প্রস্তাবিত কয়লা খনি প্রকল্পে বিপর্যয়ের আশঙ্কায় মানুষ
People fear disaster

গত ২৮ নভেম্বর সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের এক প্রতিনিধি দল বীরভূম জেলার প্রস্তাবিত কয়লা খনি প্রকল্প এলাকার সাধারণ মানুষের সাথে দেখা করে বিস্তারিত কথা বলেন। তার ভিত্তিতে প্রতিনিধিদলের মূল মূল পর্যবেক্ষণগুলি হল –

১। সমগ্র এলাকার কেউই কয়লা খনি মন থেকে চাইছেন না।

  • প্রকল্প এলাকার বাইরে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরের মহম্মদবাজারে মানুষেরা মূলত দুটি কারণে কয়লা খনিতে ভয় পাচ্ছেন। প্রথমত, বর্তমান পাথর শিল্পে উৎপাদন-পরিবহন-বিতরণের প্রক্রিয়ায় কর্মসংস্থানের যে সুযোগ ছিল কয়লা খনির ক্ষেত্রে তা আর থাকবে না, তাঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। অন্যদিকে, খোলামুখ খনির কয়লা-ধূলোতে বায়ুদূষণের শিকারও হবেন তাঁরা।

  • প্রকল্প এলাকার চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে ডেউচা গঞ্জে অনেকেই আছেন যাঁদের চাষজমি প্রস্তাবিত খনি এলাকার মধ্যে পড়ছে। এঁদের অধিকাংশেরই বাজারে ছোট ব্যবসা আছে, ছেলেমেয়েরা কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে, চাকরিও করছে তাদের কেউ কেউ। দূর দূরান্তে কনস্টেবলের চাকরি নিতে তাঁদের আপত্তি আছে। সরকারি প্যাকেজে জমির ঘোষিত দামে তাঁদের লাভই হবে। সরকারের বিরোধিতা করতে চান না। কিন্তু, জমি বেচে নিজেদের তাৎক্ষণিক আর্থিক লাভের আশাকে ছাপিয়ে খোলামুখ কয়লা খনির বৃহত্তর ক্ষতির দিকটা বারবার তাঁদের কথায় উঠে আসে। অত গভীর থেকে কয়লা তুলতে যে বিপুল পরিমাণ মাটি-পাথর ডাম্প করতে হবে তার জন্যও তো বহু জমি গ্রাস হয়ে যাবে। বায়ু দূষণ হবে। এলাকার বহু মানুষ কাজ হারাবে। কাছেই বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও অন্য কোলিয়ারি এলাকার উদাহরণ টেনে সকলেই আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, “স্থানীয়রা আর স্থানীয় থাকে না, মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ডন-মাফিয়া রাজ চলে।”

  • প্রকল্প এলাকার মধ্যে বসবাসকারী মানুষের বৃহৎ অংশ পাথর ভাঙা শ্রমিক। ঘন্টায় এক’শ টাকার বেশি উপার্জন করা যায়। কয়লা খনি হোক বা না হোক দিনমজুরিই তাঁদের ভবিষ্যৎ। কিন্তু সরকারি প্রকল্পে নিজের বর্তমান ভিটেমাটি ছেড়ে তাঁরা অনিশ্চিত আয়ের পরিযায়ি জীবনে নিক্ষিপ্ত হবেন বলে আশঙ্কা করছেন। স্থানীয় স্তরে বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে অর্জিত যেটুকু সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতা তাঁরা বর্তমানে ভোগ করেন তা আর থাকবে না।

  • প্রকল্প এলাকার লাগোয়া গ্রামগুলিতেও খনি প্রকল্পের প্রস্তাব দুঃস্বপ্নের মতো নেমে এসেছে। তাঁরা এক ভাঙাচোরা বিধ্বস্ত পরিবেশ ও দুর্বিসহ জীবনের ভবিতব্য দেখছেন। মাটির গভীরে জমাট পাথরের নীচ থেকে কয়লা তুলতে বিস্ফোরণ ভূকম্প ও ধুলোঝড়ে তাঁদের বাড়িঘর ও জীবনের কী অবস্থা হবে তা ভেবেই দিশেহারা এইসব এলাকার সাধারণ মানুষ।

  • চরম বিপন্ন ও বিষন্ন বোধ করছেন দেওয়ানগঞ্জের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। এই গ্রামের বাসিন্দাদের বড় অংশের জমিজমার কাগজ নেই। পুলিশ এর আগে তাঁদের বলপূর্বক আটকে দিয়েছিল ডেউচা সদরে এক প্রশাসনিক শুনানিতে যাওয়ার পথে।

২। সরকারি পুনর্বাসন প‍্যাকেজ এলাকার মানুষের বাস্তব পরিস্থিতিকে ছুঁতে পারেনি, কোনও অংশই খুশী নন, বড় অংশই বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন।

  • প্রকল্প এলাকার ভেতরে বসবাসকারি মানুষেরা ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়ার বিনিময়ে যা পাবেন তা কেউই মেনে নিতে পারছেন না। প্রথম সমস‍্যা মাথাপিছু হিসেবের বদলে পরিবার পিছু হিসেবে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্তে।

  • মহিলারা সরকারি আবাসনের ৬০০ স্কোয়ার ফিটের বাড়িতে উঠোনবিহীন জীবন ভেবেই উঠতে পারছেন না। মহিলাদের কথা ভাবাই হয়নি প্যাকেজে। ১৫টি স্বনির্ভর দলের নেত্রী এক আদিবাসী মহিলা জানান তাঁদের “মহিলা একতা” জমি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

  • পরিবারের পিতা ভেবে কিনারা পাচ্ছেন না কোন সন্তানকে কনস্টেবলের চাকরির জন্য মনোনীত করবেন। অন্যরা ছাড়বে কেন?

  • প্রকল্প এলাকার বাইরে থাকা অবস্থাপন্ন জমি মালিকেরা কনস্টেবল নয় সন্তানের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি চান।

  • সমগ্র এলাকার বহু মানুষের জমির কাগজপত্র নেই। কাগজে কলমে অন‍্যের জমিতে দখল কিনে বা খাস জমিতে ঘর বানিয়ে বেশ কয় দশক ধরে বসবাস করছেন এমন বহু মানুষ আছেন। সরকারি প‍্যাকেজে এঁদের “জবর দখলকারি” বলে উল্লেখ আছে এবং এরকম সংখ্যা বলা হয়েছে মাত্র ১৫। কিন্তু সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। এদের জন্য যৎসামান্য কিছু দেওয়ার কথা আছে প্যাকেজে। কিন্তু এঁরা হারাবেন অনেক কিছু।

  • এসব ছাড়াও সবচেয়ে জোরালোভাবে উঠে আসছে সাধারণ অবিশ্বাস। সরকারি যে কোনও প্রকল্পে মানুষের জন্য কাগজে কলমে যা ঘোষিত হয় বাস্তবে তার সামান্য অংশই প্রকৃত প্রাপকেরা পায়। সরকারি প্যাকেজে বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে কত সংখ্যক মানুষ আছেন তার সমীক্ষা কীভাবে হল তা নিয়ে সকলে ধন্দে আছেন।
 proposed coal mine project

৩। ‘জোর করে খনি করা হবে না’ – মুখে একথা বললেও গভীরে অন্যরকম কাজ শুরু হয়েছে –

  • হরিণসিঙ্গায় গত ২৫ নভেম্বর আদিবাসীদের মিটিং থেকে তীব্র বিক্ষোভ প্রকাশ হয়। এই বিক্ষোভের ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন খবরে প্রকাশিত হয়। এর দু’দিন পর আরেকটি ভিডিও ক্লিপ সামনে আসে যেখানে দেখা যায় আগের দিনের বিক্ষোভের একজন নেতা আদিবাসী গাঁওতার প্রাক্তন নেতা তথা বর্তমান টিএমসি নেতার উপস্থিতিতে এবং নিয়ন্ত্রণে সন্ত্রস্তভাবে ভুল স্বীকার করছেন। প্রতিনিধিদলের সাথে কথা বলার সময় আদিবাসী নেতাদের সকলেই ভয় পাচ্ছিলেন তাঁদের নাম ডিএম দপ্তরে চলে যাওয়ার।

  • আদিবাসী নেতারা পুনর্বাসন প্যাকেজ নিয়ে পূর্নাঙ্গ আলোচনা দাবি করেছেন এবং সহমত্যের ভিত্তিতে আগে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলে তবেই জমি ছাড়া হবে বলে জানাচ্ছেন। সেইসাথে বারবার তাঁরা বলেছেন যে এই অবস্থান এখনও পর্যন্ত তাঁদের ব্যক্তিগত, সাধারণ মানুষ, বিশেষত মহিলাদের কাছ থেকে যেন প্রতিনিধিদল মতামত নেয়। আর মহিলারাই প্রতিনিধিদলের সামনে সবচেয়ে তীব্র ভাষায় প্রকল্পের বিরোধিতা করেছেন।

  • হরিণসিঙ্গায় যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মহম্মদবাজার থানার পুলিশ প্রতিনিধিদলের সাথে দেখা করে সকলের নাম ঠিকানা নেয়। মানুষের সাথে কথা বলার অধিকার আমাদের আছে বলে জানান। কিন্তু, দেওয়ানগঞ্জের মানুষেরা সরাসরি আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। রাতবিরেতে অকারণে পাড়ায় পুলিশের গাড়ি টহল দিচ্ছে বলে জানান তাঁরা। এই গ্রামে প্রতিনিধিদল থাকাকালীনই তিনবার পুলিশগাড়িকে চক্কর দিতে দেখা যায়। গ্রামবাসীরা জানান যে এর আগে ডেউচা গঞ্জে জেলা প্রশাসনের ডাকা জনশুনানিতে যাওয়ার পথে তাঁদের গ্রামের মানুষদের পুলিশ বলপূর্বক আটকেছিল।

  • চলতি সপ্তাহেই খননের কাজ শুরু হয়ে যাবে বলে জেনেছেন গ্রামবাসীরা। জেলা শাসকের দপ্তর থেকে নাকি বলা হয়েছে যে দেওয়ানগঞ্জ লাগোয়া বনের “নিজেদের জমিতে” খোঁড়াখুড়ি শুরু হবে। কিন্তু সরকারের “নিজের জমি” খুঁড়তে শুরু করলে তার গা ঘেঁষে থাকা গ্রামবাসীদের জমি না দিয়ে আর কোনও উপায় থাকবে না বলে আক্ষেপ করছেন গ্রামের লোকেরা। অথচ সরকার তাঁদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখেছে।

সামগ্রিকভাবে প্রতিনিধিদলের মনে হয়েছে যে এখানকার মানুষ আশু ব্যক্তিস্বার্থ ছাড়াও সমষ্টিগত ভালোমন্দ, বিশেষত পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কমবেশি উদ্বিগ্ন। সরকার ও এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে আলাপ আলোচনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সংযোগের গভীর ঘাটতি রয়েছে। এলাকার মানুষ সংগঠিত হতে চাইছেন। গাঁওতার পুরনো নেতৃত্ব শাসকদলের অঙ্গীভূত হয়ে গ্রামবাসীদের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। বাইরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে নতুন প্রজন্ম উদ্গ্রীব হয়ে আছে, একই সাথে খুব সতর্কতার সাথেও এগোতে হচ্ছে তাঁদের।

আট জনের প্রতিনিধি দলে ছিলেন বীরভূম জেলার অশোক মণ্ডল ও প্রদ্যোৎ মুখার্জী, পশ্চিম বর্ধমান জেলার সুরিন্দর সিং ও কৃশানু ভট্টাচার্য এবং কলকাতা থেকে মধুরিমা বক্সী, লাবণী জঙ্গী, অনুপম রায় ও মলয় তেওয়ারি। একদিনের পরিদর্শনে এলাকার মাত্র কয়েকটি গ্রামের মানুষের সাথেই কথা বলা সম্ভব হয়েছে। এই এলাকার মানুষের কাছ এখন আরও বেশি বেশি করে যাওয়া দরকার। বিশেষত কলকাতা তথা রাজ্যের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগঠনের পক্ষ থেকে গিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের কথা শোনা ও পাশে দাঁড়ানো দরকার।

খণ্ড-28
সংখ্যা-42