প্রতিবেদন
কৃষক আন্দোলনের কাছে নত হল হরিয়ানার বিজেপি সরকার
peasant movement karnal

কৃষক আন্দোলনের চাপে অবশেষে নত হতে হল হরিয়ানার মনোহর লাল খট্টরের বিজেপি সরকারকে। কৃষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে তিন দফা আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় এবং কৃষক আন্দোলন অব্যাহতভাবে চলতে থাকায় চতুর্থ দফার আলোচনায় সরকার কৃষকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হল। সরকার ঘোষণা করেছে, যে আইএএস অফিসার গত ২৮ আগস্ট কারনালে বস্তারা টোল প্লাজায় কৃষকদের আন্দোলন দমনে তাদের ‘মাথা ভাঙ্গার’ নির্দেশ পুলিশদের দিয়েছিলেন, সেই অফিসার আয়ুশ সিনহার অপরাধের অভিযোগের তদন্ত করবেন হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত কমিশন। তদন্ত এক মাসের মধ্যে শেষ করে রিপোর্ট জমা দিতে হবে। যতদিন তদন্ত চলবে এবং কমিশন তাদের রিপোর্ট জমা না দেবে, ততদিন আয়ুশ সিনহাকে ছুটিতে পাঠানো হবে বলে সরকার ঘোষণা করেছে। কৃষক প্রতিনিধি ও প্রশাসনিক কর্তাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পর অতিরিক্ত সচিব আইএস অফিসার দেবেন্দর সিং বলেছেন, “যে সমস্ত দাবি তোলা হয়েছিল, সেগুলোর সবকটি সম্পর্কে আমরা একটা সম্মানজনক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাধানে পৌঁছতে পেরেছি”। সরকারের ভাষায় যেটা ‘ছুটিতে পাঠানো’, কৃষকদের কাছে সেটাই আইএএস অফিসারের সাসপেনশন। নরেন্দ্র মোদী সরকারের তৈরি করা তিনটে কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। কারনালে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রতিরোধ আন্দোলনেও তাদের নেতৃত্বকারী ভূমিকা রয়েছে। সরকার কৃষকদের দাবি মেনে নেওয়ার পর সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে,

“খট্টর সরকার আয়ুশ সিনহাকে সাসপেণ্ড করতে সম্মত হয়েছে। … হরিয়ানা কিষাণ ইউনিয়নগুলো এবং প্রশাসনের মধ্যে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির অধীনে বিচারবিভাগীয় একটা তদন্তের চুক্তিও হয়েছে। তিনি পুলিশী হিংসায় আয়ুশ সিনহার ভূমিকা নিয়ে তদন্ত করবেন, যে হিংসার ফলে একজন কৃষকের মৃত্যু হয়েছে এবং আরো অনেকে আহত হয়েছেন। তদন্ত এক মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে।

সরকার শহীদ সুশীল কাজলের (নিহত কৃষক) পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে ও সাহায্য করতে সম্মত হয়েছে। পরিবারের দু’জনকে চাকরি দেওয়া হবে। পুলিশী হিংসায় আহত কৃষকদেরও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।”

সরকারের সঙ্গে এই ফয়সালার পর কৃষকরা কারনালের মিনি সচিবালয় ঘেরাও তুলে নেন।

যে আন্দোলনের চাপের কাছে খট্টর সরকারকে নতি স্বীকার করতে হল, তার পটভূমিতে রয়েছে কৃষকদের ২৮ আগস্টের প্রতিবাদ কর্মসূচি। কৃষকরা সেদিন সমবেত হয়েছিলেন জাতীয় সড়কের ওপর কারনালের বস্তারা টোল প্লাজায়। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল সেখান থেকে ১৫ কিমি দূরে প্রেম প্লাজা হোটেলে অনুষ্ঠিত বিজেপির বৈঠকে প্রতিবাদ জানানো। সেদিন পুলিশদের যারা পরিচালিত করছিলেন তারমধ্যে ছিলেন কারনালের মহকুমা শাসক আইএএস অফিসার আয়ুশ সিনহা। তিনি পুলিশদের নির্দেশ দিলেন, কোনো কৃষক নিরাপত্তা বেষ্টনী ভাঙ্গার চেষ্টা করলে তার ‘মাথা ভেঙ্গে’ দিতে হবে। আর পুলিশরা আইএএস অফিসারের নির্দেশ মেনে কৃষকদের মাথা ফাটিয়ে দিল, তাদের মাথা থেকে রক্ত ঝড়ে পড়তে লাগল, জামা রক্তে ভিজে গেল। অন্তত দশজন কৃষককে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। সুশীল কাজল নামে এক কৃষক গুরুতর আহত হয়ে বাড়িতেই ছিলেন এবং রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

সরকার এবং পুলিশ ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ অফিসাররা ভেবেছিলেন যে, পুলিশের মারকে ভয় পেয়ে কৃষকরা গুটিয়ে যাবে। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের বিস্তার ঘটে এবং আন্দোলন তীব্রতা লাভ করে। পুলিশি নিপীড়নের পরপরই বিভিন্ন টোলপ্লাজা ও সড়ক অবরোধের কর্মসূচি নেওয়া হয়। কৃষকরা প্রথমে ‘মাথা ভাঙ্গার’ নির্দেশ দেওয়া অফিসার আয়ুশ সিনহার বরখাস্তের দাবি তোলেন। তাঁরা দাবি পূরণের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে ৭ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার কারনালে মহাপঞ্চায়েতের ডাক দেন যাতে হাজার-হাজার কৃষক অংশ নেন। সরকার কৃষকদের দাবি মানতে অস্বীকার করায়, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা কারনালের মিনি সচিবালয় ঘেরাওয়ের আহ্বান জানায়। উল্লেখ্য, খট্টর সরকারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী জেজেপি নেতা দুশ্যন্ত চৌতালা অভিযুক্ত আইএএস অফিসারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বললেও মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর ঐ আইএএস অফিসারের সমর্থনে দাঁড়ান। তিনি বলেন, আইএএস অফিসার দু’একটা বেফাঁস কথা বললেও তিনি যেভাবে কৃষক বিক্ষোভের মোকাবিলা করেছেন তার প্রয়োজন ছিল। অর্থাৎ, যে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন তাঁর সরকার চালিয়েছে তা কৃষকদের প্রাপ্য ছিল। কৃষকরা কিন্তু মিনি সচিবালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকেন। কৃষকদের অবস্থানকে কঠিন করে তুলতে, গাছের একটু ছায়া লাভ থেকে তাদের বঞ্চিত করতে সচিবালয় সংলগ্ন গাছের ডালপালা সরকার কেটে দেয় বলে সংবাদ বেরিয়েছে। তবে, কৃষকদের আন্দোলন ও অবস্থান ব্যাপকতর সমর্থন লাভ করে। তাঁরা রবি দাহিয়া, বজরং পুনিয়া, সুমিত বাল্মীকির মত অলিম্পিক পদক জয়ীদের সম্মান জানানোর প্রস্তাব দিলে তাঁরা সেখানে উপস্থিত হন এবং সেটা কৃষক আন্দোলনের প্রতি তাঁদের সমর্থন রূপেই দেখা দেয়। অবশ্য, সরকারের সঙ্গে আগের তিন দফা আলোচনায় কৃষক প্রতিনিধিরা আইএএস অফিসারের বরখাস্তের দাবির স্থানে তাঁর সাসপেনশনের দাবিকে নিয়ে আসেন। কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে যে আন্দোলন দশ মাস ধরে অবিচলভাবে চলছে, কারনালেও সেই ধরনের দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের জন্য তাঁরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। খট্টর সরকারের অবশেষে বোধদয় হল যে, কারনালকে আর একটা সিঙ্ঘু, টিকরি বা গাজিপুর সীমানার মতো কৃষক আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠতে দিলে শুধু খট্টর সরকারেরই নয়, মোদী সরকারের বিপন্নতাও বাড়বে। আর তাই কৃষকদের দাবির কাছে নতিস্বীকার ছাড়া খট্টর সরকারের কাছে অন্য কোনো পথ ছিল না।

কৃষকরা আজ সারা দেশের কাছে এক পরাক্রমী শক্তি হিসাবে, ভরসার এক দৃঢ় আধার হয়ে দেখা দিচ্ছেন। তাঁরা মোদী সরকারের তৈরি তিন কৃষক স্বার্থ বিরোধী আইন প্রত্যাহারের আন্দোলনকে দশ মাস ধরে অব্যাহত রেখেছেন, মুজাফ্ফরনগরে মহাপঞ্চায়েত অনুষ্ঠিত করে বিজেপিকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছেন, মেরুকরণের উপায় হিসাবে বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার কৌশলকেও ধাক্কা দিয়েছেন। শুধু কৃষক স্বার্থ নয়, জনগণের অন্যান্য অংশের দাবির পক্ষেও মুখর হয়েছেন। বেসরকারিকরণের বিরোধিতা করেছেন, শ্রমিকদের দাবির সমর্থনে সোচ্চার হয়েছেন। মনোহর লাল খট্টর সরকারকে যেভাবে নতি স্বীকারে তাঁরা বাধ্য করলেন, তারজন্য হরিয়ানার কৃষকদের অবশ্যই অভিনন্দন জানাতে হবে। কৃষক আন্দোলনের কারনাল অধ্যায় ফ্যাসি-বিরোধী আন্দোলনে অনুপ্রেরণার এক উৎস হয়েই দেখা দেবে।

- জয়দীপ মিত্র 

খণ্ড-28
সংখ্যা-33