২০২০ সাল। মার্চ মাস। দায়িত্বজ্ঞানহীন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে চার ঘন্টার নোটিশে গোটা দেশকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ভারতবাসী প্রথম শুনেছিল দেশজোড়া লকডাউনের কথা। মালিক বা সংস্থার কর্তৃপক্ষের দ্বারা কারখানা বা সংস্থা লকডাউনের সাথে দেশের শ্রমজীবী মানুষ অতিপরিচিত হলেও দেশের সরকারের দ্বারা গোটা দেশ লকডাউন হয় এটা ছিল নতুন এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। আজও সেই অভিজ্ঞতা এক দুঃস্বপ্ন হয়ে আছে শ্রমজীবী মানুষের মনে। ২০২০ সালের জানুয়ারী মাস থেকেই ভয়াবহ করোনা রোগের প্রকোপ শুরু হলেও ‘অচ্ছে দিনের কান্ডারী’ মোদী-শাহ তখন ব্যস্ত মধ্যপ্রদেশে কি করে বিজেপি রাজ কায়েম করা যায়, আমেরিকার তৎকালীন প্রসিডেন্ট ট্রাম্পের ভারত সফর কত নির্বিঘ্নে করিয়ে দেওয়া যায়। সময় থাকতেও শ্রমজীবী মানুষের কথা ভাবা হয়নি। ভাবা হয়নি এই পর্যায়ে তারা দুবেলা খাওয়ার সংস্থান করবেন কীভাবে? পরিযায়ী শ্রমিকরা তাঁদের রাজ্যে কীভাবে ফিরবেন? মুহূর্তের মধ্যে বেকারে পরিণত হন দেশের লক্ষ কোটি মানুষ। একদিকে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়, আক্রান্ত হলে সুচিকিৎসার অভাবে নিশ্চিত মৃত্যু, অন্যদিকে ভিনরাজ্য থেকে নিজের পরিবারের কাছে পৌঁছানোর আকুতি। সারা দেশ স্তম্ভিত হয়েছে লক্ষ লক্ষ শিশু বৃদ্ধ মহিলা পুরুষ তথা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষের পায়ে হেঁটে হাজার হাজার মাইল অতিক্রমের হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে। কত মানুষ মারা গেলেন, কত মানুষ তার পরিবারের কাছে শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেন, কতজন পারলেনই না — তার হিসাব আজও অজানাই রয়ে গেছে।
এই দুর্বিষহ অবস্থার বিরুদ্ধে দেশের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর লাগাতার চাপ সৃষ্টি এবং বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্টে এবং দেশের সুপ্রিম কোর্টে মামলা শুরু হয়। সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে যখন দেশের পরিযায়ী শ্রমিকসহ অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের সম্পর্কে সমস্ত তথ্য জানতে চাইল তখন ৭৫ বছরের স্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নির্লজ্জের মতো জানিয়ে দিল যে, তাদের কাছে কোনও তথ্যই নেই। যে দেশে শ্রমজীবী মানুষের ৯৩ শতাংশ মানুষ অসংগঠিত শ্রমিক, সে দেশের সরকারের কাছে তাঁদের কোনও তথ্যই নেই!
সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিল আগামী ৩১ ডিসেম্বরের ২০২১’র মধ্যে সমস্ত তথ্য জানাতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয় গত ২৬ আগষ্ট ২০২১ এই ই-শ্রম পোর্টাল চালু করেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে যে, এর মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের অসংগঠিত শ্রমিকদের সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ একটি তথ্যভান্ডার তৈরি করা হবে। ভবিষ্যতে অসংগঠিত শ্রমিকদের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা যোজনা প্রদান করতে এই তথ্যভান্ডার কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে সহায়তা করবে।
গত ২৯-৩০ অক্টোবর ২০২১, দিল্লীতে এআইসিসিটিইউ’র কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে ই-শ্রম পোর্টাল বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এআইসিসিটিইউ মনে করে যে, এই ই-শ্রম পোর্টালের মধ্য দিয়ে পরিযায়ী শ্রমিক এবং অসংগঠিত শ্রমিক সম্পর্কিত একটি তথ্য ভান্ডার তৈরী করা হচ্ছে, কিন্তু আসলে মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার আগামীদিনে দেশের বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণমূলক বোর্ডগুলিকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে ফেলবে — এটা হল তার প্রাথমিক পদক্ষেপ। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণ বোর্ডের কাছে বেশ কিছু অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের তথ্য থাকা সত্ত্বেও আবার এই পোর্টালে নথিভুক্ত করার যে কথা বলা হচ্ছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে যে বিগত দিনে ঐসব বোর্ডে যে শ্রমিকদের নাম নথিভুক্ত করা হয়েছিল তা এবং বোর্ডগুলিকে আগামীদিনে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হবে। এটা জানানো হয়েছে যে ভবিষ্যতে সমস্ত রকমের বেনিফিট (মহামারী, প্রাকৃতিক দূর্যোগসহ) এই পোর্টালের মাধ্যমেই দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কল্যাণ বোর্ডের কাছে দেশের শ্রমিকদের যে লক্ষ কোটি টাকা গচ্ছিত আছে সেই টাকার ভবিষ্যত কি হবে — এ প্রশ্নে একেবারেই নিশ্চুপ। বোঝাই যাচ্ছে এই কোটি কোটি টাকার তহবিল লুঠ চলবে। নির্বাচনের পূর্বে দেশের শাসকদলগুলি যে বেনিফিটের কথা ঘোষণা করে থাকে তা প্রদানের ক্ষেত্রে এই পোর্টাল ব্যবহার করা হবে কিনা সেটাও স্পষ্ট করে বলা হয়নি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বর্তমান বোর্ডগুলি যে বেনিফিট দিয়ে আসছে সেসব এই পোর্টালের মধ্য দিয়ে সংকুচিত করার আশংকা থাকছে। আমরা জানি বিভিন্ন কল্যাণমূলক বোর্ডের মধ্যে বিড়ি শ্রমিক কল্যাণ বোর্ডে বেশি বেনিফিট দেওয়া হত (বাড়ি তৈরির সুবিধাসহ) — তা মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের জমানায় গত চারবছর ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে। এই এসএসএস কোড সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে নতুন ধারণা হাজির করতে চলেছে যা মালিক বা সরকারকে শ্রমিকদের দায় থেকে মুক্ত করবে। যেমন স্বাস্থ্য বীমা (ইএসআই), অবসরকালীন বেনিফিট (পিএফ), গ্র্যাচুইটি, আবাসন, শিশুদের শিক্ষা, ইত্যাদির দায় শ্রমিকদের উপরেই বর্তাবে। এআইসিসিটিইউ মনে করে এই ই-শ্রম পোর্টালের সমালোচনা, বিরোধিতা আমরা চালিয়ে যাব, কিন্তু এসব সত্ত্বেও ই-শ্রম পোর্টালের বা অন্য কোনো কল্যাণমূলক বোর্ডের মাধ্যমে যে কমবেশি বেনিফিট শ্রমিকরা সরকারের কাছ থেকে পাবেন তাকে সুনিশ্চিত করা দরকার।
এই পোর্টাল আনুমানিক ৩৮ কোটি অসংগঠিত শ্রমিকদের নথিভুক্ত করবে এবং ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক রেখে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিকে প্রদান করার পরিকল্পনা করবে। শ্রম মন্ত্রক, ট্রেড ইউনিয়ন, রাজ্য সরকার ও কমন সার্ভিস সেন্টারগুলি (সিএসসি) দায়িত্ব সহকারে এই নতুন পোর্টালে শ্রমিকদের নথিভুক্ত করার দায়িত্ব নেবে।
(ক) ই-শ্রম কার্ড কি?
e-Shram’এ নথিভুক্ত করলে সরকার এই কার্ড দেবে। প্রতিটি e-Shram কার্ডে Unique Universal Account Number (UAN) থাকবে যার দ্বারা শ্রমিকরা যে কোনো জায়গায় যে কোনো সময় সামাজিক সুরক্ষার বিভিন্ন সুবিধাগুলি পাবেন। বারো সংখ্যার এই কার্ড দেশের সর্বত্রই মান্যতা দেওয়া হবে।
(খ) কোন শ্রমিকেরা কি সুবিধা পাবেন?
অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা একবার এই e-Shram’এ নথিভুক্ত হলে অন্য কোনো সামাজিক সুরক্ষা যোজনাতে আলাদাভাবে নথিভুক্ত হওয়ার প্রয়োজন হবে না।
e-Shram যোজনা দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রায় সমস্ত শ্রমিকদের আওতাভুক্ত করছে। যেমন নির্মাণ শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিক, গৃহ শ্রমিক, পথ হকার, ট্রাক ড্রাইভার, মৎসজীবী, কৃষি শ্রমিক, কুটির শিল্পের শ্রমিক, রিক্সা চালক, দুধ বিক্রেতা, গিগ শ্রমিক, প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক, অঙ্গনওয়াড়ী, আশাকর্মী, প্রকল্প কর্মী ইত্যাদি সব ধরনের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদেরকে আওতাভুক্ত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষা বীমা যোজনার অধীনে ৩৬৫ দিন সকল নথিভুক্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের দুর্ঘটনাজনিত বীমার আওতায় আনা হবে। দুর্ঘটনায় মারা গেলে এবং সারা জীবনের মত অক্ষম হলে ২ লক্ষ টাকা পাবেন। আংশিক অক্ষম হলে ১ লক্ষ টাকা পাবেন।
এই পোর্টাল শুধুমাত্র সামাজিক সুরক্ষাই প্রদান করবেনা, মহামারী, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে অসংগঠিত শ্রমিকদের সাহায্য প্রদান করতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে সহায়তা করবে।
এই পোর্টালের মাধ্যমে পরিযায়ী শ্রমিকদের রেকর্ড তৈরি করা হবে এবং তাদের কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে আরো সুযোগ সৃষ্টি করবে।
(গ) নথিভুক্তকরণে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ কি লাগবে?
এই পোর্টালে নাম নথিভুক্তকরণ বিনামূল্যে হবে। বয়স ১৬ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে হতে হবে।
• আধার কার্ড এবং আধার কার্ডের সাথে লিংক আছে এমন ফোন নাম্বার।
• নমিনির আধার কার্ড।
• ব্যাঙ্কের পাশবই।
• যদি ইনকাম সার্টিফিকেট থাকে দিতে পারেন।
• যদি শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট থাকে দিতে পারেন।
• তপশিলি জাতি, জনজাতি বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীভুক্ত হলে তার সার্টিফিকেট দিতে পারেন।
(ঘ) ই-শ্রম পোর্টালে নথিভুক্তিকরণের পদ্ধতি কি?
প্রথমত যাদের ফোনে (স্মার্ট ফোন) আধার কার্ড লিঙ্ক ফোন নাম্বার আছে তারা নিজেরাই নিজেদের নাম নথিভুক্ত করাতে পারবেন।
ই-শ্রম সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত যতটুকু জানা বোঝা গেল তাতে এখনই দুর্ঘটনা জনিত অনুদান ছাড়া অন্য কোনো সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি নেই। কিন্তু, যে সকল শ্রমিকরা এতকাল শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি পেতেন না এবার তাঁদের নাম এই পোর্টালে নথিভুক্তকরণের মাধ্যমে প্রাপ্ত ই-শ্রম কার্ড আইনগতভাবে শ্রমিক পরিচয়পত্র হিসেবে গণ্য হওয়ার একটা সুযোগ হয়ে গেল। আমরা জানি বেশিরভাগ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের কোনো পরিচয়পত্রই নেই। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বহুদিন ধরেই আমরা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের পরিচয়পত্র দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছি। আমাদের চারপাশে থাকা বিশাল সংখ্যার অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের পরিচয়পত্র হিসাবে এই কার্ডকে ব্যবহার করার সুযোগকে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হওয়া দরকার। আপাতত দুর্ঘটনা জনিত আর্থিক সহায়তা শ্রমিকদের পাইয়ে দেওয়ার সাথে সাথে এই যোজনা বা পোর্টালের সমস্যা, অসম্পূর্ণতা, ঘাটতি বা নেতিবাচক দিকগুলিকে শ্রমিকদের মধ্যে প্রচারে নিয়ে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবিসনদ আকারে তুলে ধরতে পারি।
- দিবাকর ভট্টাচার্য