প্রতিবেদন
সরকারি সম্পদে কর্পোরেট মুনাফা : লাভ কার?
government assets

দেশের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ‘ন্যাশনাল মনেটাইজেশন পাইপলাইন’ ঘোষণা করেছেন। এনিয়ে নানা দিকে সোরগোল উঠেছে। এমনকি সংঘ পরিবারের ট্রেড ইউনিয়ন ‘বিএমএস’ পর্যন্ত এই প্রকল্পে আপত্তি জানিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, আগামী চার বছরে সত্যিই কি সরকারের ৬ লক্ষ কোটি টাকা আয়ের সংস্থান করার জন্য এমনতর প্রকল্পের ঘোষণা? এর পিছনে কি সুদূরপ্রসারী অন্য কোনও উদ্দেশ্য বা বাধ্যবাধকতা নেই? অন্যভাবে বললে, অর্থনীতির কোন ইশারায় এমন এক বিপজ্জনক খেলায় নামল মোদী সরকার?

গত সাত বছরে মোদী সরকারের কার্যকলাপ দেখলে এই পদক্ষেপের পিছনে রাজনৈতিক-অর্থনীতির এক নতুন ও গোপন খেলা রয়েছে বলে মালুম হবে। কারণ, অর্থনীতির আঙ্গিক আজ আমূল বদলের পথে। অবশ্য, সে বদল অনুধাবন করার আগে অর্থনীতির কতকগুলি অবধারিত পরিবর্তনের দিকে আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে।

প্রথমত, গত চার-পাঁচ বছরে সারা বিশ্ব জুড়েই অর্থনীতির আঙ্গিকে এক আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। অর্থনীতির সিংহভাগ জুড়ে গত ৫০-৬০ বছরে পরিষেবা ক্ষেত্রের যে রমরমা ও আধিপত্য ছিল তা এক নতুন মাত্রা ও পরিসরে প্রবেশ করেছে। সেই পরিসর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত স্বয়ংক্রিয় এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা যেখানে শ্রম ও প্রযুক্তির চরিত্র আমূল বদলে গিয়ে এক নতুন জগতের জন্ম দিয়েছে। এই নতুন জগতের কর্মপ্রক্রিয়া পরিমাণগত ও গুণগতভাবে যন্ত্রের ওপর সম্পূর্ণ উপায়ে নির্ভরশীল। আর এই যন্ত্রব্যবস্থা এতটাই আধুনিক ও দ্রুত পরিবর্তনশীল যে স্থায়ী চরিত্রের শ্রমিক বা কর্মচারী নিয়োগের কোনও প্রয়োজন আর নেই। কর্মপদ্ধতি ও শ্রমের চরিত্র যখন এতটাই অনিশ্চিত, তখন স্বভাবতই এক কর্ম থেকে অপর কর্মে রূপান্তর এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে। তাই, স্বাভাবিক ভাবেই নির্দিষ্ট কর্মে পুঁজির বিনিয়োগ ও প্রত্যাহার অতীব নমনীয় রূপ ধারণ করেছে। যে কারণে আমরা কোম্পানির দ্রুত হাতবদল অথবা তাদের দেউলিয়া কিংবা স্ফীতকায় হয়ে ওঠা ঘন ঘন পরিলক্ষিত করি। যদিও প্রথম সারির গুটিকয়েক অতিবৃহৎ কোম্পানিগুলির ক্ষেত্রে এমনতর হাতবদল বা ক্ষয়ক্ষতি অথবা লাভালাভের প্রক্রিয়াটা অতটা প্রকটভাবে বা ঘন ঘন ঘটবেনা। কারণ, তাদের কাজের পরিধিটাই বিশাল ও ব্যাপ্ত। কিন্তু, মাঝারি ও ছোট উদ্যোগগুলোর ক্ষেত্রে তা হচ্ছে। কিন্তু এই ধরনের হাতবদল গত কয়েক বছরে এতটাই বেড়ে গেছে এবং দেখা যাচ্ছে, কোনও কোনও কোম্পানি বা তাদের কর্মপ্রক্রিয়া এতটাই ভঙ্গুর ও অনিশ্চিত যে এই ধরনের কেনাবেচায় লাভালাভ সুনিশ্চিত বলাটা ক্রমেই বেশি কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে, বহুলাংশে কোম্পানিগুলি আজকাল মালিকানার সম্পূর্ণ দায় নিতে অস্বীকার করছে। তারা অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ লিজ বা ভাড়া নিয়ে কাজ করতে। তাতে তাদের দায়ভার অনেক কম থাকে। যেমন, এক্ষেত্রে এয়ারবিএনবি ধরনের মডেলের উল্লেখ করা যেতে পারে যা অর্থনীতির স্বাভাবিক আঙ্গিক হয়ে উঠতে চাইছে।

দ্বিতীয়ত, মোদী সরকারের সংস্কার কর্মসূচির দুটি গুরুত্বপূর্ণ বড় উদ্যোগ ছিল ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেচে দিয়ে রাজকোষে অর্থ ভরা। এই দুটিই চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, তারা প্রথমটির ক্ষেত্রে চীনের মডেল অনুসরণ করতে গিয়েছিল, যা আসলে দেশের মজুর ও পরিকাঠামোকে সস্তায় পুঁজির হাতে তুলে দিয়ে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের বিকাশ ঘটানো। কিন্তু তারা এটা বোঝেনি না যে চীনের মডেলটি গত শতকের নব্বই দশকের ভাবনা যখন আধুনিক ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের কিছুটা রমরমা ছিল ও জিডিপি’তে তার একটা বড় অনুপাত থাকত। চীন যখন সেই মডেলটি বাতিল করে এই শতকের দ্বিতীয় দশকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক উদীয়মান শিল্পের দিকে ঝুঁকলো, তখন মোদী সরকার ভাবল যে ওই মডেলটিকে এবার এখানে লাগু করলে চীনের থেকে ম্যানুফ্যাকচারিং হাবগুলি পটাপট ভারতে চলে আসবে। এখানেই লুকিয়ে ছিল চিন্তার চূড়ান্ত দেউলিয়াপনা। কারণ, ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে ব্যাপক অটোমেশন ও রোবটিক্স’এর প্রয়োগের ফলে তা উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে স্বাধীন ইউনিট-পরিমাপে এতটাই কমে এল যে নতুন করে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প প্রতিষ্ঠার খুব একটা আর প্রয়োজন থাকল না।

পাশাপাশি, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলি হয়ে উঠল সাদা হাতি পোষার মতো। তার এত দায়ভার যে সেই শিল্পগুলিকে কেউ ক্রয় করতেও এগিয়ে এল না। তার ওপর এইসব সংস্থায় যারা কাজ করেন, তাঁদের স্বেচ্ছা-অবসর প্রকল্পে প্রচুর অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজন হয়, যে খরচটিও আর কোনও কর্পোরেট সংস্থা করতে রাজী নয়। শুধু এয়ার ইন্ডিয়া নয়, বিভিন্ন রেল স্টেশন অথবা অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাকে বেচে দেওয়ার ঘোষণা করা হলেও সে সব কেনার খদ্দের পাওয়া যাচ্ছেনা। তাই আর কোনও উপায়ন্তর না পেয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এবার রাষ্ট্রায়ত্ব সম্পদকে লিজ দেওয়ার পরিকল্পনা নিল, যার গালভরা নাম ‘ন্যাশনাল মনেটাইজেশন পাইপলাইন’। এই লিজ ২৫, ৩০ কি ৪০ বছর পর্যন্ত হতে পারে। এ হল সরকারের তরফে কতিপয় কর্পোরেট কোম্পানিকে দেওয়া সব থেকে দামী তোফা। প্রায় বিনা খরচে সরকারি সম্পদের ঘাড়ের ওপর চেপে মুনাফা কামানোর এমন সহজ উপায় অতীতে কখনও দেখা যায়নি। যদি মুনাফা আশাতীত না হয়, তাহলে খুব সহজেই সেগুলিকে পরিত্যাগ করে কোম্পানিকুল চলে যাবে। তাতে তাদের বিশেষ কোনও ক্ষতি নেই। আর লাভ হলে, তা হবে স্বল্প বিনিয়োগেই (সংস্থা কেনার বিশাল খরচ সেখানে লাগছে না)। বিনিময়ে শাসক দলের ভাণ্ডারে ঢুকবে ইলেক্টোরাল বন্ড (মুনাফার অংশ হিসেবে), যার উৎস থাকবে গোপন। অঙ্কটা খুব পরিষ্কার।

প্রশ্ন হল, এমন একটা মডেলের দিকে কেন্দ্রীয় সরকার অগ্রসর হল কেন? প্রধানত এর কারণ দুটি।

এক, অর্থনীতিগতভাবে দেশ এক চরম সংকটের মুখে। কর্মহীন, অর্থহীন, সর্বতোভাবে বিধ্বস্ত মানুষ কোনওভাবে দিন গুজরান করছেন। কোভিড পরিস্থিতি এই অবস্থাকে আরও শোচনীয় করে তুলেছে। সেনসেক্স’এর সূচিমুখ যতই উর্ধ্বমুখি হোক না কেন, আমজনতার এক বৃহৎ অংশের সঙ্গে তার কোনও অর্থনৈতিক সংযোগ নেই। কারণ, সেনসেক্স’এর গতিপথ নির্ধারিত হয় প্রথম ১০-১৫টি সংস্থার কার্যপ্রণালীর ওপর, আর তার সবগুলিই প্রায় ভার্চুয়াল কোম্পানি যারা এই সময়ে অত্যধিক হারে মুনাফা সংগ্রহ করেছে। ব্যাপক সংখ্যক মানুষের এই দুরবস্থায় বেশ কিছু রাজ্য সরকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চেষ্টা করেছে নানারকম সাহায্য সাধারণজনের কাছে পৌঁছে দিতে। তার ওপর ভিত্তি করে কিছুটা কষ্ট হয়তো লাঘব করা গেছে। অসহনীয় পরিস্থিতির এই সুযোগে কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে, নিজেদের বশংবদ কর্পোরেট সংস্থার হাতে সরকারি সম্পদকে লিজে তুলে দিয়ে একদিকে সরকারের আয়ের পথকে বর্ধিত করা (যা অশ্বডিম্ব বই আর কিছু নয়), অন্যদিকে এইসব কর্পোরেট সংস্থাকে ফুলে-ফেঁপে উঠতে সাহায্য করা।

দুই, কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপি যেহেতু দেশজুড়ে এখন অনেকটাই কোণঠাসা এবং আগামী উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে তাদের পরাজয়ের সম্ভাবনাও প্রবল, তাই, তাদের এখন দলের জন্য প্রভূত পরিমাণে অর্থের সংস্থান করতে হবে যা দিয়ে তারা তরী পার হওয়ার চেষ্টা করবে। আর সেই অর্থের বিপুল সংস্থান হতে পারে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে যা আসবে বন্ধু কর্পোরেট সংস্থার কাছ থেকে (আম্বানি-আদানি ইত্যাদি)। যদি ‘ন্যাশনাল মনেটাইজেশন পাইপলাইন’এর মাধ্যমে স্বল্প খরচে কর্পোরেটরা সরকারি সম্পদের ঘাড়ে চেপে বিশাল মুনাফা করতে পারে, তাহলে তার একটা অংশ ইলেক্টোরাল বন্ড হিসেবে বিজেপি’র ঘরে ঢোকাটা প্রায় নিশ্চিত। মনে করে দেখুন, ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে ২০১৬ সালের নভেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকার রাতারাতি বিমুদ্রাকরণ নীতির ঘোষণা করে বিরোধী দলের হাতে যে বিপুল পরিমাণে নগদ কালো টাকা সংগৃহীত ছিল নির্বাচনে লাগানোর জন্য, তাকে অকেজো করে দিয়ে বাজিমাত করেছিল। কারণ, এই নীতি ঘোষণার আগে বিজেপির কাছে গচ্ছিত নগদ কালো টাকাকে তারা নানাভাবে সরিয়ে ফেলে বা তাদের ১০০ ও ৫০ টাকার নোটে রূপান্তরিত করে নিজেদের অর্থের জোরকে অটুট রেখেছিল।

আবারও উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচন আসছে। এই নির্বাচনে বিজেপি’কে যেনতেন প্রকারেণ জিততেই হবে। নচেৎ, ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে তাদের পরাজয় সুনিশ্চিত। পশ্চিমবঙ্গে জোর ধাক্কা খেয়ে তাদের মাজা ভেঙ্গে গেছে। তাই আগেভাগে তারা প্রস্তুতি সেরে রাখছে। লাগাতার উত্তাল কৃষক আন্দোলন ও মুজাফ্ফরনগরে ৫ সেপ্টেম্বর কৃষক মহাপঞ্চায়েত ইতিমধ্যে বিজেপি’র রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। সম্ভাব্য পরাজয়ের আশঙ্কাতেই এখন তারা নামতে চাইছে অর্থের এক সুবিশাল থলি নিয়ে। কারণ, তাদের বিভাজনের রাজনীতি আর কোনও কাজে আসছেনা। সোশ্যাল মিডিয়াতেও তাদের আইটি সেল মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাদের আশা, কর্পোরেট মুনাফার অংশই এখন তাদের বাঁচাতে পারে। আর সে লক্ষ্যেই তাদের যাবতীয় সাম্প্রতিক ক্রিয়াকাণ্ড।

- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য 

খণ্ড-28
সংখ্যা-33