বিবৃতি
কাশ্মীরে সামরিক একনায়কতন্ত্র চলছে
কলকাতা প্রেস ক্লাবে কবিতা কৃষ্ণানের সাংবাদিক সম্মেলন

গত ৬ সেপ্টেম্বর ভিড়ে ঠাসা কলকাতা প্রেস ক্লাবে সিপিআই(এমএল) পলিটব্যুরা সদস্য তথা সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির সম্পাদক কবিতা কৃষ্ণান সাংবাদিক বৈঠক করেন। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে কাশ্মীর যখন তার বিশেষাধিকার এমনকি পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের অধিকার হারিয়ে কেন্দ্র সরকার দ্বারা অবরুদ্ধ, যখন খবর ও যোগাযোগের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে কাশ্মীরকে, তখন কবিতা কৃষ্ণান, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও তাত্ত্বিক জঁ দ্রেজ, সিপিআই(এম) তথা গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির নেত্রী মৈমুনা মোল্লা ও ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অব পিপলস মুভমেন্টের নেতা বিমল ভাই কাশ্মীর পৌঁছে গেছিলেন খানিকটা গোপনে। পাঁচ দিন তাঁরা শ্রীনগর, ডাউনটাউন শ্রীনগর, শহরতলী, মফস্বল ও দূরের গ্রামগুলিতে গিয়ে কয়েকশো মানুষের সাথে কথা বলেছিলেন। ১৪ আগস্ট দিল্লীতে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁদের প্রাপ্ত তথ্য ও সত্য তুলে ধরেছিলেন তাঁরা। “কাশ্মীর কেজড” শিরোনামে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সরকারের চাপে দিল্লীর প্রেস ক্লাব তাঁদের তোলা তথ্যচিত্র প্রদর্শন করতে দেয়নি। ৬ সেপ্টেম্বর কোলকাতা প্রেস ক্লাবে সেই তথ্যচিত্র প্রদর্শন সহ সংবাদ সম্মেলন করলেন কবিতা কৃষ্ণান। সারা ভারত জনমঞ্চ (এআইপিএফ)-এর পশ্চিমবঙ্গ প্রচার কমিটি এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। কবিতা কৃষ্ণান এআইপি এফের সর্বভারতীয় কনভেনরদের অন্যতম এবং এআইপিএফের জাতীয় প্রচার সমিতির পক্ষ থেকে কাশ্মীরের মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে দেশের বিভিন্ন শহরে সংবাদ সম্মেলন ও আলোচনাসভা আয়োজন করে সাধারণ মানুষের সামনে তথ্য ও সত্য তুলে ধরার যে কর্মসূচী নেওয়া হয় তার অঙ্গ হিসেবে কলকাতার প্রেস কনফারেন্স। কলকাতার পর, ৮ সেপ্টেম্বর বেঙ্গালুরুতে অনুরূপ কর্মসূচী সংগঠিত হয়। কলকাতার সংবাদ সম্মেলনে ‘বন্দী কাশ্মীর’ শীর্ষক পুস্তিকাও প্রকাশিত ও বিতরিত হয় দেশব্রতী প্রকাশনার পক্ষ থেকে। এই পুস্তিকায় “কাশ্মীর কেজড” রিপোর্টটির পূর্ণাঙ্গ বঙ্গানুবাদ ও কাশ্মীরের ঐতিহাসিক পরিস্থিতি সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া এআইপিএফের অন্যতম নেতা আবু রিদা সম্পাদিত ‘তালিম’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা “কাশ্মীর : অন্ধকারের দিনরাত্রি” বিতরণ করা হয়। সাংবাদিক ছাড়াও এদিন প্রেস ক্লাবে এআইপিএফের ডাকে অনেক সাথি বন্ধু উপস্থিত ছিলেন।

এআইপিএফের পক্ষ থেকে অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী ও তুষার চক্রবর্তী প্রাথমিক পরিচিতি ও প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে বলার পর কবিতা কৃষ্ণান সাংবাদিকদের সম্বোধন করেন। অবরুদ্ধ কাশ্মীরে গোপনে যাওয়া ও সেখানকার মানুষজনের সাথে কথা বলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরার সাথে সাথে তিনি বর্তমান পরিস্থিতি, অর্থাৎ ১৫ আগষ্টের পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতি এবং কেন্দ্র সরকার, কাশ্মীরে ক্রীয়াশীল কেন্দ্রীয় প্রশাসন, ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও সুপ্রীম কোর্টের ভূমিকাও তুলে ধরেন। একদিকে কাশ্মীরের সমগ্র জনতাকে বিচ্ছিন্ন অবরুদ্ধ করা, অন্যদিকে এনআরসির নামে লক্ষ লক্ষ মানুষকে রাষ্ট্রহীন করা — এই প্রসঙ্গও উত্থাপন করেন তিনি। পরদিন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এই প্রেস কনফারেন্সের রিপোর্টের শিরোনাম ছিল : “কাশ্মীরে সামরিক একনায়কতন্ত্র চলছে”।

press club kol

 

জম্মু ও কাশ্মীরে ইন্টারনেট ও মোবাইল পরিষেবা বন্ধ রয়েছে। ভারতীয় বাহিনী রাতে বাড়িতে হানা দিয়ে কাশ্মীরী কিশোরদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। গোটা রাজ্যের বিরোধী নেতারা বন্দি। কাশ্মীরে নরেন্দ্র মোদি সরকার কার্যত “সামরিক একনায়কতন্ত্র” চালাচ্ছে। প্রত্যেক সড়ক, প্রত্যেক বাড়ির সামনে, প্রত্যেকটি মহল্লার মুখে আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। অবস্থাটা সত্যিই অত্যন্ত উদ্বেগজনক! কারও কোনো কথা বলার সুযোগ নেই, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সুযোগও নেই। এসবকে “জীবন সম্মানের অধিকার হরণ ও মানবতা বিরোধী অপরাধ” হিসেবে অবিহিত করেন কবিতা। ইন্টারনেট ও মোবাইল পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া আজকের দিনে জল বা বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়ারই মতো। ইন্টারনেটের অভাবে সরকারি প্রকল্পের চিকিৎসা সাইটে লগ ইন করতে পারছেন না চিকিৎসকেরা, গরীব মানুষ ন্যুনতম চিকিৎসা পাচ্ছেন না।

কাশ্মীরের কার্ফু-জীবনের অসম্ভব হয়রানি, হাসপাতালের হাহাকার, খুশির ইদে বিষন্ন কাশ্মীরের নিস্তব্ধতা ও গন্ডিবদ্ধ মিডিয়ার একপেশে খবরের কথা তুলে ধরেন তিনি। কাশ্মীরের মানুষের যে ক্ষোভ ও বেদনা প্রত্যক্ষ করেছেন, ভারতের মিডিয়া, ভারতের সরকার ও কাশ্মীরের ভারতপন্থী দলগুলির প্রতি সাধারণ মানুষের যে অবিশ্বাস ব্যক্ত হতে দেখেছেন, কাশ্মীরের মানুষের প্রতি ভারতীয় সেনার যে ঘৃণাপূর্ণ ব্যবহারের নজির দেখেছেন, যে মায়েদের নাবালক সন্তানকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাঁদের যে অসহায় আতঙ্ক অনুভব করেছেন সেসব সম্পর্কে বলেন কবিতা; বলেন যে এইসব অভিমান, বেদনা ও অবিশ্বাস সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ তাঁদেরকে আন্তরিক আপ্যায়নে কোনও খামতি রাখেনি। কবিতা বলেন যে কাশ্মীরের এই বন্দী দশা একমাস অতিক্রান্ত হয়েছে। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্ন করেন, পৃথিবীতে এমন আর একটিও নজির কি দেখানো যাবে যেখানে একটি সমগ্র জনতাকে তাদের নিজেদেরই সরকার এত লম্বা সময় ধরে এভাবে বিচ্ছিন্ন, অবরুদ্ধ, অপমানিত ও আতঙ্কিত করে সেনাবাহিনীর পেলেট ও বুলেটের সন্ত্রাস দিয়ে শাসন করছে? ভারতের অন্য রাজ্যে কি এভাবে কার্যত গোটা সমাজকে এক মাস ধরে আটকে রাখা সম্ভব? সেক্ষেত্রে দেশজুড়ে কেমন আলোড়ন তৈরি হত?

আসামের এনআরসি প্রসঙ্গ তোলেন কবিতা। লক্ষ লক্ষ মানুষকে এভাবে রাষ্ট্রহীনতার মুখে ঠেলে দেওয়ার তীব্র বিরোধিতা করে বলেন যে বিজেপি মানুষের জীবনকে বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিয়ে, বিভিন্ন ধরনের বিভাজন ঘটিয়ে শাসন কায়েম রাখতে চাইছে। কাশ্মীর প্রসঙ্গে ফিরে এসে তিনি সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকার নিন্দা করেন। তিনি বলেন যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত দেশের এক বিরাট সংখ্যক মানুষের জীবনমরণ সমস্যার মামলা শুনতে অস্বীকার করেছে অথচ দিল্লীতে কোথায় কার-পার্কিং হবে কি হবেনা তা নিয়ে স্বতপ্রণোদিত মামলা চালাচ্ছে!

কাশ্মীরে তাঁদের তোলা ভিডিও ক্লিপিংগুলি ইতিমধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে বহু মানুষ দেখেছেন। প্রেস ক্লাবের সংবাদ সম্মেলনে তা আবার দেখানো হয়। সাধারণ মানুষের আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থা তথা এই আমানবিক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার আর্তি এইসব খন্ডচিত্রগুলিতে ফুটে উঠেছে। তাঁরা কেউই তখন ক্যামেরার সামনে মুখ দেখাতে রাজি নন, মোবাইল ক্যামেরা ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে নীচু করে রেখে ভিডিওগুলি তুলতে হয়েছে। স্বপ্রত্যক্ষ এই বাস্তবতা এক আলাদা স্বাক্ষ্য হিসেবে প্রতিভাত হয়। এরপর প্রশ্নোত্তর পর্বে একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে কবিতা বলেন যে ৩৭০ ধারা বিলোপ করার থেকেও ভারত সরকারের অমানবিক শাসন পদ্ধতিতে বেশি আঘাত পেয়েছে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ। আরেকটি প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে, ভারতের মতো পাকিস্তান সরকারও কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাক বিবাদ তৈরি করতে চায়; পাক-অধিকৃত কাশ্মীরেও একনায়কতন্ত্র চলার নজির রয়েছে, সেখানেও স্বায়ত্ত শাসনের দাবিতে লড়াই চলছে। সমগ্র বিষয়টিকে ‘ভারত-পাকিস্তান’ হিসেবে না দেখে বরং কাশ্মীরের মানুষের অবস্থান থেকে বিচার করার ও তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর আবেদন জানান কবিতা।

খণ্ড-26
সংখ্যা-28