নয়া শিক্ষানীতি ২০২০ : শিক্ষা ক্ষেত্রে খোলা হল গরিব-বহিষ্কারের একাধিক দরজা
ddew

অর্থনীতি এবং পরিবেশ সম্পর্কে কর্মনীতি ঘোষণার পর আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কর্মনীতি ঘোষণা করতে মোদী সরকার লকডাউনের সময়টাই বেছে নিল, নয়া শিক্ষা নীতি ২০২০। মোদী শাসনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হওয়ার পরপরই ২০১৯-এর মে মাসের ৩১ তারিখে ৪৮৪ পাতার একটা খসড়া পেশ করা হয়। সেই ৪৮৪ পাতার খসড়াকে সঙ্কুচিত করে এখন ৬০ পাতার এক কর্মনীতিতে পরিণত করা হয়েছে যাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা ২০২০-র ২৯ জুলাই অনুমোদন দেয়। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মনীতির ক্ষেত্রেও সংসদকে এড়াতে, কোনো ধরনের মতামত দেওয়া থেকে তাকে প্রতিহত করতে সরকার আরও একবার লকডাউনকে মওকা করে তুলল। সরকারের দাবি, ব্যাপকতর স্তরে আলোচনার পরই তারা এই কর্মনীতিকে রূপায়িত করেছে। কিন্তু শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশ সংগঠন বলছে যে ওই আলোচনার পর তার ফলাফল নিয়ে যে তথ্য সরকার জোগান দিয়েছে বলে বলছে সে সম্পর্কে সরকারের কাছ থেকে তারা আদৌ কিছু শোনেনি। আরএসএস অনুমোদিত ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডল অবশ্য এই কর্মনীতিকে স্বাগত জানিয়েছে, কেননা, তারা যে সমস্ত দাবি জানিয়েছিল তার ৬০-৭০ শতাংশই সরকার গ্ৰহণ করেছে।

নয়া শিক্ষা নীতি ২০২০ উপস্থাপিত হয়েছে একবিংশ শতকের প্রথম শিক্ষা নীতি হিসাবে যার ঘোষিত লক্ষ্য হল “ভারতীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে শিকড় চাড়ানো বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা ব্যবস্থা নির্মাণ করে … ভারতকে বিশ্বে জ্ঞানের এক অতিবৃহৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করা।” বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মান সম্পর্কে বলতে গিয়ে শিক্ষা নীতির নথিতে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে আমেরিকার আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কথা, আমেরিকার সুপরিচিত আটটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যে নামটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আধুনিক যুগের আদর্শ জ্ঞান সমাজ বলতে যা বোঝা হচ্ছে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ওই নথি পাঁচটা দেশের উদাহরণ দিয়েছে : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইজরায়েল, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ডের ভিত্তিতে তাঁরা জ্ঞান সমাজের ওই পাঁচটা দৃষ্টান্তকে আদর্শ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন সে সম্পর্কে ওই নথির রচয়িতারা অবশ্য আমাদের জানাননি। নতুন এই নথিতে আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাব সংশয়াতীত রূপে স্পষ্ট, এবং এই নীতি আমেরিকার এবং অন্যান্য বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভারতে শাখা খোলার জন্য স্বাগত জানিয়েছে।

dre

 

শিক্ষাক্রম শেষ না করেই ছাত্র-ছাত্রীদের পড়া ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপক বিস্তৃত সমস্যা এবং ভালো গুণমানের শিক্ষার সার্বজনীন লভ্যতার অভাবের কথা নয়া শিক্ষানীতি স্বীকার করেছে। এই সমস্যার সমাধানে কর্মনীতির লক্ষ্যের কিছু উল্লেখ নথিতে করা হয়েছে এবং এই দাবিও করা হয়েছে যে দু-কোটি ছাত্র-ছাত্রীকে শিক্ষা ব্যবস্থায় পুনরায় যোগদান করানো হবে। তবে এই লক্ষ্য কিভাবে অর্জিত হবে সে সম্পর্কে আমাদের অন্ধকারেই রাখা হয়েছে। স্কুলে ও তারপর  কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধরে রাখার কোন উপায় হাজির করার পরিবর্তে এই নীতি শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বহুবিধ রাস্তা খুলে রেখেছে। পড়া ছেড়ে দেওয়ার প্রত্যেকটা ধাপে একটা করে সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এইভাবে শিক্ষা ত্যাগ করার পরিঘটনাকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। দুর্বল শ্রেণী, জাত ও লিঙ্গের ছাত্র-ছাত্রীরাই শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে যায়। নয়া শিক্ষানীতি তাদের বেরিয়ে যাওয়াটা অব্যাহত রাখবে, তবে হাতে একটা সার্টিফিকেট পাবে তারা। বলা বাহুল্য যারা পাঠক্রমের গোটা পর্যায়টা অতিক্রম করে ডিগ্ৰি সম্পূর্ণ করবে একমাত্র তারাই সবচেয়ে ভালো কাজগুলো পাবে; মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিয়ে যারা সার্টিফিকেট পাবে, ভালো কাজ পেতে ওই সার্টিফিকেট কোনো সহায়ক হবে না।

eec

 

শিক্ষানীতিতে শিশুকালে শিশুদের যত্ন নেওয়া ও তাদের শিক্ষার স্তরের (ইসিসিই) ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং এই লক্ষ্যে অঙ্গনওয়ারি ব্যবস্থাপনাকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ৮ বছর বয়স পর্যন্ত ইসিসিই স্তরের (যার মধ্যে ৩ বছর পর্যন্ত বয়সীদের একটা উপ-কাঠামোও অন্তর্ভুক্ত) একটা “চমৎকার পাঠক্রম ও শিক্ষণপ্রণালী সংক্রান্ত কাঠামো”-র বিকাশ ঘটাবে এনসিইআরটি। আরও বলা হয়েছে, “যেখানে সম্ভব সেখানেই” শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা/ বাড়ির ভাষা/ স্থানীয় ভাষা, শুধু পঞ্চম ধাপ পর্যন্তই নয়, “ভালো হবে” যদি অষ্টম ধাপ এবং তার পরও এটাকে চালানো যায়। বর্তমানে ভারতে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরাজি বিশেষ অধিকার ও সুবিধার নির্দেশক রূপেই গণ্য হয়। নতুন ভাষা নীতি কি এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে যেখানে মাধ্যম হিসাবে মাতৃভাষা/ বাড়ির ভাষা/ স্থানীয় ভাষা নিকৃষ্ট রূপে বিবেচিত হবে, আর নিজেদের সন্তানদের ইংরাজির সুবিধা দিতে চাইলে দরিদ্র ও বঞ্চিত অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের মাত্রাতিরিক্ত চড়া দামের বেসরকারী স্কুলগুলোতে পাঠাতে বাধ্য হবে?

rew

 

এবং সবশেষে এই নথি প্রসঙ্গক্রমে “১৮ বছর বয়স অবধি দ্বাদশ স্তর পর্যন্ত সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের যথাযথ ও ভালো গুণমানের” শিক্ষা দিতে উপযুক্ত সহায়ক ব্যবস্থার সংস্থান করার উল্লেখও করেছে। শিক্ষা সম্পর্কিত নীতির ক্ষেত্রে এ সবই শুনতে খুব ভালো, কেবল নথিতে স্পষ্টভাবে বলা নেই সরকার দ্বাদশ স্তর পর্যন্ত (১৮ বছর বয়স অবধি) শিক্ষাকে কিভাবে সর্বজনীন করে তুলবে। সকলের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা না করলে শিক্ষাকে বুনিয়াদি অধিকার করে তোলা যাবে কিভাবে? নতুন নথিতে বলা হয়েছে, সকলের সাধ্যের মধ্যে থাকা ভালো গুণমানের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে, কিন্তু সকলের সাধ্যায়ত্ত বলতে সরকার কী বোঝাতে চাইছে তা আমরা বুঝতে পারছি না, এবং সেটা কিভাবে সুনিশ্চিত করবে তাও আমরা জানতে পারছি না। শিক্ষার সার্বজনীন লভ্যতার অপরিহার্য অঙ্গ রূপে সরকারী স্কুল ব্যবস্থাকে সম্প্রসারিত ও উন্নত করে তোলার প্রস্তাব নথিতে নেই। নথি শিক্ষার বাণিজ্যকরণকে খর্ব করার কথা বলেছে, তবে তা বেসরকারীকরণের ক্রমপ্রসারমান কাঠামোর মধ্যে। কায়দাটা খুবই সোজা; “জনহিতকর মানসিকতার” বেসরকারী স্কুল অথবা “মানবদরদী” বেসরকারী স্কুলের মতো শব্দগুলোকে বারবার ব্যবহার করে বেসরকারী শব্দটায় নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আরোপ করা হয়েছে। কারা এই জনস্বার্থধারী মানবদরদী? তারা কি সেই একই মুনাফাবাজ কর্পোরেট সংস্থাগুলো যারা সন্তানের সাফল্যের জন্য মানুষের আকাঙ্খাকে মূলধন বানিয়ে চড়া দামে শিক্ষা বিক্রি করে? তারা কি সেরকম হবে না যারা শিক্ষায় টাকা না ঢেলেও শিক্ষার এজেণ্ডা ও অগ্ৰাধিকার নির্ধারণ করবে?

শিক্ষানীতি শিক্ষায় সরকারী ব্যয়কে বাড়ানোর কথা বলেছে, তবে তা ১৯৮৪ সাল থেকে অসংখ্যবার বলে আসা শিক্ষায় ব্যয়কে জিডিপির ৬ শতাংশ করারই পুনরাবৃত্তি, যে লক্ষ্যমাত্রা কখনই পূরণ হয় না। মুচকুন্দ দুবে কমিশন ২০০৭ সালে বিহারের জন্য যে অভিন্ন স্কুল ব্যবস্থার সুপারিশ করেছিল, যাতে সমস্ত পৃষ্ঠভূমি থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের সরকারী স্কুলে আসাটাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, একমাত্র সেই ব্যবস্থাই সরকারী স্কুলের গুণমানকে উৎকৃষ্ট করতে এবং সামাজিক সাম্যের সার্বজনীন ভাবধারা ও বৈচিত্র্যের সমাদরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে (নীতীশ কুমার সরকার ভূমি সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের মতোই দুবে কমিশনের রিপোর্টকেও আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে)। এই ধরনের আমূল সংস্কারকামী জোরালো ধাক্কা না দিলে, এবং তার রূপায়ণের সুনির্দিষ্ট পথ-মানচিত্র না থাকলে এই নীতিমালার অধিকাংশ লক্ষ্য দুরাকাঙ্খার বয়ান হয়েই থেকে যেতে বাধ্য।

dew

 

শিক্ষা নীতিতে বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার পুনর্বিন্যাসের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে এবং তাকে কেন্দ্র করেই প্রস্তাবিত স্বতন্ত্র পরিবর্তনগুলো আবর্তন করছে। বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর যে জোর দেওয়া হয়েছে তার লক্ষ্য হল বৃহৎ পুঁজির প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতি রেখে দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করা। শিক্ষা নীতিতে মোট ছাত্রদের অর্ধেককেই ইন্টার্নশিপের সুযোগ সহ একেবারে ষষ্ঠ স্তর থেকে সরাসরি বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং ইনটার্নশিপকে এত আগে থেকেই প্রবর্তন করতে চাওয়া হচ্ছে কেন তা বুঝে ওঠাটা খুব একটা শক্ত ব্যাপার নয়। এই প্রক্রিয়ায় বৃত্তিমূলক শিক্ষার পথে ঘোরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বঞ্চিত গোষ্ঠীর ব্যাপক সংখ্যক ছাত্রদেরই সাধারণ শিক্ষা থেকে বার করে এনে নিম্ন দক্ষতাসম্পন্ন স্বল্প আয়ের কাজে লাগানো হবে। অন্যভাবে বললে, দ্বাদশ স্তর পর্যন্ত শিক্ষাকে সার্বজনীন করার পরিবর্তে নয়া শিক্ষা নীতি কম বয়সী তরুণ/ কিশোরদের নিছক শ্রম শক্তিতে পরিণত হওয়াটাকেই প্রাতিষ্ঠানিক করে তুলতে পারে। আমরা স্মরণ করতে পারি, মোদী সরকার শিশু শ্রমিক নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধন করেছিল যাতে ১৪ বছরের কম বয়সী কিশোররা “পরিবার ভিত্তিক উদ্যোগগুলিতে” কাজ করতে পারে, এবং এই নীতির সমর্থনে জাত-ভিত্তিক শ্রমের জাতপাতবাদী যুক্তির আশ্রয় নিয়েছিল।

বৃত্তি শিক্ষার পথ ধরে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে ভিন্ন ক্ষেত্রে চালিত করা ছাড়াও নয়া নীতি কলেজ শিক্ষার সম্পূর্ণ পুনর্বিন্যাসের কথাও বলেছে। কয়েক বছর আগে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় চার বছরের স্নাতক পর্যায়ের পাঠক্রমকে বাজিয়ে দেখার চেষ্টা করেছিল, তবে ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের তীব্র বিরোধিতার মুখে চালু করার পরই ওই পাঠক্রমকে তুলে নিতে হয়। নয়া নীতি চার বছরের ডিগ্ৰি কোর্সের রূপে সফল না হওয়া ওই নীতিকে পুনরায় চালু করছে যাতে প্রতি বছরের শেষে শিক্ষা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ খোলা রাখা হচ্ছে। মাস্টার ডিগ্ৰির সময়কালকে কমিয়ে এক বছরের কোর্সে পরিণত করা হয়েছে আর এম ফিলকে পুরোপুরি তুলে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়টা এবং তার সাথে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলা ও বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শাখা চালু হওয়া — উভয়ই উচ্চ শিক্ষা এবং গবেষণা ক্ষেত্রে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ঢোকার পথকে নিয়ন্ত্রিত করে তুলবে। স্কুল শিক্ষার মতো এখানেও বহিষ্করণের যে একাধিক বিকল্প খুলে রাখা হয়েছে তা সেই নির্দিষ্ট সমস্যাকেই চাপা দেবে ও গোপন করবে যে সমস্যাটা হল সামাজিক এবং শিক্ষাগত দিক থেকে বঞ্চিতদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঢুকতে পারার পরও ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ার পরিঘটনা। শিক্ষা নীতি একটা জাতীয় বৃত্তি পোর্টালের কথা এবং বেসরকারী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্ধেক ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ২৫ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ অর্থ যোগানের সংস্থানের কথা বলেছে, তবে, নীতির রূপায়ণ কী দাঁড়ায় সেটাই এই পরিসংখ্যানগুলো সম্পর্কে আমাদের প্রকৃত ধারণা দিতে পারবে।

যে কোনো শিক্ষা নীতির রূপায়ণের ক্ষেত্রে শিক্ষকরাই কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে থাকেন। নয়া নীতি শিক্ষার পেশায় সর্বোত্তম ও উজ্জ্বল মেধার ছাত্র-ছাত্রীদের টানার ও তাদের যথাযথ সম্মান দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। কিন্তু কাজের নিরাপত্তাহীনতা উত্তরোত্তর বেড়ে চলা, চুক্তিতে শিক্ষা প্রদানের পরিঘটনা এবং সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিত সম কাজে সম বেতন নীতির অতি মাত্রায় লঙ্ঘন নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে যে ক্ষোভ রয়েছে, নয়া নীতি সে সম্পর্কে নীরবই থেকেছে। নয়া নীতির আর একটা উদ্বেগজনক দিক হল চরম কেন্দ্রীভবনের প্রবণতা। জাতীয় শিক্ষা কমিশন ও জাতীয় গবেষণা ফাউণ্ডেশনের গঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরে অভিন্ন মূল্যায়ন ও ভর্তির পরীক্ষা ব্যবস্থা — এই সবগুলির ক্ষেত্রেই নয়া নীতি ব্যাপক হারে ‘হালকা কিন্তু দৃঢ়’ কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের পক্ষে মত দিয়েছে এবং ‘শিক্ষা’ সংবিধানের যুগ্ম তালিকার অন্তর্ভুক্ত হলেও রাজ্য সরকারগুলোর হস্তক্ষেপের কোনো অবকাশই রাখেনি।

sade

 

আক্রমণাত্মক সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ক্ষমতার নেতৃত্বে থাকায় এই ধরনের অতি-কেন্দ্রীভবন শিক্ষা ক্ষেত্রের গোটা পরিসরটারই ক্রমবর্ধমান গৈরিকিকরণের পথ প্রশস্ত করবে। নয়া শিক্ষানীতি কয়েক জায়গায় সাংবিধানিক মূল্যবোধের উল্লেখ করেছে, তার সাথেই উল্লিখিত হয়েছে বিজ্ঞান মনস্কতা, বিশ্লেষণাত্মক অনুসন্ধান, বৈচিত্র্য, বহুত্ববাদ এবং সার্বজনীনতার মতো শব্দবন্ধ। এ সত্ত্বেও পাঠক্রমে পরিবর্তন সম্পর্কে এবং গবেষণাকে আরএসএস-এর মতাদর্শগত দিশার ছাঁচে ঢালার প্রচেষ্টা সম্পর্কে আমাদের প্রহরা জারি রাখতে হবে। জোরজবরদস্তি হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে আগে যে প্রতিবাদ হয়েছিল সে সম্পর্কে হুঁশিয়ার থেকে নয়া শিক্ষানীতি আপাতত ত্রিভাষা সূত্রকে অক্ষত রেখেছে এবং তাতে জোর থেকেছে সমস্ত স্তরে সংস্কৃতকে গুরুত্ব দেওয়ার ওপর। অন্য যে বিষয়টা সম্পর্কে নয়া শিক্ষানীতি নীরব থেকেছে তা হল জাতপ্রথা ও জাত-ভিত্তিক সংরক্ষণ, এই নীতির বাঁধা বুলি হয়ে উঠেছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বঞ্চিত গোষ্ঠীসমূহ, যদিও এই গোষ্ঠীগুলোর আরও সুযোগ লাভ সুনিশ্চিত হবে কিভাবে সে বিষয়টাকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য অনুসারেই অস্বচ্ছ করে রাখা হয়েছে।

reqr

 

ভারতের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার অবশ্যই খোলনলচে বদলানো দরকার। দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষাবিদরা সরকারী/ বেসরকারী, ধনী/ দরিদ্র ধারার বর্তমান সমান্তরাল ব্যবস্থাটাকে সরিয়ে তার স্থানে সন্নিহিত অঞ্চলে অভিন্ন স্কুল ব্যবস্থা প্রবর্তনের ওপর জোর দিয়ে আসছেন, যে ব্যবস্থায় সবার জন্য বিনামূল্যে সম মানের শিক্ষা প্রদান করা হবে। শিক্ষায় ব্যয়ের ওপর অগ্ৰাধিকার দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে তাঁদের দীর্ঘকালের আর্জি, যাতে কোনো ভারতবাসীকেই অর্থের অভাবে অথবা আসন ঘাটতির কারণে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট স্কুল ও কলেজ/ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে না হয়। মোদী সরকারের নয়া শিক্ষানীতি কখনই সেই রূপান্তরণ নয় যা ভারতের শিক্ষানীতির প্রয়োজন। এর বিপরীতে এই শিক্ষানীতির নকশা এমনভাবে তৈরি হয়েছে যাতে ভারতের ব্যাপক সংখ্যাধিক দরিদ্র ও বঞ্চিত ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ক্ষেত্রের বাইরে রাখা যায় ও শিক্ষার দরজা তাদের কাছে বন্ধ হয়ে যায়; সংরক্ষণ ও সামাজিক ন্যায়কে দুর্বল করা যায়; বেসরকারী, মুনাফাভিত্তিক শিক্ষার জোয়ার বয়ে যায়; এবং ডঃ আম্বেদকর যাকে চিহ্নিত করেছিলেন “স্তর বিন্যস্ত অসাম্য” তা প্রতিষ্ঠানিক রূপ পায়।

খণ্ড-27
সংখ্যা-27