ইলেক্টোরাল বণ্ড: এক অস্বচ্ছ প্রকল্প অবিলম্বে বাতিল করতে হবে
Electoral Bond

মোদী সরকারের চালু করা ইলেক্টোরাল বণ্ড প্রকল্প সচল হওয়ার পর থেকেই বিরোধিতার মুখে পড়ে। এই প্রকল্প বাতিলের আর্জি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জমা হয়, এবং কোন দল নির্বাচনী প্রকল্পের মাধ্যমে কত টাকা পেয়েছে তা জানিয়ে সুপ্রিম কোর্ট মুখবন্ধ খামে নির্বাচন কমিশনকে রিপোর্ট দিতে বলে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন দলের কাছে চিঠি পাঠায় এবং ২০২০ সালে ১০৫টা মুখবন্ধ খাম সুপ্রিম কোর্টের কাছে জমা দেয়। সম্প্রতি রিপোটার্স কালেক্টিভ সংস্থার তথ্য সন্ধানি সাংবাদিকরা ঐ ১০৫টা দলকে খুঁজে বার করে এবং নির্বাচন কমিশনের কাছে তারা কি তথ্য দিয়েছে সে সম্পর্কে অবগত হয়। ফলে সুপ্রিম কোর্টের কাছে জমা পড়া মুখবন্ধ খামের মধ্যে কী তথ্য রয়েছে তা জানা সম্ভব হয়। সেই তথ্য সম্পর্কে আলোচনার আগে ইলেক্টোরাল বা নির্বাচনী বণ্ড প্রকল্প কী অতি সম্পর্কেতা বিধৃত করা যাক।

নির্বাচনী বণ্ড প্রকল্প অনুসারে কোনো কোম্পানি বা কোনো ব্যক্তি পছন্দের রাজনৈতিক দল যত ইচ্ছে টাকা দিতে পারবে এবং সেই দাতার পরিচয় গোপন থাকবে, কেউ জানতে পারবে না। ২০১৭র আগের প্রথা থেকে এর ফারাক এই যে, আগে কোনো কোম্পানি কোনো দলকে টাকা দিলে তা তাদের ব্যালান্স শিটে নথিবদ্ধ করতে হত এবং জনগণও জানতে পারত কোন দল ঐ কোম্পানির কাছ থেকে কত টাকা পেয়েছে। কিন্তু ২০১৭-র পর জনগণের আর জানারঅধিকার রইল না – আদানি-আম্বানি-টাটা ও অন্যান্য বিপুল পুঁজির অধিকারীরা বিজেপি ও অন্যান্য দলকে কত টাকা দিয়েছে, এবং সেই টাকার সঙ্গে তাদের প্রাপ্ত ব্যবসায়িক সুবিধার কোনো যোগ আছে কী না।

রিপোটার্স কালেক্টিভের তদন্ত থেকে জানা গেছে, যে ১০৫টা দলের তথ্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে নির্বাচন কমিশন জমা দেয়, তার মধ্যে ছিল ৭টা জাতীয় দল, ৩টে জাতীয় দলের রাজ্য শাখা, ২০টা নথিবদ্ধ স্বীকৃত রাজ্য দল এবং ৭৫টা নথিবদ্ধ হলেও অস্বীকৃত দল (যাদের মধ্যে ‘হাম আউর আপ পার্টি’, ‘আসলি দেশি পার্টি’, ‘সবসে বড়া পার্টি’র মতো দলের নাম রয়েছে)। নির্বাচন কমিশন এই ১০৫ দলের রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর ধারণা বুঝিবা হল এই যে, যত নির্বাচনী বণ্ড বিক্রি হয়েছে তা ১০৫টা দলের মধ্যেই ভাগ হয়েছে এবং বণ্ড প্রকল্প অত অগণতান্ত্রিক নয়। বাস্তবে কিন্তু দেখা গেল, মাত্র ১৭টা দল নির্বাচনী বণ্ড মারফত টাকা পেয়েছে, আর যাদের সঙ্গে বণ্ডের টাকার কোনো যোগ ছিল না, তাদের রিপোর্টও নির্বাচন কমিশন জমা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের কাছে। যারা এসবিআই-এর কাছ থেকে বণ্ড কিনেছে, তাদের সিংহ ভাগের আনুকূল্য কোন দল পেয়েছে? রিপোটার্স কালেক্টিভের শ্রী গিরিশ জালিহাল তাঁদের বিবৃতিতে জানিয়েছেন, “যে তিন আর্থিক বছরের বিশ্লেষণ আমরা করেছি তার থেকে দেখা যাচ্ছে, ইলেক্টোরাল বণ্ডের মাধ্যমে প্রদত্ত সমস্ত অর্থের বিপুল পরিমাণ, একেবারে ৬৭.৮ শতাংশ পেয়েছে বিজেপি – ঐ তিন বছরে বিক্রি হওয়া মোট ৬২০১ কোটির মধ্যে ৪২১৫ কোটি।”

রিপোটার্স কালেক্টিভ তাদের রিপোর্টে আরও জানিয়েছে – দাতাদের পরিচিতি সবার কাছেই গোপন থাকে, শাসক দল ছাড়া। যেহেতু এসবিআই এই বণ্ড বিক্রি করে এবং তার মাধ্যমেই টাকা রাজনৈতিক দলের তহবিলে যায়, এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকই যেহেতু এসবিআইকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাই কেন্দ্র সরকার ও শাসক দলের পক্ষে দাতাদের পরিচয় জানা সম্ভব হয়। কাজেই, শাসক দল বাদে অন্য কোনো দল অধিক অর্থ পেলে সহজেই তা কেন্দ্র সরকারের নজরে চলে আসে। এবং সেই দলের মদত দাতাকে বুঝে ওঠা কেন্দ্র সরকারের পক্ষে দুরূহ হয় না।

নরেন্দ্র মোদীরা এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছিলেন– এর লক্ষ্য হল “ভারতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অর্থ প্রদান ব্যবস্থাকে পরিশুদ্ধ করা।” নরেন্দ্র মোদীদের গ্ৰহণ করা এক একটা পদক্ষেপের পিছনে ঘোষিত লক্ষ্যের ফলের বিপরীতটা যেমন বাস্তবে ঘটে (নোট বন্দির ঘোষিত লক্ষ্য কালো টাকা ধ্বংসের কথা স্মরণ করুন), বণ্ড প্রকল্পের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অর্থের দৌরাত্ম্যকে নিয়ন্ত্রিত করার পরিবর্তে নির্বাচনী বণ্ড প্রকল্প রাজনৈতিক দলের কাছে কালো ও হিসাব বহির্ভূত টাকার গমনকে অবাধ করে তুলল, বণ্ড প্রকল্পের কল্যাণে শাসক দলের তহবিল উপচিয়ে উঠল।

এই প্রকল্পের পরিকল্পনার পিছনে গূঢ় অভিপ্রায় যে ছিল, এত দিনে তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ আর নেই। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ফিনান্স বিল হিসাবে এই প্রকল্পকে পাশ করান এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও নির্বাচন কমিশন এই প্রকল্প রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অর্থ প্রদান প্রক্রিয়াকে অস্বচ্ছ করবে বলে তার বিরোধিতা করলেও সেই বিরোধিতাকে অবজ্ঞা করা হয়। সরকার এ নিয়ে সংসদে এমনকি মিথ্যাচারও করে। তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ নাদিমূল হক সংসদে জানতে চেয়েছিলেন, নির্বাচন কমিশন এই প্রকল্প সম্পর্কে কোনো আপত্তি জানিয়েছে কিনা। অর্থ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী পন রাধাকৃষ্ণাণ তখন বলেছিলেন, “ইলেক্টোরাল বিয়ারার বণ্ড সম্পর্কে কোনো উদ্বেগ নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে জানায়নি।” অথচ, নির্বাচন কমিশন ২০১৭ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের আইন ও বিচার মন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল, অর্থ প্রদানে স্বচ্ছতার কথা বিবেচনা করলে এই বণ্ড প্রকল্প হল একটা পশ্চাৎমুখী পদক্ষেপ। নির্বাচন কমিশন ২০১৯-এর মার্চ মাসে এই প্রকল্প প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আর্জিও জানায়। তার কাছে জমা পড়া মুখবন্ধ খামগুলো খুলে দেখার অবসর সুপ্রিম কোর্ট আজ পর্যন্ত পেল না। আর বিজেপির তহবিলও ফুলে কলা গাছ কেন, বট-অশ্বথ হয়ে উঠতে থাকল। এই প্রকল্পকে বাতিল করতে হবে, কেননা, কোন কোম্পানি কোন দলকে কত টাকা দিল তা জানার অধিকার সাধারণ জনগণের আছে, এবং সেই অধিকার দিতে হবে।

- লিবারেশন জুলাই ২০২২ থেকে

খণ্ড-29
সংখ্যা-28