সম্পাদকীয়
সংস্কার ও নৈরাজ্যের যুগলবন্দী
Reform and anarchy

রাজ্য সরকার তেইশটি দপ্তরে জনা পঞ্চাশ পরামর্শদাতা নিয়োগের পদক্ষেপ করতে চলেছে। পদমর্যাদায় এরা হবেন বিশেষ সচিব পর্যায়ের সমতুল, বেতন মর্যাদায় সিনিয়র পরামর্শদাতারা মাসিক দু'লক্ষ টাকা, আর বাকীরা মাসিক দেড় লক্ষ টাকায় নিযুক্ত হবেন। এই নিয়োগ হবে চুক্তিতে, বলাবাহুল্য আউট সোর্সিং হিসেবে। নেওয়া হবে অবসরপ্রাপ্তদেরও। নিয়োগ বিচারে কোনও সীমারেখা রাখা হবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত-স্বশাসিত সংস্থা-বিশ্ববিদ্যালয়-গবেষণা কেন্দ্র-বেসরকারি সংস্থা-কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান-এমনকি আন্তর্জাতিক মানের পরামর্শদাতা সংস্থা যেখান থেকে পছন্দ হবে বিশেষজ্ঞদের নিযুক্ত করা হবে। তবে এই বাছাইয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে ও পদক্ষেপে আদৌ স্বচ্ছতা থাকবে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

যে কোনও পরিকল্পনা প্রণয়ন ও রূপায়ণের কাজে বিশেষজ্ঞ পরামর্শদাতা প্রয়োজন হয়, সময়ে সময়ে তার পরিবর্তনেরও প্রয়োজন হয়। তবে নীতি থাকা উচিত ‘ন্যূনতম প্রশাসন — সর্বব্যাপী পরিচালনা’ — কম খরচের সহজ প্রশাসন। ওপরতলায় আয়তনে যত ছোট সম্ভব প্রশাসন পরিচালনা যন্ত্র থাকে ততই শ্রেয়। একে তো রাজ্যপাল, মন্ত্রী, বিধায়ক ও সচিব আমলাকুলের বহর বাড়ছে, তার মানে আর্থিক বরাদ্দ ক্রমেই বেড়েই চলেছে, এদের কোনও পক্ষই নিজেদের ব্যয় কমানোর প্রসঙ্গ ভুলেও উচ্চারণ করেন না। ওপরতলার এই ক্রমাগত ব্যয়বৃদ্ধির চাপ রাজকোষে অনেকটাই টান পড়ার একটা বিশেষ কারণ। তার ওপর যদি মন্ত্রীসভা, সচিবালয় ও আবার ‘পরামর্শদাতা’ নিয়োগের বহর বাড়ানো হয় তাহলে প্রশ্ন তো তুলতেই হয়। হঠাৎ কিসের প্রয়োজনে মাসিক কোটি টাকার মাসোহারার বিনিময়ে এই নিয়োগ হবে? যেখানে সাধারণ চাকরি হয় না, থুড়ি, চাকরি যেটুকু হয় শুধু পুলিশ আর সিভিক পুলিশে, প্রতিশ্রুতির চাকরি-ক্ষতিপূরণের চাকরি সবই কেবল পুলিশে! অন্যত্র চাকরির দেখা মেলে না। এই যেখানে দুঃসহ অবস্থা সেখানে এতো বিশেষজ্ঞ নেওয়ার দরকার পড়ল কোথা থেকে? যে তেইশটি দপ্তরে নিয়োগের কথা ভাবা হয়েছে সেইসব ক্ষেত্রে ব্যর্থতার মূল কারণ কি বিশেষজ্ঞ না থাকা, নাকি সদিচ্ছার অভাব-দৃষ্টিভঙ্গীর সমস্যা-গাফিলতি থাকা! সরকার যখন সবকিছু ধোঁযাশায় রেখে পদক্ষেপ করছে সেটা স্বেচ্ছাচারিতাই। রাজ্য সরকার কিছু কিছু জনকল্যাণ খাতে সংস্কার কর্মসূচি চালু করেছে। কিন্তু বিশাল কিছু নয়, স্থায়ী কিছু নয়। ছোট করে দেখারও নয়, বিশেষ বড় করে দেখানোরও নয়। দয়া দেখানোর বিষয়ও নয়, ধন্য করে দেওয়ারও নয়। শাসন ক্ষমতায় থাকতে হলে এসব একেবারেই ন্যূনতম দায়িত্ব পালনের মধ্যে পড়ে। মমতা সরকার এরকম কিছু কিছু খয়রাতি সুরাহা দিচ্ছে ঠিক কথা। অন্যদিকে যখন যেমন শিক্ষা-স্বাস্থ্য চাকরিতে নিয়োগের ডালি সরকার সামনে আনে, তখন অনবরত তা পক্ষপাতদুষ্টতা, স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয় এবং পরিণামে জড়িয়ে যায় আইন-আদালতের জটে। মমতা সরকার কিছু আশু জনমুখী বরাদ্দ সরবরাহ করা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও আর্থিক নৈরাজ্য চালিয়ে আসার অভিযোগ বরাবরের। সারদা-নারদের দুর্নীতির কলঙ্ক মুছে যায়নি। সেইসঙ্গে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ডিএ বছরের পর বছর ফেলে রাখা হয়, অথচ ক্লাব ও পুজো কমিটিগুলোকে টাকা যোগানো হয় ! চলে শিল্প টানার নামে তথাকথিত বঙ্গ বিশ্ব সম্মেলন, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার শ্রাদ্ধ, এসবের নামে নেপথ্যে অর্থ আত্মসাৎ হয়ে কোন তহবিলকে পুষ্ট করে তা নাগরিক জনগণ বোঝেন বিলক্ষণ। এইসব কারণে আবার একদল ‘পরামর্শদাতা’র প্রশাসনিক ও আর্থিক বোঝা মেনে নেওয়া যায় না।

খণ্ড-28
সংখ্যা-42