প্রতিবেদন
এমএসপি প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের কৃষক কোথায় দাঁড়িয়ে?
Where are the farmers

পশ্চিমবঙ্গ সরকার টিভি, রেডিও সহ সমস্ত সংবাদ মাধ্যমের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ১,৯৪০ টাকা কুইন্টাল দামে সরকার সরাসরি কৃষকদের ধান কিনছে। প্রচার দেখে মনে হবে কৃষকদের চাহিদা মতো সমস্ত কৃষকই ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারছেন। বাস্তবে পুর্ব বর্ধমান, বাঁকুড়া, নদীয়া সহ বিভিন্ন জেলায় খবর নিয়ে জানা যাচ্ছে কোথাও এখনও ধান কেনা শুরুই হয়নি। মোটামুটি ব্লক পিছু একটির বেশি ক্রয়কেন্দ্র নেই। এখন নাম রেজিষ্ট্রেশন চলছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথমে লাইন দিয়ে কুপন নিয়ে ২০ থেকে ৩০ দিন পর নির্দিষ্ট তারিখে জমির কাগজ পত্র, আধার কার্ড ও ব্যাংক একাউন্ট নং দেখিয়ে রেজিষ্ট্রেশন করতে হচ্ছে। ধান বিক্রির সময়ও প্রথমে লাইন দিয়ে রেজিষ্ট্রেশন কার্ড দেখিয়ে কুপন সংগ্রহ করে পরে নির্দিষ্ট তারিখেই ধান জমা দিতে হয়। কখনও কখনও ২-৩ মাস পর ধান জমা দেওয়ার তারিখ হতে পারে। দৈনিক ২০ জনের বেশি কৃষকের থেকে ধান সংগ্রহ হবেনা। তারপর আছে ধান পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার। টাকা ব্যাংক মারফত পেতে হবে। এত দীর্ঘ প্রক্রিয়া। দৈনিক ২০ জনের ধান কেনা হলে কতদিনে ব্লকের ধান কেনা সম্পূর্ণ হবে নিশ্চয়তা নেই! কৃষকদের অপেক্ষা করতে হবে। আবার জমির কাগজ না থাকলে সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে ধান নেওয়া হবে না। কাগজপত্রের অভাবে নিজের জমির ধানও কৃষক ক্রয়কেন্দ্রে বিক্রি করতে সুযোগ পান না। নদীয়ার একটি ক্রয় কেন্দ্রের আধিকারিক বলেন, যদি মালিক তার জমির কাগজপত্র সহ আপনি চাষ করেছেন অনুমতি লিখিত দেন তাহলে ধান নেওয়া যাবে, নচেৎ নয়। পূর্ব বর্ধমান, বাঁকুড়া, নদীয়া, হুগলি সহ বেশীরভাগ জেলাতেই নতুন ধান ওঠার পর থেকেই ১,২০০/১,৩০০ টাকা কুইন্টাল দামে গ্রামাঞ্চলের ফড়ে ব্যাপারীদের মাধ্যমেই গরিব প্রান্তিক কৃষকরা ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। উৎপাদন খরচ বিঘায় ১১,০০০/১২,০০০ টাকা। উৎপাদন হয় বিঘা পিছু ৬ থেকে ৮ কুইন্টাল। এলাকা ভিত্তিক উৎপাদন খরচ ও ফলন কিছু ফারাখ হতে পারে। মোটামুটি বিঘা পিছু ৪,০০০ টাকার কম-বেশি লোকসান হয়। একর পিছু ১২,০০০ টাকা লোকসান। বছরে দু’বার ধান চাষ করলে একর পিছু ২৪,০০০ টাকা লোকসান। কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার কৃষকদের যথাক্রমে দ্বিগুণ ও তিনগুণ উন্নতি হয়েছে প্রচার করছে। ‘কৃষক সম্মান যোজনা’ ও ‘কৃষক বন্ধু প্রকল্পে’র মাধ্যমে বছরে একরে ৬,০০০ টাকা ও ১০,০০০ টাকা অনুদান দিয়েই ত্রাণকর্তা সাজার চেষ্টা করছে। সরকারি ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কেনার ব্যবস্থা করলে কৃষক একরে ৩,০০০ টাকার মতো লাভ করতে পারেন। স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এই রাজ্যে ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য হওয়া উচিত কুইন্টাল প্রতি ২,৭০০ টাকা।

এই রাজ্যের ঠিকাচাষি মানে মরসুমী লীজচাষি, অনতিভুক্ত ভাগচাষি ও পাট্টাহীন গরিব কৃষক যারা ব্যাপক সংখ্যায় ও প্রত্যক্ষভাবে কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়ে থাকেন। তারা না পায় সরকারি সহায়ক মূল্যের সুযোগ, না পায় ফসল নষ্টের ক্ষতিপূরণ, না পায় কৃষক সম্মাননিধি বা কৃষকবন্ধু প্রকল্পের সুযোগ। তাই এই ধরনের ক্ষুদ্র কৃষকদের দাবি আজকে গুরুত্বপূর্ণ। সরকারগুলোর এই শ্রেণীর কৃষকদের প্রতি কোন মাথা ব্যথা নেই। এই বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ব্যাপক ফসল। শস্যবীমার প্রচার করলেও সরকার কোনো এলাকাকে ক্ষতিগ্রস্থ ঘোষণা না করলে বীমা কোম্পানিগুলো কোনো ক্ষতিপূরণ দেবে না। আলু, পেঁয়াজ ও অন্যান্য সব্জির সরকারি কোনো সহায়ক মূল্য নির্দিষ্ট করা হয় না। যদি কখনও এই সমস্ত ফসলের মুল্যবৃদ্ধি হয়, তখন সরকারি টাস্কফোর্স নামিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্ত কৃষকরা যখন ফসলের দাম না পেয়ে সব্জি গরুকে খাওয়াতে বাধ্য হন বা জমিতেই নষ্ট করতে বাধ্য হন এবং চাষের ঋণ শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ নিতে বাধ্য হন তখনও সরকারের কোনো মাথাব্যথা থাকেনা। বরং অস্বীকার করার চেষ্টা করে থাকে। ধান কেনার ক্ষেত্রে দীর্ঘসুত্রিতার জন্য গরিব ও প্রান্তিক চাষিরা ধরেই নিয়েছেন তাদের পক্ষে সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে গিয়ে ধান বিক্রি করা সম্ভব নয়। তাই অনেক ক্ষেত্রে এনিয়ে তাদের মাথা ব্যাথা থাকে না। দেখা যায় তাদের জমির কাগজ বা রেজিষ্ট্রেশন নিয়ে অন্য লোক মানে দালাল ব্যবসায়ীরা ধান বিক্রি করে। কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কার্যকরি হচ্ছে না। অথচ সারের দোকান ও সমবায়গুলো বুক ফুলিয়ে সারের বস্তায় থাকা দাম থেকে অনেক বেশি দামে সার বিক্রি করে যাচ্ছে।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করার জন্য আইন প্রণয়নের দাবি দেশজুড়ে বর্তমানে মুল দাবি হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করছে। অথচ নিজের রাজ্যে সহায়ক মূল্যের আইন প্রণয়ন করছেনা। তাই ধান কেনার ক্ষেত্রে দীর্ঘসুত্রিতার পরিবর্তে সরল পদ্ধতিতে গ্রাম পঞ্চায়েত ভিত্তিক একটি করে ধান ক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে পর্যাপ্ত ধান ক্রয় করতে হবে। ধান কেনার ক্ষেত্রে গরিব ও প্রান্তিক চাষিদের অগ্রাধিকার দিতে হবে, লীজ চাষি-অনতিভুক্ত ভাগচাষি ও পাট্টাহীন গরিব কৃষকদের থেকে ধান কেনার ব্যবস্থা করতে হবে। ধানের সহায়ক মূল্য ২,৭০০ টাকা কুইন্টাল করতে হবে। সমস্ত কৃষি ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্দিষ্ট করতে হবে, এর আইন প্রণয়ন করতে হবে।

এই সমস্ত দাবিতে আন্দোলন জোরদার করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।

- সজল পাল

খণ্ড-28
সংখ্যা-42