“বিশ শতাব্দী গেল, একুশেরও মহরৎ হবে — পালটায় সাল, বলো দিনগুলো পাল্টাবে কবে??”
Year after year

স্বাধীনতার ৭৫’র দোড়গোড়ায় এসেও যেমন রাজনৈতিক বন্দীদের ধর্ষণ করা হয়, ঠিক তেমনি নারী ও শিশু সুরক্ষার নামে গড়ে ওঠা একের পর এক সরকারি-বেসরকারি হোমগুলিতে চলতে থাকে যৌন নিপীড়ন, শিশু পাচার এবং চিকিৎসার নামে মানসিক নির্যাতন। কিছু বছর আগেই লিলুয়ায় সরকারি হোম থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল এক তরুণী সেখানকার নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য না করতে পেরে। এই ঘটনার পর জেলা প্রশাসন, সরকার সবাই ঢাকঢোল বাজিয়ে প্রচার করলেন সরকারি-বেসরকারি সমস্ত হোমগুলিতে এবার থেকে কড়া নিরাপত্তা এবং নজরদারি চলবে, কিন্তু বাস্তবে এই নজরদারি সাধারণ মানুষের নজরে আসেনি কোনোদিনই!!

গত সপ্তাহে এক ট্রাফিক গার্ডের নজরে আসে দুই নাবালিকাকে হাতে দড়ি বেঁধে হাওড়ার মালিপাঁচগড়া থানার অন্তর্গত বাবুডাঙ্গায় রাম ঢ্যাং রোডের একটি বেসরকারী হোমে নিয়ে যেতে। সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘করুণা উইমেন এ্যান্ড চাইল্ড ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’। পুলিশ এবং মিডিয়া পৌঁছানোর পরে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত চাপে সামগ্রিক ব্যাপারটা নজরে আসে প্রশাসনের। এলাকার শাসকদলের এক প্রভাবশালী নেতার পুত্রবধূর মালিকানাধীন এই বেসরকারি হোমটি মূলত অনাথ শিশু ও মানসিক ভারসাম্যহীন কিশোর-কিশোরীর এবং বয়স্কদের একটি আশ্রয়স্থল হিসেবে সালকিয়া-বাবুডাঙ্গায় গড়ে উঠেছে বেশ কিছু বছর ধরেই। কিন্তু বাস্তবে যখন পুলিশ সেখানে পৌঁছোয় তখন দেখা যায়, হাতে পায়ে শিকল বেঁধে মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে একের পর এক রোগীকে। হোমের বাসিন্দারা পুলিশের কাছে জানায় যে দিনের পর দিন ধরে প্রশাসনিক এক কর্তার মদতে তাদের উপর লাগাতার যৌন নিপীড়ন এবং চিকিৎসার নামে নির্যাতন চলেছে। তাদের আরও অভিযোগ, বহু দুঃস্থ শিশু তাদের হোমে আসার পরে অজ্ঞাত কোনও ঠিকানায় তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অনুমান করে নেওয়াই চলে শিশু পাচারকে কেন্দ্র করে একটি ব্যবসাও ফেঁদে বসেছিল এই হোম কর্তৃপক্ষ। অগত্যা মালিপাঁচঘড়া থানার পুলিশ ৯ জনকে গ্রেফতার করে যারমধ্যে এক প্রশাসনিক কর্তা সহ উপরোক্ত প্রভাবশালী নেতার পরিবারের সদস্যাও রয়েছেন।

২১ নভেম্বর আইসা হাওড়া জেলা কমিটির পক্ষ থেকে চারজনের এক অনুসন্ধানকারী দল গুগল ম্যাপের ভূয়ো লোকেশনের বাধা টপকিয়ে বিকেল চারটের সময় পৌঁছায় সেই বেসরকারি হোমে। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায় তার আগের দিন থেকে পুলিশ এই হোমটিকে সিল করে দিয়ে গিয়েছে। এখানকার বাকি আবাসিকদের পাঠানো হয়েছে বারাসাতে সরকারি হোমে। নির্যাতিত দুই শিশুকে আপাতত রাখা হয়েছে পুলিশী হেফাজতের সেফ হাউসে।

বেসরকারি হোমটির পাশেই রয়েছে সালকিয়া সবুজ সংঘ ক্লাব। সেখানকার বেশ কিছু যুবক ও স্থানীয়দের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয় আইসার প্রতিনিধিদের। স্থানীয়রা জানান এতদিন ধরে তারা কোনও রকমের সন্দেহজনক ঘটনা লক্ষ্য করেননি এই হোমকে কেন্দ্র করে। যে দায়টা ছিল সরকারের, নারী ও শিশুকল্যাণ দপ্তরের নোডাল অফিসারদের, তারা দায়িত্ব পালন করতে সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ। সালকিয়া হোমের এই ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সরকারি-বেসরকারি রাজ্যের নানা দিকে গজিয়ে ওঠা হোমগুলিতে অনাথ ও দুঃস্থ শিশুদের, নাবালিকাদের সুরক্ষার নামে যে নিপীড়ন চালায় সেখানকার কর্তৃপক্ষ, সালকিয়ার এই চূড়ান্ত অমানবিকতার ঘটনা সেই বৃত্তের একটি অংশ। এভাবেই নীরবে-নিভৃতে কেঁদে কেঁদে গুমড়ে গুমড়ে শিশুদের জীবন এক বিভীষিকাতে পরিণত হচ্ছে প্রতিদিন। পাচার হয়ে যাওয়া কোনও নাবালিকাকে পুলিশ উদ্ধার করে নিয়ে এসে সরকারি হোমে রাখে, আর সেই সরকারি হোমে তাকে বারবার শিকার হতে হয় যৌন নিপীড়নের। এই ঘটনা ঘটছে সকলের সামনেই। খবরের পাতায় মাঝারি মাপের কিংবা ছোট হেডলাইনে প্রায়ই চোখে পড়ে আমাদের। কিন্তু তার প্রতিবাদে তার প্রতিরোধে আমরা মুখ খুলি কজন?

এখানে প্রদীপের নিচেই যে অন্ধকার, সেই অন্ধকারে আলো আনার দায়িত্ব আজ আমাদের নিতেই হবে, নাহলে একের পর এক আরও নাম না জানা শিশুরা, নাবালিকারা অচিরেই হারিয়ে যাবে।

তাই শুধুমাত্র ক্যাম্পাসের ভেতরে কিংবা শিক্ষার অধিকারের আন্দোলনে সীমিত থাকা নয়, সম্মানজনক জীবনযাপনের, অধিকার অর্জনের লড়াইয়ের শিক্ষাও দেয় আইসা।

সালকিয়া হোমের সমস্ত দোষীদের সর্বোচ্চ সাজা না হওয়া অবধি এবং সরকার কর্তৃক সরকারি-বেসরকারি প্রত্যেকটি হোম, মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে যথোপযুক্ত নিয়মিত নজরদারি ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত এ লড়াই চলবে। সালকিয়ায় আইসা হাওড়া জেলা কমিটির অনুসন্ধানকারী টিমে ছিলেন দেবমাল্য, স্নেহা, অমিতাভ ও অঙ্কিত।

খণ্ড-28
সংখ্যা-41