অহঙ্কারী মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ভারতের কৃষকরা এবং ‘আন্দোলনজীবীরা’ জিতলেন এক ঐতিহাসিক জয়!
historic victory

অবশেষে প্রধানমন্ত্রীকে অভূতপূর্ব কৃষক-প্রতিরোধের সামনে মাথা নোয়াতে হল, তিনটি বিতর্কিত আইনই খারিজের কথা ঘোষণা করতে হল। এবং সেটা ব্যাপক অসন্তোষ জাগানো বিলে পরিণত কৃষি অর্ডিন্যান্সকে সংসদে আইনে রূপান্তরিত করার পথ নিরঙ্কুশ করার চোদ্দ মাস পর! এই জয় এক ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে, কারণ জনতার সাহসী, অক্লান্ত এক আন্দোলন অত্যাচারী এক সরকারকে নতজানু হতে বাধ্য করেছে আর জনগণের ক্ষমতা রাষ্ট্রশক্তি ও ক্ষমতাগর্বী অভিজাত শাসকের দম্ভ আর নৃশংসতাকে পরাস্ত করতে সফল হয়েছে। এই চমকপ্রদ ‘ইউ-টার্ন’ ঘোষণাটির জন্য নরেন্দ্র মোদী শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানকের জন্মজয়ন্তী অর্থাৎ গুরুপরবের দিনটিকে বেছে নিয়েছেন। স্পষ্টতই তার উদ্দেশ্য ক্রুদ্ধ শিখসম্প্রদায়কে শান্ত করা আর উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড পাঞ্জাবের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে যে বড়সড় ক্ষতির আশঙ্কা বাড়ছে তা কমানোর চেষ্টা!

গোদী মিডিয়া-র সঞ্চালক ও ভাষ্যকারেরা, যারা এতদিন কৃষি আইনকে সোল্লাসে তালি বাজিয়ে বাহবা দিয়ে এসেছেন, তারা যেন চরম ধন্দে পড়ে একেবারে চুপসে গেছেন! কেউ কেউ প্রবল সংশয়ে চিন্তাকুল হয়ে উঠলেন, এবার সরকার আবার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) এবং ৩৭০ ধারা নিয়েও নতি স্বীকার করে বসবে নাকি! কেউ আবার এই পদক্ষেপকে একজন ‘সূক্ষ্মদর্শী’ রাষ্ট্রনেতার ‘বিচক্ষণতা’ বললেন। কেউ বলেছেন-এটা জাতীয় স্বার্থে হয়েছে; কেউ আবারএই দীর্ঘ বিলম্বিত ঘোষণায় বাজিমাত করা এক ‘মোক্ষম নির্বাচনী চাল’ আবিষ্কার করে ফেলেছেন! আবার কেউ এই ‘পিছু হটা’কে পশুরাজের দু’পা পেছোনোর সঙ্গে তুলনা করে ফেলেছেন — ‘আরে সেটা তো পালানোর জন্যে নয়, বরং প্রবল বিক্রমে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে’!

সময় বলবে মোদীর ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বিজেপি’র ক্ষতিকে আদৌ বা কতটা কমাতে পারবে, আর ঠিক কীভাবে সরকার কৃষকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু এই মুহূর্তে এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে সরকার কৃষকদের অসম্মানিত, হতোদ্যম করার ও ‘ভয়ঙ্কর শয়তান’ হিসেবে তুলে ধরতে ও আন্দোলনকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে সম্ভাব্য সমস্ত ছলাকলার আশ্রয় নিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। প্রচণ্ড হতাশ, সংশয়গ্রস্ত ও ভীত হয়েই সরকার আইনগুলি বাতিলের কথা ঘোষণা করেছে। প্রতিবাদী কৃষক এবং অন্যান্য শক্তি যাঁরা ন্যায়, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের জন্য লড়ছেন, তাঁদের এই মুহূর্তটা আঁকড়ে ধরে আরও বড় জয়ের জন্য দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যেতে হবে।

কী সেই বস্তু যা এই বিরাট জয়কে সম্ভব করে তুলল? এটা আবারও প্রমাণ হল, ভারত রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাশালী সরকারের পক্ষে একটা পর্যায়ের পর ভারতের কৃষক জনতাকে উপেক্ষা করা এবং বিরোধিতা করা সম্ভব নয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম কয়েকটি বড় কৃষক আন্দোলন ও কৃষক বিদ্রোহের পর্বে চিহ্ণিত। ভারতীয় কৃষক সম্প্রদায়ের উদ্দীপ্ত অংশগ্রহণই স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছে এবং শেষপর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটেছে। ১৯৪৭-এর পর প্রত্যেকটি বড় মাপের সামাজিক ও রাজনৈতিক অভ্যুত্থানে কৃষক এবং যুব সম্প্রদায় অবধারিতভাবেই সামনের সারিতে থেকেছেন। এমনকি বিগত তিন দশকে যখন সাধারণ প্রবণতায় হিন্দুত্বের রাজনীতির এবং বাজার আধিপত্য ও বিশ্বায়নের অর্থনীতির উত্থান হচ্ছে, কৃষক আন্দোলন সেক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি সঙ্কট মুহূর্তে শৃঙ্খল ভাঙতে পেরেছে।

এসইজেড-বিরোধী আন্দোলন ১৮৯৪-এর জমি অধিগ্রহণ আইনের ইতি টেনেছে, আর কৃষক ও আদিবাসীরা কর্পোরেট স্বার্থে মোদীর ২০১৩-র জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ আইনকে উল্টে দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিতে পেরেছেন। মোদীর সাত বছরে কৃষকরা এই দ্বিতীয় বার সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করতে সক্ষম হলেন।

দেশব্যাপী শত শত কৃষক সংগঠনের এক উদার-ভিত্তিক এবং সুশৃঙ্খল কার্যকরী ঐক্য গড়ে তোলা ও তাকে রক্ষা করা এবং সঙ্ঘ বাহিনীর বিভেদকামী সাম্প্রদায়িক প্রচারকে সচেতন প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়েই কৃষক আন্দোলন এই বিজয় অর্জন করেছে। যখন পাঞ্জাবের কৃষকদের ‘খালিস্তানি’ তকমা দিয়ে দাগিয়ে দেওয়া ও বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হল, হরিয়ানা তাদের পাশে দাঁড়ালো আর তারা একসঙ্গে ২৬ নভেম্বর দিল্লী সীমানায় প্রতিবাদী শিবিরের খুঁটি পুঁতলো। ২৬ জানুয়ারির পর সংবাদমাধ্যমের বিভ্রান্তিকর মিথ্যা প্রচার আর নিপীড়নকে তুচ্ছ করে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা নতুন উদ্যম আর শক্তি নিয়ে আন্দোলনে যোগ দিলেন। লখিমপুর খেরিতে কৃষক-গণহত্যার পর গোটা দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেল, দাঁড়াল আন্দোলনের পাশে।

সরকার এবং সঙ্ঘ বাহিনী প্রতিবাদী কৃষকদের যত ‘ভয়ঙ্কর দুর্বৃত্ত’ হিসেবে জনসমক্ষে তুলে ধরার ও অত্যাচার ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আন্দোলনকেও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল, কৃষকদের সংকল্প ও ঐক্য তত দৃঢ়তর হল, আর কৃষকদের অক্লান্ত সংকল্পবদ্ধ প্রচার, শ্রমজীবী জনতার বিভিন্ন অংশের মধ্যে সহানুভূতি ক্রমশ বাড়িয়ে তুললো। ২ নভেম্বর ঘোষিত উপ-নির্বাচনের ফলাফল যথেষ্ট পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিয়েছে যে অতিরিক্ত জনরোষের উদ্গীরণ ঘটছে নির্বাচনী পরিসরে। যখন বিরোধী দলগুলো বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল রয়ে গেছে, কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই বিকাশমান গতিশীল বিরোধিতা হিসেবে উঠে এসেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আওতামুক্ত থেকে, কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ সর্বত্রই মানুষের কাছে নির্বাচনে বিজেপি'র পরাজয় নিশ্চিত করার আবেদন রেখেছে, আর এভাবেই বিজেপি বিরোধী এক বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছে। কৃষক আন্দোলনের উদার ব্যাপক ঐক্য আর শক্তিশালী রাজনৈতিক কণ্ঠস্বরের সমন্বয়ই মোদী সরকারকে বাধ্য করেছে সবশুদ্ধ পৃষ্ঠপ্রদর্শন করতে — আইনগুলো খারিজ করতে; তার কাছে আর বিকল্প রাস্তা ছিল না।

মোদী কিন্তু কৃষক আন্দোলনে যে সাতশো’রও বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন, তাদের জন্য কৃষকদের কাছে ক্ষমা চাননি। কেউ কেউ সরাসরি মোদীর দল ও তার সরকারের হিংস্রতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর অন্যেরা, খোলা আকাশের নিচে যে জীবন গত এক বছর ধরে কাটাতে বাধ্য হয়েছেন কৃষকরা, তার রূঢ়তা সইতে পারেননি। মোদী সেইসব গালাগাল, কুমন্তব্যের জন্য কোনও দুঃখপ্রকাশ করেননি যেগুলো তার মন্ত্রী ও বরিষ্ঠ নেতারা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন কৃষকদের আর তাদের আন্দোলনের উদ্দেশে, বা কৃষক আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানো মানবাধিকার কর্মীদের উদ্দেশে তার নিজের, সংসদে দাঁড়িয়ে সেই কুখ্যাত কুমন্তব্য ‘আন্দোলনজীবী’র জন্যও তাকে লজ্জিত হতে দেখা যায় নি। তিনি বরং ক্ষমা চেয়েছেন ‘মানুষের’ কাছে, কৃষি আইনগুলির অনুমিত সুফল সম্পর্কে ‘কৃষকদের একটা অংশকে বোঝাতে’ অক্ষম হওয়ার জন্য! তিনি, বিশেষ করে ডিজেল আর সারের অবিরাম মূল্যবৃদ্ধির জন্য লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলা চাষের খরচ কমানোর ব্যাপারে একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না; বরং তিনি বললেন ‘জিরো বাজেট’ কৃষির কথা, নতুন আইন তৈরির জন্য নতুন কমিটি গড়ার কথা।

কৃষকরা সঠিকভাবেই প্রতিবাদ জারি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত আইনগুলি প্রকৃতপক্ষে বাতিল হচ্ছে, সমস্ত শস্যের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি গ্যারান্টি, নতুন বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহার সহ আন্দোলনের অন্য দাবিগুলি সরকার মেনে না নিচ্ছে। স্তাবক গোদী মিডিয়া মোদীর নতুন ‘মাস্টারস্ট্রোক’ আর ‘মহানুভবতা’ নিয়ে বহুল প্রচারে জীর্ণ হয়ে যাওয়া মিথ্যে গল্পগুলো ছড়ানোর চেষ্টা করতে ব্যস্ত থাক; ভারতীয় জনগণ কৃষকদের কুর্নিশ জানাবেন, সালাম জানাবেন যে সুবিশাল কাজ তাঁরা ইতিমধ্যেই সমাধা করে ফেলেছেন তার জন্য! সালাম জানাবেন এই অতিমারীর মাঝে এক শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলা, চালিয়ে যাওয়া এবং একটা ফ্যাসিবাদী সরকারের অভ্রংলিহ দম্ভ আর নিষ্ঠুর আগ্রাসনের মুখে দাঁড়িয়ে সেই আন্দোলনকে বিজয় পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য! এখনই সময় প্রতিটি চলমান গণ সংগ্রামের কৃষকদের থেকে অনুপ্রেরণা আর সাহসে উদ্দীপ্ত হওয়ার আর মোদী-শাহ-যোগী রাজের ফ্যাসিস্ট ছককে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এক ব্জ্রকঠিন শক্তিশালী প্রত্যাঘাত হানার!

(লিবারেশন সম্পাদকীয়, ডিসেম্বর ২০২১)

খণ্ড-28
সংখ্যা-41