প্রতিবেদন
ভারত বনধ হবে রাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে
India will be closed

যারা কানে শুনতে পায় না সেই বধিরদের শোনাতে গেলে সজোরে আওয়াজ প্রয়োজন। পরাধীন ভারতে শাসক ইংরেজের বিরুদ্ধে এ কথা বলেছিলেন ভগত সিং। ঔপনিবেশিক আইনের বিরুদ্ধে তিনি এবং তাঁর কমরেডরা পার্লামেন্টে বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন। আজ যখন আমাদের দেশকে নয়া উপনিবেশিক শোষণের ফাঁদে ফেলে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে তখন সেই মহান বিপ্লবীর দিশানির্দেশকে পাথেয় করে দিল্লীর রাজপথ থেকে কিষাণ আন্দোলনের আওয়াজ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে গোটা দেশজুড়ে। পৌছে যাচ্ছে নতুন এক উচ্চতায়। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর ভারত বনধের আহ্বানে জেগে উঠছে সারা দেশ। নয় মাস পেরিয়ে গেলো, তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবি যখন সরকার কর্ণপাত করছে না, তখন শাসকের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছে জনগণের স্ট্রাইক বা প্রত্যাঘাত। সমস্বরে জোরালো আওয়াজ উঠেছে, কর্পোরেটের গোলামী মানছি না, মানবো না। আমাদের দেশের কৃষি শিল্প সরকারী সম্পদ দেশী বিদেশী কর্পোরেটদের লুঠের কারবারে সমর্পণ করা চলবে না। নয়া কৃষি আইনের মধ্য দিয়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা তথা খাদ্য স্বয়ংভরতা ধ্বংস করে দেশকে খাদ্য আমদানীর পথে নিয়ে যাওয়া চলবে না। চুক্তি চাষের আইনের আড়ালে সাম্রাজ্যবাদী অধীনতাকে বরণ করা চলবে না। কৃষি জমির দখলদারী বন্ধ করো। চলমান এই কৃষক আন্দোলন ফ্যাসিস্ট সরকারের চোখে চোখ রেখে আন্দোলনের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। রাস্ট্রের ব্যাপক দমন পীড়নকে মোকাবিলা করে গণতান্ত্রিক পরিসরকে বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। দেশের শ্রমিক শ্রেণী, ছাত্র-যুব, মহিলা, আদিবাসী, দলিত সহ ব্যাপক মানুষের মধ্যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছে। বিভাজনের রাজনীতিকে অকার্যকর করে দিয়ে শ্রেণী ঐক্যের ঐতিহ্যকে সামনে নিয়ে এসেছে।

বেশ কয়েকমাস হয়ে গেল সংসদে গায়ের জোরে পাশ করা কৃষি আইনের প্রভাব ইতিমধ্যেই জনগণের দৈনন্দিন জীবনে পড়তে শুরু করেছে। নিত্যপণ্য, ভোজ্য তেল প্রভৃতি খাদ্যদ্রব্যের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে খাদ্যপণ্যর অবাধ মজুতদারীর ছাড়পত্রের নয়া আইন কি অদৃশ্য কায়দায় বাজারে নিত্যপণ্যের দাম উর্দ্ধমুখী করে তুলছে। অন্নদাতারা তাঁদের উৎপাদিত ফসলের অভাবী বিক্রি করছে আর তার আট দশগুণ দামে ক্রেতারা বাজারে তা কিনছে। কৃষিপণ্যের বানিজ্য কব্জা করে কর্পোরেটদের ছোট বড়ো এজেন্টরা বা সিন্ডিকেটগুলি কিভাবে একদিকে উৎপাদক চাষি অপরদিকে মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত ক্রেতা দুদিকেই তাদের মুনাফার থাবা বিস্তার করে চলেছে। কৃষক সম্মান বা কৃষক বন্ধু নামক মুখোশ চাষির প্রতি সরকারের সীমাহীন বঞ্চনা প্রতারণার প্রকৃত মুখটাকে আড়াল করতে পারছে না। কর্পোরেটদের করছাড় দিয়ে পেট্রোপণ্যের উপর বিপুল কর চাপানো সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম প্রধান রাস্তা হয়ে উঠেছে। এর প্রভাবে একদিকে পরিবহনের খরচ বাড়িয়ে মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া হয়ে উঠছে, অপরদিকে কৃষি উপকরণের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি করে চাষীদের ঋণফাঁদে ফেলে দিচ্ছে। তাঁদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে আত্মহত্যার পথে। সরকারী ক্ষেত্রের বিলোপ কর্মসংস্থানের সামনে কালো পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছে। শিল্পে মন্দা পরিযায়ীদের গ্রামে ফিরিয়ে এনে গ্রামীণ বেকারত্ব সর্বকালীন রেকর্ড করেছে। বিশেষত সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষি মজুর হলেন শ্রমজীবী মহিলারা। তাদের কর্মহীনতা বেড়ে চলেছে। কৃষির উপর শ্রমের চাপ বাড়ছে, কৃষিতে আয় কমছে। সব মিলিয়ে আক্রান্ত সর্বস্তরের শ্রমজীবী মানুষ হয়ে উঠেছে একই নৌকার যাত্রী। ভারত বনধ তাই সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে ময়দান তৈরি করেছে।

আন্দোলনকারী কৃষকরা কেবল বাঁচাও বাঁচাও বলে আওয়াজ তুলছেন না! তারা দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে গণমুখী দিশায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবি তুলে ধরেছেন। তারা বলছেন আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী কৃষকদের ও কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করতে এবং কৃষিকাজকে যথাযথভাবে সুরক্ষিত করতে সরকার বাধ্য। জীবন যাপনের অধিকারকে বাস্তবায়িত করা ও জীবিকার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য নীতি নির্ধারণ এবং উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ও লাগু করে কৃষকদের দুর্দশা রোধ করা সরকারের সাংবিধানিক কর্তব্য। এই লক্ষেই তারা কৃষিপণ্যের লাভজনক দর গ্যারান্টি আইন প্রনয়ণের দাবি তুলে ধরেছেন। তাই এ লড়াই কেবল কৃষকের নয়, এটা দেশ বাঁচানোর লড়াই। দেশের সংবিধান গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই। আজ সমগ্র দেশের কৃষি ব্যবস্থায় ব্যাপক মাত্রায় সরকারী বিনিয়োগ করে কৃষকের স্বার্থরক্ষাকারী নীতি প্রনয়নের প্রশ্নটা প্রধান দাবি হয়ে উঠেছে। কৃষক আন্দোলনের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে আসছেন সারা দেশের পাশাপাশি এ রাজ্যের ক্ষুদ্র জোতের উপর নির্ভরশীল কৃষকরা এবং ব্যাপক বাম ও গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তিগুলি। বনধের দিন তারা অবশ্যই রাস্তায় থাকবেন।

- জয়তু দেশমুখ

খণ্ড-28
সংখ্যা-34