প্রতিবেদন
কাশ্মীর : অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের এক নয়া মডেলের পরীক্ষাগার
এই পদক্ষেপের নিগূঢ় ইঙ্গিত নিয়ে যাদের  সবচেয়ে বেশি ভাবা দরকার ছিল তারা একে সমর্থন করলেন — খুব দুঃখজনক।
ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদের এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তির প্রচণ্ড কোপ কাশ্মীরেই থেমে থাকবে না।

প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দু’জনেই অত্যন্ত জোরের সাথে বলেছেন ভারতীয় সংবিধানের বিশেষ সাময়িক সংস্থান হিসেবে জুড়ে থাকা জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার বিষয়টি একটা মারাত্মক অসংগতি, যেটা শেষ হওয়া খুবই দরকার ছিলো। যেহেতু কাশ্মীর ভারতের একটি অচ্ছেদ্য অংশ, দেশের অন্য অংশগুলিকে যেভাবে দেখা হয়, কাশ্মীরকেও সেভাবেই দেখা উচিত। তাদের যুক্তি, ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ করে কাশ্মীরকে অবশিষ্ট ভারতের সঙ্গে সমান করা হল। এই প্রক্রিয়ায় তারা একটি সাবেক ঔপনিবেশিক রণকৌশল প্রয়োগ করেছেন : বিষয়টিকে কেন ভিন্নতরভাবে দেখা উচিত তাকে যুক্তিগ্রাহ্য করতে তারা উপনিবেশের ক্ষেত্রে এক প্রচলিত পদক্ষেপের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে।

দেশীয় রাজন্যশাসিত রাজ্যগুলিকে নিয়ে সমস্যা

ভারতীয় সংবিধান সংবিধানে কেন ৩৭০ এবং ৩৭১ অনুচ্ছেদগুলি যুক্ত হল তার বিশেষ কিছু নির্দিষ্ট কারণ আছে। এই অনুচ্ছেদগুলির সাময়িক বিশেষ সংস্থানগুলি শুধু যে জম্মু এবং কাশ্মীরের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়েছে তা নয়। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে মাউন্টব্যাটেন যখন তার দেশভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, বেশ কয়েকটি বড় বড় দেশীয় রাজন্যশাসিত রাজ্য যেমন ত্রিবাঙ্কুর, হায়দ্রাবাদ, ভূপাল — ভারত বা পাকিস্তান কারও সঙ্গে যুক্ত না হয়ে, স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চিন্তা করেছিল। মাউন্টব্যাটেন এই সম্ভাবনাকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃপর অন্তর্ভুক্তির শর্ত নিয়ে এই রাজ্যগুলির প্রত্যেকটির সঙ্গে ঝড়ের গতিতে আলোচনা চললো। রাজন্যদের ভয় ছিল যে তারা তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা হারাবেন। তার প্রশমনের জন্য ঘোষণা করা হল, অন্তর্ভূক্তি বলতে বোঝাচ্ছে — ভারত অথবা পাকিস্তান, এই ডোমিনিয়ন সরকারের আইন রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হবে কেবলমাত্র তিনটি ব্যাপারে : প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি এবং যোগাযোগ। অন্য সব বিষয়ে, রাজ্যগুলির, যে ডোমিনিয়ন-এর সঙ্গে যুক্ত হবে তার সাথে ইচ্ছামতো চুক্তি করার স্বাধীনতা থাকবে।

এগুলি ছিল, ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে ইচ্ছুক রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে সংযোজনের প্রথম পর্যায়ের শর্ত। এদের মধ্যে ৫০০-র বেশি রাজ্য — যদিও সেগুলির বেশির ভাগই স্টেটস ইউনিয়ন (states union) হিসেবে সংযুক্ত ছিল যেমন সৌরাষ্ট্র, মধ্য ভারত, ত্রিবাঙ্কুর, কোচিন, রাজস্থান, পাতিয়ালা ও পূর্ব পাঞ্জাব এবং বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্রতর রাজ্য পার্শ্ববর্তী প্রদেশগুলির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। রাজন্যরা ছিলেন সাংবিধানিক প্রধান যাদের বলা হত রাজপ্রমুখ। রাজ্য সরকারগুলির প্রধানমন্ত্রীর অধীনে দায়িত্বশীল বিভিন্ন মন্ত্রক ছিল।

প্রত্যেকটি রাজ্য বা রাজ্য ইউনিয়ন,ভারতীয় সংবিধানের (নয়া দিল্লিতে যার খসড়া তৈরি হচ্ছিল) কতটা গ্রহণ করবে সেটা স্থির করার জন্য নিজস্ব প্রতিনিধিত্বমূলক সাংবিধানিক সভা গঠনের তোড়জোড় শুরু হল। ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের এটা প্রয়োজন ছিল দুটি কারণে — রাজন্যদের দ্বারা সংযুক্তি প্রক্রিয়ায় জনসাধারণের সম্মতির বিষয়টি চালু করা এবং রাজন্যদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে জনসাধারণের আকাঙ্খাকে ব্যবহার করা।

মাউন্টব্যাটেন এবং বল্লভভাই প্যাটেলের যুগপৎ আশ্বাস ও হুমকি এবং রাজ্যসমূহের মন্ত্রকে প্যাটেলের ডান হাত ভি পি মেননের অক্লান্ত কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে প্রায় সমস্ত রাজন্যবর্গ উদার রাজন্যভাতার বিনিময়ে সংযুক্ত হতে শেষপর্যন্ত রাজী হয়ে গেলেন। একটা সমস্যা হল কাথিয়াবাড়ের ছোট্ট রাজ্য জুনাগড়কে নিয়ে। সেখানকার নবাব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইলেন যদিও তার বেশির ভাগ প্রজাই ছিল হিন্দু। স্থানীয় কংগ্রেসীদের নেতৃত্বে এক গণবিদ্রোহ ও এক অস্থায়ী বিদ্রোহী সরকার গঠনের পর, এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক অবরোধের ফলে নবাব পাকিস্তানে পালিয়ে গেলেন। রেখে গেলেন দেওয়ান শাহ নওয়াজ ভুট্টোকে (জুলফিকার আলি ভুট্টোর বাবা) ভারতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে কথাবার্তা চালানোর জন্য। জুনাগড়ে এক গণভোট হল যাতে ৯০% মানুষ ভারতে যোগ দেওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিল।

হায়দ্রাবাদের নিজাম বিষয়টা এক বছরের ওপর ঝুলিয়ে রাখলেন। তিনি  ভেবেছিলেন, ভারত, পাকিস্তান — উভয়কেই এড়াতে পারবেন এবং স্বাধীন থাকবেন। গণভোটের জন্য ভারতীয় জোরাজুরিতে তিনি সম্মত হননি। কারণ তার ৮৫% প্রজাই ছিল হিন্দু আর তাই ভোটের ফলাফলটা ছিল পূর্বনির্ধারিত। ভারত সরকার  একটি ভারতীয় সমুদ্র বন্দর থেকে একটি রেলপথ নিজামকে দিতে ইচ্ছুক ছিল। তার সঙ্গে রাজ্যের সাংবিধানিক সভায় মুসলিমদের ৪৫% সংরক্ষণের এবং নিজস্ব সেনাবাহিনী রাখার অধিকারের প্রতিশ্রুতিও ছিল। জম্মু ও কাশ্মীরকে যা দেওয়া হয়েছিল তার থেকে অনেক বেশি। কিন্তু নিজাম ওসমান আলী এই সময়ে রাজাকারদের সশস্ত্র মিলিশিয়ার প্রধান, মানুষ-খেপানো এক উগ্র ধর্মান্ধ নেতা কাসেম রাজভীর হাতে কার্যত বন্দি ছিলেন। এই কাসেম চেয়েছিলেন হায়দ্রাবাদের পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তি।

সুস্থ, সুপরামর্শগুলোর প্রত্যেকটিকে দূরে ঠেলে, নিজাম ভারতীয় প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করলেন। শেষে, ১৯৪৮-এর সেপ্টেম্বরে, জিন্নার মৃত্যুর দু’দিন পর, ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সাঁজোয়া বাহিনী বিমানবাহিনীর বোমারু বিমানের সহায়তায় হায়দ্রাবাদে ঢুকে পড়ল। ঝটিতি নবাবের সেনার আত্মসমর্পণ করা ছাড়া অন্য কোনো পথ ছিল না। ভারতের সঙ্গে তাঁর সংযুক্তিও ঘটে গেল অনিবার্যভাবেই। দুটো বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ সামান্যই হয়েছিল, মানে হতে পেরেছিল। কিন্তু ভারতীয় বাহিনী ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়ে গেল ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক হিংসা। শুরুটা হয়েছিল রাজাকারদের প্ররোচনায়, কিন্তু পরে হিন্দুদের প্রতিহিংসাও ভীষণ আকার নিল। ভারতের সঙ্গে হায়দ্রাবাদের সংযুক্তির পিছনে কোনো রাজনৈতিক চুক্তি ছিল না, ছিল শুধুমাত্র সামরিক দখলদারি। তাই সেখানে কোনো গণভোটও হয়নি, সাংবিধানিক সভাও গঠিত হয়নি। রাজ্যটির ভার রইলো এক সামরিক গভর্নরের (প্রশাসকের) হাতে।

জম্মু ও কাশ্মীরের ভারতের সঙ্গে সংযুক্তিতে মহারাজা হরি সিং ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে স্বাক্ষর করেন। কাশ্মীরে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সামরিক অভিযানের ফলে ১৯৪৯-এর জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি ঘটে রাষ্ট্রসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে। ইতিমধ্যে এক রাজনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে মহারাজা হরি সিং ন্যাশনাল কনফারেন্স-এর শেখ আবদুল্লাকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ করলেন। তিনি একটি সাংবিধানিক সভা আহ্বানে সম্মত হন। এ ছাড়াও এই সংযুক্তিকে “জনগণের আকাঙ্খা অনুযায়ী’’ স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য দু’তরফই আশ্বাস দেয়। পরে এটিকে সিলমোহর দেয় রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ। সংযুক্তির এইসব সাংবিধানিক শর্তের কোনওটিই জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য এক এবং একমাত্র নয়।

৩৭০ এবং ৩৭১ অনুচ্ছেদ

১৯৪৯-এর মাঝামাঝি, যখন নয়াদিল্লিতে সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়াটি শেষের পথে, কেবলমাত্র সৌরাষ্ট্র, ত্রিবাঙ্কুর-কোচিন, মহীশূর এবং জম্মু ও কাশ্মীর তাদের সাংবিধানিক সভাগুলি গঠন করে উঠতে পেরেছিল।

ভারত সরকারের অনুরোধে, সংবিধান বিশেষজ্ঞ বি এন রাউ, সেইসব রাজ্যের জন্য মডেল সংবিধানের খসড়া তৈরি করেছিলেন, যেগুলো তখনও ততটা অনুমোদন পায়নি। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় সেইসব রাজ্য, যেগুলো পার্ট-বি রাজ্য হিসাবে আখ্যায়িত, সেগুলি সংক্রান্ত সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয়গুলি ভারতীয় সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হবে।

এই সময়ে সৌরাষ্ট্র সাংবিধানিক সভা ভারতীয় সংবিধান সম্পূর্ণ ভাবে গ্রহণ করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয় এবং সাংবিধানিক সভা ভেঙে দেওয়া হয়। ১৯৫০-এর জানুয়ারিতে যখন ভারতীয় সংবিধান ঘোষিত হয় তখন কেবলমাত্র তিনটি রাজ্যের সাংবিধানিক সভা তখনও ছিল যেগুলো তাদের কাজ শেষ করতে পারেনি। সেই জন্য, ৩৭০ অনুচ্ছেদটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল কেন্দ্র সরকার এবং জম্মু ও কাশ্মীরের মধ্যকার সম্পর্ককে তুলে ধরার জন্য যতক্ষণ না পর্যন্ত পরবর্তীটির সাংবিধানিক সভায় নিজস্ব সংবিধান তৈরি হয়।

৩৭১ অনুচ্ছেদটিও দশ বছরের মেয়াদে এইরকম একটি সাময়িক সংস্থান। এর দ্বারা ইউনিয়ন সরকার রাষ্ট্রপতির আদেশবলে তার আইনগুলির কোনোগুলি পার্ট-বি রাজ্যগুলির জন্য প্রযুক্ত হতে পারে বা পারে না, তা ঘোষণা করতে পারে। এর তৈরি হওয়ার তাৎক্ষণিক কারণ, মহীশূর ও ত্রিবাঙ্কুর-কোচিন-এর জন্য স্থান সংকুলান করা যাদের সাংবিধানিক সভা তখনও ভারতীয় সংবিধানকে গ্রহণ করেনি।

১৯৫২ সালের সাধারণ নির্বাচনে, মহীশূর, ত্রিবাঙ্কুর-কোচিন যারা নিজেদের সাংবিধানিক সভা ভেঙে দিয়ে ভারতীয় সংবিধান গ্রহণের পথে এগোচ্ছিল, সেই রাজ্যগুলিসহ পার্ট-বি ভুক্ত সমস্ত রাজ্যে কংগ্রেসী মন্ত্রীসভা ক্ষমতায় এল। সুতরাং, ১৯৫২ থেকে, ভি পি মেননের কথায় ৩৭১ অনুচ্ছেদ ‘‘ডেডলেটার” (অকার্যকর) হয়ে গেল। কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীরে ছিল ন্যাশনাল কনফারেন্স সরকার। শীঘ্রই শেখ আবদুল্লাহ নয়াদিল্লির নেতৃত্বের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে ক্ষমতা থেকে অপসারিত ও গ্রেফতার হলেন। বক্সী গুলাম মহম্মদ, আবদুল্লাহর মন্ত্রীসভার সহকর্মী, প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং কংগ্রেস-এ যোগ দিলেন। ১৯৫৬-তে জম্মু ও কাশ্মীরের সাংবিধানিক সভা রাজ্যের জন্য একটি সংবিধান তৈরি করল এবং নিজেকে ভেঙে দিল। কিন্তু একগুচ্ছ আইনি অভিমত আছে যাদের বিশ্বাস এই ঘটনার পর ৩৭০ অনুচ্ছেদ ভারতীয় সংবিধানের এক স্থায়ী বিষয় হয়ে গেল যা কোনো কর্তৃপক্ষই পরিবর্তন করতে পারে না। অন্যরা বিশ্বাস করেন যে সাংবিধানিক সভার অনুপস্থিতিতে, জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচিত আইন পরিষদকে, এই ধরনের যে কোনো পরিবর্তনকে অনুমোদন করতে হত। যে কোনো ঘটনায়, ৩৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কাশ্মীর এবং অবশিষ্ট ভারতের মধ্যে সম্পর্কের পরিবর্তন বিষয়ে কাশ্মীরী জনগণের সম্মতির উপাদানটি থাকতেই হবে। এটা কাশ্মীরে প্রতিশ্রুত গণভোট কখনোই অনুষ্ঠিত না হওয়ার প্রেক্ষিতে, আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

একই সময়ে, ৩৭১ অনুচ্ছেদের আয়ু বেড়েছে কারণ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশে পর্যায়ক্রমিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিণতিতে চুক্তির মাধ্যমে এই বিশেষ সাংবিধানিক সংস্থান তৈরি হয়েছে যার মধ্যে বিধৃত রয়েছে নির্দিষ্ট রাজ্যগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রের সম্পর্কের সংজ্ঞা। এর ভিত্তিতে মহারাষ্ট্র এবং গুজরাটকে বিদর্ভ, মারাঠাওয়াড়া এবং কুচে উন্নয়ন বোর্ড গঠনের বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হল। তেমনই নাগাল্যান্ডের ক্ষেত্রে, রাজ্য বিধানসভার সঙ্গে চুক্তি ব্যতিরেকে ইউনিয়ন আইনগুলি সেখানে নাগা জনগণের ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশীলন, প্রথাগত রীতি নীতি সংক্রান্ত  আইন এবং জমির মালিকানা বিষয়ে প্রযুক্ত হতে পারবে না। মিজোরামের জন্যও একই বিশেষ সংস্থান চালু রয়েছে। আসাম, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম ও গোয়ার জন্যও রয়েছে বিশেষ সংস্থান — যেগুলো অন্যান্য রাজ্যের জন্য প্রযোজ্য নয়।

কারও কারও মনে থাকতে পারে, ১৯৭৫ সালে জরুরী অবস্থার সময় যখন ভারতীয় সেনার দ্বারা সিকিম সংযুক্ত হয়, এটি ভারতের সঙ্গে প্রথম যুক্ত হয় একটি “অ্যাসোসিয়েট রাজ্য” হিসাবে। এটা একটা একেবারে স্বতন্ত্র শ্রেণি। এরপর সিকিমের জনগণ এক গণভোটের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান এবং ভারতের সঙ্গে সংযুক্তির বিষয়টি অনুমোদন করলে, এটি স্বাভাবিক হয়। এটা প্রমাণ করে যে, আইনি একরূপতার আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও, দেশের বিভিন্ন অংশের মানুষ যে বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়, তা একটি নমনীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো দাবি করে। এটি না থাকলে, রাষ্ট্রের আধিপত্যকারী শক্তি মানুষের ইচ্ছুক সম্মতিকে দমিয়ে দিতে পারে।

kashmir jammu

কাশ্মীর — ভারতের এক উপনিবেশ

জম্মু ও কাশ্মীর ছাড়া আর কোথাও এটা এমন মোক্ষম এবং মর্মান্তিকভাবে প্রমাণিত হয়নি। বছরের পর বছর ধরে পুতুল সরকারের শাসন, রিগিং-এর ভোট, গণঅভ্যুত্থান, সামরিক নিপীড়ন এবং সন্ত্রাসবাদী হিংসার আমলে, ৩৭০ অনুচ্ছেদের দেওয়া স্বায়ত্তশাসন কেন্দ্র থেকে রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে এবং একই সঙ্গে রাজ্য বিধানসভার অনুমোদনে, ক্রমান্বয়ে লঘুকৃত হয়েছে। কংগ্রেস দল, বিগত শেষ পাঁচ দশকে যে দলটি সবচেয়ে বেশি সময় ধরে দিল্লিকে শাসন করেছে, প্রাথমিক ভাবে তারাই এর জন্য দায়ী। সত্যি, যখন থেকে কাশ্মীর বিতর্ক একটি আন্তর্জাতিক বিষয় এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মূল বিবাদের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন থেকে বৈদেশিক নীতি এবং নিরাপত্তার ব্যাপারটা শাসকদের চিন্তার উপর আধিপত্য করে যাচ্ছে। কাশ্মীরের জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্খা সেখানে তুচ্ছ হয়ে গেছে।

নয়াদিল্লির নীতি নির্ধারকদের বহুধাব্যাপ্ত এই দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের বাকি অংশের জনসাধারণের সাধারণ বোধে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকে মিশে গেছে। তারা এমনটাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে কাশ্মীর ভারতের একটা সম্পত্তি — মূল্যবান একটি স্থাবর সম্পত্তি পাকিস্তান যেটা দখল করতে চায় — এবং কাশ্মীরীরা একটা বিরক্তিকর উপদ্রব বিশেষ যাদের সবক শেখাতে হবে। অবশ্যই গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারের জন্য প্রয়োজন ছিল, স্থানীয় রাজনীতিকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা আর কাশ্মীরীয়াত-এর প্রতি সমর্থনের বিষয়টি মাঝে মাঝেই মানুষের কাছে ইঙ্গিতবাহী করে তুলে ধরা।

কিন্তু এই ধারণাটা, যে কাশ্মীরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য মাঝে মাঝেই জরুরী অবস্থা জারি করতে হবে এবং উপত্যকাকে পাকাপাকিভাবে সামরিক দখলে রাখতে হবে — মানুষের মধ্যে অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি বিষয় হিসেবে একবারে গেঁড়ে বসেছে। দিল্লির বর্তমান শাসকরা জাতীয়তাবাদী আত্মঘোষণার এক নয়া পুনরুত্থানে অহংস্ফীত হয়ে আবরণটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।

পুরোনো দিনে, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন অথবা ফ্রান্সের উদারপন্থী সরকারগুলি নিজের দেশে গণতন্ত্র আর উপনিবেশে স্বৈরতন্ত্র — এই দ্বৈত নীতিকে সাফাই দিত এই যুক্তিতে, যে যদিও গণতন্ত্র ‘সরকারের’ সর্বজন স্বীকৃত শ্রেষ্ঠ রূপ, উপনিবেশের লোকগুলো তার (গণতন্ত্রের) জন্য তখনও তৈরি নয়। তাদের স্বাধীনতার অধিকারগুলি দেওয়ার আগে আলোকপ্রাপ্ত স্বৈর শাসনের মাধ্যমে শিক্ষিত করে তোলা উচিত। বিজেপি নেতারাও এখন কাশ্মীরে অতিরিক্ত কঠোরতা চাপিয়ে দেওয়ার সাফাই দিতে এই কথাগুলোই বলছে। তারা স্বীকার করছে পরিস্থিতি খুব কঠিন কিন্তু এ সবকিছুই নাকি কাশ্মীরীদের আখেরে ভালোর জন্যেই।

এই শূন্যগর্ভ বাকচাতুর্য দেখিয়ে দিচ্ছে ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদের অর্থটা পাল্টে যাচ্ছে। পঞ্চাশ বছর আগে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ছিল মূলত উপনিবেশ বিরোধী। এই জাতীয়তাবাদ নিজেকে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এগুলোর কায়েম করা ঔপনিবেশিক শোষণ ও জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে ‘লড়াকু’ হিসেবে দেখত এবং আফ্রিকা ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামে সংহতি জানিয়েছিল। এখন ভারত নিজেকে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলির একটি হিসেবে ভাবতে পছন্দ করে। জিম্বাবুয়ে অথবা সুদান অথবা প্যালেস্টাইনের মানুষ জনের সঙ্গে ভারতীয়দের ভাগ করে নেওয়ার মতো কী আছে? কেন সমস্ত বৃহৎ শক্তিগুলোর মতো, আমাদেরও কাশ্মীরে নিজস্ব ঔপনিবেশিক সমস্যা থাকবে?

আমরা এখন বাস্তবনিষ্ঠ হয়ে চরম নির্বিকারত্ব ও অসংবেদনশীলতার সঙ্গে সমস্যাটিকে এমনভাবে মোকাবিলা করব যা আমাদের আগেকার সরকারগুলো করতে সাহস পায়নি।

বিজেপি সরকার কেন ৩৭০ ধারা বাতিল, জম্মু ও কাশ্মীরের অঙ্গচ্ছেদ এবং এটিকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য এই মুহূর্তটাকেই বেছে নিয়েছিল তা নিয়ে অনেকের অনেক জল্পনা আছে। হয়তো আফগানিস্তানে ইউনাইটেড স্টেটস এবং তালিবানদের মধ্যে আসন্ন চুক্তি এবং তা পাকিস্তানকে রণকৌশলগত কোোন সুবিধা  যদি পাইয়ে দেয় — এই সম্ভাবনাটা কার্যকর থাকতে পারে। রাজ্যটির কার্যকরী  রাজনৈতিক চরিত্রে বদল আনার উদ্দেশ্যে, কাশ্মীরে সম্পত্তির মালিকানা এবং জন সংখ্যাগত পরিবর্তন সংক্রান্ত গজিয়ে ওঠা নানা পরিকল্পনা থাকতে পারে, কিন্তু ঐসব পরিকল্পনার ফল পেতে অনেক বছর লেগে যেত। অথবা এটা হতে পারে, বিরোধী দলগুলোর মধ্যেকার চূড়ান্ত বিভ্রান্তি এবং হতাশা সরকারকে সুযোগ এনে দিয়েছিল সংসদের উভয় কক্ষের মাধ্যমে এই পদক্ষেপগুলো চাপিয়ে দেওয়ার। এই পদক্ষেপের বৈধতা নিয়ে অবশ্যই আগামীদিনে বিচারবিভাগীয় সমীক্ষা হবে। কিন্তু যা ঘটানো হয়েছে, ভারতীয় জনগণের জন্য তার রাজনৈতিক তাৎপর্য শুধু রীতিমতো আশঙ্কাজনকই নয়, বিপর্যয়করও।

রাজনৈতিক ফলাফল

প্রথমত, এর মাধ্যমে একটি প্রকৃত এবং বহু বিতর্কিত সাংবিধানিক  সংস্থান যেখানে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যেকার যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের মৌলিক কাঠামো নিয়ে কিছু দিকনির্দেশ রয়েছে, প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে সেটিকে বিলোপ করার এক নজির তৈরি হল আর তা সংশ্লিষ্ট রাজ্যটির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনো আলাপ আলোচনা ছাড়াই, শুধুমাত্র সংসদে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অনুমোদিত হল।

দ্বিতীয়ত, এটা কেন্দ্রীয় সরকারকে কোনো একটি রাজ্যের জনগণ বা তাদের নির্বাচিত বিধানসভার (লেজিসলচার-এর) মতামতের কোনো তোয়াক্কা না রেখেই, সেটিকে ভাগ করার ক্ষমতা দিয়ে দিল।

তৃতীয়ত, অখণ্ড একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রীয় ভিত্তিতে তৈরি অংশগুলোর সংহতিকরণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত পথে, একটি রাজ্য যা সংবিধানের শুরু থেকে বিদ্যমান ছিল, সেটিকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল  হিসেবে অবনমিত করা হল এবং করা হল এই যুক্তিতে যে এতে রাজ্যটি, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের পক্ষে আরও উপযোগী হয়ে উঠবে। এর চেয়ে বেশি ঔপনিবেশিক যুক্তি আর কী হতে পারে !

এটা অত্যন্ত দুঃখের যে, যেসব দল এবং তাদের নেতাদের, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার জন্য এই পদক্ষেপের গূঢ় ইঙ্গিত সম্পর্কে  সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত ছিলো, তারা একে সমর্থন করলেন অথবা নীরব থাকলেন। জাতীয়তাবাদের ঔপনিবেশিকীকরণের এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার লজিকের প্রচণ্ড কোপ শুধুমাত্র কাশ্মীরেই থেমে থাকবে না। একমাত্রিক জাতীয়তার (হোমোজিনিয়াস নেশনহুড) পথে অন্তরায় প্রত্যেকটি সংখ্যালঘু অস্তিত্ব — ভাষা, ধর্ম, জাত, লিঙ্গ যে কোনোটাই হোক — আক্রান্ত হবে। একমাত্র উচ্চ বর্ণের হিন্দু যার ভাষা হিন্দি — তার নিজের ‘ভারতীয়ত্ব’ প্রমাণের কোনো দায় থাকবে না; এই সর্বোচ্চ নিরঙ্কুশ অধিকার বা সুযোগ শুধুমাত্র তার (তাদের) জন্যই সংরক্ষিত।

পুরোনো ধরনের ঔপনিবেশিকতা, উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামের পর আন্তর্জাতিক স্তরে নিন্দিত হয়েছে। কিন্তু এই অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ অন্য ধাঁচের। এটা দেশীয় ব্যাপার যার কোনো নিয়ম নেই। ভারত কি এই অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতার সাংবিধানিক বিধির বিকাশের পরীক্ষাগার? দুঃখের বিষয়, যারা এর পরবর্তী শিকার, তারা মনে হচ্ছে, এখনও আদৌ উদ্বিগ্ন নন!

- পার্থ চ্যাটার্জী
একজন সমাজ বিজ্ঞানী এবং ইতিহাসবিদ
‘‘দি ওয়্যার’’-এর পাতা থেকে

খণ্ড-26
সংখ্যা-28