সম্পাদকীয়
অন্ধকারের অতলে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা
state is in the dark

তিনি প্রবল প্রতাপান্বিত সর্বময়ী নেতৃ! রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। নবাব-বাদশা-রাজাধিরাজদের মতোই মুখ ফস্কে কোন কথা বেরোলে সেটাই হয়ে যায় আইন। পবিত্র বিধি নিয়ম। তার পরিণতি যাই হোক না কেন। আপাদমস্তক দুর্নীতির দগদগে পচা ঘা থেকে অবিরাম রক্তক্ষরণ যে রাজনৈতিক দলের চরিত্রলক্ষণ, তারই মাথায় স্বঘোষিত ‘সততার প্রতীক’এর অবস্থান। এরকম কদর্যতম প্রবঞ্চনা আর কিছুই হতে পারে না। রাজ্যজুড়ে শিক্ষক নিয়োগের যে পঙ্কিল দুর্নীতি বছরের পর বছর ধরে চলে আসছিল, যে কল্পনাতীত অবৈধ অর্থের লেনদেনের সাথে যুক্ত ছিল তাবড় তাবড় নেতা-মন্ত্রী-শিক্ষা দপ্তরের উচ্চপদস্থ আমলা, যে নিপুণ মেশিনারির মাধ্যমে পরিচালিত হতো দুর্নীতির এই বহু শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত বন্দোবস্ত, প্রায় সমগ্র শিক্ষা দপ্তর যখন আজ কারান্তরালে — এতো বড় বহরের দুর্নীতিকে মুখ্যমন্ত্রী স্রেফ “কাজ করতে গিয়ে ভুল করা” বলে অমার্জনীয় একটি অপরাধকে শুধু লঘু নয়, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার এক অমোঘ বার্তা দিলেন তাঁর দলের নেতা কর্মীদের প্রতি। তিনি যেন বোঝাতে চাইলেন দুর্নীতি, তা যত বড় মাপের ও পরিধি জুড়েই হোক না কেন, সকলকে তিনি দেখবেন ‘ক্ষমাসুন্দর চোখে’। তাই “একটা কেষ্টর জায়গায় হাজারটা কেষ্ট”র জন্ম নেওয়ার বার্তার পাশাপাশি, জেল থেকে বেরোনোর দিনে তাকে ‘বীরের সম্মান’ দিয়ে বরণ করার নিদান তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দিয়েছেন।

এই মুখ্যমন্ত্রীই ঘোষণা করলেন, “আমি ক্ষমতায় আসার পর বললাম, সিবিএসই-আইসিএসই’র সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে নম্বর বাড়িয়ে দাও”। তাঁর কথাই আইন। শিক্ষা দপ্তর তাঁর হাতের ক্রিড়নক মাত্র। এ’যেন পড়ুয়াদের হাতে মোয়া মুড়কি তুলে দেওয়া। শিক্ষাক্ষেত্রকে কতটা এলেবেলে মনে করলে এই ধরনের নির্দেশ আসে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের তরফ থেকে। তারই কথায় ও সম্মতিতেই সব চলে, অথচ এতদিন ধরে এতো সুনিপুণ অর্থ লেনদেনের পাট যে শিক্ষা দপ্তরের অধীনে চলতো, তাকে ছোটখাটো ভুল হিসাবে ‘উপেক্ষা’ করে আদতে সেই অপরাধকেই প্রশ্রয় ও মদত দিয়ে গেছেন।

শুধু শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত প্রশ্নে দুর্নীতি নয় — তৃণমূল আমলে আজ ফুটে বেরিয়েছে গোটা রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার হাড় জিরজিরে কঙ্কালসার চেহারাটা। দেউলিয়ে হয়ে গেছে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামো, মারাত্মকভাবে কমেছে শিক্ষক-পড়ুয়ার অনুপাত, ক্ষয়প্রাপ্ত শিক্ষার মান, উধাও স্কুলছুট কমানোর জরুরি পদক্ষেপ ও আরো বেশি সংখ্যক সমাজের পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক বঞ্চিত মানুষদের স্কুলের আঙিনায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা। এ প্রশ্নে মমতা সরকার নিদারুণ ভাবে ব্যর্থ। বেছে নেওয়া যাক একটা মাত্র উদাহরণ। রাজ্যের অন্যতম পশ্চাদপদ জেলা ঝাড়গ্রাম, যা তপশীলি জাতি উপজাতি অধ্যূষিত। মোট ১১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৫৪৮ জনসংখ্যার এই জেলায় তপশীলি জাতি-উপজাতির হার যথাক্রমে ২০.১১ এবং ২৯.৩৭ শতাংশ। এখানকার ‘আধারিশোল প্রাইমারি নয়াগ্রাম’ সার্কেলে মোট স্কুল ৮৩। এরমধ্যে শিক্ষক নেই ১টি স্কুলে, একজন শিক্ষক দিয়ে স্কুল চলছে ৮টি স্কুলে, দু’জন শিক্ষক দিয়ে স্কুল চলছে ৫৯টি স্কুলে! ‘আধারিশোল প্রাইমারি নয়াগ্রাম ১’ সার্কেলে মোট স্কুল ৮৭, যারমধ্যে একজন শিক্ষক দিয়ে স্কুল চলছে ২১টি স্কুলে, দু’জন শিক্ষক দিয়ে স্কুল চলছে ৬০টি স্কুলে। ঝাড়গ্রাম পূর্ব সার্কেলে মোট ৬৪ স্কুলের মধ্যে একজন শিক্ষক রয়েছেন ৪টিতে আর ২ জন রয়েছেন ২৪টিতে। এদিকে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা, তাঁর আমলেই “পশ্চিমবঙ্গে পড়াশুনোর ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন হয়েছে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে”। কিছু স্কুল বিল্ডিং হয়তো বেড়েছে শিক্ষক ছাড়াই, আর এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে এ রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রের ভবিতব্য।

সমস্ত অর্থনীতিবিদ’রা এ বিষয়ে একমত, অতিমারীর ছোবলে ক্ষতবিক্ষত অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা হয়তো ধাপে ধাপে সামাল দিয়ে উঠে দাঁড়াবে, কিন্তু শিক্ষাজগতে যে অপরিসীম ক্ষতি হয়ে গেল, তা আর পূরণ করা যাবে না। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় অধিকাংশ পড়ুয়ারাই আগের পড়া বেমালুম ভুলে গেছে, হারিয়েছে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ। নিয়মিত স্কুলে আসতেও তাদের প্রবল অনীহা। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছাত্রীরাও নিজেদের বক্তব্য গুছিয়ে লিখতে পারছেনা, নিজেদের নামের বানান, সাধারণ যোগ-বিয়োগ, রিডিং — কিছুই সঠিকভাবে করতে পারছেনা। বহু শিক্ষাবিদ এই সংকটের পরিত্রাণ হিসাবে যে ব্রিজ কোর্সের কথা বলেছিলেন, রাজ্য সরকার তা কর্ণপাতও করলনা। এর পাশাপাশি রয়েছে শিক্ষক-পড়ুয়ার অনুপাতের মারাত্মক রকমের ভারসাম্যহীনতা।

দুর্নীতি শিক্ষা ব্যবস্থার দৃশ্যমান এক ভয়ংকর রোগ। যার মূলোৎপাটন করা রীতিমতো কঠিন। যোগ্য কর্মপ্রত্যাশীদের নিয়োগের পাশাপাশি রাজ্যের গোটা শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার সাধনের লক্ষ্যেই বিবেকবান গণতন্ত্রপ্রিয় নাগরিক, বামপন্থীদের এগিয়ে আসতে হবে — অর্থের বিনিময়ে নিজেদের প্রভাবিত বৃত্তে অল্প কিছু জনকে নিয়োগের পাশাপাশি, বিপুল সংখ্যক শিক্ষক পদে নিয়োগ না করে শিক্ষা ব্যবস্থাকেই আজ ঠেলে দেওয়া হয়েছে গভীর অন্ধকারের অতলে।

এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে।

খণ্ড-29
সংখ্যা-44