সম্পাদকীয়
মমতা সরকার নির্বিকার
government is indifferent

সাতশোর কাছাকাছি মৃত্যু, সহস্রাধিকের গ্রেপ্তারী, গন্ডায় গন্ডায় ভূয়ো মামলার ফাঁস, নৃশংস হত্যাকান্ড এবং অবিশ্রান্ত নানা কুৎসার মোকাবিলা করে কৃষকশক্তি যে অটুট আন্দোলনের ধারায় তিনশ সাতান্ন দিনের মাথায় মোদী সরকারকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করল, এক অভূতপূর্ব জয় ছিনিয়ে নিল, তার কোনও তুলনা হয় না। বিপরীতে, মোদী যতই ‘হাতজোড় করে ক্ষমাপ্রার্থী’ হোন, ওটি যে বাহানা প্রদর্শন ছাড়া অন্য কিছু নয়, সেটাই লেখা থাকবে ইতিহাসে, মানুষের ইতিহাস মোদী জমানাকে কখনই ক্ষমা করবে না।

তবে শিক্ষা যা পাওয়া গেল তার উপর্যুপরি প্রয়োগ কি কেবল বিজেপি জমানার বিরুদ্ধে সীমিত থাকবে? পশ্চিমবাংলার মতো অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যে কোনও আঁচ নিয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই! অবশ্যই রয়েছে। কারণ এখানেও কৃষি ও কৃষকের অবস্থা মোটেই বিপরীত মেরুর নয়। পশ্চিমবাংলার গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে দিল্লী থেকে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার প্রচারক দল এসেছিল। বিজেপিকে রুখে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন অংশে প্রচার করেছিল। তার সুফল সবচেয়ে বেশি পেয়েছে তৃণমূল। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কৃষকরা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় ভোট না দিলে তৃণমূলের আবার ক্ষমতায় ফেরা হত না। অন্যদিকে মমতা সরকার দিল্লীর কৃষকদের প্রতি মোদী সরকারের নৃশংস আচরণের নিন্দা জানিয়েছে, অভিনন্দন জানিয়েছে লড়াকু কৃষকদের। তিন আইন প্রত্যাহারের ও সংশ্লিষ্ট বাকি দাবিগুলির ফয়সালার লড়াই সড়ক থেকে সংসদে নিয়ে যাওয়ার যে সম্মিলিত দাবি উঠেছে, তাতেও সামিল থাকবে বলেছে তৃণমূল। কিন্তু পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে কি করছে? অন্তত ধরা যায় যদি ধান-চালের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পাওয়ার প্রশ্নে?

পশ্চিমবঙ্গে ধান কেনার সরকারি সহায়ক মূল্য ২০১৮-১৯ সালে ছিল কুইন্টাল প্রতি ১৮১৮ টাকা। ২০২০-২১-এর দীর্ঘসময় ধরে যদিও অতিমারী পর্ব চলেছে, কৃষি কাজ বন্ধ ছিল না, কিছু বিধিনিয়ম মেনে চলে। ২০২০-তে ধানের সহায়ক মূল্য বেড়ে হয়েছিল ১৮৬৮ টাকা। আর ২০২১ সালে সেটা আরেকটু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৪০ টাকা, এর সাথে বোনাস আরও ২০ টাকা, মোট ১৯৬০ টাকা। সরকার সাধারণত কেনে মোটা ধান, তার উৎপাদন খরচ হয় কুইন্টাল পিছু ন্যূনতম ১৮০০ টাকা। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার দাবি — ফসল উৎপাদন খরচের দেড় গুণ ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দিতে হবে। সেইমতো পশ্চিমবঙ্গে উপরোক্ত ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ হওয়ার কথা ২৭০০ টাকা। সরকার অথচ ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করেছে কুইন্টাল প্রতি ৭৫০ টাকা কম। তার ওপর সরকারি সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু হতেই দেরী হয়, চলে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। ফিবছর চলে একই দুর্দশা। এবছর ঘোষণা ছিল নভেম্বরের গোড়া থেকে ধান সংগ্রহ শুরু হবে। আর, বাস্তবে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত চলছে কেবল নাম নথিবদ্ধকরণ, সরকার এখনও ধান কিনতে নামেনি। কবে থেকে নামবে তার নিশ্চয়তা নেই। ফলে চাষিদের, যাদের চাষের ব্যয় উসুল করতে একটু অপেক্ষা করার উপায় থাকে না — তারা বাধ্য হন অভাবী বিক্রিতে। এখন বাধ্য হচ্ছেন কুইন্টাল প্রতি ১১০০-১২০০ টাকায়, খুব বেশি হলে ১৪০০-১৫০০ টাকায় ধান-চাল মান্ডির বাইরে ফড়েদের কাছে বেচে দিতে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেওয়ার প্রশ্নে মমতা সরকার আদৌ সদাশয় দাবি করতে পারে না। মোদী সরকার মান্ডি অকেজো করে দিয়ে চাপাতে চায় কর্পোরেটরাজ। মমতা সরকারের রাজত্বে মান্ডি থেকেও অধরা, গেঁড়ে রয়েছে ফড়েরাজ। এটাই যা তফাৎ। রাজ্য সরকার প্রচার করছে ‘ধান দিন, চেক নিন’, ‘মান্ডিতে আসুন, নয়তো বাড়ি বসে ধান বেচুন’। সরকার ‘খাদ্য সাথী : অন্নদাত্রী অ্যাপ’ খুলেছে। অন লাইন বুকিং করা চাই, তবে বাড়ি আসবেন সরকারের সংগ্রাহকরা। কিন্তু বাস্তবে? মান্ডিতে যাওয়ার পথে বাধা ফড়ে দাপট। আর বাড়ি বসে বেচতে হলে করতে হবে অন্তর্জালের সংস্থান, খরচের ওপর খরচ। তাই এখানেও বাড়ছে চাষ ও চাষির সংকট। সরকার নির্বিকার।

খণ্ড-28
সংখ্যা-41