প্রতিবেদন
ঔদ্ধত্য নয়, চাই আনুগত্য!
want loyalty

বহু ঢক্কানিনাদিত ‘দুয়ারে সরকার’-এর শিবির চলছিল রাজারহাট থানার চাঁদপুর হাইস্কুল প্রাঙ্গণে। তার দুয়ারেই ঘটল এই কাণ্ড। রেশন কার্ড চাইতে এসে, না পেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করছিল লোকটি। সে নাকি তখন ‘নেশাগ্রস্ত’ ছিল। তাই সকলের চোখের সামনেই মারতে মারতে তাকে টহলদারি পুলিশ ভ্যানে তোলা হয়। পরদিন ভোরে তার বাড়ির লোক জানতে পারে ‘হৃদরোগে’ আক্রান্ত হয়ে তার ‘মৃত্যু’ হয়েছে!

রাজারহাটের মোবারকপুরের বাসিন্দা সঞ্জয় হলপাত্র। বয়স ৩৮। পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান। কর্মস্থল বড়বাজার। স্ত্রী বাড়িতে কলম তৈরি করেন। বাড়িতে আছে আরও দু'জন। বৃদ্ধা মা ও সপ্তমশ্রেণির ছাত্রী একমাত্র কন্যা।

কী অপরাধ ছিল তার? মদ্যপান? তাহলে সরকার এত মদের দোকানকে ঢালাও লাইসেন্স দিয়েছে কেন? বেকার যুবকদের উপার্জনের সুযোগ করে দেওয়া? সহজ পথে রাজস্ব আদায়?

মদ্যপান ব্যক্তির স্বাস্থ্যের জন্য শুধু নয়, সমাজের স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকারক। সরকার জানে। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের মহিলাদের জন্য ‘মদ’ এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ, তাও সরকারের অজানা নয়। তবু মদ বিক্রির লাইসেন্স দেওয়া বাড়বে বৈ কমবে না!

তাহলে অপরাধটা কী? মাতলামি? অভব্য আচরণ? সরকারি কাজে ব্যাঘাত ঘটানো?

সেটা অপরাধ বটে। কিন্তু তার জন্যে মারতে মারতে গাড়িতে তুলতে হবে কেন? স্বল্প শিক্ষিত একজন শ্রমজীবী মানুষ, কিন্তু সে তো এক নাগরিক! তার নাগরিক অধিকার নিয়েই তো ‘দুয়ারে সরকার’-এর দ্বারস্থ হয়েছিল। ‘সবক’ শেখানোর জন্যে বেধড়ক মারা যায় এক ছা-পোষা নাগরিককে, এক স্ত্রী’র স্বামীকে, এক মায়ের সন্তানকে, এক স্কুলছাত্রী সন্তানের পিতাকে! চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, রাহাজানি, ছিনতাই, খুন যারা করে, তাদেরও তো মারতে মারতে পুলিশের গাড়িতে তোলা যায় না। তার গ্রেফতারের জন্যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চাই, তারপর তো আছে বিচারপ্রক্রিয়া। তাহলে?

কয়েক মাস আগে, চাকরি চাইতে এসে পুলিশের লাঠির ঘায়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন মইদুল ইসলাম। তখন মুখ্যমন্ত্রী সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, হয়তো কোনও রোগ ছিল, তাতেই মারা গেছে যুবকটি। এ ক্ষেত্রেও ঠিক তাই! ময়নাতদন্তের ‘প্রাথমিক রিপোর্টে’র ভিত্তিতে প্রশাসন কর্তৃপক্ষ প্রাণপণে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন ‘হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার’ গল্পকে। ‘মৃত্যু’ মানেই তো হৃদযন্ত্রের স্পন্দন থেমে যাওয়া। কিন্তু পুলিশি হেফাজতে হঠাৎ কেন সেটা ঘটল? থানায় পুলিশের ‘'জামাই আদর'’ হাড়ে হাড়ে জানা আছে মানুষের। সঞ্জয়ের পরিবারের লোকজন তাকে সেইদিন রাতে থানা লক-আপের মেঝেতে বমি করে উপুর হয়ে পড়ে থাকতে দেখেন। পুলিশের সাফাই — ‘অতিরিক্ত মদ্যপানের’ জন্যেই নাকি ঐ অসুস্থতা! পরদিন ভোরে মৃতের কানের পাশে রক্ত জমাট বাঁধার চিহ্ন দেখেন আত্মীয়রা। তারা দাবি করেছেন, রাজারহাট থানায় পুলিশী নির্যাতনেই মৃত্যু হয়েছে সঞ্জয়ের। কিন্তু প্রশাসন ময়নাতদন্তের চূড়ান্ত রিপোর্ট এলে তদন্তের আশ্বাস দিলেও থানায় মারধরের কথা বেমালুম অস্বীকার করেছে। ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। জনতা দিনভর রাজারহাট থানা ও রাস্তা অবরোধ করে রাখে। মুখ্যমন্ত্রী ঘটনার পরই ‘পরিবারের পাশে’ দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন এবং তদনুযায়ী স্থানীয় বিধায়ক মৃতের স্ত্রীকে মাসিক দশ হাজার টাকার মাসোহারার আশ্বাস দিলে সঞ্জয়ের প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনসহ স্থানীয় জনতা দীর্ঘক্ষণের অবরোধ তুলে নেন।

‘সবক’ শেখানোর এই ধরনটা সমাজেও ছড়াচ্ছে। মালদহের হরিশচন্দ্রপুরে হাতে দড়ি ও পায়ে শেকল বেঁধে চব্বিশ বছরের এক তরুণকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। ছেলেটি নাগপুরে কাজ করতো, কিছু দিনের ছুটি কাটিয়ে আবারও সেখানে ফেরার কথা ছিল। মানিকতলা মেন রোডের বসাক পাড়ায় আরেকটি তরুণকে মোবাইল চুরির অভিযোগে (প্রমাণ ছাড়াই) ১৪ জন মিলে রাত ১২টা থেকে ভোর ৫ টা পর্যন্ত ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে পিটিয়ে, মৃতদেহ একটা অটোয় ফেলে যায়। মূল অভিযুক্ত একজন সিভিক পুলিশ। কর্ণাটকে এক মহিলাকে নগ্ন করে বেধড়ক পেটানোর এক ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে। সেখানেও ‘সবক’ শেখানোর অভিযোগ, এক সিভিক পুলিশের বিরুদ্ধে। এই সিভিক পুলিশদের সম্প্রতি এই ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ দুর্বলের ওপর বা একা মানুষের ওপর সবলের বা দলবদ্ধভাবে আক্রমণ ও মেরে ফেলাটা প্রায় বিনোদনের পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। কে রুখবে এই ভয়ঙ্কর প্রবণতা পুলিশ নিজেই যখন অত্যাচারী, খুনী!

‘দুয়ারে সরকার’-এর উদ্দেশ্য সরকারের এক জনদরদী কল্যাণকর রূপ তুলে ধরা। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পগুলি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ যাতে অবহিত হতে পারেন, সুযোগ নিতে পারেন তার জন্য পঞ্চায়েত বা পৌরসভার মাধ্যমে পাড়ায় পাড়ায় পৌঁছে গেছে প্রশাসন। কিন্তু সেই সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষক প্রশাসনের হাত কেন নিরীহ মানুষের রক্তে রঞ্জিত হবে? তাহলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন, দাঙ্গায় মদত দেওয়া দিল্লী পুলিশ বা সুশীল কাজলের হত্যাকারী হরিয়ানা পুলিশের থেকে তাদের কীভাবে ফারাক করা যাবে? বিশেষ করে তাদের অপরাধ ঢাকতে রাজনৈতিক নেতারা যখন ‘হৃদরোগের’ তত্ত্ব সামনে আনেন, তখন সরকারের ‘জনদরদী’ রূপটা যে ঝাপসা হয়ে যায়! সরকারের উদ্দেশ্য যদি যথার্থই সদর্থক হয়, তাহলে প্রশাসনকেও সেই অভিমুখে চালিত করতে হবে। না হলে যে ‘ষোলোআনাই ফাঁকি’!

আসলে হতভাগ্য সঞ্জয়ের অপরাধ ছিল প্রশাসনের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া, ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রশ্ন করা। প্রশাসন চায় কৃতাঞ্জলিপুটে ‘দান’ গ্রহণকারী অনুগৃহীত প্রজার আনুগত্য, অধিকার সচেতন নাগরিকের ঔদ্ধত্য নয়!

এবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক কয়েকটি পরিসংখ্যানে, তাহলে বোঝা যাবে কতটা উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে হেফাজতে হত্যার ঘটনা গোটা দেশেই। ১২ আগস্ট, ২০২১-এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী, গত তিন বছরে সারা দেশে বিচার বিভাগীয় হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে মোট ৫২২১ জনের, পুলিশি হেফাজতে ৩৪৮ জনের। বিচার বিভাগীয় হেফাজত-মৃত্যুর ঘটনায় শীর্ষে আছে উত্তরপ্রদেশ-১২৯৫; তারপর মধ্যপ্রদেশ- ৪৪১; পশ্চিমবঙ্গ তৃতীয় স্থানে -৪০৭ এবং বিহার- ৩৭৫; পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা: গুজরাট-৪২, মধ্য প্রদেশ- ৩৪, মহারাষ্ট্র-২৭, উত্তর প্রদেশ-২৩ (রাজ্য সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পেশ করা তথ্য)।

ইন্ডিয়াস্পেন্ড-এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে ২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর মোট ঘটনা ১০০৪, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ মৃত্যুর নথিবদ্ধ কারণ — ‘স্বাভাবিক’ বা ‘অসুস্থতা’; ২৯ শতাংশ ‘আত্মহত্যা’, এতগুলো মৃত্যুর ঘটনায় সাজা হয়েছে মাত্র ৪ জন পুলিশ কর্মীর। ২০১০এ-১ জন, ২০১৩তে-৩ জন।

২০২০-র ১৬ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সংসদে পেশ করা তথ্যে জানা যাচ্ছে — ২০১৯-২০২০-তে ভারতে গড়ে দৈনিক ৫টি হেফাজত-মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

এই প্রসঙ্গে ভারতের প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা পুলিশি হেফাজতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন “দি থ্রেট টু হিউম্যান রাইটস্ এ্যান্ড বডিলি ইনটিগ্রিটি আর দি হাইয়েস্ট ইন পুলিশ স্টেশনস্”। এরপর আর কিছু বলার থাকে!

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত 

খণ্ড-28
সংখ্যা-33