প্রতিবেদন
গোরুর দুধে সোনা! তাতেও রাজনীতি!

যে সময়ে বাংলাতে কম্পিউটার এসেছিল সেই সময়কার একটা গল্প দিয়ে লেখাটা শুরু করা যাক। আজকের দিনে যারা স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহার করেন তাঁদের কাছে হয়তো গল্পটা হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু ঘটনাটা সত্যি। এক বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ডিরেক্টর, যিনি শুধু পয়সা আর ক্ষমতা বলে কলেজের ডিরেক্টর হয়েছেন, একদিন সেই কলেজের শিক্ষকদের নিয়ে মিটিং করছেন। সবাই তাঁদের দাবি জানাচ্ছেন। কম্পিউটার শিক্ষকেরা বললেন ভাইরাস ঢুকে কম্পিউটারগুলো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কিছু অ্যান্টিভাইরাস কিনলে ভালো হতো। এই শুনে তো ডিরেক্টরের মাথায় হাত। উনি বললেন সমস্ত ঘরে এসি বসানো, সমস্ত কাঁচ বন্ধ, তাও ভাইরাস ঢুকছে কি করে ? উনি নিদান দিলেন শিক্ষকদের জুতো খুলে ঢুকতে, এবং দরজা জানলাগুলো ভালো করে বন্ধ করতে। আজকে এই ঘটনা শুনলে হয়তো হাসি পাবে। কিন্তু সেদিন অনেকেই ভেবেছিলেন হয়তো কথাটা সত্যি। পুরনো কথা কিন্তু আজকে এটা বলার কারণ, ইদানিং দেখা যাচ্ছে যে দেশের এবং রাজ্যের শাসকদলের প্রথম সারির নেতাদের এক একটি কথায় সারা সমাজে বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি হচ্ছে। এই যেমন কিছুদিন আগেই শোনা গেছিল যে গোমুত্র সেবন করলে নাকি ক্যান্সার সারে। তারও কিছুদিন আগে শোনা গিয়েছিল যে গরুর পিঠে হাত বুলালে নাকি মানুষের শারীরিক প্রেশার কমে যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর কথাটি বলেছেন বাংলার বিজেপির প্রেসিডেন্ট, যা বহু মানুষ কি বিশ্বাস করতেও শুরু করেছেন! তিনি বলেছেন যে গোরুর শরীরে একটি স্বর্ণনাড়ি থাকে তাতে সূর্যের আলো পড়লে তার থেকে যে ক্ষরণ হয়, তা গোরুর শরীরে মিশে যায়, পরে যখন দুধ দেয় সেই গরু তখন সেই দুধের মধ্যেও সোনা মিশে থাকে। তাঁর এই বক্তব্যের পিছনে তাঁর যে যুক্তি আছে সেটাকেও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, বলেছেন যে তিনি এটা শুধু জানেন না, তিনি অনেক বইতে এটা পড়েওছেন। এরপরে যথারীতি যা হওয়ার তাই হয়েছে। আজকাল মিডিয়ার চেয়ে জোরে দৌড়োয় যা তা হল সোশ্যাল মিডিয়া, সেই সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে বিভিন্ন রকমের মন্তব্য, মিমের ছড়াছড়ি। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত এবং তারিফযোগ্য হলেও কিছু কথা এখানে বলা জরুরী। মূলত কারা এই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন? একটু পড়াশুনা করেছেন যারা, তাঁরাই মূলত এই লেখা বা কার্টুন বা মীমের (ব্যঙ্গচিত্র) সঠিক বা বলা ভালো আসল গ্রাহক, যারা মূলত স্মার্টফোন ব্যবহার করেন তাঁরাই একে অপরকে এই জিনিস, সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষায় পাঠিয়ে চলেছেন বা ফরওয়ার্ড করে চলেছেন। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে বা গেছে এই সংক্রান্ত লেখা, ছবি এবং ব্যঙ্গচিত্র। অনেকেই হয়তো ভাবছেন ইসস এই নেতা মন্ত্রীরা কি বোকা, এই সাধারণ বোধটুকুও নেই? কিন্তু যদি একটু তলিয়ে ভাবা যায় এর পিছনেও একটা সূক্ষ্ম রাজনীতি আছে।

গোরুর দুধে সোনা! তাতেও রাজনীতি!

আসলে কিছু মানুষ এই কথাগুলো বিশ্বাস করেন বলেই এটা বলা হয়। কেউ কেউ এটা বিশ্বাস করতে ভালবাসেন যে জ্যোতিষীরা ঠিক বলতে পারেন অনেক কিছু, তাই তাঁদের এই জ্যোতিষী বাবাদের উপর অগাধ বিশ্বাস। ঘটনাচক্রে দেখা যাবে যে যারা এটা বিশ্বাস করেন তাঁদের সংখ্যাই হয়তো বেশি। তাই গ্রামে গঞ্জে এঁদের প্রভাবও বেশি। এখনও বাংলার গ্রামে গঞ্জে খোঁজ নিলে ডাইনি, তুকতাক, ঝাড়ফুকের ঘটনার খবর আসে। এই ঠগ জোচ্চোরদের ওপর যারা বিশ্বাস করেন তাঁদের সংখ্যাটাও কম নয় হয়তো বা যারা বিশ্বাস করেন না তাঁদের থেকে বেশিই। এই মানুষেরা এই বিষগুলো বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন। শুধু গ্রাম কেন শহরের একাংশও এই কথা বিশ্বাস করেন। এইখান থেকে শুরু হয় গুজব ছড়ানো। গল্পের গরু গাছে চড়ার কথা শুনলেও বাস্তবে এইভাবেই এগুলো ছড়ানো হয়। মানুষের মধ্যে একটা ধারণা যদি তৈরি করে দেওয়া যায় যে ওই ‘নেতা’ কিংবা ‘মন্ত্রীর’ অসীম ক্ষমতা এবং তিনি সমস্ত কিছুতে পারদর্শী তাহলে সেই ধারণার জোরেই হয়তো বা নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব। সেই ধারণা সেই নেতাকে এমন উঁচু স্থানে প্রতিষ্ঠা করে দেয় যাতে মনে হয় সেই নেতাকে গণতান্ত্রিকভাবে আর বোধহয় হারানো সম্ভব নয়। এমন একটা ধারণা থেকেই জন্ম নেয় সেই বিশ্বাস যে ‘উনি’ মিথ্যা বলতেই পারেন না, ওঁর জন্যই প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে আমরা উচিত শিক্ষা দিতে পেরেছি এবং পারব ভবিষ্যতেও যদি ‘উনি’ জিতে আসেন। পারলে ‘উনিই’ পারেন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের তাড়াতে। উনি মুখ্যমন্ত্রী হলে হয়তো যে কথাটা উনি বলেছেন যে গোরুর দুধে সোনা আছে সেটা সত্যিও হতে পারে। তাই মেদিনীপুরের এক কৃষক গোরু নিয়ে ব্যঙ্কেও উপস্থিত হয়ে পড়েন, সোনা বন্ধক রেখে ঋণ পাওয়ার জন্য।

আসলে সমাজে যে অনেক পশ্চাদপদতা আছে সেই জায়গাটা এই নেতা মন্ত্রীরা বুঝে গেছেন এবং এই মানুষদের যদি ইচ্ছাকৃত অন্য আলোচনার মধ্যে মগ্ন করে রাখা যায় তাহলে অনেক অপ্রিয় প্রশ্ন অনেকেই ভুলে যেতে পারেন। আপনি ভাবছেন আপনি বুদ্ধিমান, দিলীপ ঘোষ বোকা ? উনি বলেছেন যে গোরুর দুধে সোনা পাওয়া যায় আর সেই নিয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিলেন হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজের পর মেসেজ। আপনি ভাবছেন তো যে ওরা কত বড় বোকা আসলে কি আপনারাই বোকা নয়, মানে ঘুরিয়ে বললে আমরাই বোকা নই ?

ওদিকে পাঞ্জাব মহারাষ্ট্র ব্যাঙ্কে টাকা তোলার যে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে তার ফলে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮।

ডিটেনশন ক্যাম্পে মৃত্যু মিছিল চলেছেই, এখনো অবধি যা খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে সংখ্যাটা একেবারেই কম নয়, যদি না ভুল করি বোধহয় সংখ্যাটা ২৭।

কাশ্মীর অবরুদ্ধ হয়ে আছে প্রায় ৩ মাস। মানুষ, যোগাযোগ বিহীন হয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

এনআরসির আতঙ্কে আত্মহত্যা করছেন বহু মানুষ, সকাল থেকে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন বিভিন্ন জায়গায় নাম আর ঠিকানা ঠিক করতে।

চারিদিকে চাকরি বাকরি নেই। ওদিকে মোদী বলেছে ৯ ঘন্টা কাজ বাধ্যতামূলক করতে হবে।

মানুষ দিল্লিতে নিশ্বাস নিতে পারছেন না।

এই সমস্ত বিতর্ক একবারে পিছনে চলে যায় দিলীপ ঘোষের এই মন্তব্যে। আপনি সারাদিন ধরে এগুলো নিয়ে হাসাহাসি করেই গেলেন আর ওদিকে যা হবার হয়েই গেল।

অন্তরালে কিন্তু অন্য কেউ হাসছে। বোকাটা কে হচ্ছে? কে হয়ে চলেছে ? রোজ প্রতিদিন আমরাই বোকা হচ্ছি না কি ?

যতই শহুরে তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ মানুষজনের কাছে এই কথাগুলো হাস্যরসাত্মক মনে হলেও এর পিছনেও একটা রাজনীতি আছে। যতই কিছু মানুষ ভাবুক না কেন এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক কথা বললে ভারতের মতো এতো বড় গণতান্ত্রিক দেশের অসম্মান করা হয় কিন্তু এই রোগটার বীজ অনেক গভীরে পোঁতা। যখন ফ্রান্সের নোতরদামে আগুন লাগার পর আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বিমান করে কেন জল দেওয়া যায় না এই প্রশ্ন তোলেন তখন আসলে দেশের সমস্ত মানুষের সাধারণ বোধকেই কাঠগড়ায় তোলা হয়। যখন বলা হয় গোমূত্র পান করলে ক্যান্সার সারে তখন দেশের ডাক্তারদের ভুমিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যায় ? যখন বলা হয় বিমান বাহিনীর সৈনিকদের ‘তিনি’ নির্দেশ দিয়েছিলেন মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থাকাকালীন আক্রমণ করতে তখন তাঁদের সক্ষমতা নিয়েই যে প্রশ্ন ওঠে সেটা ভাবা কি জরুরী নয়? কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সেই ছোট ছেলেটিকে আজ বড় প্রয়োজন ছিল যে প্রশ্ন করতো ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’ নাকি অজ্ঞানতা অপবৈজ্ঞানিক চিন্তার দিকে আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে আমাদের দেশ? নামে হবে ডিজিট্যাল কিন্তু কাজে হবে অন্ধকারাচ্ছন্ন সেটা সময়েই বলবে? আগামী প্রজন্ম কিন্তু প্রশ্নটা শেষ পর্যন্ত আমাদেরকেই করবে যখন ভারতবর্ষ সেই মিনি বাসের পরিচালকের কথামতো ‘আসতে আসতে পিছনের দিকে এগিয়ে চলুন’-এর রাস্তায় যাচ্ছিল তখন আমাদের কি ভুমিকা ছিল? উত্তরটা কিন্তু আমাদেরই দিতে হবে।

খণ্ড-26
সংখ্যা-36