শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে ভারত যা শিখতে পারে
Sri Lankan Crisis

৯ জুলাই, ২০২২ দিনটি শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে লেখা থাকবে এক চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট ও বিস্ফোরক জনরোষের মুখে এক অত্যাচারী শাসকের দেশ ছেড়ে পালানোর দিন হিসেবে। হাজার হাজার সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ দখল করে নেয়। তারা রাষ্ট্রপতি ভবনের সুইমিং পুল থেকে রান্নাঘর, বেডরুম থেকে মিউজিক হল মায় পুরো ভবনটাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এইসব ছবি আর ভিডিও ভাইরাল হয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। গোতাবায়া রাজাপক্ষে সিংহাসন বাঁচাতে খুব চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংঘে সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের চেষ্টা করছেন।

শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যত কী হতে চলেছে তা এই মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। আমরা কেবল আশা করতে পারি যে, দ্বীপ রাষ্ট্রটি দ্রুত এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে, এবং আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর কাছে দাবি করতে পারি যে পূর্বতন সরকারের বৈদেশিক ঋণের বোঝা থেকে শ্রীলঙ্কাকে মুক্তি দিয়ে দেশটির জনগণের পাশে দাঁড়ানো হোক। শ্রীলঙ্কার মানুষের প্রতি আমরা এই শুভকামনা ব্যক্ত করি যে, একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটুক যেখানে বর্তমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির জন্যে জন্য দায়ী নীতিগুলির পরিবর্তন হবে এবং শ্রীলঙ্কার সাধারণ জনগণের চাহিদা ও অধিকারকে সমস্ত পরিকল্পনার কেন্দ্রে রেখে এক নতুন অভিমুখে তাঁরা এগিয়ে যাবেন। শ্রীলঙ্কার সামাজিক বিন্যাস বৈচিত্র্যময়, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতিতে সিংহলী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের এক নগ্ন নির্লজ্জ তীব্র আগ্রাসী প্রাধান্য দেখা গেছে। শ্রীলঙ্কায় গণতন্ত্র ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে গেলে এই আগ্রাসী অরাজক জাতিয়তাবাদ থেকে সরে এসে সকলকে নিয়ে সকলের জন্য এক বহুত্ববাদী পরিবেশ গড়ে তোলা অপরিহার্য কর্তব্য।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি অবশ্যই জটপাকানো এবং বিশৃঙ্খল, ভবিষ্যতও হয়তো অনিশ্চিত, কিন্তু শ্রীলঙ্কা কীভাবে কী কী কারণে এই সঙ্কটে গিয়ে পড়ল সেদিকে আমাদের নজর দেওয়া দরকার। শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে ভারতের বেশিরভাগ সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের বেশিরভাগ মন্তব্যেই বর্তমান বিপর্যয়ের জন্য রাজাপক্ষে পরিবার এবং তাদের ‘পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি’কে দায়ি করেছে। শ্রীলঙ্কার জনগণের ক্ষোভও ফেটে পড়েছে মূলত এই রাজাপক্ষে পরিবারের ওপর। এটাও ঘটনা যে, আগের যের কোনো শাসক বংশই রাজাপক্ষের মতো এতো শক্তিশালী এবং এতটা প্রকট রূপে স্বজনপোষক ও লুণ্ঠনকারী ছিল না। শুরুর দিকে, যখন মাহিন্দা রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তখন গোতাবায়া ছিল তাঁর প্রতিরক্ষা সচিব। এবং তখনই দুই ভাই মিলে এলটিটিই-কে চূর্ণ করতে একটি বিষাক্ত যুদ্ধের অবতারণা করেছিলেন। তাঁদের ছোট ভাই বাসিল ছিলেন অর্থনৈতিক উন্নয়ন মন্ত্রকের দায়িত্বে এবং বড় ভাই চমল তখন স্পিকার। একটা কথা চালু আছে যে, তখন চল্লিশ জনের মতো রাজাপক্ষে পদবীধারী কোনো না কোনো সরকারি দফতর থেকে সমগ্র শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। মাহিন্দা ২০১৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হেরে গেলেও গোতাবায়া ২০১৯ সালে রাষ্ট্রপতি হয়ে যান এবং মাহিন্দাকে তাঁর প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন।

চরম ক্ষমতার সাথে এসেছে চরম দুর্নীতি, চূড়ান্ত অব্যবস্থা আর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন। দ্রুত হারে বৃদ্ধির নামে, ২০১৯ সালের শেষে রাজাপক্ষে সরকার ধনীদের জন্য ব্যাপক হারে কর ছাড় দেয় এবং ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনে, পাশাপাশি আরো বেশ কয়েকটি কর বাতিল করে। কর প্রদানকারী নাগরিকের সংখ্যা ২০২০ সালের শুরুর দিকে প্রায় ১৫ লক্ষ থেকে কমে ২০২১ সালে ৫ লক্ষেরও নিচে নেমে যায়। এছাড়া কোভিড অতিমারীর কারণে শ্রীলংকার পর্যটন শিল্প এবং প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের রেমিট্যান্স বাবদ পাঠানো অর্থথেকে শ্রীলঙ্কার আয় হ্রাস পায়। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার ৮৮০ কোটি ডলার থেকে নেমে আসে ২৫০ কোটি ডলারে। অতিমারী কিছুটা কমতে না কমতেই আবার ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের ফলে অত্যাবশকীয় আমদানির সরবরাহ শৃঙ্খল সাংঘাতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রুতই শ্রীলঙ্কা গগনচুম্বী দ্রব্যমূল্য এবং খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের তীব্র সংকটের মধ্যে পড়ে। গণ বিক্ষোভ শুরু হয়, গোতাবায়া ২ এপ্রিল একটি সার্বজনীন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং এর তিন মাসের মধ্যে শ্রীলঙ্কা অভূতপূর্ব এক গণ-অভ্যুত্থানের মুখোমুখী হয়।

এখন প্রশ্ন হল রাজাপক্ষেরা কীভাবে এত শক্তিশালী হয়ে উঠলেন এবং কী করে এত দীর্ঘ সময় ধরে এই স্বেচ্ছাচারী অপশাসন চালিয়ে গেলেন? এখানেই আমাদের শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ফিরে দেখা দরকার। নৃশংস সেনা অভিযান চালিয়ে এলটিটিইকে নিশ্চিহ্ন করার পর, রাজাপক্ষেরা নিজেদের শ্রীলঙ্কার ত্রাণকর্তা হিসেবে তুলে ধরেন। মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে একজন পৌরাণিক নায়ক, একজন অবতার হিসেবে জনগণের কাছে তুলে ধরা হয়। সরকারি নিয়ন্ত্রণকে সুসংবদ্ধ ও দৃঢ় করতে, নবগঠিত সিংহলী বৌদ্ধ জঙ্গি সংগঠন বোদু বালা সেনাকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে তাদের হাতে যথেচ্ছ ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়। এলটিটিই ধ্বংস হওয়ার সাথে সাথে, শ্রীলঙ্কার মুসলমানরা আগ্রাসী সিংহলী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের আক্রমণের পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হয়ে যায়। গত দুই দশকে শ্রীলঙ্কায় ঘটে যাওয়া ঘটনাক্রম এবং তার গতিপথকে ভারতীয় রাজনীতির গতিপথের প্রতিবিম্ব মনে হবে।

মাহিন্দা রাজাপক্ষে অধিকতম দুইমেয়াদ পাল্টে দিয়ে রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ আরো বৃদ্ধির জন্যে সংবিধান সংশোধন করে আরো ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা করতেই মানুষের মনে বিপদঘন্টা বেজে ওঠে এবং ২০১৫ সালের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। কিন্তু ২০১৯ সালে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঠিক আগে যখন একটি শক্তিশালী সরকারের দাবিতে দেশজুড়ে বিতর্ক চলছে তখন, ইস্টার বোমা হামলা আবার রাজাপক্ষদের ক্ষমতার অলিন্দে ফিরিয়ে আনে। যেহেতু বিরোধীরা ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রপতি পদের পুরোনো নিয়ম ‘দুই-মেয়াদ’কে আবার ফিরিয়ে এনেছে তাই মাহিন্দা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। তখন তাঁর ভাই গোতাবায়া, যিনি তখন পর্যন্ত প্রধানত সামরিক ভূমিকা পালন করে আসছিলেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য তার আমেরিকান নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন।

তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং অব্যবস্থা এই অতি প্রবল শ্রীলঙ্কা সরকারকে এক আগ্রাসী সিংহলী বৌদ্ধ জাতীয়তাদের তরঙ্গ শীর্ষথেকে এমন এক নির্বোধ সত্তায় নামিয়ে এনেছে যার বোঝা শ্রীলঙ্কা আর বইতে পারছে না। জনগণের এই বিস্ফোরক ক্ষোভের পটভূমি তৈরী করেছে নির্লজ্জ স্বজনপোষণ, স্বৈরাচারী শাসন এবং পুরোদস্তুর অর্থনৈতিক অব্যবস্থা যেগুলো রাজাপক্ষের শাসনের বৈশিষ্ট্য। এগুলো ততক্ষণ কোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি যতক্ষণ পর্যন্ত না সমগ্র সংকট এমন পর্যায়ে গেছে যে, জনগণ বৌদ্ধআধিপত্যবাদী সিংহলী জাতীয়তাবাদের ফাঁপা উন্মাদনা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।

নির্দিষ্টভাবে এখানেই শ্রীলঙ্কার কাছ থেকে ভারতের শিক্ষা নেওয়া উচিত। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের মতো মাপকাঠিতে ভারত শ্রীলঙ্কার থেকে অনেক খারাপ অবস্থায় থাকলেও বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার বা বুনিয়াদী অর্থনৈতিক শক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত তুলনামূলকভাবে অনেক শক্তিশালী। তবু, ভারতীয় অর্থনীতিও কিন্তু মোদির শাসনের বছরগুলিতে একই ধরনের অব্যবস্থা এবং স্বৈরাচারী পদক্ষেপের শিকার হয়ে চলেছে অর্থনীতির ভিত নাড়িয়ে দেওয়া নোটবন্দী এবং অপরিপক্ক জিএসটি নীতি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রগুলির ধবংসসাধন এবং কিছু বাছাই হাতে সরকারি সম্পদ হস্তান্তর ইত্যাদির মাধ্যমে। আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য, সর্বকালের সর্বোচ্চ বেকারত্বর সাথে আন্তর্জাতিক মুদ্রা-বাজারে রুপির মূল্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। তা সত্বেও অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার বিষয়ে আলোচনা প্রায় নেই, সমগ্র নজর থাকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রচার এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টার দিকে।

আমাদের ভুলে যাওয়া চলবে না যে মাত্র দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কার মানব উন্নয়ন সূচক ছিল ১৮৯টি দেশের মধ্যে ৭১; যেখানে ভারত ছিল ১৩১তম স্থানে৷ শ্রীলঙ্কার ঘটনা সমগ্র বিশ্বের সরকারগুলির জন্য এই হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, স্যাঙাতি পুঁজি ও কর্পোরেট লুণ্ঠনকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও স্বৈরাচারী শাসনের মাধ্যমে আড়াল করে চিরকাল শাসন চালিয়ে যাওয়া যায় না।

এম এল আপডেট, সম্পাদকীয় ১২-১৮ জুলাই ২০২২

খণ্ড-29
সংখ্যা-28