বিপন্ন স্বদেশ ও আক্রান্ত গণতন্ত্র রক্ষায় বামপন্থাকে উঠে আসতে হবে নতুন ভাবে, নবতর রূপে
the Left must rise in a new way, in a new form

১২তম রাজ্য সম্মেলনের বার্তা:

১৩ মে কবি সুকান্তের ৭৬তম মৃত্যু দিবস। তাঁর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে রক্তপতাকা উত্তোলন করলেন নকশালবাড়ি কৃষক অভ্যুত্থানের কিংবদন্তিদের অন্যতম সিরিল এক্কা। শুরু হয়ে গেল সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ১২তম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলন কল্পনা দত্ত-বটুকেশ্বর দত্ত নগরে (মহানগরী কলকাতাকে মহান এই দুই স্বাধীনতা সংগ্রামীর নামে চিহ্নিত করা হয়)। সম্মেলনস্থান মৌলালী যুবকেন্দ্র’কে উৎসর্গ করা হয় শহীদ আনিস খানের স্মৃতিতে। সম্মেলন পরিচালনায় গঠন করা হয় দশ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলী। সেইসঙ্গে পাঁচ সদস্যের সহায়ক সঞ্চালকমন্ডলী। তেভাগা আন্দোলনের ৭৫তম বর্ষে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে কৃষিমজুর, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, চা ও পাট শিল্প সমেত সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘু ও সমাজের অনগ্রসর অংশ থেকে উঠে আসা মহিলা ও পুরুষ প্রতিনিধি সহ উপস্থিত ছিলেন ছাত্র-যুব ও বুদ্ধিজীবীরা। এক কথায় আনিস খান সভাগৃহ হয়ে উঠেছিল সংগ্রামী বাংলারই যেন এক ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। নবীন ও প্রবীণ — উভয় প্রজন্মের অভিজ্ঞতার আদান প্রদান, সমালোচনা-আত্মসমালোচনার মাধ্যমে ৩ দিনের এই সম্মেলন প্রাণচঞ্চল ও বলিষ্ঠ প্রত্যয়ের এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সত্যি বলতে কী, ‘কোম্পানিরাজ’ কায়েম করার লক্ষ্যে আরএসএস-বিজেপি’র উন্মাদনা সৃষ্টি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতি ও অপশাসনে যখন মানুষ অতীষ্ঠ তখন জনগণের রুটি-রুজি-গণতন্ত্রের বুনিয়াদী দাবিগুলিকে প্রবলভাবে সামনে আনার জন্য যে শৃঙ্খলাবদ্ধ, বিপ্লবী বামপন্থী শক্তির জাগরণ প্রয়োজন তারই নবতর সূচনা ঘটিয়েছে এই সম্মেলন।

সভাগৃহের সুবিমল সেনগুপ্ত মঞ্চে প্রকাশ্য অধিবেশনের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের শিল্পীরা কবি সুকান্তের লেখা গান দিয়ে (বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত) আরম্ভ করে তেভাগার গান (হেই সামালো), নকশালবাড়ির অগ্নিবিষাণ (ও নকশাল, নকশাল, নকশালবাড়ির মা), সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিরুদ্ধে বজ্র নিনাদ (রাম রহিমের বাঁচার লড়াই) ও আন্তর্জাতিক সর্বহার ঐক্যের (পিট সিগারের ‘ভোরের আগে যেন ঘোর আঁধার’) গান শুনিয়েছেন। ২০২১ সালে প্রয়াত প্রখ্যাত নাট্যকার বাদল সরকারকে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করা হয়। এরপর প্রকাশ্য অধিবেশনে পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য যে বক্তব্য রাখেন তা ইতিমধ্যেই সমস্ত সংবাদ মাধ্যমে কমবেশি প্রকাশিত হয়েছে (তাঁর ভাষণ এই সংখ্যায় আলাদভাবে রয়েছে)। সেই বক্তব্যের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে অন্যতম কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সুচেতা দে বক্তব্য রাখেন। দিল্লীর জাহাঙ্গীরপুরি, শাহিনবাগ প্রভৃতি এলাকায় বুলডোজারের সামনে বামপন্থীদের প্রতিরোধ গড়ার উদাহরণ টেনে তিনি জেএনইউ-এ ঠিকা কর্মীদের আন্দোলনে তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথাও তুলে ধরেন। দিল্লী পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তাঁর প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সত্বেও সেখানে লড়াই জারি আছে এবং ঠিকা কর্মীরা ব্যারিকেড ভেঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে তাঁদের জোরদার অবস্থান বিক্ষোভ চালিয়ে গেছেন। সুচেতা দিল্লীতে ছাঁটাই স্বাস্থ্যকর্মী (সরকারি হাসপাতালগুলিতে কোভিডকালে নিযুক্ত এই কর্মীরা অক্লান্ত পরিষেবা দিয়েছেন) ও পুর নিগমের সাফাই কর্মীদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের কথা তুলে ধরেন।

rise in a new way, in a new form

সুচেতার বক্তব্যের পর বিদায়ী রাজ্য কমিটির সম্পাদক অভিজিত মজুমদার রাজনৈতিক-সাংগঠনিক খসড়া প্রতিবেদন (আসলে যা গত চার বছরের কাজের রিপোর্ট) পেশ করেন। প্রতিবেদনকে ঘিরে শুরু হয় বিতর্ক, আলোচনা ও সমালোচনা। উঠে আসে নানা পরামর্শ, বিভিন্ন প্রস্তাব। মোট ৮০ জন প্রতিনিধি এই আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন। প্রকৃত অর্থে ১৪-১৫ মে, দুই দিন প্রতিনিধিদের তীক্ষ্ম, টানটান বক্তব্যই ছিল সম্মেলনের আসল প্রাপ্তি। তাঁদের বক্তব্যে যেমন ছিল একদিকে বিদায়ী রাজ্য কমিটির দুর্বলতাগুলিকে চিহ্নিত করে কঠোর সমালোচনা, পার্টি শিক্ষা ও অনুশীলনে দুর্বলতাগুলিকে তীরবিদ্ধ করা, তেমনি ছিল আন্দোলনের ময়দান থেকে উঠে আসা অভিজ্ঞতার জীবন্ত ও বিচিত্র সংকলন। এরই ধারায় বিষ্ণুপুরের ছাত্র ও যুব কর্মীরা (এক তরুণী সমেত) ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি কীভাবে মেহনতী গরিব মানুষদের আন্দোলনে সামিল হয়েছেন তার ইতিবৃত্ত পেশ করেন। তাঁরা বলেন, ভগৎ সিং-আম্বেদকার-নেতাজীর মতো স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মনস্বীদের জন্মদিন পালনে বিভিন্ন ক্লাব সংগঠনকে সামিল করা, প্রতিরোধের সিনেমা প্রদর্শন, ফ্রি কোচিং ক্যাম্প চালানো — প্রথম প্রথম সবই হয়েছে পার্টির পতাকা ছাড়াই। আর এখন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র রক্ষায় বিভিন্ন কর্মসূচিতে পার্টির ঝান্ডা তুলে ধরা যাচ্ছে সহজে ও অত্যন্ত জোরের সাথে। উঠে আসে, এই মফঃস্বল শহরে এক পুরকর্মীর মুখ থেকে তাঁদের সংগঠিত হওয়া ও দাবি আদায়ের কঠিন লড়ায়ের কথা। একেবারে অন্য স্বাদের অভিজ্ঞতার কথা শোনা গেল হাওড়ার উলুবেড়িয়া অঞ্চলের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রক্ষণশীল পরিবার থেকে আসা এক মহিলা প্রতিনিধির মুখে। তিনি সগর্বে জানান, পর্দার অবগুণ্ঠন সরিয়ে, মধ্যবয়সে তিনি সকলের সঙ্গে প্রকাশ্যে একাসনে বসার অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই রূপান্তরের জন্য তিনি আমৃত্যু পার্টির কাছে ঋণী ও বিশ্বস্ত থাকবেন। একই ভাবে, মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের সংখ্যালঘু পরিবার থেকে উঠে আসা আর এক মহিলা প্রতিনিধি শোনালেন তাঁর গণ্ডী ভেঙ্গে এগিয়ে চলার কথা। কীভাবে পারিবারিক বাধা টপকে বিড়ি শ্রমিক মহিলাদের সংগঠিত করে প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন তার কাহিনী শোনান তিনি। পূর্ব বর্ধমানের এক প্রতিনিধি শিক্ষক রাজ্যে নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির প্রতিবাদে ‘যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চের’ পতাকাতলে চাকরিপ্রার্থী, উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের দীর্ঘ আন্দোলনের কাহিনী তুলে ধরেন। তিনি জানান, এই মঞ্চকে পরিচালনার ক্ষেত্রে পার্টি পরিচালিত যুব সংগঠন আরওয়াইএ’র বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। পার্টিকে এই আন্দোলনের সপক্ষে আরো দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর জন্য তিনি আবেদন জানান। প্রতিনিধিদের মুখ থেকে উঠে এসেছে এলাকাস্তরে তৃণমূলের সন্রাস ও দুর্নীতিকে রুখে দেওয়ার কথা। নদীয়ার এক মহিলা প্রতিনিধি কিভাবে তিনি ‘একশো দিনের কাজে’ ভুয়ো মাস্টাররোল প্রত্যাহারে তৃণমূলের মাতব্বরদের বাধ্য করেছেন এবং নতুন করে কাজ আদায়ের ক্ষেত্রে এলাকার জনগণকে সামিল করে আন্দোলন চালিয়েছেন তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। পূর্ব বর্ধমানের এক যুব কমরেড বলেন, ‘লক্ষীর ভান্ডার প্রকল্প’কে তাচ্ছিল্য না করে তাঁরা এই প্রকল্পে উপভোক্তাদের মাসে দু’হাজার টাকা ভাতা দেওয়ার জন্য প্রচার চালিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। জনগণের প্রতিটি সমস্যার সমাধানে তাঁদের পাশে থাকায় তাঁদের মজবুত গণভিত্তি গড়ে উঠেছে। তাঁদের বিক্ষোভ কর্মসূচীগুলি রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে গণক্ষোভ গঠনে বিশেষ ফল দেয়। কখনো কখনো সিপিআই(এমএল)-এর ঠ্যালা সামলাতে টিএমসি ব্লক জমায়েত ডাকতে বাধ্য হয়। উত্তরবঙ্গসহ বিভিন্ন জেলার একাধিক প্রতিনিধি মাইক্রোফিনান্স ঋণ থেকে, ঋণদাতা কোম্পানিগুলির জুলুম হতে বাঁচাতে ‘ঋণমুক্তি কমিটির’ ইতিবাচক ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, এই ঋণফাঁদ থেকে গ্রামের মহিলারা এখনও মুক্ত নন এবং ‘ঋণমুক্তি কমিটিকে’ আরও সক্রিয় হতে হবে। হুগলীর এক আদিবাসী প্রতিনিধি, আদিবাসীদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় তাঁদের উদ্যোগের কথা বলার পাশাপাশি আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ও আজও টিকে থাকা কিছু অন্ধবিশ্বাসকে দূর করার জন্য তাঁদের প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেন। কলকাতার এক তরুণ অধ্যাপিকা সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে গিগ শ্রমিকদের সংগঠিত করার সম্ভাবনাময় আশার বার্তা শোনান। অনেক প্রতিনিধির মুখে কাজের বাজারে অনিশ্চয়তা ও শ্রমিকদের উদ্বেগের কথা উঠে আসে। দার্জিলিং’এর দু’জন প্রতিনিধির মুখে উঠে আসে নির্মাণ শ্রমিকদের সমস্যার কথা। একই সাথে তাঁরা নদী থেকে পাথর তুলে গরিব মেহনতিরা এতদিন যে জীবিকা নির্বাহ করতেন তার সামনে ‘জেসিবি’ মালিক ও ঠিকাদারদের খাড়া করা বিপদের কথা তুলে ধরেন। দার্জিলিং জেলার আর এক প্রতিনিধি, বাস্তু ও কৃষিজমি প্রোমোটারদের হাতে চলৃ যাওয়া রুখতে ‘কাওয়াখালি-পোড়াঝার জমি রক্ষা কমিটি’র আন্দোলন ও তিস্তা প্রকল্পে অব্যবহৃত জমি কৃষকদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলনের বার্তা শোনান। বলা বাহুল্য, সম্মেলনে অধিকাংশ প্রতিনিধিই এসেছিলেন গ্রামাঞ্চল থেকে। স্বভাবতই সার্বিক কৃষি সঙ্কট ও তা মোকাবিলার কথা অনেক প্রতিনিধির বক্তব্যে উঠে আসে। কৃষি ক্রমশ অলাভজনক হয়ে ওঠায় অনুপস্থিত জমির মালিক ও ধনী চাষিরা এখন লীজ বা চুক্তি চাষের দিকে ঝুঁকছেন। ‘জমির কাগজ’ না থাকায় গরিব লিজ বা চুক্তি চাষিদের সমস্ত ধকল সহ্য করতে হচ্ছে। তাঁদের স্বার্থ রক্ষায় এক প্রতিনিধি বলেন, “লিজ চাষীদের পরিচয়পত্র দিতে হবে। বীজ, সার, কৃষিযন্ত্র ইত্যাদি সুলভে সরবরাহের জন্য ব্লকে ব্লকে একাধিক ন্যয্যমূল্যে কৃষি ভান্ডার খোলার দাবি তুলতে হবে।” খাদ্যশস্যের বদলে অন্যান্য নগদ অর্থকরী ফসল চাষের ফলে কৃষিক্ষেত্রে যে ভারসাম্যহীনতা দেখা যাচ্ছে তা নিয়ে সমীক্ষা চালানোর গুরুত্বও প্রতিনিধিদের মুখে উঠে আসে। তবে জমির লড়াই আজও যে প্রাসঙ্গিক, খাস জমি উদ্ধারের দাবিতে আজও যে লড়াই গড়ে তোলা যায় তা স্মরণ করিয়ে দেন পূর্ব বর্ধমানের এক প্রতিনিধি।

দু’দিন ধরে প্রতিনিধিদের বক্তব্য শোনার পর বিদায়ী রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার তাঁর ‘সম্ভাষণে’ সমস্ত গঠনমূলক প্রস্তাব-পরামর্শ গ্রহণ করে, প্রতিনিধিদের উত্থাপিত রাজ্য সংগঠনের কিছু দুর্বলতাকে স্বীকার করে খসড়া প্রতিবেদন অনুমোদন করার আবেদন জানান। সংযোজনী, সংশোধনীসহ খসড়া প্রতিবেদন সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

সবশেষে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক ধীরেন্দ্র ঝা’র তত্ত্বাবধানে আগামী রাজ্য কমিটি গঠনের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি পরিচালিত হয়। বিদায়ী রাজ্য কমিটি ৬১ জনের রাজ্য কমিটির যে প্রস্তাব রাখে সম্মেলন তা অনুমোদন করে। ৬১ জন রাজ্য সদস্যের তালিকা সম্মেলনে রাখা হয়। কোন বিকল্প নাম না আসায়, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নতুন রাজ্য কমিটি নির্বাচিত হয়। অভিজিৎ মজুমদার রাজ্য সম্পাদক পদে পুননির্বাচিত হন। এরপর সম্মেলনকে উদ্দেশ্য করে বক্তব্য রাখেন ধীরেন্দ্র ঝা। সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য আরও একবার সম্মেলনকে সম্বোধিত করেন। সম্বোধিত করেন বর্ষীয়ান পলিটব্যুরো সদস্য স্বদেশ ভট্টাচার্য। সবশেষে সম্মেলন থেকে মূল্যবৃদ্ধি রোধ, সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিকে রুখে দেওয়া ইত্যাদি কয়েকদফা প্রস্তাব গৃহীত হয়। তিনদিন ধরে মূলত যে ছাত্র-যুব স্বেচ্ছাসেবী সাথীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে সম্মেলন সফল সম্ভব হয়েছে তাদের মঞ্চে আহ্বান জানিয়ে গোটা সম্মেলন কক্ষ প্রবল করতালিতে সম্বর্ধনা জানায়। আগামী দিনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সংগ্রামী বাংলার মুখ ও লড়াইয়ের নিশান হয়ে উঠবে — এই প্রত্যয় ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে।

Resolution adopted by the State Conferenceresulation of wb state conference

১) আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি দেশবাসীকে গভীর সংকটে নিক্ষিপ্ত করেছে। রান্নার গ্যাসের দাম হাজার টাকা ছুঁয়েছে। গত আট বছরে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। সীমাহীন বেকারত্ব, ক্রমহ্রাসমান ক্রয় ক্ষমতা, গভীর খাদের মুখে দেশের অর্থনীতি — এর বিরুদ্ধে দেশের ৫টি বামপন্থী দল ২৫-৩১ মে মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই রাজ্যেও মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে কর্মসূচিকে সর্বাত্মকভাবে সফল করার প্রস্তাব এই সম্মেলন সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করছে।

২) ক) তৃণমূল সরকারের শাসনকালে জনগণের উপর নানান দিক থেকে হামলা নেমে এসেছে। দেউচা-পাঁচামীতে পরিবেশ বিরোধী, জনবিরোধী এই প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এই সরকার বদ্ধপরিকর। ইতিমধ্যে আরএসএস চলমান প্রতিবাদী আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করার যে অপচেষ্টা চালায়, তা স্থানীয় অধিবাসী প্রত্যাখ্যান করেছে। এই সম্মেলন এই প্রকল্পকে বাতিল করার প্রস্তাব গ্রহণ করছে।

খ) গোটা রাজ্যজুড়ে নারী নির্যাতন চরম সীমায় পৌঁছেছে। কিশোরী-নাবালিকাদের ধর্ষণ, পুড়িয়ে হত্যা, আর প্রায় প্রতিটি ঘটনার সাথে তৃণমূলের কোন না কোন স্তরে নেতা-পুলিশ প্রশাসনের যোগসাজশ আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। সম্মেলন এই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা করার পাশাপাশি প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিচ্ছে।

গ) প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের নেতা আনিস খান হত্যার বিরুদ্ধে রাজ্যের ছাত্র-যুব সমাজের এক প্রতিবাদী উত্থান আমরা লক্ষ্য করেছি। যত দিন যাচ্ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে, এই হত্যাকান্ডের নেপথ্যে তৃণমূল নেতা ও পুলিশ প্রশাসনের গভীর সংযোগ। এখন পর্যন্ত প্রকৃত দোষীদের গ্রেপ্তার করা হল না। এই সম্মেলন দাবি জানাচ্ছে, আনিস হত্যার সঙ্গে জড়িত হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

৪) এসএসসি’র কর্মপ্রত্যাশীদের ধারাবাহিক আন্দোলন এতোদিন পর রাজ্য সরকারের টনক কিছুটা নড়িয়েছে। তাঁদের দাবি পূরণের জন্য আবার কিছু বস্তাপচা আশ্বাস, কিছু ঘোষণা, ইত্যাদি এই আন্দোলনে জল ঢেলে দেওয়ার লক্ষ্যেই পরিচালিত। এই সম্মেলন দাবি জানাচ্ছে, এসএসসি কান্ডে উচ্চস্তরে যে বিরাট দুর্নীতি হয়েছে, তা উন্মোচিত হোক, সমস্ত শূন্যপদ পূরণ করতে হবে। তালিকা অনুযায়ী সকলকে নিয়োগ করতে হবে।

৫) বুলডোজারের যে দমনমূলক ফ্যাসিস্ট রাজনীতি বিজেপি সরকার এখন কার্যকর করছে, তার বিরুদ্ধে দিল্লীর বুকে আমাদের পার্টি ও বাম পার্টির নেতৃবৃন্দ যে হিম্মত দেখিয়েছেন তা সারা দেশের গণতান্ত্রিক মানুষের নজর কেড়েছে। আমাদের পার্টি এই বুলডোজার রাজনীতির বিরুদ্ধে মে মাস জুড়ে প্রতিবাদী বিক্ষোভ কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সম্মেলন এই কর্মসূচী কার্যকরি করার এবং এই বুলডোজার রাজনীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার প্রস্তাব গ্রহণ করছে।

dhrien jha and swadesh bhattachrya


কেন্দ্রীয় কমিটির পর্যবেক্ষক ধীরেন্দ্র ঝা

কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য ধীরেন্দ্র ঝা সম্মেলনের অন্তিম পর্বে বলেন, সম্মেলন জীবন্ত ও গণতান্ত্রিক হয়েছে। পার্টির সাধারণ সম্পাদক যেমন বলেছেন, আমিও সেরকমই বলতে চাই যে স্বাধীনতার ৭৫ বছরে অমৃতমন্থনের নামে বিষ উঠছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবীদের যে সাহস ছিল, সেই সাহস নিয়ে আমাদের লড়তে হবে। যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত যায়না বলে তাদের গর্ব ছিল, সেই গর্ব ছেড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের লড়াইয়ের কাছে পিছু হেঁটে তাদের শাসন ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। সেই রকম সাহস নিয়েই আজকে লড়তে হবে বিজেপি’র ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে।

পাঁচ-সাত বছর আগে যখন সিপিআই, সিপিএম’এর সঙ্গে যৌথ আন্দোলনে আমরা যেতাম, তখন সিপিএম আমাদের বিহারের দল বলে খানিক তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত। এখন পরিস্থিতি বদলেছে ও গোটা দেশে আমাদের পরিচিতি সম্মান বেড়েছে।

পাঞ্জাব ও বাংলা স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই প্রধান কেন্দ্র ছিল। পাঞ্জাবে বিরাট আন্দোলন আমরা দেখলাম, বাংলাতেও তা হোক।

বাংলায় আদিবাসীদের মধ্যে থেকে, মহিলাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজের সাড়া দেখা যাচ্ছে। এ আরো প্রসারিত হোক। গ্রামীণ সংঘর্ষকে বাড়িয়ে আমাদের ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা করতে হবে। জমির অধিকারসহ নানা অধিকারকে নিয়ে যে আন্দোলন হত, সেরকম নানা অধিকার আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করতে হবে।

১৯-২০ নভেম্বর ২০২২ আয়ারলার জাতীয় সম্মেলন বাংলায় হবে। জবকার্ড, স্টাইপেন্ড সহ নানা সুবিধা পাওয়ার জন্য এখানে ঘুষ দিতে হচ্ছে। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে শক্তিশালী করতে হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে, গ্রাম, মহল্লায় গিয়ে সদস্য সংগ্রহ ও সম্মেলনের প্রচার করতে হবে।

পলিটব্যুরো সদস্য স্বদেশ ভট্টাচার্য

সংক্ষিপ্ত ভাষণে বর্ষীয়ান পলিটব্যুরো সদস্য স্বদেশ ভট্টাচার্য সফল সম্মেলনের জন্য সকলকে বিপ্লবী অভিনন্দন জানিয়ে বলেন যে এই সম্মেলন গণ্ডী ভাঙার দিকে দিশা দিয়েছে বলে মনে হয়েছে।

ছাত্রদের বলব গণ্ডী ভাঙতে হলে বড় করে ভাবতে হবে। আইসা’র আগামী সম্মেলন হোক দশহাজার কেন, তারও অনেক বেশিজনকে সদস্য করে। বাংলায় লক্ষ লক্ষ ছাত্র রয়েছে। তাদের মধ্যে যত বেশি জনকে সম্ভব আইসা’র প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসুন।

এই রাজ্য সম্মেলন থেকে বেরিয়ে পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতির বড় কাজ ও পাশাপাশি অন্যান্য কাজে আমাদের নিয়োজিত হতে হবে। ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ করার ব্যবহারিক ও বৈচারিক দিকগুলিকে আরো দৃঢ়ভাবে আয়ত্ত করতে হবে। ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ করার শক্তিকে বাড়াতে হবে। প্রতিরোধের শক্তিকে বাড়াতে হলে গ্রামের মানুষকে সংগঠনবদ্ধ করার কাজে বিশেষ জোর দিতে হবে। আয়ারলার আসন্ন সম্মেলনকে সফল করতে হবে। এটা শুধু গ্রামীণ ও কৃষিমজুর সংগঠনের ওপর ছাড়লে হবেনা, গোটা পার্টিকে এই কাজে নামতে হবে। সমস্ত গ্রামীণ মেহনতি মানুষকে এখানে যুক্ত করার আহ্বান নিয়ে তাদের কাছে যেতে হবে। রাজ্য ও জেলাকমিটির নেতা ছাড়াও ব্রাঞ্চস্তর অবধি পার্টিকে নিয়ে যেতে হবে এই কাজে।

খণ্ড-29
সংখ্যা-19