খবরা-খবর
ভারতে এখন পুরোপুরি আর্থিক সংকট এসেছে : জয়তী ঘোষ

কয়েকদিন আগে কলকাতায় পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের কর্মচারী সংগঠনের (যা ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া, বেফাই-এর অন্তর্ভুক্ত) এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিষয় ছিল ভারতে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার সামনে চ্যালেঞ্জ এবং দেশের আর্থিক ব্যবস্থা। অন্যতম প্রধান বক্তা ছিলেন দিল্লির জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপিকা জয়তী ঘোষ। মৌলালী যুব কেন্দ্রে তিল ধরার জায়গা ছিল না। সমস্ত শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিঃশব্দে জয়তী ঘোষের বক্তৃতা উপভোগ করছিলেন। বক্তার মূলকথাগুলি উল্লেখ করা হচ্ছে।

দেশের আর্থিক অবস্থা  জয়তীর মতে সংকটের পর্যায়ে এসে গেছে। কিছুদিন আগেও হয়তো এটাকে অর্থনৈতিক নিম্নগামিতা বা মন্থরতা বলে চালানো যেত। কিন্তু এখন একটা সংকটের বা মন্দার পর্যায়ে এসে গেছে। মন্দার কারণ অবশ্য জয়তী ২০০২-০৩ সাল অর্থাৎ অটল বিহারী বাজপেয়ির সময় থেকেই বলে মনে করেন। কিভাবে? তার কারণ ওই সময় থেকেই দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার বাড়তে থাকে ভালো মাত্রায়। এই জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার মনমোহন সিংহের প্রথম পাঁচ বছর তো বটেই, দ্বিতীয় দফার কিছুদিন পর্যন্ত চলেছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ওই বৃদ্ধি হচ্ছিল শ্রমিকের এবং সাধারণ মানুষের মজুরি বৃদ্ধির হারকে অবদমন করে বা কম রেখে। তাঁর  ব্যাখ্যায় জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার সেই সময় ৮% বা ৯% হলেও মজুরি বৃদ্ধির হার ১% বা ২% করে  বাড়ছিল। এর ফলে দেশের সাধারণ মানুষের খরচ করার ক্ষমতা যতটা বাড়লে ভালো হতো ততো বেশি বাড়লোনা। একটা পর্যায়ে এসে অর্থাৎ ২০০৮-এ বিশ্বে ফিনান্সিয়াল সঙ্কট এসে গেলে ভারত তাতে  কিছুটা সাবধানী হওয়ার চেষ্টা করে। তখনও বৃদ্ধি ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু সেই একইভাবে মজুরিকে দমন করেই। এই ব্যবস্থাই চলতে থাকে বছরের পর বছর। এরপর এরই পরিণতি হলো ২০১৬ সালে।এই সময়ে ভারতে সাধারণ মানুষের মজুরি বৃদ্ধির হার এতো নেমে গেল (ঋণাত্মক) যা ভারতের ইতিহাসে আগে দেখা যায়নি। এর পরেই আরো বড় মাত্রায় আঘাত আসলো ভারতীয় অর্থনীতিতে।

জয়তী মনে করেন ডিমনিটাইজেশন বা নোট বন্দি সাধারণ মানুষকে একেবারে বিপর্যয়ের মুখে ফেলল। বহু মানুষ কাজ হারালো।বহু ছোট উদ্যোগ বন্ধ হলো। সাধারণ মানুষের একেবারে নাভিশ্বাস। অনেকে এটাকে মনে করেছিলেন সাময়িক ব্যাপার। কিন্তু জয়তীৱ মতে এর ফল ছিল সুদুরপ্রসারী। এটা কেবল অসংগঠিত ক্ষেত্রকেই বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। আবার এর পরেই এল জিএসটি-র কোপ। জিএসটি (গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স) বহু দেশেই চালু হয়েছে, তাতে ভালো-মন্দ দুরকমই হয়েছে। কিন্তু এই ট্যাক্স ব্যবস্থা জয়তীৱ মতে অত্যন্ত জটিল বিষয়। কানাডা, ফ্রান্স কিংবা মালয়েশিয়ায় দু’বছর ধরে অর্থাৎ অনেক সময় নিয়ে চালু হয়েছিল। ভারতে তড়িঘড়ি করে তিন মাসের মধ্যে চালু করা হল। কি বিপর্যয় হয়েছে সকলেই তা দেখেছেন। এখানেও অসংগঠিত ক্ষেত্রই বেশি মার খাচ্ছে।

জয়তীর বড় একটা উপলব্ধি হলো আগে যখন অসংগঠিত ক্ষেত্র মার খাচ্ছিল তখন দেশের সরকার বুঝতে পারেনি যে এটা এক সময়ে সংগঠিত ক্ষেত্রকেও গ্রাস করবে। তাই আজকের অটোমোবাইল শিল্প, লৌহ ইস্পাত শিল্প, রিয়াল এস্টেট, বস্ত্র বয়ন শিল্প, গয়না শিল্প অর্থাৎ রপ্তানি ক্ষেত্রও সঙ্কটের মুখে পড়ল। প্রথমটা থেকে দ্বিতীয়টা আসে। তাই আজকের দেশের অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণ জয়তীর মতে সাধারণ গ্রামীণ মানুষের এবং শহরের মানুষের আয় কমে যাওয়া এবং কেনার ক্ষমতা কমে যাওয়া।

এই প্রসঙ্গে  জয়তীর মত হল ব্যাঙ্ক শিল্পের সংকটও একইভাবে জড়িত। ব্যাঙ্ক সংকটের মূল কারণ তাঁর মতে সরকারের ভুল নীতি গ্রহণ। এখন সরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের একত্রীকরণ করে (মার্জার) সমস্যা বাড়বে তবু কমবে না। বড় ব্যাংক করার একমাত্র কারণ হল বড় কর্পোরেটকে ঋণের সুবিধা করে দেওয়া, ক্রনি ক্যাপিটালিজমকে বেশি সুবিধা করে দেওয়া। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে অসাম্য বাড়বে। বাড়বে ফিনান্সিয়াল নড়বড়েপনা, মানে অর্থব্যবস্থার দোদুল্যমানতা। জয়তী আরও বলেন ব্যাংকের একত্রীকরণের পরেই তাদের বেসরকারিকরণের দিকে সরকার তৎপর হবে। ফলে দেশের আর্থিক অবস্থা আরও দোদুল্যমান হবে। আসলে তাঁর মতে পৃথিবীর কোথাও এটা প্রমাণিত হয়নি যে ব্যাংকের আয়তন বাড়লে দেশের গঠনের জন্য ঋণদান অনেক সুবিধাজনক হয়।

সভার শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জয়তী বলেন এই সময়ে লক্ষ লক্ষ লোক কাজ হারাচ্ছেন, তাঁদের পরিবারকে বাঁচাবার জন্য অনেক অনেক বেশি করে গ্রামে ও শহরে কাজ সৃষ্টি করার জন্য খরচ বাড়াতে হবে। এই ক্ষেত্রে ধার্য অর্থের পরিমাণ অনেক বাড়াতে হবে।

খণ্ড-26
সংখ্যা-28