ঐতিহাসিক দ্বিজেন্দ্র নারায়ণের প্রয়াণ: আপোসহীন ইতিহাস লেখকের বিদায়
DN Jha

কিছু কিছু মৃত্যু পাহাড়ের মতো ভারী। ঐতিহাসিক দ্বিজেন্দ্র নারায়াণ ঝা’র চলে যাওয়া যেন আরেকবার তা প্রমাণ করে দিল। ফেব্রুয়ারী ২০২১’র প্রথম সপ্তাহে একাশি বছর বয়েসে ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন এই খ্যাতনামা ঐতিহাসিক। শুধু নামকরা ঐতিহাসিক বা ইতিহাসের অধ্যাপক নন, তিনি ছিলেন এমন ইতিহাসবিদদের অন্যতম, যাঁরা ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আপোস করেননি। গোয়েন্দার মতো সত্যের অনুসন্ধান করাই যে ঐতিহাসিকের কাজ, এবং একমাত্র তথ্য প্রমাণের সাহায্যেই যে ইতিহাস রচনা সম্ভব, তা তিনি কখনোই ভোলেননি। যদিও সবকিছুর মূল্যে ঐতিহাসিক সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য বারে বারে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁর লেখা বই তুলে নিতে বাধ্য করা হয়েছে প্রকাশককে, এমনকি মৃত্যুর হুমকিও দেওয়া হয়েছে বর্ষীয়ান এই ঐতিহাসিককে। কিন্তু কোনো প্রতিরোধই তাঁকে নিজের কাজ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বারবার লিখেছেন এমন ইতিহাস, যা পড়তে ভারতেরই এক নব্য শ্রেণির পাঠকের অস্বস্তি হয়েছে। কারণ তাঁর ইতিহাস সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনৈতিক এজেন্ডার বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।

অধ্যাপক দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা’র সাথে কলকাতারও একটা যোগাযোগ রয়েছে। কলকাতার তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইতিহাস নিয়ে স্নাতক পর্যায়ের পড়া শেষ করে তিনি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মার কাছে নিজের গবেষণা শেষ করেন। এরপর ঐতিহাসিক হিসাবে তাঁর জীবন প্রায় তিরিশ বছরেরও বেশি চলেছে, কিন্তু তাঁর লেখায় কখনো ইতিহাসের অপলাপ করেননি এই সাহসী ইতিহাসবিদ। শক্ত শিরদাঁড়া নিয়ে বারে বারেই লিখেছেন ইতিহাস, যা সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে তাঁকে অপ্রিয় করে তোলে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতীয় ইতিহাসে তাঁর পারদর্শিতা অতুলনীয়। তিনি অবশ্য মনে করতেন প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সাম্প্রতিক সময়ের নিরিখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর লেখা পড়লে বোঝা যায় এই মতামতের কারণ। ২০০১ সালে তাঁর লেখা বই “দ্য মিথ অফ দ্য হোলি কাউ” প্রকাশিত হয়েই শোরগোল ফেলে দেয়। এই বইতে ঝা তথ্যপ্রমাণসহ দেখিয়েছিলেন যে, গরু খাওয়ার চল মুসলমানদের হাত ধরে ভারতে শুরু হয়নি, বরং তা প্রাচীন যুগ থেকেই প্রচলিত ছিল। প্রাচীন যুগে গরু খাওয়া যে ট্যাবু ছিল না, তা নানা রকম উপাদান ঘেঁটে প্রমাণ করেন অধ্যাপক ঝা। স্বভাবতই ভারতের সমকালীন রাজনীতির ময়দানে এই বই শোরগোল ফেলে দেয়। গোমাংস নিয়ে মিথ্যা প্রচারের বেলুন ফুটো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় সাম্প্রদায়িক শক্তি পেশীশক্তির প্রদর্শন শুরু করে, ফলে প্রকাশক বইটি বাজার থেকে তুলে নিতে বাধ্য হন। কিন্তু অধ্যাপক ঝা’কে থামানো যায়নি। কয়েক বছর বাদে বইটি আবার অন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে ভারতে ও ভারতের বাইরে প্রকাশিত হয় এবং একই রকম সাড়া ফেলে। মুশকিল হল অধ্যাপক ঝা’র লেখাকে মিথ্যা বলে দাগিয়ে দেওয়া অন্তত ঐতিহাসিকভাবে সম্ভব নয়। তাই তাঁর বিরুদ্ধে বারবার পেশীশক্তির প্রয়োগ ছাড়া উপায় থাকে না।

অবশ্য শুধু গোমাংস খাওয়া নিয়ে ইতিহাস লেখা দিয়ে অধ্যাপক ঝা’র মতো শক্তিশালী ঐতিহাসিকের মূল্যায়ন করা একেবারেই সঠিক নয়। কিন্তু একথা বলাই যায় যে তিনি প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের “হোলি কাউ” বা পবিত্র বেশ কিছু ধারণা বদলে দিতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। যেমন গুপ্তযুগকে স্বর্ণযুগ হিসাবে চিহ্নিত করাকে প্রশ্নের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন এই প্রথিতযশা ঐতিহাসিক। ভারতমাতা বা অখন্ড ভারতের কল্পনা যে খুব বেশি হলে একশো বছরের পুরনো এবং প্রাচীন ভারতে ভারতমাতা বা বিশাল ভারতবর্ষের চিত্র পাওয়া যায় না, তা তিনি দেখিয়েছিলেন নিজের লেখায়। এছাড়াও ১৯৯১ সালে বাবরি মসজিদ নিয়ে বিতর্কের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি ও অন্য দুই ঐতিহাসিক এম আতহার আলি ও সুরজ ভান একটি লেখা লেখেন, যার শিরোনাম ছিল “বাবরি মস্ক অর রাম’স বার্থপ্লেস: হিস্টোরিয়ান্সেস রিপোর্ট টু দি ইন্ডিয়ান নেশন”। এই লেখাটিতে লিখিত ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ভিত্তিতে দেখানো হয়েছিল যে বাবরি মসজিদের নীচে কোনো হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব কখনোই পাওয়া যায়নি। স্বভাবতই, একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রোপাগান্ডার মূল ধরে নাড়া দিয়েছিল এই লেখা (২০১৯ সালে প্রকাশিত সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে অবশ্য, এই লেখা “ঐতিহাসিকদের মতামত মাত্র”!!!)। প্রকৃতপক্ষে ১৯৮৬ সালে যখন অধ্যাপক ঝা ছিলেন ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের সচিব পদে, তখন থেকেই এই রামজন্মভূমি বিতর্কমাথা চাড়া দিয়েছিল, এবং ঝা’র মতামতের জন্য তাঁকে অনেক রকম সমস্যার সম্মুখীনও হতে হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন এমন এক প্রজন্মের ঐতিহাসিক, যাঁদের কাছে তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাস রচনার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। তাই ‘হিন্দুবিরোধী’ বা ‘ব্রাহ্মণ বিরোধী’ তকমা দিয়েও তাঁকে পোষ মানানো যায়নি। এরপরেও তিনি লিখেছেন যে দক্ষিণপন্থী ঐতিহাসিকদের ঋকবেদ নিয়ে অবসেশনের আসল কারণ হল তাঁদের নিজেদের সাম্প্রদায়িক বা মুসলমান বিদ্বেষী মনোভাব। এত সরাসরি এরকম কঠিন সত্যি বলা বোধহয় একমাত্র অধ্যাপক ঝা’র পক্ষেই সম্ভব ছিল। মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে পর্যন্তও তিনি ইতিহাস চর্চা চালিয়ে গেছেন। কোনো বিরোধ, কোনো ভয় তাঁকে এক চুলও সরাতে পারেনি নিজের বিশ্বাস এবং কাজের প্রতি সততা থেকে। স্বাভাবিকভাবেই কিছু দক্ষিণপন্থী শক্তি বারবার তাঁর লেখার বিরোধিতা করেছে।

আজ যখন সাম্প্রদায়িক শক্তি তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নতুন এক কাল্পনিক ইতিহাস রচনা করে সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতিবিদ্বেষের বিষ ছড়াতে, সেই সময় অধ্যাপক ঝা’র মতো শক্ত মেরুদণ্ডের ঐতিহাসিকের চলে যাওয়া ইতিহাসের ছাত্র এবং সাধারণ পাঠকের পক্ষে অপূরণীয় ক্ষতি। তাই আরো বেশি করে এই সময় তাঁকে স্মরণ করা প্রয়োজন। তাঁর লেখা ইতিহাস পড়া এবং সেই ইতিহাসের ধারাকে অনুসরণ করে তথ্যপ্রমাণসহ ইতিহাস রচনার পদ্ধতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই বোধহয় তাঁকে সঠিক অর্থে স্মরণ করা।

- সায়ন্তনী অধিকারী (সাধনচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপিকা)  
nagorik.net এ লেখাটি পূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল   

খণ্ড-28
সংখ্যা-6