দ্রুত রন্ধনকর্মীদের ভাতা বৃদ্ধি করতে হবে
Allowance of cooks

শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও তার পরিচিতা অর্পিতা মুখোপাধ্যায় গ্রেপ্তার। অর্পিতার কাছ থেকে উদ্ধার ২২ কোটি টাকা। বিপরীতে স্কুলের রন্ধনকর্মীরা মাসে ১৫০০ টাকা সাম্মানিকে কাজ করে চলেছেন। বেশ কয়েকটি দৈনিকে মিড ডে মিল কর্মীদের দুরবস্থা নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

বেশ কয়েক বছর পর সিটু রন্ধনকর্মীদের সাম্মানিক ভাতা নিয়ে মুখ খুলেছে। খবরে প্রকাশিত হয়েছে সিটু অনুমোদিত ‘পশ্চিমবঙ্গ মিড ডে মিল কর্মী ইউনিয়নের’ সাধারণ সম্পাদিকা মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় রন্ধনকর্মীদের দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, বর্তমানে রন্ধনকর্মীরা মাসে সাম্মানিক ভাতা হিসাবে মাত্র ১৫০০ টাকা পান। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যরা যেখানে রন্ধনকর্মীর কাজ করেন সেখানে এই ১৫০০ টাকা ভাগ হয়ে গিয়ে মাসে এক এক জন রন্ধনকর্মী পাচ্ছেন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। সিটু নেতৃত্বের বিলম্বিত বোধোদয় ও বক্তব্যকে স্বাগত জানাচ্ছি। রন্ধনকর্মীদের কেন এই দুরবস্থা? জানতে হলে একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক।

‘মিড ডে মিল’ কেন্দ্রীয় সরকারের ‘জাতীয় পুষ্টি সহায়তা প্রকল্প’-র অধীনে ১৯৯৫ সালে চালু হয়। সেই সময় রান্না করা খাবার দেওয়ার পরিববর্তেবেশির ভাগ রাজ্যে শিশুদের মাথা পিছু মাসে তিন কেজি চাল ও তিন কেজি গম দেওয়া হত। ২০০১ সালে পিইউসিএল-এর মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট রান্না করা খাবার দেওয়ার নির্দেশ দেয়। পশ্চিমবঙ্গে আরও অনেক পরে মিড ডে মিল চালু হয়। তাও আবার ২০০৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে।

তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার আর্থিকভাবে ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা মহিলাদের স্বনির্ভর করে তোলার লক্ষ্যে গ্রাম ও শহরে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তোলে। কিছুদিন চলার পর দেখা গেল এই গোষ্ঠীগুলো নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না, এমনকি এই গোষ্ঠীগুলোর তৈরি পণ্যের বিপণনের ব্যবস্থাও করা হল না। ইতিমধ্যে সারা দেশে মিড ডে মিল প্রকল্প চালু হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর হাজার হাজার মহিলাকে মিড ডে মিল প্রকল্পে ঢুকিয়ে দিল। ফল দাঁড়াল প্রয়োজনের বেশি মহিলা স্কুলে রান্নার কাজে যুক্ত হলেন। এবং মাসের সাম্মানিক টাকা বহুর মধ্যে ভাগ হয়ে গেল। এই সব মহিলাকর্মীদের কাজে নিয়োগের জন্য কোনো নিয়োগপত্রও দেওয়া হল না। গ্রুপের নামেই কাজ চলতে থাকল। অন্য কোনো রাজ্যে এই নিয়ম চালু নেই। এই অনিয়মের জন্য সিটু পরিচালিত ‘পশ্চিমবঙ্গ মিড ডে মিল কর্মী ইউনিয়ন’ নেতৃত্বের আত্মসমালোচনা করা উচিত। বামফ্রন্ট সরকারের সেই সময়কার ভুল সিদ্ধান্তের ফলে হাজার হাজার রন্ধনকর্মীর জীবিকা অনিশ্চিয়তার মধ্যে চলে গেছে। রন্ধনকর্মীদের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমান রাজ্য সরকার এই নিয়ম পরিবত্তর্নের কোনও সদিচ্ছা দেখাচ্ছে না। এরা ধরে নিয়েছেন ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প দিয়েই শ্রমজীবী মহিলাদের ক্ষোভ সামলে নেবেন।

রাজ্য রাজনীতি পরিবর্তনের পর থেকে রাজ্যে বেশ কয়েকটি মিড ডে মিল কর্মী ইউনিয়ন গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত ‘পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধনকর্মী (মিড ডে মিল) ইউনিয়ন’ অন্যতম। যা রাজ্য শ্রম দপ্তরে নাম নথীভুক্ত (রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার ২৬৪২৭) হয়ে আছে। রন্ধনকর্মী ইউনিয়ন ২০১৭ সাল থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে সাম্মানিক ভাতা বৃদ্ধি সহ বিভিন্ন দাবি সম্বলিত দাবিপত্র পেশ করেছে। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন মিড ডে মিল কাজকে ১০০ দিনের কাজের সাথে যুক্ত করবেন। কর্মীরা আশ্বস্ত হলেন। হয়তো বা কিছু রোজগার বাড়বে। কিন্তু ঘোষণাই সার। বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য কোন অর্থ বরাদ্দ হল না। গত ৭-৮ জুন কয়েক হাজার রন্ধনকর্মী ধর্মতলায় বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন। তারা শিক্ষা দপ্তরে স্মারকলিপি জমা দিলেন। দাবি জানালেন – (১)  শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি, (২) ন্যূনতম মজুরি, (৩) ন্যূনতম পেনশন ৬০০০ টাকা, (৪) ১২ মাসের বেতন, (৫) বোনাস, (৬) চিকিৎসা বীমা, (৭) ১৮০ দিনের মাতৃত্বকালীন ছুটি, (৮) জিরো ব্যালেন্সের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা, (৯) বেসরকারিকরণ ও এনজিও-দের হাতে প্রকল্প দেওয়া চলবে না, (১০) ছাত্রদের মাথাপিছু বরাদ্দ ন্যূনতম ১০ টাকা করা।

এই প্রকল্পে আর্থিক দায়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের অনুপাত ছিল ৭৫:২৫। বর্তমানে তা ৬০:৪০ হয়েছে। এইভাবে মোদী সরকার ক্রমশ মিড ডে মিল থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। ৪৫ ও ৪৬তম শ্রম সম্মেলনের সুপারিশ হল, তবু রন্ধনকর্মীদের শ্রমিকের মর্যদা, মজুরি বৃদ্ধি, সামাজিক সুরক্ষার ইত্যাদি বিষয়গুলো কার্যকর করা হল না। এখন তো মিড ডে মিলের নামই পাল্টে দিয়েছে। ‘পি এম পোষণ’ নতুন নামকরণ হয়েছে।

প্রায় দুই দশক রাজ্যের ২ লক্ষ গরিব ঘরের মহিলা যারা বেশিরভাগ তপশিলিজাতি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ, নামমাত্র সাম্মানিকে কাজ করে চলেছেন। বেশ কয়েকটি রাজ্যের রাজ্য সরকার গণ শিক্ষা প্রসারের দায় থেকে রাজ্যের তহবিল থেকে অতিরিক্ত সাম্মানিক দিচ্ছে। যেমন কেরল-৭৬০০, পুদুচেরী-৬৪৫৮, অন্ধ্রপ্রদেশ-৩০০০, মহারাষ্ট্র-৩০০০, ওড়িশা- ৩০০০, ঝাড়খণ্ড-২০০০, বিহার-১৬৫০, পশ্চিমবঙ্গ -১৫০০। পশ্চিমবঙ্গের সাম্মানিক ভাতার হার সবচেয়ে কম। রন্ধনকর্মীরা অতি সামান্য ভাতায় হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে চলেছেন। নিজেরা অর্ধভুক্ত অবস্থায় শিশুদের পুষ্টির জন্যে কাজ করে চলেছেন। এই সামান্য টাকাও প্রতিমাসে ঠিক সময় কর্মীরা হাতে পাননা। আর্থিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা মহিলারা কঠিন পরিস্থিতিতে মিড ডে মিল প্রকল্পে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। রন্ধনকর্মীদের পশ্চিমবঙ্গে সাম্মানিক দেশের মধ্যে নীচের দিকে, শিক্ষা দপ্তরের দুর্নীতি আকাশ ছোঁয়া। অবিলম্বে মিড ডে মিল কর্মীদের সাম্মানিক ভাতা বৃদ্ধি করুন।

- নবেন্দু দাশগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-29