আবেদন
আফগান জনগণের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়ান
Afghan people for freedom

(তালিবানরা আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পরে ভারতের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগঠন সংহতির আহ্বান জানিয়ে স্বাক্ষর করা একটি বিবৃতি দিয়েছিল। এখানে সংক্ষেপে তার মূল মূল বিষয় পুনপ্রকাশ করা হল।)

কুড়ি বছরের মার্কিন দখলদারির অবসান আফগানিস্তানের মানুষের জীবনে কোনো স্বস্তি আনতে পারলো না। ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকে তালিবানরা আফগানিস্তানে এক বিশৃঙ্খল, সংকটময়, অনিশ্চিত ও ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

তালিবানি নৃশংসতার নিত্যনতুন খবর দিয়ে আফগানিস্তানে প্রত্যেকটি দিন শুরু হয়। তালিবানরা সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষদের হত্যা করেছে, ডয়েশ উইলি নামে একজন সাংবাদিকের পরিজনদের হত্যা করেছে, একজন মহিলা টিভি সঞ্চালককে সরিয়ে পুরুষ সঞ্চালককে বসিয়েছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের খুঁজে বার করে অপহরণ করেছে; সাংবাদিকদের উপর অত্যন্ত হিংস্র আক্রমণ করেছে এবং এদের মধ্যে অন্তত একজনকে হত্যা করেছে এবং প্রতিবাদকারীদের গুলি করে প্রকাশ্য রাস্তায় হত্যা করেছে। তালিবানদের ঘোষণা অনুসারে তাদের কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে যে, মেয়েরা কতদূর পড়াশোনা করতে পারবে, তারা কোন বিষয়ে পড়াশোনা করবে, কোনও চাকরি করবে; এবং অবশ্যই কী ধরনের পোশাক পরবে। ইতিমধ্যেই আফগান মহিলাদের উপর যথেচ্ছ তালিবানি আক্রমণের খবরাখবর আসছে। অন্যদিকে, অপরিসীম সাহসের সাথে মহিলারা কাবুলের রাস্তায় হাতে লেখা পোস্টার নিয়ে প্রতিবাদ করছেন; এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আফগান মহিলা ও পুরুষরা হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে তালিবানদের অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। এরাই আফগানিস্তানের সংগ্রামী গণতন্ত্রপন্থী জনগণ, যাঁদের কণ্ঠস্বর আরও সোচ্চার করতে আমাদের সংহতি প্রয়োজন।

আফগানিস্তানের আজকের দুঃখজনক পরিস্থিতির জন্য বহু আন্তর্জাতিক কুশীলব দায়ী। ১৯৭৯ সালে তৎকালীন আফগান সরকারের নির্দেশে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ আফগানিস্তানকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার ঠান্ডা যুদ্ধের দৃশ্যপটে তুলে আনে। সোভিয়েত মদতপুষ্ট সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে থাকা মুজাহিদীন শক্তিসমূহকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাগাতার অর্থ ও অস্ত্রের জোগান দিয়েছিল। এই ছিল তালিবানদের উত্থানের পটভূমি। ২০০১ সালে আফগানিস্তানের জনসাধারণ ও বিশেষত মহিলাদের স্বাধীনতা দেওয়া এবং তালিবান সহ দেশটির অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী সংগঠন গুলিকে ধ্বংস করার নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আবার সামরিক অনুপ্রবেশ ঘটায় এবং আফগানিস্তান দখল করে নেয়।

ঐ আক্রমণ ও দখলদারির পেছনে যে কারণগুলোকে অজুহাত হিসেবে দেখানো হয়েছিল পরিস্থিতির সাম্প্রতিক বিকাশ তাকে ইতিমধ্যেই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। মার্কিন অধিকৃত আফগানিস্তানে জনগণ দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের ভাড়া করা অরাষ্ট্রীয় বাহিনীর বোমা হামলা, ড্রোন হামলা, ঘরে ঘরে নির্বিচার তল্লাশি ও হত্যার লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। মার্কিন আগ্রাসন আসলে তালিবানদেরই নিজেদের সুসংহত করার অবকাশ তৈরি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং আফগান সরকার সহ অন্যান্য মিত্রশক্তিকে বাদ দিয়ে তালিবানদের সঙ্গে একতরফা সমঝোতা করেছে। মার্কিন-তালিবান চুক্তি সকলের কাছে এটা স্পষ্ট করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রই তালিবানদেরকে ক্ষমতা হস্তান্তর করছিল। “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ”, “গণতন্ত্র রক্ষার যুদ্ধ” এবং “আফগান মহিলাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ” — এহেন অজুহাতগুলোর মুখোশ খসে পড়ার সাথে সাথেই আফগানিস্তানকে পরাধীন করার এক হিংস্র ও নিষ্ঠুর আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ সামনে এসেছে।

আজ আফগানিস্তানের নারীবাদী মানুষ, মানবাধিকার কর্মী, পরিচর্যা ও সমাজকল্যাণ কর্মীদের স্বাধীনতা ও জীবন তালিবান রাজত্বে বিশেষভাবে বিপন্ন। শরণার্থীরা যেসব দেশে আশ্রয় খুঁজছেন সেখানেও তাদেরকে জায়গা দেওয়ায় অনীহা ও নানারকম হিংসার মুখোমুখি হচ্ছেন।

ভারত সরকার এখনও তালিবানের প্রতি অবস্থান স্পষ্ট করেনি। উপরন্তু শাসক বিজেপি ও হিন্দু-আধিপত্যকামী আরএসএস নেতারা ইসলাম ও গোটা মুসলিম সমাজকে বর্বর ও নিপীড়ক তালিবানদের সাথে একই পংক্তিতে বসিয়ে ভারতীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক প্রচার করছে। ধর্মীয় ও অন্যান্য পরিচয় নির্বিশেষে সকলের নাগরিকত্বের সাংবিধানিক নিশ্চয়তার বিরুদ্ধে যাওয়া সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)-এর প্রসঙ্গ টেনে সরকার নির্লজ্জভাবে ঘোষণা করেছে যে, তারা আফগান শরণার্থীদের মধ্যে হিন্দু ও শিখদেরকে “অগ্রাধিকার” দেবে।

আমরা ভারতবর্ষে যারা বিজেপি-আরএসএসের দমনমূলক চাপিয়ে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা, যেমন মানুষ কী খাবে, কী ভাববে, কী লিখবে, কোন গান গাইবে এবং কী বিষয়ে কতটুকু কথা বলতে পারবে, কাকে আমরা ভালোবাসবো — এই সমস্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে যেভাবে এ'দেশে প্রতিবাদে সোচ্চার হই, ভিড় হিংসার বিরুদ্ধে দিনের পর দিন যারা লড়াই জারি রেখেছি, আসুন তারা সবাই আফগানিস্তানের মানুষের স্বাধীন জীবনযাপন ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের পাশে দাঁড়াই। আমরা যারা ভারতের সংবিধান ও জাতীয় পতাকাকে আরএসএস ও বিজেপির আক্রমণ থেকে রক্ষা করি, তারা আফগান জনগণের পাশে থাকি যাতে একইভাবে তাঁরা দেশের সংবিধান ও পতাকাকে তালিবান রাজত্বের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে এবং সাংবিধানিকভাবে একটি নির্বাচিত সংসদের দাবি করতে পারে, যেখানে বিভিন্ন আইন পাশ বা সংশোধন ও জাতীয় প্রতীক সংশোধন করার অনুমতি দেওয়া হবে। আমাদের স্পষ্ট দাবি —

১) প্রত্যেক আফগান নাগরিকের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে যাতে তারা এক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারকে শাসনক্ষমতায় আনতে পারে। রাষ্ট্রসংঘের তদারকিতে এক অস্থায়ী ও অন্তর্বতীকালীন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সত্বর সেখানে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করা যায়।

২) একটি আন্তর্জাতিক বিচারালয় স্থাপনের কাজ শুরু করা প্রয়োজন, যাতে আফগানিস্তান আক্রমন ও জবরদখলের সময়ে আমেরিকা ও ন্যাটো দ্বারা সেখানকার সাধারণ নাগরিকদের ওপর চালানো যুদ্ধাপরাধের ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত হয়।

৩) রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার কমিশনকে অবিলম্বে একটি তদন্তকারী দল গঠন প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে, যার কাজ হবে আমেরিকান সৈনিক ও তালিবান সহ যে সমস্ত সশস্ত্র শক্তি হিংসাত্মক নিপীড়ন চালিয়েছে আফগান নাগরিক সমাজের ওপর, তাদেরকে খুঁজে বার করে যথাযোগ্য শাস্তি প্রদান করা। অতীতে ও বর্তমানে মহিলা ও সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংস অত্যাচারী তালিবান নেতাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।

৪) রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা উপদেষ্টা, মানবাধিকার কমিশন, অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক মহলকে এই বিষয়টা নিশ্চিত করতে হবে যে, আফগান নাগরিকদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ও শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত সমস্ত সমঝোতা ও উদ্যোগের কেন্দ্রে যেন সেদেশের নারী অধিকার সংগঠনগুলি অবশ্যই থাকতে পারে।

৫) আফগান শরণার্থীদের আশ্রয়দানের ক্ষেত্রে ভারত সরকারকে কোনোরকম ধর্মীয় বাছবিচার বন্ধ করতে হবে। জাতিধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক বিপন্ন আফগান শরণার্থীর এদেশে সুরক্ষিত আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

৬) সময় নষ্ট না করে ভারত সরকারকে আফগানিস্তান থেকে সমস্ত ভারতীয় নাগরিককে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে হবে (ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীদের ফেরানো হলেও শয়ে শয়ে অন্যান্য মানুষ এখনও দেশে ফেরার কোনো নির্দিষ্ট সরকারী পরিকল্পনা ও দিশা না পেয়ে সেখানে আটকে আছেন)। ভারত সরকারকে অবশ্যই আফগান ছাত্রছাত্রীদের ভারতের শিক্ষা এত কিছু প্রস্তাব প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনা করার সুযোগ করে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।

৭) ভারতে বসবাসকারী সমস্ত আফগান নাগরিকের নিরাপত্তা ভারত সরকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে।

৮) উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের আসন্ন নির্বাচনের প্রচারে আফগানিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ ও তালিবানি শাসনকে মূল ইস্যু বানিয়ে যাতে কেউ কোনো সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়াতে না পারে সেটা ভারতের নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে।

৯) রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার কমিশনকে ভারতে আসা আফগান শরণার্থীদের নিবন্ধন করাতে হবে যাতে তারা প্রয়োজনানুসারে কর্মসংস্থান ও শিক্ষা নিশ্চিতভাবে পেতে পারেন।

১০) সিঙ্গল উইন্ডো ব্যবস্থায় আফগান শিক্ষার্থীদের ভাতা, বৃত্তি, ভিসার আবেদন সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করতে হবে।

১১) আমরা ভারতের জনগণ ও গণআন্দোলনকারী সংগঠনসমূহের কাছে আবেদন রাখছি–
ক) আফগান জনগণের স্বাধীনতা, শান্তি ও ন্যায়বিচারের সংগ্রামকে সংহতি জানিয়ে কর্মসূচি নিন।
খ) আফগান শরণার্থীদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনার সাথে তাঁদের দিকে সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
গ) মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়াতে যারা তালিবানদের ব্যবহার করবে তাদের সর্বতোভাবে প্রত্যাখ্যান ও প্রতিরোধ করুন।

আওয়াজ-ঈ-নিশান, আইপোয়া, আইসা, সারা ভারত দলিত মহিলা অধিকার মঞ্চ, অল ইন্ডিয়া এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, তানজীম ঈ ইনসাফ, আনহাদ, বেবাক কালেক্টিভ, ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন, ক্যাম্পেইন ফর পিস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (মণিপুর), কমিউনালিজম কমব্যাট, কমিউনিটি ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট, ফাও (এফএও), ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান জার্নালিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন, হরিয়ানা জ্ঞান বিজ্ঞান সমিতি, এইচআরএফ, ইনসাফ, খোয়াজা আহমেদ আব্বাস মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, খুদাই খিদমতগার, মুসলিম উইমেন'স ফোরাম, এনএপিএম, এনএফআইডব্লিউ, নর্থ ইস্ট নেটওয়ার্ক, ওবিআর ইন্ডিয়া, পিইউসিএল, সবরং ইন্ডিয়া, সহেলি, সাউথ এশিয়া সলিডারিটি গ্রুপ, ইউএএইচ ও অন্যান্য সংগঠন দ্বারা অনুমোদিত।

খণ্ড-28
সংখ্যা-34