সিটের আনিস-রিপোর্ট প্রশ্নাতীত নয়
Anis-Report of SIT

আনিস খানের মৃত্যুরহস্যের যে রিপোর্ট রাজ্যের বিশেষ তদন্তকারী সংস্থা (সিট) পেশ করেছে তা আশ্বস্ত করার পরিবর্তেবেশকিছু গুরুতর অসঙ্গতি ও প্রশ্নের জবাব চাইতে বাধ্য করছে। উচ্চ আদালতের আদেশে নিযুক্ত সিটের তদন্ত রিপোর্টের বিস্তারিত অপ্রকাশিত। তবে যতটুকু যা সংবাদ জগতে প্রকাশ হয়েছে তার ভিত্তিতে কিছু কথা তুলতেই হয়। সিট একশো পৃষ্ঠার দীর্ঘরিপোর্ট পেশ করেছে। কিন্তু তার মূল মূল বক্তব্যের একটির সাথে অপরটির সাযুজ্য নেই। অভিযুক্ত করার ফৌজধারী ধরন খতিয়ে দেখা দিয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু করা যায়। আনিসের বাড়ি গভীর রাতে হানা দেওয়ার দায়ে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশের পাঁচজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাতে আছেন থানার ওসি, একজন এএসআই, হোমগার্ড, দুই সিভিক পুলিশ। কিন্তু হোমগার্ড ও সিভিক পুলিশদুজনের তুলনায় ওসি ও এএসআইয়ের বিরুদ্ধে ধারা লাগু করা হয়েছে কম। আর যা সব ধারা লাগু করা হয়েছে তাতে দৃষ্টান্তমূলক কঠিন শাস্তির সংস্থান নেই, বরং সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে অভিযুক্তরা বেকসুর খালাস পেয়ে যেতে পারে। বলা হয়েছে, অভিযান চালানো হয়েছিল পরিকল্পনা করেই, কিন্তু কোন লিখিত নির্দেশ ছিলনা। অর্থাৎ পুলিশ কোন তথ্যপ্রমাণ রাখতে চায়নি, বেআইনি অভিযান চালায়। সেইমতো অভিযোগ আনা হয়েছে কি? যাকে ধরতে এতো উঠেপড়ে লাগা তার দোষটা কী ছিল? তিনি তো কোন ‘ফেরার’ ‘সন্ত্রাসবাদী’ ছিলেন না, নির্দোষ ছিলেন। হ্যাঁ, পাঁচ রকমের প্রতিবাদে লড়াকু ছিলেন। তাহলে তাঁকে ধরতে পুলিশী হানার দরকার হয়েছিল কেন? গভীর রাতে পুলিশী হানার পরিকল্পনা করা হয়েছিল কেন? পরোয়ানা ইস্যু না করে, বাড়িতে ঢোকার আগে প্রতিবেশিদের না জানিয়ে, কোনও সাক্ষীসাবুদ না করিয়ে অভিযান চালানোর গোপন উদ্দেশ্য কি ছিল? বাড়িতে জবরদস্তি ঢুকে যেরকম মারমুখী তান্ডব চালানো হয় তাতে কি সিটের এটা দাবি করা সাজে যে, আনিসের মৃত্যুর জন্য দায়ি পুলিশের ‘গাফিলতি’ মাত্র! সিট বলেছে, পুলিশ খুন করতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়নি, আনিস ধেয়ে আসা পুলিশের ভয়ে তেতলা থেকে লাফ দিয়ে পালাতে গিয়ে নিচে পড়ে মারা যান! তবে এই মন্তব্য অবশ্য করেছে যে, প্রচন্ড রক্তাক্ত ও প্রায় নিথর হয়ে থাকা আনিসকে বাঁচানোর কোনও চেষ্টা পুলিশ করেনি — তাই আনিসের মৃত্যুর পেছনে খুন নয়, পুলিশের ‘গাফিলতি’কেই দায়ি করেছে সিট। এখন তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় ‘গাফিলতি’ই কারণ, তবু প্রশ্ন হল, এই গাফিলতি ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত? ‘অনিচ্ছাকৃত’ বললে গোটা পুলিশী অপারেশনের গুরুতর ধরণকে লঘু করে দেখা হয়। আর, ‘ইচ্ছাকৃত’ সাব্যস্ত করলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া বা ভীতসন্ত্রস্ত করে মরণঝাঁপ দিতে বাধ্য করার সন্দেহ নাকচ করে দেওয়া যায়না। তাছাড়া সিট যদিও অভিযুক্ত করেছে ‘ষড়যন্ত্রমূলক অপরাধের’ ধারায়, তবে এটাও নিঃসংশয় করতে পারেনি যে কোন বিশেষ ষড়যন্ত্রমূলক উদ্দেশ্য কাজ করেছে? ক্ষমতার প্রাবল্যে মত্ত পুলিশ অনেক সময় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনেক অতি অপরাধ করে থাকে। তবে আনিস মৃত্যুকান্ড যেভাবে ঘটেছে সেটা স্রেফ একান্তই থানার পুলিশের বাড়াবাড়ির ফল বলে মেনে নেওয়া মুশকিল। ধৃত সিভিক পুলিশ ও হোমগার্ডরা প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন — তাঁদের পরিকল্পনা করে ফাঁসানো হয়েছে। এই দাবির সারবত্তা সিট খুঁজে দেখেছে? নাকি অবান্তর মনে করেছে! স্থানীয় থানা ও শাসকদল টিএমসি’র কোনও গোপন আঁতাত, আরও ওপরতলার যোগসাজশ ছিল কিনা — সেসব অনুসন্ধান আদৌ করা হয়েছে? আনিস মৃত্যুকান্ডের অস্বাভাবিকতার পেছনে নিশ্চিত প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ঘটনাবহুল গরম হাওয়া ছিল। বামপন্থায় বিশ্বাসী এই ছাত্রনেতা সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংগ্রাম-সমাবেশে সবসময় থাকতেন নির্ভীক। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ্য সরকারের প্রচ্ছন্ন মদতে কর্পোরেট অনুপ্রবেশ কিংবা তাঁদের গ্রামীণ বসবাসের এলাকায় টিএমসি’র দাপটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কারণে তিনি চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন কিনা। তাঁর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ খুঁজে পেতে হলে উপরোক্ত সামগ্রিক প্রেক্ষিতে তদন্ত করা প্রয়োজন। ফেসবুকে কিছু তথাকথিত মন্তব্যের জেরে পুলিশী হানার সাফাই গাওয়া স্রেফ এক অজুহাত মাত্র। এবিষয়ে সিটের বক্তব্য অস্পষ্ট।

এরাজ্যে প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই সঙ্গত গণতন্ত্র ও ন্যায় মেলে না। প্রায়শই অভিযোগ ওঠে, আইনের শাসন নয় — চলছে শাসকের ‘আইন’, তার নির্দিষ্ট রূপ হল শাসক তৃণমূলের দলতন্ত্র-দমনতন্ত্র, এককথায় — অপশাসন। এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থাকে, প্রশাসনকে, প্রভাবিত করার অপচেষ্টা চলে আদালতের বিচারব্যবস্থাকেও। বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি গ্রাহ্য হয় না। এই পরিস্থিতিতে, তাই আনিসের মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে সিটের তদন্ত রিপোর্ট প্রশ্নাতীত গণ্য হতে পারে না।

খণ্ড-29
সংখ্যা-28