প্রতিবেদন
আপনি না বুঝে পরকে মজায় : হিন্দি আগ্রাসন রুখব কীভাবে?

‘আপন বিরহে আপন তনু জর জর’। দারুণ লাইন না বিদ্যাপতির এটা? বা এই লাইনটা, ‘সকল ফুলে ভ্রমরা বুলে কে তার আপন পর’, জ্ঞানদাসের লাইন। কিংবা চণ্ডীদাসের এই লাইনটি, ‘আপনি না বুঝে পরকে মজায়’। কে মজায় কীসে কেমন করে মজায়, কৃষ্ণপ্রেমী সব বাংলাভাষী জানেন। কী গভীর ব্যঞ্জনা এই লাইনটির! কিন্তু, সেটা এখানে প্রসঙ্গ নয়। যে জন্য এই লাইনগুলির উল্লেখ, তা হল, এই ‘আপনি’ শব্দটি। ‘আপন বা আপনা’ মানে ‘স্বীয়’ বা নিজ। মজা দেখুন, সেই শব্দটিই আবার ঠিক উল্টোদিকের ব্যক্তিকে সম্মান দেখাতেও বাংলা এবং হিন্দি ভাষাতেও ব্যবহার হয়। হয় না? ‘আপনি’ তো বাংলায় মধ্যম পুরুষের সম্মানবাচক শব্দ। এই শব্দের রুট যদি সংস্কৃত ‘আত্মীয়’ হয়, যেমনটি কিনা বঙ্গীয় শব্দকোষ রচয়িতাগণ দেখিয়েছেন, (আত্মীয় > (প্রাকৃত) অপপণ> ‘আপন’), তাহলে ‘নিজ’ বা ‘স্বীয়’ অর্থে ঠিক আছে। কিন্তু এই ‘নিজ’ অর্থযুক্ত শব্দটি বাংলায় সম্মানার্থে মধ্যম পুরুষকে নির্দেশ করে কীভাবে?

আরেকটি শব্দ হল ‘আর’। সংস্কৃত ‘অপর’ শব্দ থেকে প্রাকৃতে হয়েছে ‘অরর’, সেখান থেকে বাংলায় হয়েছে ‘আর’ হিন্দিতে হয়েছে ঔর, মৈথিলী ভাষায় ‘আওর’ ইত্যাদি। এদের সবারই মানে হল ‘অন্য’। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায় পাই, ‘আর কিছু হউক না হউক, ইহার মনের সুখ চিরকালের জন্য নষ্ট হইবে’। অপর থেকে অন্য হলে, শব্দের মূল রক্ষিতই থাকছে। ‘আর’ কথাটির আরেকটি অর্থ, ‘আরও’। চণ্ডীদাসের পঙক্তি, ‘আর না করিও দেরি’। কিন্তু বাংলায় ‘আর’ মানে ‘এবং’ কীভাবে হল? সাঁওতালি শব্দ ‘আরহঁ’ মানে ‘এবং’। হতে পারে ‘এবং’ অর্থে ‘আর’ কথাটির বাংলায় ব্যবহারের পেছনে আজকের বাংলায়, বাংলাভাষা সৃষ্টির পূর্ববর্তী সময়ের দান এই ব্যবহার। ‘আর’ মানে যখন ‘আরও’, তার রুট ‘অপর’ শব্দে। ‘আর’ মানে যখন ‘এবং’ সেটি খেরওয়ারি ভাষার দান। ‘দন্ত’ শব্দটি সংস্কৃত থেকে খেরওয়ারি ভাষার লোনওয়ার্ড, না খেরওয়ারি থেকে সংস্কৃতে গেছে, তা আজ বলা সম্ভব নয়। কিন্তু সংস্কৃতজাত দাঁত শব্দটি যেমন আমরা পেয়েছি, খেরওয়ারি ভাষা থেকে পেয়েছি ‘ডাঁটা’ শব্দটি। তাহলে বাংলা ভাষার গঠনে সংস্কৃতর ভূমিকা যেমন সত্যি, খেরওয়ারি ভাষাগুলির দানও অস্বীকার করা যায় না!

আমরা কথা বলছিলাম ‘আপন’ বা ‘আপনি’ শব্দটি নিয়ে। যে কোনো ভাষার কিছু সূক্ষ্ম দিক বিবেচনা করে, সেই ভাষায় কথা বলা মানুষের মনস্তত্ত্বের পরিচয় পাওয়া যায়, একথা আজ সবাই জানেন। একটি ভাষার প্রত্যেকটা শব্দের মধ্যে সেই ভাষাগোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক পরিচিতি চিহ্নিত করা যায়। এই প্রত্যেকটা শব্দের সূচনা, তার আদি স্বরবর্ণটি, সেই স্বরটির উচ্চারণস্থান বিবেচনা করলে শব্দটির নির্মাণের মনস্তত্ত্বকে খুঁজে পাওয়া যায়। ধরুন, ‘ই’ উচ্চারণ করতে যে মুখব্যাদান, ‘আ’ উচ্চারণ করতে তার ঠিক উলটো। এবার দেখুন বাংলা শব্দ বিনয়, ইংরেজি শব্দ ইনোসেন্স, ফ্রেঞ্চ শব্দ naïveté। ভাবুন শব্দগুলি সবই ‘ই’ ধ্বনির প্রাবল্য ধারণ করে আছে। কিংবা খুব বেশি হলে ‘উ’ আসতে পারে। কারণ ‘ই’-র মতোই ‘উ’-র মধ্যেও বিনয়ের ভাব নিহিত আছে, বোঝা যায়। যেমন, জার্মান শব্দ Unschuld, বা একেবারে অন্য পৃথিবীর ভাষা, ধরুন, ম্যান্ডারিন ভাষায় Wúgū। যে যে জাতিগুলি ‘ই’ দিয়ে বিনয় প্রকাশ করছে, আর যে জাতি ‘উ’ ধ্বনিতে বিনয় প্রকাশ করছে, তাঁদের জাতিচরিত্র ভেবে দেখুন। একজন জার্মান আর একজন ফ্রেঞ্চ মানুষের জাতিগত বৈশিষ্ট্য তুলনা করে দেখুন ... এবার ধরুন যদি পাওয়া যায় কোনও জাতি ‘আ’ শব্দে বিনয় প্রকাশ করছে, বাকিদের সঙ্গে তাদের একটা চিন্তা ও আচরণগত বৈশিষ্ট্যের ইতিহাস ভিত্তিক আলোচনা হতে পারে। যেমন আরবি ভাষায় বিনয় বোঝান হয় براءة (‘বারা’আতুন্’) এরকম একটি শব্দে। এখানেও কিন্তু ‘উ’ ধ্বনিটি আছে, তবে বড়ই কোণঠাসা। এভাবেই যদি খোঁজা হয় তো, দেখা যাবে ‘আ’ ধ্বনি দিয়ে বেশীরভাগ ভাষায় ‘আস্ফালন’ বোঝান হচ্ছে। আস্ফালন নেতিবাচক অর্থে বলছি না। আ দিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখুন গুরুত্ব দেওয়া বোঝায়। আন্তরিক, আস্ত, আপাদমস্তক, আগুন, আওয়াজ প্রত্যকটি শব্দই কোনও আগ্রাসী বিষয়কে বোঝাতে ব্যবহার হচ্ছে। আ দিয়ে আমি। ইংরেজি আই মানে আমি। একেবারে অন্য রুটের ভাষা কোরিয়ান, আমি সেখানে naneun। দ্রাবিড় ভাষা মালয়লম, সেখানে আমি হল ñān, বাংলায় এর উচ্চারণ লিখলে হবে ‘আঁআন’। জাপানি ভাষায় আমি হচ্ছে Watashi। মধ্যম পুরুষে তুই তুমি, ইংরেজিতে ইউ। প্রথম পুরুষ সে, ইংরেজিতে he she। স্বরের প্রবণতায় আমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তুমিতে উ। আমার থেকে কম গুরুত্ব লাভ করছে মধ্যম পুরুষ। সবচেয়ে ‘সে’ কম গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলা হিন্দি ইংরেজি ইত্যাদি সব আর্য ভাষাগুলিতে।

সাঁওতালি ভাষায় আমি হল ‘ইঞ’, তুমি ‘আম’, সে ‘উনি’। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্ব আরোপিত হচ্ছে প্রথম পুরুষে। এবং মজার কথা এই যার সঙ্গে বাক্যালাপ করছে একজন সাঁওতাল, তাকে অর্থাৎ বন্ধু বা অতিথি বা পরিচিত অপরিচিত সামনের জনকে সম্মান জানানোটা তাঁর সবার আগে প্রয়োজনীয় মনে হয়: এরকম ব্যাখ্যা কি করা যায়? ভাষা মনস্তত্ত্ব অন্তত সেরকমই ইঙ্গিত করে। সাঁওতালি ভাষার আর একটি মজার বৈশিষ্ট্য হল সামনের ব্যক্তির প্রতি এই গুরুত্ব আরও বাড়ানোর জন্য সে মধ্যম পুরুষকে দ্বৈততা আরোপ করে। আমরা জানি সাঁওতালি ভাষায় সংস্কৃতর অনুরূপ ডুয়াল নাম্বার আছে। মানে সাঁওতালিতে তিনটি বচন। একবচন দ্বিবচন ও বহুবচন। একজন সাঁওতাল যখন মধ্যম পুরুষকে অনেক বেশি সম্মান জানাতে চায়, সে ‘আম’ নয়, বলে ‘আবিন’। ‘আবিন’ মানে আসলে ‘তোমরা দুজন’, কিন্তু এটা শুধু একজন তুমিকেই বোঝাতে ব্যবহার হয়, খুব সম্মানীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে, যেমন শ্বশুর জামাই, বেয়াই বেয়ান। এবং এই ব্যবহারটি শুধু পারিবারিক সম্মাননায় নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হয়েছে পরবর্তী সময়ে। যেমন বাংলায় ‘আপনি’, সাঁওতালিতে ‘আবিন’। এমনিতে নাহলে সাঁওতালি ভাষায় ‘তুই তুমি আপনি’র পার্থক্য নেই। যে কারণে খেয়াল করবেন যে, সাঁওতাল যখন বাংলায় বলে সে সবাইকে ‘তুই’ ডাকে। কিন্তু বিশেষ ক্ষেত্রে সে মধ্যমপুরুষকে সম্মান জানায়, দ্বিত্বতা প্রয়োগে। গুরুত্ব আরোপের উদ্দেশ্যে দ্বিত্বতা আরোপ কিন্তু সে প্রথম পুরুষেও করে, যখন সে কাউকে থ্রেট করে। ভয় দেখানো বা হুঙ্কার ছাড়ার জন্য ‘আমি’কে গুরুত্ব আরোপ করতে হয়। নিজেকে বোঝাতেও তখন সে দ্বিত্বতা আরোপ করে, বিনয়ী ‘ইঞ’ না বলে বলছে, ‘আলিঞ’।

বাংলা ভাষায় দ্বিবচন নেই। কিন্তু মধ্যম পুরুষকে সম্মানার্থে সেই প্রাচীন খেরওয়ারি সম্মানবোধ, সেই পুরাতন কিন্তু রয়ে গেছে বাংলায় ও হিন্দি ভাষায়। এবার একটা মজার জিনিস দেখুন, যা ভারতীয় আর্য ভাষাগুলির মধ্যে কেবলই বাংলায় আছে, কিন্তু হিন্দি বা অন্য ভাষায় নেই; সেটা হল সম্মানবাচক প্রোনাউনগুলির সঙ্গে সঙ্গে ‘ন’ বা ‘এন’-যুক্ত সম্মানবাচক ক্রিয়াপদের ব্যবহার। ভারতীয় আর্যভাষার সবচেয়ে ঘনিষ্ট সহোদরা হল ইরাণীয় আর্য ভাষা। ইরাণীয় আর্য উপভাষাগুলির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া যায় পাঞ্জাবী ভাষার। সেখানে এই ‘ন’-যুক্ত সম্মানবাচক ক্রিয়াপদের ব্যবহার নেই। বাংলায় ‘আপনি আসুন’ পাঞ্জাবী ভাষায় ‘ਤੁ ਸੀਂ ਆਓ’ (Tusīṁ ā’ō)। হিন্দিতে এই বাক্য হবে ‘आप आ जाइए’। ‘তুমি’কে সম্মানার্থে ‘আপ’ বলা হচ্ছে। ক্রিয়াপদের ক্ষেত্রে এই ভাষা কিন্তু ভাববাচ্যের আশ্রয় নিচ্ছে। ভারতীয় আর্য ভাষাগুলির মধ্যে একমাত্র বাংলা ভাষাতেই এই ‘ন’-যুক্ত সম্মানবোধক ক্রিয়াগুচ্ছ রয়েছে। এটা এলো কোথা থেকে?

সাঁওতালি ভাষা থেকে।
‘দুজনের একজন আয় /
এসো’ ‘মিৎ হড় হিজুক্-বেন’।
‘কী ব্যাপার তোমার, বউমা?’
‘চেকাএনাবেন, বাহু?’
‘হাটে গিয়েছিলে?’
‘হাটতেবেন সেনলেনা?’

ক্রিয়াপদের এই ‘ন’ আর্যায়ীত হবার সময়কাল পেরিয়ে রয়ে গেছে বাংলা ভাষায়।

এরকম আরও অনেক কিছুই রয়ে গেছে বাংলাভাষী মানুষের জিভে যা আসলে প্রমাণ করে বাঙালির খেরওয়ারি অরিজিন।

“খাঁ খাঁ, খাঁখাঁর, বাঁখারি, বাদুড়, কানি, জঙ্ঘা, ঠ্যাঙ, ঠোঁট, পাগল, বাসি, ছাঁচ, ছোঞা, কলি, ছোট, পেট, খোস, ঝাড়, ঝোপ, ডোম, চোং, চোঙ্গা, মেড়া, বোয়াল, দা বা দাও, পগার, গড়, বরজ, লাউ, লেবু, কলা, কামরাঙ্গা, ডুমুর প্রভৃতি সব বাংলা শব্দই মূলত অস্ট্রিকগোষ্ঠীর ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে আবদ্ধ। পুন্ড্র-পৌন্ড্র, তাম্রলিত্তি-তাম্রলিপি-দামলিপ্তি এবং বোধ হয় গঙ্গা ও বঙ্গ নাম দুটিও একই অস্ট্রিক ভাষার দান। কপোতাক্ষ ও দামোদর নামদুটিও কোল কব-দাক ও দাম-দক থেকে গৃহীত। কোল দা বা দাক অর্থে জল এবং দা বা দাক থেকেই সংস্কৃত উদক। ... অস্ট্রিক ভাষাভাষী লোকেরা নিজেদের ভাষায় নদ-নদী পাহাড়-পর্বত, গ্রাম-জনপদের যেসব নামকরণ করেছিল, আজও বাংলা বুলিতে তার কিছু কিছু রেশ আছে। যেমন শিয়ালদহ বা শিয়াল-দা, ঝিনাইদহ বা ঝিনাইদা, দহ বলতে বোঝায় জলভরা গর্ত, নদীগর্ভের গর্ত।” লিখছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত “বাঙালির ইতিহাস” নামে বইতে। এই বইটি ড. নীহাররঞ্জন রায়ের “বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদিপর্ব)” নামক বইয়ের একটি সংক্ষিপ্তসার। ড. নীহাররঞ্জন রায় তাঁর উক্ত বইতেও এই বিষয়টি বিস্তারিত লিখেছেন। এখানে সেই বিস্তারের সুযোগ নেই। কিন্তু একটা জিনিস নিয়ে কারও সন্দেহ নেই যে, অস্ট্রিক ভাষাগুলি বাংলাভাষা বিকাশের ক্ষেত্রে কী ভূমিকা নিয়েছিল। শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮১৮ সালে। আধুনিক বাংলাভাষার চর্চায় উইলিয়াম কেরি, জশুয়া মার্শম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ডের ভূমিকা আমরা সবাই জানি। জানি হলহেড সাহেবের লেখা প্রথম বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের কথাও। কিন্তু তাঁদের এই কাজের কারণে বাংলাভাষার উন্নতি যেমন হয়েছে, তেমন সমস্যাও হয়েছে একটা। তা হল এই মিশনারিরা বাংলাকে দেখেছিলেন সংস্কৃত ও ইংরেজির আধারে। তাঁদের উৎসাহে যে বাংলাভাষার চর্চা শহরকেন্দ্রিক শিক্ষিত মানুষ শুরু করলেন, সেই শিষ্ট বাংলায় খেরওয়ারি শব্দ ‘ঢাকনা’ সরিয়ে, ‘আবরণ’ বেশি সুন্দর শোনালো। বাংলা ভাষার সংস্কৃত্যায়ণ শুরু হল। বাংলা ভাষায় শুধু যে অস্ট্রিক শব্দাবলী গুরুত্ব রাখে, তা-ই নয়। এই অঞ্চলের আর্য আগমনের আগে দ্রাবিড় ভাষাভাষী মানুষজন ছিলেন। আজও কুর্মি উপজাতির মানুষজন এই বাংলার জনবিন্যাসে একটা বড় অংশ ধরে রাখেন। বাংলা ভাষায় গঠনে আজকের মাহাতোদের দান অনস্বীকার্য। দ্রাবিড় শব্দ ‘ভল্লি’ বাংলায় পল্লি, এরকম বহু উদাহরণ আছে। বাংলা ভাষায় ভোটচীনি, মোঙ্গলীয়, ফারসি আরবি শব্দের আগমনও ঘটেছে দীর্ঘ সময় ধরে নানান ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে। দুঃখের কথা উইলিয়াম কেরি থেকে বিদ্যাসাগর হয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের সময় পর্যন্ত যে শিষ্ট বাংলার উদ্ভব ঘটল, তা সংস্কৃত-ঘেষা এক কলকাত্তাইয়া বাংলা, যা সেই মায়ানমারের আরাকান থেকে ত্রিপুরা বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গ ওদিকে আসাম এদিকে ঝাড়খণ্ডের বিস্তীর্ণ এলাকার সাধারণ বাংলাভাষী মানুষের বলা কথার বিস্তর ফারাক। একদিকে একটি আবহমান বাংলা ভাষা, অপরদিকে একটি কৃত্রিম শহুরে ভাষা। স্কুল কলেজের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এই কৃত্রিম ভাষাই প্রচলিত হল সাহিত্যের বাংলা হিসেবে। স্কুল কলেজের ভাষাতত্ত্বের বইগুলি আমাদের শেখাল, সংস্কৃত হল আমাদের জননীভাষা। গম্ভীর সমাসবদ্ধ সদাঝংকৃত সংস্কৃত শব্দের আরও আরও প্রয়োগে আমরা বাংলাকে নিয়ে তুললাম আমাদের প্রতিদিনের সরল নুনভাত জীবনের বিপরীত কল্পিত রাজপ্রাসাদে। সে আবদ্ধ হল তাই, সাধারণ মানুষ তার কাছ ঘেঁষতে অক্ষম হল। আর সেই ফাঁকে ঢুকে পড়তে শুরু করল হিন্দি ইংরেজি। আজ হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হচ্ছে বাংলায়। ইংরেজি আগ্রাসন কেন মেনে নিচ্ছি আমরা।

ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে পুরুষসুক্তে আছে
ব্রাহ্মণস্য মুখমাসীদ্
বাহু রাজন্য কৃতঃ
ঊরু তদস্য যদ্বৈশ্যঃ
পদ্ভাংশূদ্রো অজায়ত

পরম পুরুষের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, ঊরু থেকে বৈশ্য, আর পা থেকে শূদ্র জন্মেছে। বাংলার কোনো কবি বলেছিলেন, “পা আমার সবচেয়ে প্রিয়!”

পা! শ্রমজীবী মানুষের পায়ের জোরে সভ্যতা বেঁচে থাকে। শ্রমজীবী মানুষের পা মাথায় নিয়ে চলা উচিৎ জিহ্বাজীবী মানুষের। বাংলা শব্দতালিকার যে অংশ খেরওয়ারি ভাষা থেকে পাওয়া, খেয়াল করে দেখুন, তার সিংহভাগই কৃষিকাজ সংক্রান্ত। সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখছেন, “ভেতো বাঙালি বলে আমাদের একটা দুর্নাম আছে। এই দুর্নামের পেছনে আছে এক গৌরবময় সভ্যতার সুপ্রাচীন ইতিহাস। সে সভ্যতা হল কৃষি সভ্যতা। অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় লোকেরাই প্রথম চাষাবাদের প্রচলন করে। ... ধানই ছিল তাদের প্রধান খাদ্য। আর ‘লাঙল’ শব্দটাও তাদেরই ভাষা থেকে নেওয়া। ...” ধামা কুলো চ্যাঙাড়ির সংস্কৃত নেই। এই শব্দের তালিকাকে কে ‘খাঁটিবাংলা শব্দ’ বলেছিলেন আমি জানি না। খুব সঠিক নামকরণ ছিল। আজকের বাঙালি এই শব্দগুলোর ইংরেজি বিকল্পকে অভ্যেস করে ফেলেছে তার প্রাত্যহিক জীবনে। খাঁটি বাংলা শব্দগুলো বাদ দিয়ে ফেলছি আমরা। কিছু না এতে বাঙালির পা দুর্বল হচ্ছে। একদা নবজাগরণের বাংলা খেরওয়ারি শব্দগুলো সংস্কৃত দিয়ে বদল করে নিয়েছিল। আজকে সংস্কৃতর বদলে ইংরেজি এসেছে। নিজের পা-কে যদি কেউ অস্বীকার করে, সে এগবে কীভাবে? নিজের পা যদি না শক্ত হয়, কীভাবে লড়বে বাঙালি হিন্দির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে! কাদাজল গুগোবর মারিয়ে আসা পা, দেখলে ঘেন্না লাগে। কিন্তু পা না থাকলে মাথা সোজা থাকবে কীভাবে!

‘আপনার’ শিকড় যদি বিনষ্ট হয়ে যায়, দাঁড়াব কীভাবে?

আমাদের কি কিছু করার আছে?

কিছুদিন আগে একটি সরকারি ঘোষণার খবর পেলাম: অলচিকি বিশ্ববিদ্যালয় হবে। বিচিত্র প্রস্তাব! অলচিকি একটি লিপি। যেমন দেবনাগরী একটি লিপি। দেবনাগরী বিশ্ববিদ্যালয় কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। উত্তর ভারতে দলিতদের আলাদা পথ থাকে গ্রামে। আলাদা শ্মশান থাকে। হয়তো দলিতদের জন্য শ্মশানে খুব বাতানুকূল ব্যবস্থা করলেন আপনি। কিন্তু তাতে কি সমাজের উঁচুনীচু বর্ণ ব্যবস্থার ঘৃণ্য সংস্কারকে স্বীকার করে নিলেন না? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ডিপার্টমেন্ট নেই? সেখানেই তাহলে সাঁওতালি বা কুর্মী বা কোল ভাষার ডিপার্টমেন্ট থাকতে অসুবিধা কি? তাহলে অলচিকি বিশ্ববিদ্যালয় আবার কী জন্যে? ভারতের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ট্রিক ভাষার ডিপার্টমেন্ট থাকা সমীচীন। তাদের অধীন প্রতিটি কলেজে মুণ্ডারি ভাষাগুলি পড়ানো উচিৎ। একজন বাঙালি ছাত্র যদি সংস্কৃত পড়তে পারে, ফ্রেঞ্চ জার্মান চাইনিজ শিখতে পারে, তাহলে সাঁওতালি শিখতে বাধা কোথায়? প্রশ্নটা এই ভাষা চর্চা আপনার দরকার আছে কিনা! আমাদের বাংলাভাষার ইতিহাস ও বর্তমান জানতে, নিজের পা শক্ত করে নিজের জমির ওপর দাঁড়াতে কি এই ভাষার চর্চা আমাদের কাজে আসবে?

যদি আসে, তাহলে আপনিও লিখুন এবিষয়ে। গলা তুলুন। শুধু শ্লোগান দিয়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোখা যায় না।

- সুবিনয় হেম্ব্রম

খণ্ড-26
সংখ্যা-33