প্রতিবেদন
গড়চিরোলির হত্যাকান্ড : অনেক বিভ্রান্তি, অনেক প্রশ্ন
Gadchiroli's murder

১৩ নভেম্বর ২৬ জন ‘মাওবাদী’ অত্যাধুনিক নিরাপত্তা বাহিনী সি-৬০’র সাথে ‘সংঘর্ষে’ নিহত হন। সংবাদের দুনিয়ায় খবরে প্রকাশ, ‘সংঘর্ষ’ হয়েছিল গড়চিরোলি জেলার মার্দিনোতোলা জঙ্গলে যা ছত্তিসগড়ের রাজনন্দনগাঁও জেলার লাগোয়া। ঘটনাস্থল নিয়ে দ্বিমত আছে। নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চকর্তা বলেছেন ‘বিভিন্ন জায়গায়’ (‘মাল্টিপল্ লোকেশানস’) এঁরা নিহত হয়েছেন। ২৬ জনের মধ্যে ১৬ জন ‘সন্দেহভাজন মাওবাদী’ (‘সাসপেক্টেড মাওয়িস্ট’), ১০ জনের পরিচিতি অজানা। সুতরাং এঁদেরকে নিশ্চিত ভাবে মাওবাদী বলা যাচ্ছে না। ‘সংঘর্ষ’ কীভাবে হল? একটা মত হচ্ছে, রুটিন চিরুনি তল্লাশি চলছিল, হঠাৎ জঙ্গিরা বাহিনীর ওপর গুলি চালাতে শুরু করে। আরেকটা মত হচ্ছে, খবর ছিল গভীর দুর্গম জঙ্গলে মাওবাদীদের একটা সামরিক ক্যাম্প চলছে যেখানে তাদের দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের থাকার সম্ভাবনা আছে। আধা-সামরিক বাহিনী সেই অঞ্চল ঘিরে ফেলাতে তাদের ওপর আক্রমণ হয়। অর্থাৎ যা সব সময় বলা হয়ে থাকে, বাহিনী আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে। প্রমাণ করার চেষ্টা যে এটা ভুয়ো সংঘর্ষ নয়। বলা হচ্ছে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেছে, ছবিও ছাপানো হয়েছে, যদিও প্রশ্ন ওঠে সেগুলো যে নিহতদের থেকেই পাওয়া গেছে তার কী প্রমাণ আছে?

এতো সব প্রশ্ন উঠছে কারণ অতীতে এরকম ঘটনা ঘটেছে যেখানে তথাকথিত মাওবাদীদের ওপর বড়সড় অপারেশনের পর নিরাপত্তা বাহিনী উল্লাস করেছে, নেতা-মন্ত্রীরা একে অপরের পিঠ চাপড়িয়েছে, তারপর তদন্তে দেখা গেছে যে যাঁরা নিহত হয়েছেন তাঁরা ছিলেন সাধারণ গ্রামবাসী। ২০১২ সালে ২৭-২৮ জুন ছত্তিসগড়ে একটি ঘটনায় ৩ জন শিশু সহ ১৭ জন মারা যান। প্রায় একবছর বাদে ১৭-১৮ মে, ২০১৩-তে আরেকটি ঘটনায় ৮ জন মারা যান। দুটি ঘটনা নিয়ে এতো হৈচৈ হয় যে দাপুটে রমণ সিংয়ের বিজেপি সরকারও তদন্ত কমিশন গঠন করতে বাধ্য হয়। ২০১৯এ কংগ্রেস সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর এই দুটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তদন্তে প্রমাণিত হয় যে নিহতরা কেউ মাওবাদী ছিলেন না, সবাই ছিলেন সাধারণ গ্রামবাসী। কিন্তু আজ অবধি নিহতদের পরিবার কোনও ক্ষতিপূরণ পাননি এবং যাদের হাতে এতোগুলো মানুষ বেঘোরে প্রাণ হারালেন সেই দোষী অফিসারদের কোনও শাস্তি হয়নি।

২০১৮ সালের ২২ এপ্রিল এই গড়চিরোলি জেলায় একটি তথাকথিত সংঘর্ষ হয় এবং নিরাপত্তা বাহিনী সি-৬০ দাবি করে ১৬ জন মাওবাদী নিহত; কয়েকদিনের মধ্যে তারা দাবি করে যে আরও ২৪টি দেহ পাওয়া গেছে এবং মোট মৃতের সংখ্যা অন্তত ৪০। তিনটি মানবাধিকার সংগঠন, ‘কো-অর্ডিনেশন অফ ডেমোক্রেটিক রাইটস অর্গানাইজেশন’ (সিডিআরও), ‘ইন্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশন অফ পিপলস লইয়ার্স’ (আইএপিএল), ‘উইমেন এগেন্সট স্টেট রিপ্রেশন এন্ড সেক্স্যুয়াল ভায়োলেন্স’ (ডব্লিউএসএস) ঐ ঘটনার ওপর তথ্যানুসন্ধান করে একটি রিপোর্ট পেশ করে ‘ম্যাসাকারস্ মাস্কড্ এজ এনকাউন্টারস্ঃ দ্য নিউ স্টেট পলিসি ফর ডেভেলপমেন্ট ইন গড়চিরোলি’। ঐ রিপোর্টে লিখছে সি-৬০ বাহিনী এবং সিআরপিএফ চারিদিক থেকে মাওবাদীদের ঘিরে ফেলে এবং হত্যা করার উদ্দেশ্য নিয়ে অত্যাধুনিক ‘আন্ডার ব্যারেল গ্রেনেড লঞ্চার্স’ (ইউবিজিএল) থেকে এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। রিপোর্ট পরিস্কার জানায় যে সেটা ছিল ঠাণ্ডা মাথায় খুন (নিউজক্লিক, ৮ মে ২০১৮)। বিস্ময় প্রকাশ করা হয় যে এতোবড়ো একটি ‘সংঘর্ষে’ বাহিনীর কেউ আহতও হয়নি! ঘটনাস্থল বা নিহতদের কোনও ছবি পাওয়া যায়নি (তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ১৩ নভেম্বরের মৃতদেরও কোনও ছবি কোথাও দেখা যায়নি)। তথ্যানুসন্ধান দলটিকে গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলতে দেওয়া হয়নি; নিরাপত্তা বাহিনী তাঁদের সর্বত্র অনুসরণ করেছে। নিহতদের কয়েকজনের শরীরে গুলির চিহ্ন পাওয়া যায়নি, কিন্তু অন্য ক্ষত পাওয়া গেছে, যার থেকে সন্দেহ হয় যে তাঁরা পুলিশী টর্চারের শিকার।

আসলে গড়চিরোলি জেলা বহুদিন ধরেই মাইনিংয়ের লীলাক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জমি থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে মাইনিং কোম্পানিগুলির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। এই কোম্পানিগুলিকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বিশাল বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। আদিবাসীরা প্রতিবাদ করছেন এবং প্রতিবাদ করলেই তাঁদের ‘মাওবাদী’ বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। বিনা কারণে সাধারণ মানুষকে হেনস্থা করা হয়, শুধুমাত্র ‘মাওবাদী’ সন্দেহে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয় ও মাসের পর মাস কারাগারে ফেলে রাখা হয়। তাই ঐ তথ্যানুসন্ধান দল মনে করে এই ধরণের হত্যাকান্ডগুলি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

এই প্রসঙ্গে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় গ্রেপ্তার মহেশ রাউতের কথা উল্লেখ করতে হয়। মাত্র ৩৩ বছরের এই তরুণ ‘টাটা ইন্সটিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্স’ এর প্রাক্তনী ও ‘প্রাইম মিনিস্টার রুরাল ডেভেলপমেন্ট’এর ফেলো ছিলেন। তিনি ঐ অঞ্চলে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে মানুষকে সংগঠিত করতেন, তেন্ডুপাতার ভালো দাম পাওয়ার জন্য আদিবাসীদের হয়ে সওয়াল করতেন। ব্যস, শাসকের চোখে তিনি হয়ে গেলেন ‘মাওবাদী’! তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর জেলার প্রায় ৩০০টি গ্রামসভা তাঁর মুক্তির দাবি জানিয়ে প্রস্তাব নেয়। উক্ত রিপোর্ট থেকে জানা যায় বেশ কয়েক বছর ধরেই মানবাধিকার কর্মী বা সমাজকর্মীরা জমি অধিগ্রহণ, পুলিশী অত্যাচার, ভুয়ো সংঘর্ষ ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই তাঁদের নানা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়, গ্রেপ্তার করা হয়; আর এখন তো লাগামছাড়া ভাবে ইউএপিএ প্রয়োগ করা হয়। মাইনিং কোম্পানিগুলোর সুবিধা করে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্র এখানে চরম দমনমূলক পদক্ষেপ নিতেও দ্বিধা করেনা। সন্ত্রাস এখন এমন পর্যায়ে যে কোনও মানবাধিকার গোষ্ঠিকে সেখানে গিয়ে তদন্ত করতেও দেওয়া হবেনা। যারাই যাবে তাঁদের ‘মাওবাদী সংগঠন’ বলে ছাপ্পা মেরে দেওয়া হবে। ২০০৬ সালের ‘জাতীয় অরণ্য আইন’ আদিবাসীদের জমির অধিকার প্রদান করেছে, কিন্তু ঝাড়খণ্ড, ছত্তিসগড়ের মতো গড়চিরোলির বহু আদিবাসী মানুষ পাট্টা পাননি। ‘পেসা’ (পঞ্চায়েত এক্সটেনশন টু শিডিউল্ড এরিয়াস অ্যাক্ট) ১৯৯৬ সংশোধন করার চেষ্টা হচ্ছে যাতে গ্রামসভা না করেই জমি অধিগ্রহণ করা যায়। কর্পোরেট মাইনিং কোম্পানিদের জমি লুঠ এবং তার বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের প্রতিরোধ এটাই হচ্ছে এইসব হত্যাকান্ডের মধ্যে নিহিত মূল কাহিনী।

- সোমনাথ গুহ

খণ্ড-28
সংখ্যা-41