণুপুর তফসিলি আসনটি বিজেপি ৪৭ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছে। সেই অর্থে তফসিলি জাতি ও অন্যান্য পিছিয়ে থাকা জাতিগুলির মধ্যে বিজেপি’র অনুপ্রবেশ ভালো পরিমাণে ঘটেছে। এরকম ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া দক্ষিণ ২৪ পরগণার শ্রমজীবী মানুষ বিজেপি’কে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

উত্তর ২৪ পরগণা বিধানসভা আসন সংখ্যা ৩৩টি। এরমধ্যে ১৪টি আসন হল শিল্প অধ্যুষিত অঞ্চলে। বিভিন্ন পেশা, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা মিলে এক মিনি ভারতবর্ষ চোখে পড়ে। এখানে ভারী, বৃহৎ, মাঝারি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং সরকারী উদ্যোগগুলো আছে। একমাত্র ব্যারকপুর শিল্পাঞ্চলে ভাটপাড়া আসনটি বিজেপি জিতেছে। এখানে বিজেপি তৃণমূলের ভোটের পার্থক্য ১২% (বিজেপি ৫৩%, টিএমসি ৪১% এবং কংগ্রেস ২%)। এই কেন্দ্রে হিন্দিভাষী ৩৫% এবং উর্দুভাষী মুসলমান জনসংখ্যা ১৪.৪৬%। জেলায় গড়ে ভোট পেয়েছে টিএমসি ৪৭%, বিজপি ৩৭% সংযুক্ত মোর্চা ১০% পেয়েছে।

উত্তর ২৪ পরগণা জেলায় চটকল, বস্ত্র, ভারী ইঞ্জনিয়ারিং, চামড়া, তথ্যপ্রযুক্তি, সিরামিক, হ্যাল, রাইফেল ফ্যাক্টরি, কাঁচরাপাড়া রেল ওয়ার্কশপ, এছাড়াও হোসিয়ারি, ব্যাগ সহ অসংখ্য ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প আছে। এদিকে বন্ধ হয়ে গেছে বড়, মাঝারি, ছোট নিয়ে কয়েকশত শিল্প প্রতিষ্ঠান। কর্মচ্যুত হওয়া শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

দুর্গাপুর আসানসোল, হাওড়া, হুগলি, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণা শিল্পাঞ্চলে ধর্ম বা ভাষার কোন মেরুকরণ হয়নি। এখানে মোদী সরকারের শ্রমিক বিরোধী শিল্পনীতি ও শ্রমনীতির বিরুদ্ধে শ্রমিকরা এককাট্টা হয়েছেন। বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে লকডাউন, প্রবাসী শ্রমিকদের দুর্দশা, মূলবৃদ্ধি, কারখানা বন্ধ, বেসরকারীকরণ, ৪টি শ্রম কোডের বিরুদ্ধে শ্রমিকের স্পষ্ট মনোভাবের প্রতিফলন ঘটছে। মোদী সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ধর্মঘটের প্রভাবও শ্রমিকদের এই রায়ের মধ্যে আছে। ‘নো ভোট টু বিজেপি’ শ্রমিকদের মধ্যে কিছুটা প্রভাব ফেলেতে পেরেছে। ফলে ‘হিন্দিভাষী মানেই বিজেপি’ এই আষাঢ়ে গল্পেরও ইতি হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে আরও একটা বিষয় আলোচনায় সামনে এসেছে। উত্তর প্রদেশ, বিহার ও ঝাড়খণ্ডে মোদী বিরোধী যে হাওয়া উঠছে এই রায়ে তার ইঙ্গিত আছে। এছাড়াও বিহারের আরজেডি, ঝাড়খন্ডের জেএমএম এবং উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টি মমতাকে সমর্থন দেওয়ায় বাংলার ভোটে তার প্রভাব পড়েছে।

উত্তর বাংলায় সত্তাপরিচিতির আন্দোলন এখনো মূল ধারা হিসেবে আছে

উত্তর বাংলায় চা শিল্প একমাত্র সংগঠিত শিল্প। এই ক্ষেত্রে প্রায় ৪.৫ লক্ষ শ্রমিক কর্মরত। এদের উপর নির্ভরশীল ১২ লক্ষ মানুষ। বিগত ৬-৭ বছর ধরে চা বাগানে ন্যূনতম মজুরি এবং স্থায়ী শ্রমিকদের বস্তির জমির পাট্টার দাবিতে আন্দোলন চলছিল, ট্রেড ইউনিয়নগুলির যুক্তমঞ্চের তরফ থেকে। এই আন্দোলনে বামপন্থীরা নেতৃত্বে ছিলেন। রাজ্য সরকারের উপর আন্দোলনের চাপ বাড়িয়ে কিন্তু ইউনিয়নগুলি দাবি আদায় করে নিতে পারেনি। বিজেপি সুচতুরভাবে নির্বাচনী প্রচারে এই ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসে। ঘোষণা করে ক্ষমতায় এলে ৩৫০ টাকা ন্যূনতম মজুরি ও জমির পাট্টা দেওয়া হবে। চা শ্রমিকেরা এই প্রচারে প্রভাবিত হয়ে বিজেপি’কে ঢেলে ভোট দিয়েছে। এখানে আর একটা বিষয় লক্ষনীয়, ‘সংযুক্ত মোর্চা’র সংঘবদ্ধ প্রচার খুব কম ছিল। ২০১৬ সালে কংগ্রেস যেমন বামেদের ভোট দেয়নি, বামেরা এবার কংগ্রেসকে বঞ্চিত করেছে। কংগ্রেসের গড় ভোট সেই ইঙ্গিতই দেয়। তাহলে বামেদের ভোট কোথায় গেল? বিচারের ভার পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিলাম! পাহাড়ের তিনটি কেন্দ্রে গোর্খা জনমোর্চার ভাঙনকে বিজেপি পুরোমাত্রায় কাজে লাগিয়েছে। প্রচুর টাকা ছড়িয়ে, বিদ্বেষ ও বিভাজনের রাজনীতিকে সম্বল করে চা বাগান অধ্যুষিত অঞ্চলে বিজেপি সাফল্য পেয়েছে। রাজবংশী, আদিবাসী ও গোর্খা জনজাতির ‘সত্তাপরিচিতি’ আন্দোলনে ধর্ম, জাতপাত ও ভাষার বিভাজনের বিষাক্ত রাজনীতি প্রচার করেছে। এমনকি এনআরসি’র পক্ষেও প্রচার চালায়। এখানে ‘নো ভোট টু বিজেপি’র প্রচার তুলনামূলকভাবে কম ছিল যা মানুষের মনে দাগ কাটতে পারেনি। একমাত্র ব্যাতিক্রম মালবাজার বিধানসভা আসনটি যা তৃণমূল পেয়েছে।

বিধানসভা কেন্দ্রগুলো দেখে নেওয়া যাক।

দার্জিলিং জেলায় ৫টি আসন। পাহাড়ে কার্সিয়াং, দার্জিলিং আসন বিজেপি পায় এবং কালিম্পং আসনটি গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা (বিনয় তামাং গোষ্ঠী) জিত হাসিল করেছে। গোর্খা জনমোর্চার দুটো গোষ্ঠীর ভোট ভাগাভাগিতে বিজেপি’র প্রভুত সুবিধা হয়। এছাড়াও জিএনএলএফ বিজেপি’কে সমর্থন দেওয়ায় সহজেই জয় পায়।

মাটিগাড়া-নকশালবাড়ী ও ফাঁসিদেওয়া দুটি বিধানসভা আসন। এখানে চা বাগান ও কৃষি নিয়ে মিশ্র অর্থনীতি চালু আছে। বাগানে শ্রমিকরা আদিবাসী এবং কৃষিক্ষেত্রে বেশিরভাগ রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ। এদের মধ্যে আরএসএস’এর পরিকল্পিত নিবিড় কাজ আছে, বিজেপি নিজের শক্তি বাড়িয়ে দুটো আসনই জিতে নেয়। ২০১১ ও ২০১৬ সালে এই আসন দুটিতে কংগ্রেস জিতেছিল, এবার তৃতীয় স্থানে চলে যায়।

আলিপুরদুয়ার জেলায় ৫টি আসনে বিজেপি জয়লাভ করেছে। চা বাগানে আদিবাসী ও গোর্খা সম্প্রদায়ের মানুষ শ্রমিক হিসেবে কর্মরত। এখানকার ৩টি আসন কুমারগ্রাম, মাদারিহাট, কালচিনি বিজেপি জিতেছে। জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার ও নাগরাকাটা বিধানসভা চা বাগান এলাকা। মালবাজার আসনটি তৃণমূল এবং নাগরাকাটা বিজেপি পেয়েছে।

বিজেপি কুচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিঙে অধিকাংশ আসন জেতে। রাজবংশী, নেপালী, আদিবাসীরা বিজেপি’কে ভোট দিয়েছে। বামপন্থী আন্দোলন যত দুর্বল হয়েছে, দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদী শক্তি ততো বেড়েছে। পাশের রাজ্য আসামে এবারও বিজেপি জিতেছে, এর প্রভাবও পড়তে পারে। আরও বিস্তারিত মূল্যায়ণের দাবি করে।

ভোটের যে হার তাতে বাম আন্দোলন ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য খুবই চিন্তাজনক। বিজেপি ৫টা কেন্দ্রে ৫০ শতাংশের বেশি, ৪টি কেন্দ্রে ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। একটা আসন টিএমসি ৪৬ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জিতেছে। বামেদের অবস্থা শোচনীয়। পাহাড়ে তিনটি কেন্দ্রে বামেদের সর্বোচ্চ ভোট ১.৫ শতাংশ। তরাইয়ে সর্বোচ্চ ভোট ৯.৩ শতাংশ। আলিপুরদুয়ার জেলায় সর্বোচ্চ ভোট ৪.৯ শতাংশ। জলপাইগুড়ি জেলায় ৯.৩ শতাংশ।

গোর্খা জনজাতিসত্তা, আদিবাসী ও পিছিয়ে থাকা রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষের দাবি ও মর্যাদা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে যুক্ত করার সময় এসে গেছে বলেই মনে হয়।

কথা শেষে এটা বলতেই হয় বাংলার শ্রমিকশ্রেণি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছেন। আবার বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ের তারতম্য আছে, সবকিছুই একইভাবে হবে না। শ্রমিকশ্রেণির বেশির ভাগ অংশ বিজেপি’র ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান’কে প্রত্যাখ্যান করেছে। বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নের কাছে চ্যালেঞ্জ, সমগ্র শ্রমিকশ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলার।

-- নবেন্দু দাশগুপ্ত 

খণ্ড-28
সংখ্যা-19