প্রতিবেদন
পশ্চিমবাংলায় মবলিঞ্চিং প্রতিরোধ আইন সম্পর্কে কিছু কথা

সম্প্রতি এ রাজ্যে মবলিঞ্চিং বা ভীড় হত্যা নিয়ে একটা আইন তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশের ভারতীয় দণ্ডবিধিতে (আইপিসি) ‘‘মব লিঞ্চিং” শব্দটি খুঁজে পাওয়া যাবে না। অপরাধীরা বেকসুর খালাস হয়ে যাচ্ছে, কখনও বা তাদের গলায় মালা পড়িয়ে দিচ্ছে বিজেপি- আরএসএস বাহিনী। তাই পশ্চিমবাংলায় এই আইনকে সমর্থন জানিয়েও কিছু প্রশ্ন তোলা জরুরি। ইতিপূর্বে পশ্চিমবাংলায় এই অপরাধ সংগঠিত করে যাদের হত্যা করা হয়েছে আজও তাঁদের “বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে”। অপরাধীরা দিনের আলোয় বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার সময়কালে রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের যে ভূমিকা দেখা গিয়েছিলো তা বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির থেকে পৃথক কিছু ছিলো না। ভারতের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার যে কথা রয়েছে কার্যক্ষেত্রে তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এ রাজ্যে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে যে লম্বাচওড়া প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়ে থাকে বাস্তবে তার বিপরীতটাই দেখা গেছে। গুজরাট, রাজস্থান বা উত্তরপ্রদেশে মবলিঞ্চিং-এর যে ঘটনাগুলি সারা দেশে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলো পশ্চিমবাংলার বুকেও দেখা গিয়েছে সেই একই চিত্র। সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে এ খবর ছাপা হয়নি। “চুরির অপবাদ”-জাতীয় খবর অত্যন্ত ছোট পরিসরে পরিবেশিত হয়েছে। আড়ালে থেকে গিয়েছে হিন্দুত্ববাদীদের ষড়যন্ত্রের কাহিনী — তার সাথে মিলে শাসক দলের জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনের সহযোগী ভূমিকার কথা। এখন এ রাজ্যে নতুন আইনে “মৃত্যুদণ্ড”র বিধান অন্তর্ভুক্ত করে আক্রান্ত মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার বা ভবিষ্যতে এই অপরাধমূলক ঘটনা রোধ করা যাবে কি? মানবাধিকারের অবস্থান থেকে মৃত্যুদণ্ডর বিরুদ্ধে সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে সর্বোচ্চ শাস্তি রূপে রাখার ন্যায়সঙ্গত দাবি উঠেছে। কিন্তু ঘৃণা প্রচার বা বিভেদ বিদ্বেষের যে বিষাক্ত পরিবেশ আজ ফ্যাসিস্ট শাসক বিজেপি তৈরি করতে চাইছে; কাশ্মীর-এনআরসি দিয়ে শুরু করে রামমন্দির —এক দেশ এক আইন প্রভৃতি এজেন্ডাকে চাপিয়ে দিয়ে এক ধরনের গণউন্মাদনা সৃষ্টি করেছে, যার ফলে সহজেই ওরা সাধারণ মানুষকে মবলিঞ্চিং-এর অপরাধমূলক কাজে যুক্ত করে নিতে সক্ষম হচ্ছে কিংবা প্রতিবাদহীন এক “নীরব সন্মতি” গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন মবলিঞ্চিং বিরোধী আইনকে স্বাগত জানিয়েও বলা যায় যে শুধু আইন করে এই ষড়যন্ত্র রোধ করা সম্ভব হবে না। পাশাপাশি এর সাথে সমাজের ভিত্তিভূমিতে থাকা ধর্মীয় উন্মত্ততার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজ অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত।

এ রাজ্যে মব লিঞ্চিং-এর কয়েকটি ঘটনাকে বিচার করে দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এই এলাকাগুলিতে আরএসএস-বিজেপি তাঁদের ভালোই নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। যেখানে মবলিঞ্চিং-এর ঘটনার অব্যাবহিত পরেই অপরাধীরা জামিন পেয়ে গেছে। গতবছর ১৯১৮ সালের ২২ জুন উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়া থানার ধুলাগোছ গ্রামের মহঃ নাসিরুদ্দিন, কুটিপাড়া গ্রামের নাসিরুল সেখ, কান্দাপাড়া গ্রামের সামিরুদ্দিন সেখ — এদেরকে পরিকল্পিতভাবে একই সময়কালে ফোন করা হয়। এদের বাড়ি থেকে ৩ কিমি দুরবর্তী দুর্গাপুর গ্রামে ডেকে নেওয়া হয়। এই তিন জনেরই বয়স ৩০-এর নীচে। নির্মাণ শ্রমিক, কিংবা বাগানে চা পাতা তোলার কাজে এরা যুক্ত থাকত। হিন্দু-প্রধান দুর্গাপুর গ্রামে প্রকাশ্যে কয়েকশত মানুষের উপস্থিতিতে এদের পিটিয়ে মারা হয়, রটিয়ে দেওয়া হয় এরা নাকি গরু চুরি করেছে! মধ্যরাতে পুলিশ এদের বাড়িতে ফোন করে খবর দিলে বাড়ির লোকেরা এসে মৃতদেহ নিয়ে যায়। সেই রাতে পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে কিছুক্ষণ পরেই ছেড়ে দেয়। কেস ডাইরিতে লেখা হয় “চুরির অভিযোগে গণপ্রহারে মৃত্যু”। পরের দিন থানায় গেলে পুলিশ সংখ্যালঘু মানুষদের হুমকি দিয়ে বলে বেশি বাড়াবাড়ি করলে লকআপ করে দেওয়া হবে। ঐ এলাকায় সংখ্যালঘু মানুষেরা এক আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। নীরব সন্মতি বা এক ধরনের “কমন সেন্স” এমন সূচারু রূপে জনমানসে গড়ে তোলা হয়েছে যে ঐ এলাকার গঞ্জে বা পাকা রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে দাঁড়ালে সেই “গরু চুরি”-র পরিচিত গল্পই শোনা যাবে। অথচ গ্রামের ভেতরে বাড়ি বাড়ি বা পাড়া-মহল্লার গেলে চুরির কোন বিশ্বাসযোগ্য তথ্য আদৌ পাওয়া যাবে না। একই রকমভাবে জলপাইগুড়ি জেলার ধুপগুড়ি ব্লকের দাদন গ্রামে আনোয়ার হোসেন ও হাফিজুল সেখ নামক দুই যুবক যখন স্থানীয় হাট থেকে গরু কিনে নিয়ে যাচ্ছিল তখন রাস্তায় গাড়ি থেকে তাঁদের টেনে নামিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে মারা হয়। ড্রাইভার পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে জানা গেছে ঐ যুবকদের একজনের বাড়ি কুচবিহারে অপরজনের আসামে। তাঁদের পরিবারের লোকেরা থানায় এলে জানতে পারে মৃতদের নামেই পুলিশ কর্তৃপক্ষ চুরির অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেছে। মালদা জেলার বৈষ্ণবনগর এলাকায় শানাউল সেখ নামে একজন যুবককে গত ২৬ জুন বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বাইক চুরির অপবাদ দিয়ে প্রকাশ্যে পিটিয়ে মারা হয়। এই ঘটনা মোবাইলে ভাইরাল হয়ে যায় এবং পুলিশ চার জনকে গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীতে অপরাধীদের পক্ষ থেকে বাইক চুরির একটি সাজানো ঘটনা থানায় নিয়ে গেলে প্রমানাভাবে সেটা ধোপে টেকে নি। পার্শবর্তী কালিয়াচক এলাকায় সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যাধিক্য রয়েছে। সম্ভবত তাদের বিক্ষোভের চাপেই পুলিশ আসামীদের জামিন দেয়নি।

উপরোক্ত তিনটি ঘটনাতেই দেখা যাচ্ছে সেখানে বিজেপি-আরএসএস সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটিয়ে ভালো পরিমানে শক্তিবৃদ্ধি করেছে। সেখানে হিন্দু সংহতি, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ, দুর্গাবাহিনী প্রভৃতি নামে সংগঠন গড়ে তুলেছে আরএসএস। এরাই পেছন থেকে মব লিঞ্চিং-এর ঘটনাগুলি সংগঠিত করেছে। সরকার প্রশাসন তাদের মদত দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই দাঙ্গাকারী সংগঠনগুলিকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। সোস্যাল মিডিয়াতে বড় মাত্রায় অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে বিজেপি-আরএসএস, যারা পরিকল্পিতভাবে গুজব রটিয়ে দেওয়ার কাজে অত্যন্ত দক্ষ। সর্বোপরি “গোরক্ষা”র নামে একটা ভাবাবেগ তৈরি করে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সব কিছুই মিলিতভাবে সমাজের বুকে মবলিঞ্চিং-এর একটা বিশাল ভিত্তিভূমি নির্মাণ করে চলেছে। তাই এই দিকগুলির বিরুদ্ধে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে গণচেতনা-গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেই মবলিঞ্চিং বিরোধী আইনকে কার্যকরি করা সম্ভব। সারা দেশেই মবলিঞ্চিং প্রতিরোধ আইন প্রণয়নের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।

খণ্ড-26
সংখ্যা-27