২০২০-র স্বাধীনতা দিবসের অঙ্গীকার: ফ্যাসিবাদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করব
deebv

আগস্ট হল ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের মাস। এবার ভারত ৭৩তম স্বাধীনতা বার্ষিকী উদযাপন করবে অনেক নীরবে নিভৃতে, আগে যা কখনও হয়নি। শুধু যে জমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞার অবশ্যপালনীয় কর্তব্য বা কোভিড-১৯ প্রতিহত করার অঙ্গ হিসাবে প্রত্যাশামাফিক দূরত্ব বিধি মেনে চলার কারণেই স্বাধীনতা দিবস এমন নিঃশব্দে নীরব হবে তা নয়। তার আরও বড় কারণ হল জীবনজুড়ে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ঘনিয়ে ওঠা হতাশা ও অনিশ্চয়তার ঘনঘটা। একথা ঠিকই যে কোভিড-১৯ অতিমারী সারা বিশ্বেই হানা দিয়েছে। কিন্তু একদিকে কোভিড-১৯ আর অন্যদিকে বিচার-বিবেচনাহীনভাবে পরিকল্পিত, বিশৃঙ্খল ভাবে পরিচালিত এবং নির্মমভাবে বলবৎ করা লকডাউন — এই উভয়েরই ফলে যে বিপর্যয় তা একান্তই ভারতের।

কোভিড-১৯ অতিমারী শুরু হওয়ার আট মাস পর দেখা যাচ্ছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই এর ছড়িয়ে পড়াকে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে এবং ঝড়-ঝাপটার সবচেয়ে খারাপ পর্যায়টা পেরিয়ে এসেছে। এই অতিমারী ভারতে আসে তুলনামূলকভাবে কিছুটা দেরীতে, কিন্তু এরজন্য যে সময়টা পাওয়া যায় তাকে এর মোকাবিলার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির কাজে একটুও সদ্ব্যবহার করা হয়নি। এক একটা সপ্তাহ গেছে আর ভাইরাসের সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। বিশ্বজোড়া এই অতিমারীর ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলকে সঙ্গে নিয়ে ভারত এখন সবার প্রথমে। প্রসঙ্গত, এই তিনটে দেশেরই শাসন ক্ষমতায় রয়েছে কট্টর দক্ষিণপন্থী স্বৈরতান্ত্রিক সরকার, যারা সমস্ত বিচক্ষণ পরামর্শকেই অগ্রাহ্য করে এবং নিজেদের স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপ্রধানের আবেগের তাড়না, খামখেয়াল এবং ঔদ্ধত্য দ্বারা চালিত হয়।

কোভিড-১৯ যে কঠিন চ্যালেঞ্জ সে সম্পর্কে মোদী সরকারের যখন জ্ঞানোদয় হল, প্রধানমন্ত্রী মোদী তখন মনে করলেন যে গোটাকয়েক নাটুকে ভাষণ ও চটকদার ক্রিয়াকলাপ দিয়ে তিনি এর মোকাবিলা করতে পারবেন, এটাকে তিনি মহাভারতের যুদ্ধ বলে অভিহিত করলেন যে যুদ্ধ ২১ দিনে জেতা হয়ে যাবে। এখন ২১ দিনের বদলে প্রায় ২১ সপ্তাহ অতিক্রান্ত হতে চলল, আর সংখ্যাগুলো যত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগল মোদীর মুখের কথাও হারিয়ে গেল। মোদী এখন আর কোভিড-১৯ নিয়ে প্রায় কোনো কথাই বলেন না; তিনি এখন এই সংকটকে একগুচ্ছ সুযোগ রূপে গণ্য করার নবলব্ধ সূত্রকেই আঁকড়ে ধরেছেন। এই ‘সুযোগগুলোকে’ তিনি পুরো মাত্রায় কাজে লাগাতে শুরু করেছেন, অর্থনীতি এবং রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই।

coal

 

কয়লা ব্লকগুলোকে নিলাম করা হচ্ছে, বেসরকারী উদ্যোগে ট্রেন চালানো শুরু হচ্ছে, শ্রম আইনগুলোকে মুলতুবি করা হচ্ছে, কৃষি বিপণন বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। গোটা দুনিয়াই যখন রাষ্ট্রের কার্যকরী হস্তক্ষেপের, বিশেষভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবার সামাজিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে, মোদী সরকার তখন রাষ্ট্রের কর্তব্যকে পরিত্যাগ করে অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্বিচার বেসরকারীকরণকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই উঠেপড়ে লেগেছে। এবং, চূড়ান্ত ধৃষ্টতার সাথে ‘ভাবনা-চিন্তা’ ব্যাপারটাকেই খিল্লিতে পর্যবসিত করে মোদী সরকার রাষ্ট্রীয় কর্তব্যের পরিত্যাগ ও কর্পোরেট অধিগ্ৰহণের যৌথ পদক্ষেপকে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ অভিযান বলে বেচতে চাইছে।

বেসরকারীকরণের এই আগ্ৰাসী তৎপরতার পাশাপাশিই বিরোধী কণ্ঠের ওপর এবং জন আন্দোলনের কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালাতে লকডাউনকে অস্ত্র হিসাবে লাগাতার প্রয়োগ করতে দেখতে পাচ্ছি আমরা। অতিমারীর জন্য এনপিআর প্রকল্পকে সাময়িকভাবে স্থগিত করা হলেও সরকার সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বকারী কর্মীদের ওপর প্রণালীবদ্ধভাবে নিগ্ৰহ চালাচ্ছে ও তাদের গ্ৰেপ্তার করছে, এমনকি দুরভিসন্ধিমূলক ভাবে দিল্লী দাঙ্গাতেও তাদের জড়িত করছে। দিল্লী দাঙ্গার হত্যালীলায় মূল ধাক্কাটা নিরপরাধ মুসলিমদেরই সহ্য করতে হয়েছে। ভীমা কোরেগাঁওয়ের ঘটনায় দলিতদের ওপর আক্রমণের ক্ষেত্রে যেমন করা হয়েছিল, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে দিল্লী দাঙ্গাকেও বিকৃতভাবে উপস্থাপিত করে তাকে ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের ওপর নিপীড়ন নামিয়ে আনার এক ন্যক্কারজনক অভিযানে পরিণত করা হচ্ছে।

মোদী সরকার গত বছর আগস্ট মাসে একতরফাভাবে ৩৭০ ধারাকে অকার্যকর করে তোলে এবং জম্মু ও কাশ্মীরের শুধু স্বায়ত্ততাই নয়, তার রাজ্যের মর্যাদাও কেড়ে নেয়। বাস্তবের জমিতে এই চকিত হামলাকে বলবৎ করা হল এক সুবিশাল ও সার্বিক দমন নামিয়ে — ইন্টারনেট ও মোবাইল টেলিফোন পরিষেবাকে বন্ধ করে দেওয়া হল, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীরা সহ সমস্ত নেতৃবৃন্দকেই গৃহবন্দী করা হল এবং জনগণকে কার্যকরীভাবেই তালাবন্দী করে রাখা হল, কেননা, রাজ্যকে অভূতপূর্ব মাত্রায় সেনা দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর থেকে ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যটিতে জনসংখ্যার মৌলিক চরিত্র পালটে দিতে নির্লজ্জ ঔদ্ধত্য চালিয়ে আরও আইনি ও নীতিগত পরিবর্তন সম্পাদিত হয়েছে।

গোড়ার দিকে জম্মু ও লাদাখে এই পদক্ষেপের পক্ষে সমর্থন ছিল, কিন্তু গত এক বছরে এই সমর্থন বলতে গেলে মিলিয়েই গেছে এবং গোটা জম্মু ও কাশ্মীরে মোহমুক্তি, ক্রোধ ও বিচ্ছিন্নতা বোধ প্রকট হয়ে মাথা চাড়া দিয়েছে। ভারতের কাশ্মীর সংকটকে তীব্র করে তুলছে লাদাখে চীনের সঙ্গে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার ক্রমান্বয়ী পরিবর্তন, যা লাগাতার উত্তেজনা ও সংঘাতের এক অঞ্চল হিসাবে দেখা দিয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ রেখা এবং চীনের সঙ্গে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা একই সাথে উত্তেজনাপ্রবণ হয়ে ওঠাটা জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে নয়া দিল্লীর কাছে এক দুঃস্বপ্ন হয়েই দেখা দেবে, আর মোদি সরকার এখন ঠিক এই পরিস্থিতির আবর্তেই ভারতকে এনে ফেলেছে। গালওয়ান উপত্যকায় চীনের সঙ্গে সংঘর্ষে ভারতকে ১৯৬৭ সালের পর সবচেয়ে বড় ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে, এবং প্রাপ্ত সমস্ত সংবাদ থেকেই জানা যাচ্ছে যে পারস্পরিকভাবে সম্মত হয়ে সেনা অপসারণ ও পিছিয়ে যাওয়ার ঘটনায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রন রেখা ভারতের দিকেই আরও কয়েক কিলোমিটার ঢুকে এসেছে। মোদী সরকার অনমনীয়ভাবে অস্বীকার করে চলছে, কিন্তু তা দিয়ে পরিস্থিতির পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন তো আর ঘটবে না।

বিদেশনীতির ক্ষেত্রে মোদী সরকারের ক্রমবর্ধমান বিপর্যয়ই ভারতের কাছে চীনা চ্যালেঞ্জকে আরও সংকটময় করে তুলেছে। সরকার সর্বদাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমেরিকা ও ইজরায়েলেকে তুষ্ট করার চেষ্টা করে, যদিও গোটা পৃথিবীতে আধিপত্য করা এবং অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করার মার্কিন নীতি ভারতের নিজের স্বার্থের পক্ষে ক্রমেই আরও বেশি প্রতিকূল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর বিদেশনীতির ক্ষেত্রে সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা রূপে সামনে এসেছে প্রায় সমস্ত প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতা ও তাদের সঙ্গে বৈরিতা। কেবলমাত্র পাকিস্তানের সঙ্গে ‘বরাবরের প্রতিদ্বন্দ্বিতার’ মধ্যেই আর ভারতের সমস্যা আটকে নেই; আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং বিশ্বের অপর একমাত্র হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ নেপালের সঙ্গেও ভারতের এখন সম্পর্কের জটিলতা। ভারতের বড় বড় বৈদ্যুতিন ও ছাপা সংবাদমাধ্যমগুলোতে নেপাল-বিরোধী কুৎসার প্রাবল্য এবং মোদীর নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্র বারাণসিতে নেপালি নাগরিকদের অবমাননার মর্মন্তুদ ও লজ্জাজনক ঘটনা নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে আরও বিষিয়েই তুলবে।

indus

 

অর্থনীতি এবং বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে ধারাবাহিক ব্যর্থতা এবং কোভিড-১৯ অতিমারী নিয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে সরকার এখন আরও একবার বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলোতে সরকার ফেলার খেলায় মেতে উঠে এবং অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণকে কেন্দ্র করে হিন্দু ভাবাবেগকে উস্কিয়ে তুলে জনগণের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অতিমারীর প্রাদুর্ভাবের মাঝে এবং লকডাউন চলাকালে সমস্ত ধর্মীয় সমাবেশ নিষিদ্ধ হওয়া সত্বেও মোদী ৫ আগস্ট প্রস্তাবিত রাম মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করতে যাবেন বলে সংবাদ। আর এটা হবে মোদী সরকার কর্তৃক কাশ্মীরের সাংবিধানিক অধিকার ও রাজ্য-মর্যাদা বিলুপ্ত করার ঠিক এক বছর পর। সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান যে ভারতের সংবিধান এবং সংবিধান প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের উপর বিজয় অর্জনের বিশেষ দিবস হিসাবে ৫ আগস্টকে চিহ্নিত করতে চায় তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না।

ভারত নিয়ে দুটো ধারণার লড়াই এখন জনগণের সামনে মূর্ত হয়ে উঠেছে। একটা ধারণার কেন্দ্রে রয়েছে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ঊর্ধ্বে তুলে ধরা স্বাধীনতা, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়বিচার; আর অন্য ধারণাটা ভিত্তি করে রয়েছে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্রের ওপর, ডঃ আম্বেদকরের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী যা ভারতের কাছে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হয়েই দেখা দেবে। স্বাধীনতার স্পৃহাই ভারতকে জমিদারী প্রথা ও করদ রাজ্যগুলোর বিলোপ, গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও পরিষেবাগুলোর জাতীয়করণ এবং এক শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র সৃষ্টির দিকে, এবং সাম্রাজ্যবাদী হুকুমদারী থেকে মুক্ত এক বিদেশ নীতি অনুসরণের দিকে চালিত করেছিল। মোদী-শাহ জমানায় এই সব বিষয়গুলোকেই আমরা বিপজ্জনকভাবে বিপরীতমুখী হতে দেখছি। এই সর্বনাশা বিপদের মুখোমুখি হয়ে ভারতের জনগণকে ভগৎ সিং ও আম্বেদকরের মতো ব্যক্তিত্বদের দেখানো পথেই ফিরে যেতে হবে এবং ভারতকে নিয়ে যেতে হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক সাম্যের বৈশিষ্ট্য সমন্বিত প্রাণোচ্ছল জনগণতন্ত্রের এক গন্তব্যে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৮ জুলাই ২০২০)  

খণ্ড-27
সংখ্যা-27