আজকের দেশব্রতী বিশেষ বৈদ্যুতিন সংখ্যা (২৩ এপ্রিল, ২০২০)
head issue

নির্দিষ্ট একটা হেডিং-এর ওপর ক্লিক করুন (তখন বাকিগুলো দেখাবে না)

edi

 

h1

করোনা থেকে মুক্তির লড়াইয়ে লকডাউন ব্যবস্থা এখনও যা স্থির আছে আরও দিন দশেক চলবে। তারপরে কী দাঁড়াবে তার কোনো আভাস এখনও নেই। প্রধানমন্ত্রী আবার কবে জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর পরবর্তী ভাষণ দেবেন, কী বলবেন তারও কোনো ইঙ্গিত নেই। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের যুগ্মসচিব তথ্য শুনিয়েছিলেন, লকডাউন না করলে সংক্রমণ ১৫ এপ্রিলের মধ্যে পৌঁছে যেত ৮.২ লক্ষে। ঐ বিবৃতির মধ্যে দিয়ে লক ডাউনের প্রশ্নাতীত কার্যকারিতাই কেবল জাহির করতে চাওয়া হয়েছিল। কোনো সমালোচনা কানে তোলা হয়নি। বিপরীতে, সমালোচনায় যারা সোচ্চার তারা এর উপযোগিতার বিরোধী নন, তাদের প্রবল সমালোচনা রয়েছে অপরিকল্পিত বে-দরদী লকডাউন চাপানোর বিরুদ্ধে। ঘটনাপ্রবাহে অজস্র তথ্যপ্রমাণ মিলেছে, এখনও মিলছে, লকডাউন সমাজের ওপরতলার অংশের কাছে না হলেও ব্যাপকতম জনতা, বিশেষত শ্রমজীবী জনতার কাছে চরম নিষ্ঠুরতার কারণ প্রতিপন্ন হয়েছে! কেন্দ্র সংক্রমণের বিপদ এড়ানোয় যাই-ই প্রাথমিক সাফল্য দাবি করে থাকুক, এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে পৌঁছে সংক্রমণ বৃদ্ধির অবস্থা যথেষ্ট দুশ্চিন্তাজনক। ‘দি টাইমস অব ইন্ডিয়া’র এক সমীক্ষা রিপোর্ট বলেছে, দেশব্যাপী সংক্রমণের বৃদ্ধির হার কমলেও, সংক্রমণ বৃদ্ধিই প্রধান প্রবণতা, আর মৃত্যুহারও বাড়ছে। এখনও টেস্টকে প্রত্যাশিত গুণমানে ও ব্যাপকতায় নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে থাকছে ঘাটতি। টেস্ট সেন্টারের সংখ্যা এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত যা ছিল তারপর তার সংখ্যাবৃদ্ধির ব্যাপারে দেশ কোথায় রয়েছে সেই তথ্য পরিসংখ্যান পরিস্কারভাবে জানানো হচ্ছে না। আক্রান্ত হওয়ার তালিকায় সাধারণ মানুষের সাথে সাথে বেড়ে চলেছে এমনকি চিকিৎসারত ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, সাফাই কর্মীদের সংখ্যা। অপ্রতুল ও নিম্নমানের প্রতিরোধক সাজ সরঞ্জামই করোনা মোকাবিলায় ফ্রন্টলাইনে থাকা বাহিনীর সংক্রামিত হয়ে যাওয়ার মূল কারণ।

কেন্দ্রের সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রক বলেছে, দেশের দশটি বড় বড় শহরে লক ডাউননের প্রথম পর্বে গৃহহীন, ভিক্ষুক ও অন্যান্য ফুটপাতবাসী প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষকে খাইয়ে আসা হচ্ছে। কিন্তু একবারও এই পরিসংখ্যান পেশ করতে দেখা গেল না যে দেশব্যাপী ভুখা, নিরাশ্রয়ী, হয়রান হয়ে চলা হাজারে হাজারে পরিযায়ী শ্রমিকদের খাওয়া-পরা-আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে, তাদের ঘরে ফেরানো ও পরিবারকে পরিষেবা দেওয়ার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার কী করেছে! ২৭ মার্চ থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত সমীক্ষার রিপোর্ট ছিল খুবই করুণ। সমীক্ষা করেছিলেন একটি স্বনিয়ন্ত্রিত সংস্থার একদল গবেষক কর্মী। রিপোর্টে প্রকাশ, লক ডাউনে আটকে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রায় ৯৬ শতাংশের কোনো রেশন মেলেনি, আর ৭০ শতাংশ কোনোরকম স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দ্বারা পরিবেশিত রান্না করা খাবারের সন্ধান পায়নি। এফসিআই-এর গুদামে ৭৭ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। তাহলে রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজ্যে রাজ্যে ঘরে ঘরে বা যেখানে যেখানে পরিযায়ী শ্রমিকদের আটকে রাখা হয়েছে সেখানে সরকারি ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহের সুষ্ঠু বন্দোবস্ত করা হবে না কেন। এ প্রসঙ্গে কোনো কথাই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে ছিল না, আজও কেন্দ্রের মুখে টু-শব্দটি শোনা যাচ্ছে না। কেন্দ্র বরং লক ডাউনের ধূয়ো তুলে যারা নিজ ঘরে আছেন তাদের ভুখা-আধা ভুখা গৃহবন্দী করে রাখছে, অন্যদিকে পরিযায়ীদের ঘরে ফেরানোর প্রশ্নে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, আর রিলিফের প্রশ্নে কোনোরকম যুদ্ধকালীন কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ছাড়াই সমস্ত দায়িত্ব চালান করে দিয়েছে রাজ্য সরকার এবং এনজিও-গুলোর ওপর। লকডাউনে আটকে গিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের কী দূর্ভোগ-উৎপীড়ন-বর্বরতার শিকার হতে হয়েছে দিল্লী বা বান্দ্রার রেল স্টেশনের চিত্রাবলী তার দৃশ্যমান খন্ডচিত্র মাত্র। ঘরবন্দীর অনুশাসনের নামে কোথাও যেমন উত্তরপ্রদেশে যোগী সরকারের পুলিশ পিটিয়ে মেরে ফেলেছে খিদের জ্বালায় বিস্কুট কিনতে বের হওয়া মুসলিম তরুণকে, তেমনি কাশ্মীরে কুখ্যাত ইউএপিএ-তে যুবতী মহিলা আলোকচিত্রী সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হল প্রধানমন্ত্রীর প্রদীপ জ্বালানোর কর্মসূচীর সমালোচনা ফেসবুকে পোস্ট করার ‘অপরাধে’! এছাড়া রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন পুরানো মামলা খুঁচিয়ে তুলে সংগ্রামী মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তার বা ছাত্রকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশী তদন্ত অনুমোদন পাচ্ছে, লকডাউন অমান্যের অজুহাত দেখিয়ে শয়ে শয়ে গ্রেপ্তারি অভিযান চলছে। এব্যাপারে রাজ্য সরকারগুলো কিছু কম যাচ্ছে না। রেশনে ‘গরিব কল্যাণ যোজনা’য় খাদ্যশস্য দেওয়ার কেন্দ্রীয় প্যাকেজ ঘোষণা হয় বহু চাপ ওঠার পরে। প্রধানমন্ত্রী ভাষণে রেশন দেওয়ার কথা শোনালেও সপ্তাহ গড়িয়ে যায়, রাজ্যে রাজ্যে বাস্তবে তার যোগান মেলেনি। তবে ‘নীতি আয়োগে’র সিইও রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলগুলোতে কর্তৃস্থানীয়দের চিঠি পাঠান। যাতে সমস্ত দাতব্য ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো এফসিআই গুদাম থেকে ২২ টাকা কিলো চাল ও ২১ টাকা কিলো গম সংগ্রহ করতে পারে। শুধু তাই নয়, জানিয়ে দেয় ত্রাণের জন্য চাল-গম কেনায় কোনও ঊর্দ্ধসীমা থাকছে না। এনজিও সংস্থাগুলোর প্রতি এত দরাজহস্ত হওয়ার পিছনে প্রকৃত কারণ রহস্যপূর্ণ। ঐ সংস্থাগুলোর অধিকাংশের নেপথ্য-পরিচালন ক্ষমতায় রয়েছ বকলমে বিজেপি-আরএসএস নেটওয়ার্ক। বাজেটে টাকা ধরা থাকে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা খাতে, হাজার হাজার কোটি টাকা জমে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে, টাকা জমা পড়ছে উপরন্তু ‘পিএম কেয়ারস ফান্ডে’। তবে অসহায় অবস্থায় থাকা ৬০-৭০ শতাংশ জনতার একাউন্ট পিছু নগদ ৬০-৭০ হাজার কোটি টাকা পাঠানো যাচ্ছে না কেন? দায় এড়াতে সরকার নিয়েছে নীরবতার কৌশল। লকডাউনে আটকে যাওয়া বিদেশীদের এক বড় দলকে বিশেষ বিমানে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পাঠানো হল, এমনকি সড়ক পথে পাকিস্তান সীমান্তে প্রত্যর্পণ করে আসার ব্যবস্থা হল, কিন্তু দেশের মধ্যে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক ও অন্যান্যদের ফেরানোর বন্দোবস্ত হয় না!

খাদ্যের অধিকার, গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক জরুরি অবস্থা।

করোনা পরিস্থিতিতে পশ্চিমবাংলার পরিস্থিতি বেশ অস্থিরতা ও গোলমেলে পাকচক্রের আবর্তে পর্যবসিত হচ্ছে। সময়মতো কথা নেই, বার্তা নেই, কেন্দ্রের প্রতিনিধি দল টেস্ট, লক ডাউন, রেশন ব্যবস্থা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণের নামে যেভাবে ঝটিতি সফরে এলেন, সীমান্তরক্ষী বাহিনী পরিবৃত হয়ে, রাজ্য সরকারকে অগোচরে রেখে, পছন্দমতো পরিদর্শন পরিক্রমায় নেমে পড়লেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার রীতিনীতি লঙ্ঘন করারই সমার্থক। কেন্দ্র সাফাই দিচ্ছে ‘জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলার আইনি ধারা’ মেনেই অভিযানে এসেছে। বাস্তবে ওপর থেকে কর্তৃত্ব ফলানোর অপপ্রয়াস শুরু করেছে, একটা সমান্তরাল গোয়েন্দা অভিযান চালাতে চাইছে। কেন্দ্রের এই ভূমিকা দেখতে চায় একমাত্র রাজ্যপাল এবং বলাবাহুল্য বিজেপি। রাজ্যপালের সাথে ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে সাক্ষাৎ হয়েছে বিজেপির রাজ্য প্রতিনিধি দলের, আর রাজ্যপাল বিজেপির দাবি মতোই এরাজ্যে করোনার মোকাবিলার দায়িত্ব আধা-সেনার হাতে তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন কেন্দ্রের কাছে। এইসব পুঁজি করে কেন্দ্র তার হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য হাসিল করতেই পাঠিয়েছে প্রতিনিধিদল। কীভাবে কেন্দ্রকে পশ্চিমবঙ্গবাসীর দরদী চিত্রিত করার এবং বিজেপির রাজনীতির বাজার জমানোর সুযোগ করা যায়, এটাই মোদী-অমিত শাহ’দের টার্গেট।

রাজ্যের তৃণমূল সরকারের করোনা পরিস্থিতির সার্বিক মোকাবিলার নমুনা জনগণের মধ্য অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলছে। করোনা টেস্ট, চিকিৎসা ব্যবস্থা, আক্রান্ত তালিকা, মৃত্যু সংখ্যা, মৃতদেহ দাহ করা, রেশন দুর্নীতি, ত্রাণ কাজে দলতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে তথ্য গোপন করার অভিযোগ উঠেই চলেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে, পুঞ্জিভূত হচ্ছে ক্ষোভ-বিক্ষোভ। পরিস্থিতিতে এতো ব্যর্থতা-অপদার্থতা-দূর্গন্ধ-অভাব-অভিযোগ ছড়ানো পরেও মুখ্যমন্ত্রী ড্যামেজ কন্ট্রোলে চালাকির আশ্রয় নিচ্ছেন। রেশন ব্যবস্থায় ৯০ শতাংশ ঠিকঠাক চলছে, গোলমাল মাত্র ১০ শতাংশ সাফাই গেয়ে আর দায়িত্ব থেকে একজন অফিসারকে অপসারণ বা খাদ্যমন্ত্রীকে কিঞ্চিৎ ভর্ৎসনা করে, এভাবে কিছু কিছু ওপর ওপর প্রসাধনী মেকআপ দিয়ে চেষ্টায় আছেন জনক্ষোভ থেকে পার পাওয়ার। এভাবে হাত ধূয়ে ফেলার অপচেষ্টা কিন্তু লোকের চোখে নির্লজ্জ্বই ঠেকছে। এইসব অপকীর্তি উল্টে কেন্দ্রের ও বিজেপির মাতব্বরি ডেকে আনার উপকরণ যোগাচ্ছে।

sahidminar

 

h2

১) কোভিড-১৯ মহামারী ও মোদি সরকার ঘোষিত লকডাউনের ফলে সারা দেশে আমরা চিকিৎসা, জীবিকা ও খাদ্যের তীব্র সংকটে পড়েছি। গরিব খেটে-খাওয়া মানুষ, বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিকেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। “জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ” – চারু মজুমদারের এই আহ্বানকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়ানোর শপথ নিচ্ছি। অভুক্ত ভারতকে অন্ন দাও, কোভিড-১৯-কে পরাজিত কর।

২) মানুষ যখন কোভিড-১৯ মহামারী ও লকডাউনে কঠোর মূল্য দিচ্ছে তখন আরএসএস ও বিজেপি চীন ও মুসলমান সম্প্রদায়কে দায়ী করে ঘৃণাপূর্ণ মিথ্যা প্রচার ছড়িয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। বিভিন্ন মিথ্যা খবর, কুসংস্কার ও বুজরুকি চিন্তা ছড়িয়ে দিয়ে মানুষকে ভুল পথে চালিত করছে। আমরা এই সাম্প্রদায়িক প্রচার অভিযানকে তীব্র ধিক্কার জানাই। করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া অস্পৃশ্যতা ও অপমান আমরা মানছি না। মুসলিম সম্প্রদায়কে সামাজিক ও আর্থিকভাবে বহিষ্কার করার চক্রান্তকে আমরা ধিক্কার জানাই। এর বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াব, জনগণের ঐক্য ও সংহতি শক্তিশালী করতে যা যা করণীয় তা আমরা করব – কোভিড-১৯ রোগের শিকারদের প্রতি সহমর্মিতা ও মৈত্রী প্রসারিত করব, সামনের সারিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া স্বাস্থ্যকর্মী ও সাফাই কর্মীদের সমর্থন যোগাব, যুক্তি-বিবেচনা ও প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটাব এবং সাম্প্রদায়িকতার ভাইরাসকে পরাজিত করব।

৩) এই সংকট ইতিমধ্যেই দেখিয়ে দিয়েছে যে কেন্দ্রের মোদি সরকার ও অধিকাংশ রাজ্য সরকারেরই কোনও উদ্বেগ বা সহমর্মিতা সাধারণ মানুষের প্রতি নাই। গরিব খেটে-খাওয়া মানুষের জন্য কোনো রকম বন্দোবস্ত না করেই তারা লকডাউন ঘোষণা করে দেয়। গরিবদের জন্য রাষ্ট্রের আছে কেবল দমন আর অপমান, যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ও গণতন্ত্র সংরক্ষিত আছে শুধুমাত্র বড়লোকদের জন্য। আমরা আমাদের সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতা একত্রিত করে সিপিআই(এমএল)-কে শক্তিশালী করব এবং জনগণের রাজনৈতিক মতামত ও ক্ষমতা প্রসারিত করতে জন-আন্দোলনকে তীব্রতর করব।

৪) এতদিনকার সমস্ত প্রতারণা ও ব্যর্থতাকে আড়াল করে ফেলার যুৎসই বাহানা হিসেবে কোভিড-১৯ মহামারীকে ব্যবহার করছে মোদি সরকার। দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত মানুষের গণতন্ত্র কেড়ে নিয়ে পুলিশরাজ কায়েম করার হাতিয়ার হিসেবে লকডাউনকে ব্যবহার করছে রাষ্ট্র। এই সুযোগে কর্পোরেট লবিগুলি এবং সামন্ততান্ত্রিক সাম্প্রদায়িক ও অপরাধী শক্তিগুলি লুটপাট ও আধিপত্য বাড়িয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরও আঁটোসাটো করতে চাইছে। লকডাউনকে এইসব শক্তির নোংরা তাণ্ডবের লাইসেন্স বানিয়ে ফেলতে দেব না আমরা। সবদিক থেকেই এটা পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে যে কোভিড-১৯ মহামারী ভারতকে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং মোদি সরকার সেই মন্দার বোঝা পুরোপুরি জনতার কাঁধে চালান করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। আমরা আমাদের সব শক্তি দিয়ে এর বিরুদ্ধে লড়ব এবং সরকারকে দায়বদ্ধ করব। কোভিড-১৯ সংকট পেরিয়ে ভারত যাতে এক সমতামূলক দেশ হিসেবে উঠে আসে তার জন্য লড়ব আমরা, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা পাবার অবাধ অধিকার।

৫) কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্ব-পুঁজিবাদের চরম নড়বড়ে অবস্থাকে প্রকাশ করে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেবল নিজের জনতাকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে তাই নয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(হু)-কেও আক্রমণ করেছে। তারা ভারতকে চোখ রাঙাচ্ছে এবং ভেন্টিলেটর নির্মাণ সংস্থাগুলির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যেন তারা কিউবা ও ভেনিজুয়েলায় ভেন্টিলেটর বিক্রি না করে। এইভাবে তারা মহামারীকেই নিজেদের যুদ্ধাস্ত্র বানাতে চেয়েছে। পুঁজিবাদে অগ্রণী দেশগুলিই মহামারীর সবচেয়ে বড় শিকার। এই দেশগুলোতেও সেই শ্রমিকশ্রেণী আর নিপীড়িত প্রান্তিক মানুষেরাই কিন্তু সবচেয়ে কঠোর মূল্য চোকাচ্ছে। পুঁজিবাদী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যনীতি, যা স্বাস্থ্যকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে না দেখে পণ্য ও মুনাফা লোটার ব্যবসা হিসেবে দেখে, জনতার পরিত্রাণ ও পরিষেবা প্রদানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তার তুলনায়, গণমুখী স্বাস্থ্যসেবার দৃষ্টিভঙ্গী ও নীতিমালা অনেক ভালো কাজ দিয়েছে, তা সে কিউবা-তেই হোক বা ভারতের কেরালায়।

আমরা আরেকবার নিজেদের উৎসর্গ করছি, এই ধ্বংসাত্মক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটানোর কাজে এবং ন্যায্য ও সমতাভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে যার কেন্দ্রে থাকবে মেহনতি মানুষের স্বার্থ ও পরিবেশ রক্ষার কর্মসূচী ও তাগিদ।

আজ পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নায়ক ও সমাজতন্ত্র নির্মাণের প্রথম ব্যাপক প্রচেষ্টার স্থপতি মহান লেনিনের একশ পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকী। এই উপলক্ষে আমরা কমরেড লেনিনের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি ও সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত করে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠার তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার শপথ গ্রহণ করি।

সিপিআই(এমএল) দীর্ঘজীবী হোক।
আমাদের সমস্ত প্রয়াত সাথী ও শহীদদের জানাই লাল সেলাম।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ।

-- সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি

what

 

h2

কার্ল মার্ক্সের দ্বিশতবার্ষিকী পেরিয়ে আমরা এসে পৌঁছেছি লেনিনের একশ পঞ্চাশতম জন্মশতবার্ষিকীর দোরগোড়ায়। লেনিনের মৃত্যুর পরেও প্রায় কেটে গেছে একশ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে ভোলগা আর গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। লেনিন আজ অনেকটাই ঐতিহাসিক বিস্মৃতির কবলে। যে সময়ে ভগৎ সিং লেনিন পড়ে ফাঁসির মঞ্চে চড়তেন, যে সময়ে সুকান্ত লিখতেন “বিপ্লব স্পন্দিত বুকে আমিই লেনিন”, যে সময়ে শেখ আবদুল্লা তাঁর দলের জন্য বেছে নিতেন লাল পতাকা আর শ্রীনগরে গড়ে উঠত লাল চক বা রেড স্কোয়ার, সেই সময় থেকে আজকের সময়টা বেশ ভিন্ন। পৃথিবীর বড় অংশ জুড়ে বিশেষ করে আমাদের দেশে সময়টা আজ যথেষ্ট গোলমেলে। এই গোলমেলে সময়ে উচ্ছ্বাস নাহয় নাই বা থাকল, লেনিনের প্রাসঙ্গিকতা বোধকরি অতীতের তুলনায় আরও বেশিই। সময়টা গোলমেলে আর লড়াইটা কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদী বলেই লেনিনকে চাই।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে বামপন্থী মহলেও রুশ বিপ্লবের ইতিহাস চর্চা বেশ স্তিমিত হয়ে পড়েছে। আর তার সাথে সাথে লেনিনের মহান মতাদর্শগত অবদানও আজ অনেকটাই বিস্মৃত, উপেক্ষিত। এই দৃষ্টিভঙ্গী ভীষণ অনৈতিহাসিক। সমাজতন্ত্র নির্মাণের সমস্ত ফলিত প্রয়োগ ও প্রচেষ্টাকে অস্বীকার করে শুধু মার্ক্সে ফিরে যাওয়ার অর্থ মার্ক্সকেও খণ্ডিত ও নিষ্প্রাণ বানিয়ে দেওয়া। সত্তর বছরে রুশ বিপ্লবের প্রাণশক্তি কেন নিঃশেষ হয়ে গেল সে ব্যাপারে অবশ্যই অধ্যয়ন ও গবেষণা চলতে থাকবে, কিন্তু সে দায়ভার লেনিনের উপর চাপিয়ে বিপ্লবের প্রধান স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে তা আজকের গণতন্ত্র, সাম্য ও ন্যায়ের লড়াইকেই ভীষণ ভাবে দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

লেনিন ও তাঁর সহযোদ্ধা কমরেডরা যখন রাশিয়ার মাটিতে জারতন্ত্রের জোয়াল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে কর্মকাণ্ড শুরু করেন তখন তাঁদের কাছে অনুশীলনগত বা ব্যবহারিক উদাহরণ ছিল যথেষ্ট সীমিত। কমিউনিস্ট ঘোষণাপত্র ও পুঁজি থেকে শুরু করে মার্কস-এঙ্গেলসের অনেক রচনাই ততদিনে প্রকাশিত হয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু অনুশীলনের ভাণ্ডারে জমা পুঁজি ছিল প্যারিস কমিউন, জার্মানীর সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এবং প্রথম ও দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সীমিত অভিজ্ঞতা। এখান থেকে শুরু করে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনার এক ধারাবাহিক অভিযান চালিয়েছেন লেনিন, যে অভিযানে তত্ত্ব ও অনুশীলন হাতে হাত রেখে এগিয়ে গেছে। এই অভিযানের যাত্রাপথে আমরা পেয়েছি ১৯০৫ সালের অসফল বিপ্লবী মহড়া, বারো বছর পরে ১৯১৭-র ফেব্রুয়ারী ও অক্টোবর (পরবর্তী হিসেবে নভেম্বর) মাসে পরপর দুটি সফল বিপ্লবী পটপরিবর্তন, সমাজতন্ত্র নির্মাণের অমূল্য প্রারম্ভিক অভিজ্ঞতা এবং কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের পতাকাতলে পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে দিন বদলের লড়াইয়ের উত্তাল ঢেউ।

প্রাক-লেনিন পর্যায়ে কমিউনিজম, বা তার নিকটতর ও প্রাথমিক পর্যায় সমজতন্ত্র, ছিল একটি ঘোষণাপত্র বা ইস্তেহার। এক স্বপ্নের হাতছানি। এক নতুন সমাজের অস্পষ্ট রূপরেখা। লেনিনের জীবদ্দশায় তাঁর তিন দশকের অনুশীলনে এই অস্পষ্ট রূপরেখা স্পষ্ট আকার গ্রহণ করতে শুরু করে। মার্কসের চিন্তাভাবনার সূত্র ধরে এক বিরাট গণউদ্যোগ, গণআলোড়ন দেশে দেশে ইতিহাসের ধারাকে ঘুরিয়ে দিতে থাকে ব্যাপক জনগণ ও তাদের গণতন্ত্রের পক্ষে। তত্ত্ব ও অনুশীলনের এই যুগান্তকারী মেলবন্ধন পরিচিতি অর্জন করে লেনিনবাদ নামে। বস্তুত লেনিনোত্তর পর্বে অনুশীলনমুখী মার্কসবাদের নতুন নাম দাঁড়ায় মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। কিন্তু লেনিনকে তাঁর জীবনে যেভাবে মার্কসবাদের যান্ত্রিক ব্যাখ্যা ও অনুশীলনের বিরোধিতা করে তার জীবন্ত ও সৃজনশীল বিকাশের পক্ষে লড়তে হয়েছে, আজ বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরবর্তী পর্যায়ে একইভাবে আমাদেরও লেনিনের তত্ত্ব ও অনুশীলনের জীবন্ত, গতিশীল উপাদান ও বৈশিষ্ট্যের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে।

কমিউনিস্ট ঘোষণাপত্র থেকে সংগঠিত কমিউনিস্ট পার্টিতে উত্তরণের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে লেনিনের ভূমিকা দিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক। এই উত্তরণের প্রথম সোপান হল চলমান রাজনীতিতে জনগণের সচেতন ও সংগঠিত হস্তক্ষেপ। লেনিনের প্রথমদিকের রচনা ‘What Is To Be Done?’ বা ‘কী করিতে হইবে’ আজও এই গণরাজনৈতিক উন্মেষের অমূল্য আকর গ্রন্থ। এই রাজনৈতিক চেতনার মূল কথা হল গভীর মানবিক/সামাজিক/গণতান্ত্রিক সম্বেদনা। জারশাসিত রাশিয়ার নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে এই সম্বেদনার মূলে ছিল জারের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন থেকে মুক্তির তীব্র আকাঙ্খা। কমিউনিস্ট রাজনীতি বা শ্রমিকশ্রেণীর রাজনীতিকে, শ্রমিক আন্দোলন বা আরও নির্দিষ্টভাবে শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ফ্রেমের মধ্যে বোঝা বা আয়ত্ত করার চেষ্টার বিপরীতে লেনিন মূলত এক স্বাধীনতা বা মুক্তি আন্দোলনের ভিত্তিতে, তারই অভিন্ন অঙ্গ হিসেবে পরিভাষিত করেছেন। এই রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ও বিকাশের কোনো নির্দিষ্ট কাঠামো বা ছক নেই। এখানে একজন ছাত্র একজন শ্রমিকের প্রতি সহমর্মিতা থেকে রাজনৈতিকভাবে জেগে উঠতে পারে, একজন পুরুষ শ্রমিক কোনো কৃষক রমণীর মুক্তির ডাকে সাড়া দিতে পারে, একজন বুদ্ধিজীবী বা সংস্কৃতিকর্মী একজন সাধারণ নাগরিকের অধিকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, পুলিশ বা সৈনিকের সাথে কৃষক ও শ্রমিকের দাবিদাওয়ার আন্দোলন কোনো এক বিন্দুতে এসে সহজেই মিলিত হতে পারে। ‘কী করিতে হইবে’ বইতে লেনিন গণরাজনীতির এমন এক জীবন্ত প্রক্রিয়ার চরিত্রচিত্রণ করেছেন যেখানে কোনো আগে-পরের ‘স্টেজ থিওরি’ বা পর্যায়ক্রমিক তত্ত্ব নেই, চেতনা ও অনুশীলনের বিভিন্ন দিকের মধ্যে নেই কোনো চীনের প্রাচীর। রাজনীতি শেষবিচারে অর্থনীতিরই ঘনীভূত রূপ এই মার্কসবাদী প্রজ্ঞাকে মেনে নিয়েও লেনিনের চোখে রাজনীতি অর্থনীতি থেকে শুরু আর অর্থনীতিতেই শেষ নয়, অর্থনীতির চৌহদ্দির বাইরেও সমাজজীবন ও মানব চেতনার বিস্তীর্ণ পরিসর জুড়ে রাজনীতির ব্যাপ্তি। অর্থবাদের পরিবর্তে লেনিনের অনুশীলনে এই জীবন্ত রাজনীতির অগ্রাধিকার, ঘটনার লেজুড়বৃত্তি ও স্বতঃস্ফূর্ততার উপাসনার বদলে সংগঠিত, সচেতন, পরিকল্পিত হস্তক্ষেপের উপর তার বিশেষ নিরন্তর জোর।

cpiml

 

আজ অর্থবাদ ছাড়াও একক ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন বা কোনো নির্দিষ্ট পরিচিতি বা বৈশিষ্ট্য-ভিত্তিক রাজনীতি সামগ্রিক সমাজপরিবর্তনের রাজনীতির পাশাপাশি এক বিকল্প ধারা হিসেবে যথেষ্ট জায়গা করে নিয়েছে। লেনিনের ‘কী করিতে হইবে’ রচনার সূত্র ধরে আমরা যদি এই রাজনৈতিক বিন্যাসকে বোঝার চেষ্টা করি তাহলে আমরা সামগ্রিক বনাম আংশিক বা সাধারণ বনাম নির্দিষ্টের বিতর্কে আটকে যাব না, বরং গণতন্ত্রের ব্যাপ্তি ও গভীরতা এবং সমাজপরিবর্তনের আবেগ ও গতিধারার মাঝে দুয়ের এক জীবন্ত যোগসূত্র খুঁজে পাব। সব রকমের নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ও সাম্যের তাগিদকে যদি উপলব্ধি করা যায় তাহলে শ্রেণীসংগ্রাম একটা গভীর ও ব্যাপক মাত্রা অর্জন করে। লেনিনের কাছে শ্রেণীসংগ্রাম সবসময়ই ব্যাপক ও গভীর, সেই শ্রেণীসংগ্রামের ফলশ্রুতি হিসেবে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের মানেই হচ্ছে প্রকৃত অর্থে সংখ্যাগুরু মানুষের জন্য সার্বিক গণতন্ত্র, মেহনতি জনগণের গণতন্ত্র, বঞ্চিত সমাজের গণতন্ত্র। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক মানুষের জন্য প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকারের এক সমৃদ্ধ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। বিংশ শতাব্দীর সেই প্রাথমিক পর্যায়ে গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নেও উন্নত পুঁজিবাদী দেশকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। নারীর অধিকার, শিশুর অধিকার, বৃদ্ধদের অধিকার, সমলৈঙ্গিক ব্যক্তিদের অধিকার – সবদিক থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন ছিল পথপ্রদর্শক। যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশ গঠনের প্রশ্নেও এই গণতন্ত্রই ছিল মূল ভিত্তি, জাতিসত্তার অধিকার তাই সোভিয়েত ইউনিয়নে সর্বোচ্চ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, এমনকি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আধিকার হিসেবেও স্বীকৃত হয়েছিল।

ইতিহাসের নির্মম প্রহসনে সত্তর বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় ছবিটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। গণতন্ত্রের অপ্রতুলতা বা গণতন্ত্রহীনতা সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রকে নিষ্প্রাণ, নিরর্থক করে তোলে এবং শেষপর্যন্ত দেশটাই ভেঙ্গে যায়, হারিয়ে যায়। আজ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের তিন দশক পরেও চীনে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছে ঠিকই, কিন্তু গণতন্ত্র ও নাগরিক স্বাধীনতার প্রশ্নে আজকের চীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অচলায়তনের চেয়েও এক গুরুতর অবক্ষয়ের প্রতিমূর্তি। সোভিয়েত ইউনিয়নের অতিকায় মহাশক্তিসুলভ সামরিক প্রভুত্ব এবং আধিপত্যবাদী বিদেশনীতিকে এড়িয়ে চলতে চীন হয়তো অনেকটাই সতর্ক, অর্থব্যবস্থার প্রশ্নে বাজার অর্থনীতি ও প্রযুক্তি বিপ্লবকে কাজে লাগানোর প্রশ্নে চীন অনেক বেশি গতিশীল ও যত্নবান, কিন্তু অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের প্রশ্নে চীন গোটা পৃথিবীর কাছে এক চূডান্ত নেতিবাচক দৃষ্টান্ত। একুশ শতকে নতুন করে লেনিনকে পড়ার অর্থ সবার আগে মার্কসবাদের তথা কমিউনিস্ট আন্দোলনের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও মর্মবস্তুকে পুনরুদ্ধার করা। বিশেষ করে বিশ্ব পুঁজিবাদ যখন তার দক্ষিণপন্থাকে অনুসরণ করে দেশে দেশে গণতন্ত্র-বিরোধী ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস ও সংকীর্ণতার পথে হাঁটতে শুরু করেছে তখন কল্যাণমূলক অর্থনীতির পাশাপাশি ব্যাপক জনগণের গণতন্ত্র ও নাগরিক স্বাধীনতার প্রশ্নেও কমিউনিস্ট বা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিকে আজ পুঁজিবাদকে অতিক্রম করে বিকল্প মডেল পেশ করতে হবে, গণনিয়ন্ত্রণ ও অংশগ্রণের গড়তে হবে নতুন নজির। কমিউনিস্ট আন্দোলনের কাছে মার্কস এবং লেনিন এই প্রশ্নেও আলোকবর্তিকা এবং পথপ্রদর্শক।

সংগঠিত বাম রাজনীতি যাঁরা অনুশীলন বা অনুসরণ করেন তাঁদের কাছে লেনিনের বড় পরিচয় কমিউনিস্ট পার্টির এক মহান স্থপতি হিসেবে। কমিউনিস্ট নীতি ও আদর্শকে প্রয়োগ করে কোনো দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বিশ্লেষণের ভিত্তিতে একটি গতিশীল কর্মসূচী প্রণয়ন করা এবং সেই কর্মসূচীকে বাস্তবায়িত করতে এক সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল পার্টি গড়ে তোলা – বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে এই অভিজ্ঞতার প্রথম উজ্জ্বলতম উদাহরণ আমরা পাই লেনিনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে। পার্টি সংগঠন নির্মাণ ও পরিচালনার প্রামাণ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ছড়িয়ে আছে লেনিনের অধিকাংশ ছোট-বড় লেখায়, বিশেষ করে ‘ওয়ান স্টেপ ফরওয়ার্ড, টু স্টেপস ব্যাক’ বা ‘এক পা এগিয়ে, দুই পা পিছিয়ে’র মতো কমিউনিস্ট সম্মেলনের ধ্রুপদী ধারাভাষ্যে। কৌশল নির্ধারণের নীতিগত বিতর্কের চমৎকার জীবন্ত দলিল লেনিনের বিখ্যাত রচনা ‘Two Tactics of Social Democracy in Democratic Revolution’ বা ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সমাজগণতন্ত্রের দুই কৌশল’। জার শাসনে রাশিয়ার বাইরে যখন লেনিনকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে তখনও তাঁর তীক্ষ্ণ নজর থাকত রাশিয়ার মাটিতে আন্দোলনের ও রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের উপর। বাদ যেত না বিশ্ব রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ, বিশেষ করে ঔপনিবেশিক দেশগুলির মুক্তিসংগ্রামের ওঠানামা। সভা-সমাবেশের প্রচারপত্র, সম্মেলনের প্রস্তাব, ঘনিষ্ঠ কমরেডদের উদ্দেশে চিঠি, পুস্তক সমীক্ষা এবং মতাদর্শগত বিতর্ক – লেনিনের বিরাট রচনা ভাণ্ডার তাঁর রাজনৈতিক অনুশীলনের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। লেনিন নিজেকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক পাবলিসিস্ট বা প্রচারক হিসেবে বর্ণনা করতেন, (প্রচারক শব্দটি ভারতে সংঘবাহিনীর বর্তমান ফ্যাসিবাদী শাসনের পর্যায়ে যথেষ্ট কালিমালিপ্ত হয়ে উঠলেও আদর্শভিত্তিক গণআন্দোলনের নির্মাণ, সম্প্রসারণ ও পরিচালনায় প্রচারকের ভূমিকার অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করা কঠিন নয়)।

lenin

 

আদর্শ সম্পর্কে নিরন্তর তাত্ত্বিক চর্চা এবং গণঅনুশীলনের কষ্টিপাথরে তাকে পরখ করা ও সমৃদ্ধ করার ধারাবাহিক প্রক্রিয়াকে বাদ দিয়ে কিন্তু লেনিনের এই সংগঠক ও প্রচারকের ভূমিকাকে বোঝা যাবে না। সংগঠক বা প্রচারকের কাজ কোনো রেডিমেড ছককে ছড়িয়ে দেওয়া নয়, বরং পুরনো ছক ভেঙ্গে নতুন ছক গড়ার ছন্দসাধনায় সিদ্ধিলাভ করা। পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই লেনিনের অনুশীলন ও অগ্রাধিকারেও আমরা অনেক বাঁক পরিবর্তন দেখতা পাই। লেনিনের অনেক প্রশংসক বা সমালোচকই কিন্তু এই গতি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন ও পরিচালনা সম্পর্কে এক তথাকথিত লেনিনীয় মডেল নিয়ে চর্চা করে থাকেন।

লেনিনের সমালোচকদের অনেকের চোখেই লেনিনের তত্ত্ব ও অনুশীলন জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবীর এক অবাস্তব প্রকল্প। অর্থনীতিবাদ বা অভিজ্ঞতাবাদের গণ্ডীর বাইরে কমিউনিস্ট চেতনার উন্মেষের লেনিনীয় সূত্রের এ এক চূড়ান্ত অপব্যাখ্যা। শ্রমিকশ্রেণীর উপর বুদ্ধিজীবী বর্গের নেতৃত্ব নয়, শ্রমজীবী মানুষের বিপ্লবী শ্রেণীচেতনার নির্মাণ ও বিকাশের প্রক্রিয়াতে বিভিন্ন পৃষ্ঠভূমি থেকে আসা ব্যক্তির মতাদর্শগত মিলনের সম্ভাবনা ও প্রয়োজনের উপর ছিল লেনিনের জোর। সর্বহারা শ্রেণীর অগ্রবাহিনীর পার্টি গঠনের অর্থ ব্যাপক জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে উপর থেকে বা বাইরে থেকে কোনো নেতৃত্বকারী চক্র গড়ে তোলা নয়, শৌখিন বিপ্লবীয়ানার বিপরীতে কঠিন কষ্টসাধ্য নিয়মিত অনুশীলনের উপর জোর দিয়েই লেনিন রাজনৈতিক পেশাদারিত্বের ধারণা তুলে ধরেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ছোট ছোট পাঠচক্র, বিভিন্ন কারখানার বা মহল্লার শ্রমজীবী জনগণের স্থানীয় বিক্ষোভ ও সংগ্রামের মধ্যে গভীর যোগসূত্র ও ব্যাপক সমন্বয়ের সম্ভাবনা ও তাগিদ ছিল লেনিনের অনুশীলনের মূল কথা আর এভাবেই বলশেভিক পার্টি দ্রুত এক বিশাল গণচরিত্র অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল।

পার্টি ঐক্য এবং শৃঙ্খলার প্রশ্নেও লেনিনের অনুশীলনে এক দীর্ঘ যাত্রা আমরা দেখতে পাই। পার্টি গঠনের শুরুর পর্যায়ে আরএসডিএলপি বা রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি (কমিউনিস্ট পার্টির প্রাকবিপ্লবী পর্যায়) ছিল বিভিন্ন গোষ্ঠীর এক খোলা সমন্বয় যেখানে বিভিন্ন প্রশ্নে প্রকাশ্য তীব্র বিতর্কের মধ্য দিয়েই পার্টির নীতি ও অবস্থান নির্ধারিত হত। বিতর্কসভার এই পরিবেশের মধ্য দিয়েই পরবর্তীতে গড়ে উঠেছিল লৌহদৃঢ় ঐক্য ও শৃঙ্খলা, যে ঐক্য ও শৃঙ্খলা ছাড়া যুদ্ধে টিকে থাকা ও জয়লাভ করা কখনোই সম্ভব নয়। বিতর্কের মধ্য দিয়ে ঐক্যের এই জটিল প্রেক্ষাপট ও জীবন্ত প্রক্রিয়াকে বাদ দিয়ে লেনিনীয় অবধারণা ও অনুশীলনকে মনে হবে হয় বুদ্ধিজীবীসুলভ বিতর্ক ও তাত্ত্বিক কচকচি অথবা শৃঙ্খলার নাগপাশে বিতর্কের কণ্ঠরোধ।

শোষণবিহীন সমাজের মুক্তিকামী স্বপ্ন ও সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে নিরলস গতিময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ কমিউনিস্ট অনুশীলন – লেনিনকে ফিরে দেখার অর্থ এই দুটি বিষয়ের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়া। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে শাসকশ্রেণীর স্বার্থরক্ষার যুদ্ধকে জনগণের ক্ষমতা দখলের বিপ্লবীযুদ্ধে রূপান্তরিত করার যে নির্দিষ্ট ও সফল উদাহরণ গত শতাব্দীর গোড়ার পর্বে রাশিয়াতে আমরা দেখেছি তার হয়তো একইভাবে আর কোথাও পুনরাবৃত্তি হবে না। সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির যে অধ্যয়ন লেনিন করেছিলেন আজ দানবীয় বিত্তীয় পুঁজি ও ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে তার অবশ্যই নতুন সংস্করণের প্রয়োজন। কিন্তু রুশ বিপ্লবকে যাঁরা গণতন্ত্রহীনতার পর্যায়ে এক প্রাক-আধুনিক সমাজ থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের উদাহরণ হিসেবেই শুধু দেখতে অভ্যস্ত এবং যাঁদের মনে হয়েছিল পরবর্তী পর্যায়ে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের পরিপক্কতা ও বিচক্ষণতা সেই পরিপ্রেক্ষিতটাই বদলে দিয়েছে আজ তাঁদেরও নতুন করে ভাবনাচিন্তা করার সময় এসেছে।

লেনিন সাম্রাজ্যবাদকে মরণাসন্ন পুঁজিবাদ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। গত একশ বছরে পুঁজিবাদ সেই সংকটকে বারবার অবশ্যই কাটিয়ে উঠেছে। তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতন এবং প্রাক-পুঁজিবাদী ঔপনিবেশিক বিশ্বে উপনিবেশবাদের পতনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব পুঁজিবাদের ভৌগোলিক ব্যপ্তিও আজ অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি প্রকট। কিন্তু পুঁজিবাদের প্রশ্নাতীত ব্যাপকতা ও গভীরতাই তার সংকটকেও আরও ব্যাপক ও গভীর করে তুলেছে। বিশ্বায়ন ও বাজারিকরণের আগ্রাসী নীতি দেশে দেশে জন্ম দিয়েছে এক নতুন অস্থিরতার। আর ভারসাম্যহীনতা ও অস্থিরতার এই নতুন পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের আপাত পরিপক্ক ও বিচক্ষণ ব্যবস্থা আজ প্রায় দুনিয়াজোড়া সংকটের মুখে। উগ্র দক্ষিণপন্থা ও ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন আজ বিশ্বব্যাপী। প্রযুক্তি বিপ্লব একদিকে মানুষের জ্ঞান ও চেতনাকে প্রসারিত করেছে, প্রশস্ত হয়েছে মানবাধিকারের ও গণতন্ত্রের ধারণা, রাষ্ট্রের সীমানা ও কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণের নিশ্ছিদ্র কাঠামোর বাইরে ব্যাপক মানুষের সহঅস্তিত্ব ও সহযোগিতার সম্ভাবনা ক্রমেই বেশি বেশি করে নজরে আসছে, অন্যদিকে একই প্রযুক্তি রাষ্ট্রের হাতেও তুলে দিয়েছে দানবীয় ক্ষমতা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের যে ঘোষিত নীতির ভিত্তিতে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের সৌধ-রচনা হয়েছিল সেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আজ পাহারাদার রাষ্ট্রের দাপটের কাছে অসহায় শিশু। এর সাথে পরিবেশের বিপন্নতা ও জলবায়ু পরিবর্তন জনিত অনিশ্চয়তাকে জুড়ে দিলে আমরা পাব বিশ্বপুঁজিবাদের এক অভূতপূর্ব সংকটের চালচিত্র। এমনই এক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে লেনিন রুশ বিপ্লব ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের মাধ্যমে এক বিকল্প তুলে ধরেছিলেন। রোজা বলেছিলেন সমাজতন্ত্র অথবা বর্বরতা দুয়ের মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হবে। এই পরিস্থিতি আজ পোড়খাওয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেও নতুন করে সমাজতন্ত্রের প্রশ্ন তুলে ধরছে। বার্ণি স্যান্ডার্স বা জেরেমি করবিনের নির্বাচনী প্রচারের কথা আজ থেকে ত্রিশ, বিশ বা দশ বছর আগেও ভাবা যেত না, কিন্তু আজ পরিস্থিতি তাকে সম্ভব করে তুলেছে। পুঁজিবাদের গভীর সংকট ও বিকল্পের হাতছানির এই বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে আছেন ছক ভাঙার সিদ্ধহস্ত কারগর। ‘কী করিতে হইবে’ বই হাতে যিনি আজও পাঠকদের ভাবান, পথে নামান।

(স্বরান্তর, জানুয়ারি ২০২০ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত)

ss

 

head 3

কলকাতা:

dharmatala

 

২২ এপ্রিল কলকাতায় লেনিন মূর্তির পাদদেশে বামদলগুলির পক্ষ থেকে লেনিনের মূর্তিতে মাল্যদান করা হয়। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে মাল্যদান করেন বাসুদেব বসু।

সিপিআই(এমএল)-এর ৫১ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও কমরেড লেনিনের ১৫০ তম জন্মবার্ষিকীতে মৌলালিতে পার্টির রাজ্য অফিসের সামনের শহীদ বেদীতে স্থানীয় মানুষদের নিয়ে কর্মসূচী হয়। মাল্যদান করেন প্রবীর দাস, বাসুদেব বসু।

jadavpur

 

আইসা ও সিপিআই(এমএল)-এর উদ্যোগে ৫০ টি পরিবারকে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ সহ করোনার সম্পর্কে সচেতনতা মূলক অভিযান চালানো হয় বেহালার সিপিআই(এমএল)-এর কালীতলা পার্টি অফিস সংলগ্ন অঞ্চলে। বেহালার রবীন্দ্রনগর অঞ্চলে দিনটি পালন করা হয় কমরেড চারু মজুমদার ও কমরেড সরোজ দত্ত এর মূর্তিতে মাল্যদান করে সমস্ত শহীদদের স্মরণ ও সংকল্প গ্রহণের মাধ্যমে। যাদবপুর-ঢাকুরিয়া লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবস পালিত হয় লোকাল অফিসে পতাকা উত্তোলন ও শহীদ বেদীতে মাল্যদান করার মধ্য দিয়ে। ২২ এপ্রিলের পার্টির আহ্বান পাঠ করেন কমরেড জয়তু দেশমুখ। টালিগঞ্জ লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে শপথ পাঠ ও সংকল্প গ্রহণ করে ২২ এপ্রিল পালিত হয়। সমস্ত কর্মসূচীতে স্থানীয় কমরেডরা সামিল হন শারীরিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্য বিধি বজায় রেখে।

hooghly

হুগলী :

জেলা অফিস – ২২ এপ্রিল সকালে হুগলী ঘাটে জেলা পার্টি অফিসে কর্মসূচীর শুরুতে রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন বর্ষীয়ান পার্টি সদস্য কমরেড মানিক দাশগুপ্ত, এরপর জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার সহ সকলে শহিদবেদী ও লেনিনের প্রতিকৃতিতে পুষ্প অর্পণ করেন। শহিদ স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটি প্রেরিত শপথ পত্রটি সম্মিলিতভাবে পাঠ করা হয়। লাউডস্পীকারে সাধারণ সম্পাদকের  আহ্বানটি প্রচারিত হয়। সবশেষে ‘ভেদী অনশন মৃত্যু তুষার ও তুফান’ গানটির সঙ্গে উপস্থিত কমরেডদের গলা মেলানোর মধ্য দিয়ে কর্মসূচী সমাপ্ত হয়। পার্টি অফিস সংলগ্ন গরিব মানুষদের পরিবার সহ ৫০টি পরিবারের হাতে খাদ্য সামগ্রী তুলে দেওয়া হয়।

bainchi

 

গ্রামাঞ্চল – পাণ্ডুয়া ব্লকের বৈঁচিতে লোকাল পার্টি অফিসে পতাকা উত্তোলন করেন কমরেড আব্দুল কাশেম এবং ২২ এপ্রিলের শপথপত্র পাঠ ও আলোচনায় অংশ নেন আদিবাসী ও কৃষিজীবি কয়েকজন কমরেড। পাণ্ডুয়ার সাঁচিতাড়া ব্রাঞ্চে পতাকা উত্তোলন ও শপথপত্র পাঠ হয়। বলাগড় ব্লকের গুপ্তিপাড়া ব্রাঞ্চের পক্ষ থেকে রক্ত পতাকা করেন ব্রাঞ্চ সম্পাদক কমরেড কীর্তিবাস বৈদ্য। এরপরে নীরবতা পালন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বানের শপথপত্র পাঠ করা হয়। মহিপালপুর লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে ইটাগড় গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে সকাল ৮টায় রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন কমরেড সুভাষ বাউলদাস এবং ১ মিনিট নীরবতা পালনের পর শপথপত্র পাঠ করা হয়। ইছাপুর বেলেডাঙ্গা ব্রাঞ্চের পক্ষ থেকে বেলেডাঙ্গা গ্রামে পতাকা উত্তোলন করা হয় সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে।পতাকা উত্তোলন করেন পার্টির ব্লক কমিটির সদস্য কমরেড শুকলাল মাণ্ডি। নীরবতা পালনের পর শপথপত্র পাঠ করা হয়। ধনিয়াখালির মল্লিকপুরে শহীদ স্মরণ ও কেন্দ্রীয় কমিটির শপথপত্র পাঠ করে আলোচনা হয়।

chuchu

 

শহরাঞ্চল – চুঁচুড়ায় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত  খাগড়াজোল এলাকায় অসংগঠিত শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত পার্টি ব্রাঞ্চে ২২ এপ্রিলের কর্মসূচী পালিত হলো। উপস্থিত কমরেডরা শহিদ স্মরণ ও কেন্দ্রীয় কমিটির শপথ পাঠ করেন। ভদ্রেশ্বরে চাঁপদানি এলাকায় অ্যাঙ্গাস ব্রাঞ্চের উদ্যোগে পতাকা উত্তোলন ও শপথবাক্য পাঠ করেন শ্রমিক কমরেডরা। পার্টির উত্তরপাড়া-রিষড়া এরিয়া কমিটির আহ্বানে এই কমিটির অধীনস্থ প্রায় সবক’টি ব্রাঞ্চের উদ্যোগে কোন্নগর ও হিন্দমোটরের মোট ৭ টি জায়গায় স্মরণ ও শপথগ্রহণ কর্মসূচী সংগঠিত হয়, যার মধ্যে ছিল – কোন্নগর হরিসভা, এলপুকুর, অরবিন্দ পল্লী, ২ নং কলোনি বাজারে পার্টি অফিসের সামনে, কোতরং বিধানপল্লী, হিন্দমোটর ইটখোলা মোড় ও দেশবন্ধু পার্ক এলাকা। এর মধ্যে বিধানপল্লী এলাকার কর্মসূচীতে বিশেষ অগ্রণী ভূমিকা রাখেন কমরেড দূর্গা রায়, কৃষ্ণা পাল, সীমা যাদব প্রমুখ, হিন্দমোটর ইটখোলা মোড়ের কর্মসূচী সামগ্রিক ভাবেই নির্মাণ শ্রমিক কমরেডদের পরিচালনায় হয় এবং কোন্নগর অরবিন্দ পল্লীতে কর্মসূচীটি হয় পার্টি পরিচালিত ত্রাণকেন্দ্রের সামনে, যেখান থেকে লকডাউনে বিপন্ন দরিদ্র পরিবারগুলির বাড়িতে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানো হচ্ছে।

belg

উত্তর ২৪ পরগণা :

বসিরহাটে পার্টির ৫১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী এবং কমরেড লেনিন-এর ১৫০ তম জন্ম বার্ষিকীতে প্রথমে প্রয়াত সাথী ও শহিদদের স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন করার পর শপথ পাঠ এবং কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য-এর হোয়াটস অ্যাপের যুগে ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ লেখাটি পাঠ করা হয়।

আইসা উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পক্ষ থেকে লেনিনের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী ও সিপিআই(এমএল)-এর ৫১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালিত হয় এবং কমরেডরা আজকের দিনটিকে স্মরণ করে একটি ভিডিও প্রকাশ করে।

গাইঘাটা ব্লকে ঢাকুরিয়া পার্টি অফিসে পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করা হয়।

খড়দায় কমরেডরা শপথ বাক্য পাঠ করেন।

bizpur

 

বীজপুর পার্টি কমিটির পক্ষ থেকে আজ দাসপাড়া অঞ্চলে কমরেডরা মাঠে লাল ঝান্ডা হাতে জড়ো হয়ে শপথ পাঠ করেন।

বেলঘরিয়ায় লেনিনের ১৫০ তম জন্ম বার্ষিকী ও ৫১তম পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবসে সিপিআই(এমএল)-এর জেলা কার্যালয়ে কর্মসূচী পালিত হয়। পতাকা উত্তোলন, প্রতিবাদী কর্মসূচী, কেন্দ্রীয় কমিটির আবেদন পড়া ও আলোচনা হয়। বেলঘরিয়া লোকাল কমিটির সম্পাদক কমরেড অশোক সাহা কোভিড ১৯ নিয়ে সহজ সাবলীল ভাষায় আলোচনা করেন।              

barasat

 

বারাসাতে পার্টির উদ্যোগে উত্তর ২৪ পরগণা জেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনে মহামতি লেনিনের ১৫০ তম জন্মদিবস ও সিপিআই(এমএল)-এর ৫১ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে কর্মসূচী সংগঠিত হল যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে সকাল ১০টায়। অনুষ্ঠানে শহীদবেদিতে মাল্যদান করেন পার্টির বারাসাত লিডিং টিমের সম্পাদক কমঃ দিলীপ দত্ত। ভারতবর্ষের বিপ্লবী বাম আন্দোলনের সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১ মিনিট নীরবতা করার পরে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন পার্টির উত্তর ২৪ পরগণা জেলা কমিটির সদস্য কমলেড নির্মল ঘোষ, বক্তব্য রাখেন রাজ্য নেতা তথা রাজ্য পার্টির বাংলা মুখপত্র ‘আজকের দেশব্রতী’ পত্রিকার সম্পাদক কমরেড অনিমেষ চক্রবর্তী। দেশজোড়া করোনাজনিত লকডাউনের পরিস্থিতিতেও স্থানীয় কমরেডদের উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল লক্ষণীয়। পথচলতি সাধারণ মানুষকেও আজকের কর্মসূচী যথেষ্ঠ আকৃষ্ট করে।

নৈহাটি শহর আঞ্চলিক কমিটির উদ্যোগেও আজ ২২ এপ্রিল কর্মসূচী পালিত হয়। নৈহাটির শিবদাসপুর গ্রামে কমরেডরা রক্ত পতাকা উত্তোলন করে শপথ পাঠ করেন।

অশোকনগর পার্টি কার্যালয়ে ২২ এপ্রিল সকালে ৫১তম পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবসের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সন্ধ্যাবেলায় কমরেডরা আজকের দিনের তাৎপর্য নিয়ে ঘরোয়া আলোচনা করেন।

জগদ্দলের পার্টি কমরেডরা লকডাউনের মধ্যে বাড়ি থেকেই শপথ পাঠ করেন।

bankara

দক্ষিণ ২৪ পরগনা :

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা দপ্তরে লেনিনের ১৫০তম জন্মদিবস ও পার্টির ৫১তম প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপনে পার্টির আহ্বান ৫টি শপথ নিয়ে ব‍ক্তব‍্য রাখেন জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার। রক্তপতাকা তোলেন কমঃ লক্ষিকান্ত অধিকারী। মাল‍্যদান, শ্লোগান ও শহীদ স্মরণের মধ্যে দিয়ে সভা শেষ করা হয়। বজবজ গ্ৰাম লোকাল কমিটিতেও যথাযোগ্য মর্যাদা ২২ এপ্রিল পালন করা হয়।

howra

হাওড়া :

বালিতে জেলা অফিসে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস এবং লেনিন জন্মবার্ষিকী স্মরণে পাঠ করা হয় পার্টির ২২ এপ্রিলের আহ্বান। ঘোড়াঘাটা লোকাল কমিটির উদ্যোগে রক্ত পতাকা উত্তোলন, শপথ পাঠ ও শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিলি করা হয়। জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ; জেলার অন্যান্য এলাকার মতোই আজ পার্টি প্রতিষ্ঠাদিবসে বাঙালপুর-হাটুরিয়া লোকাল কমিটির সদস্যরা পৌঁছে গেলেন মানুষের কাছে। ত্রাণের খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয় বাগনান রাজাপাড়া ও হাড়োপ শেখপাড়ায়।

nadia

নদীয়া :

২২ এপ্রিল সিপিআই(এমএল)-এর ৫১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে নবদ্বীপ শাখার পক্ষ থেকে পাঠচক্র সংগঠিত হয়। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই অংশগ্রহণ করেন স্হানীয় কমরেডরা। পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস পালিত হয় গাছা বাজার ও নোয়াপাড়া কালীনগর গ্রামে।

মুর্শিদাবাদ:

মুর্শিদাবাদ জেলা অফিসে পার্টির আহ্বান পাঠ ও সংকল্প গ্রহণের মাধ্যমে উদযাপিত হয় ২২ এপ্রিল।

purba

পূর্ব বর্ধমান :

মন্তেশ্বরে সিপিআই(এমএল) পার্টি অফিসে পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবস ও কমরেড লেনিন-এর ১৫০তম জন্ম বার্ষিকী পালন করা হয় এবং শপথ পাঠ করা হয়।

বর্ধমান শহরে পার্টি প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করা হয়। কমঃ কুনাল, শ্রীকান্ত, বাপন, হোসেন, শিবু, প্রাণ বল্লভ উপস্থিত ছিলেন। সকলেই আজকের দিনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কিছু আলোচনা করেন

বর্ধমান সদরের কামারকিতা ব্রাঞ্চে পার্টির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করা হয়। কমঃ সমীর, নারায়ণ, চাঁপা, লক্ষণ ও অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।

আজ করন্দায় পার্টির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করা হয়।

পার্টির ৫১তম প্রতিষ্ঠা দিবস পালিত হয় পূর্বস্থলীর মেড়তলা চন্ডীপুরে। প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করা হয় ফলেয়া পার্টি অফিসে। এছাড়াও রায়না ও তিয়াগুলে পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস ও লেনিনের জন্মদিবস স্মরণ করা হয়।

আলিপুরদুয়ার :

বাবুরহাটে আলিপুরদুয়ার জেলা পার্টি অফিসে পার্টির ৫১তম প্রতিষ্ঠা দিবস ও কমঃ লেনিনের ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে রক্তপতাকা উত্তোলন করেন পার্টির জেলা কমিটির বর্ষীয়ান সদস্য কমঃ সুশীল চক্রবর্তী।উপস্থিত ছিলেন জেলা সদস্য কমঃ সুনীল রায় সহ অন‍্যান‍্য কমরেডরা।

sili

দার্জিলিং :

শিলিগুড়িতে জেলা পার্টি অফিসে লেনিনের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান এবং শপথ গ্রহণ করা হয়। শিলিগুড়ির শক্তিগড় ব্রাঞ্চে শহীদ স্মরণ ও শপথ গ্রহণ করা হয়।

ফাঁসিদেওয়া ব্লকের রাঙ্গাপানিতে পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস ও লেনিনের জন্মদিবসে পতাকা উত্তোলন ও শপথ গ্রহণ কর্মসূচী সংগঠিত হয়।

খড়িবাড়ী ব্লকের বিত্তানজোতে পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস পালন ও শপথ গ্রহণ। পতাকা উত্তোলন করেন নকশালবাড়ি আন্দোলনের শহীদ বাবুলাল বিশ্বকর্মকারের পুত্র বিভাস কর্মকার। শপথ পাঠ করান চানেশ্বর সিং। বক্তব্য রাখেন ব্লক সম্পাদক কান্দ্রা মুর্মু। উপস্থিত ছিলেন মীরা মাহালি, লাল সিং, রমু সিং প্রমুখ।

fansi

জলপাইগুড়ি :

জলপাইগুড়ি পার্টি অফিসে পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস ও লেনিনের জন্মদিবসে শহীদ স্মরণ ও শপথ গ্রহণ করা হয়।

বাঁকুড়া জেলার রিপোর্ট –

বাঁকুড়ায় সকাল ৭টায় হেলনা বিকেল ৫টায় নিকুঞ্জ পুর ছাতনার তিলাসোতা এবং বিষ্ণুপুরে পালন করা হয়। হেলনায় ৭ জন, বিষ্ণুপুরে ১৩ এবং নিকুঞ্জপুরে ১৭ জন তিলাসোতায় ৮ জন উপস্থিত ছিলেন। সব জায়গায় সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য শোনানো হয় এবং কেন্দ্রীয় কমিটির বক্তব্য পাঠ করা ব্যাখ্যা করা হয়। হেলনা এবং নিকুঞ্জপুরে ব্যাখ্যা করেন বাবলু ব্যানার্জী, তিলাসোতায় রামনিবাসএবং বিষ্ণুপুরে ফারহান। গত একমাসে জেলা পাটির যা ইতিবাচক কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়। যেমন হেলনাতে বাসন শিল্পের সাথে যুক্ত ৩৪টি শ্রমিক পরিবারকে বিডিও নিজে এসে চাল দিয়ে যান এদের সবার কার্ড RKSY-২। এবং ষোলআনা কে কাজে লাগিয়ে ১৪৮ পরিবারকে চাল-আলু-কুমড়ো দেওয়া হয়। মে মাসেও দেওয়া হবে। বিষ্ণুপুরে পাটির পক্ষ থেকে ২০০-র বেশি পরিবারকে চাল দেওয়া হয়। ইন্দপুরে ৭ পরিবারকে বিডিও অফিস থেকে চাল দেওয়া হয়। বেলিয়াতোড় থানা থেকে কোষ্ঠিয়া অঞ্চলের ৩টি গ্রামের ৬৪টি পরিবারকে চাল, আলু আদায় করিয়ে দেওয়া হয়। বিশেষ ত্রাণের চাল তৃণমূল নিজেরা পাটি অফিস থেকে বিলি করছে। বাঁকুড়া-১ বিডিও-কে এই অভিযোগ করার পর কোষ্ঠিয়া পঞ্চায়েত আমাদের নেতৃত্বকে আজ ডাকেন, সেখানে তৃনমূলের নেতাদের উপস্থিতিতে আমাদের কৃষিমজুর নেতারা তর্ক করার পরে পঞ্চায়েত সচিব আমাদের তালিকা গ্রহণ করেন। এইসব শুনে উপস্থিত সমস্ত কমরেড খুশিী হন এবং করোনা পরিস্থিতিতে পার্টিকে আরো প্রাসঙ্গিক করে তুলতে এবং আন্দোলনমুখী করে তুলতে কিছু কর্মসূচী নেওয়া হয়। চার জায়গায় সরকারের ‘প্রচেষ্টা প্রকল্প’র ফর্ম বিভিন্ন গ্রামে ব্যাপক সংখ্যায় পুরণ করে জমা দেওয়া হবে। বিষ্ণুপুর এসডিও-কে ডেপুটেশন দেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় কর্মসূচীর অংশ হিসেবে আগামী ২৭ এপ্রিল সকাল ৭টা থেকে ৯টা নিকুঞ্জপুর সবজি হাটে পোষ্টার ব্যানার সহ অবস্থান করা হবে ৪০ জনের উপস্থিতিতে। দাবি হল, রেশন কার্ড ছাড়াই প্রতি পরিবারকে মাসে ৫০ কেজি চাল দিতে হবে, সব গরিব পরিবারকে মাসে ১০০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, চাষিদের কাছ থেকে সমস্ত ধরনের ফসল দেড়গুণ দামে কিনতে হবে, এবছর সব ধরনের চাষিদের বিনামূল্যে বীজ-সার-কীটনাশক ওষুধ, সেচের বিদ্যুৎ বা ডিজেল দিতে হবে।

lsnin

 

sou

“লেনিন সেবার শীতকালে/ভালোবেসে ফুল জীবন্ত/আনলেন মরা দিনকালে/তোমারই জন্য বসন্ত” – শুধু রাশিয়ার মরা দিনকালেই নয়, দুনিয়াজোড়া মুষ্টিমেয় মানুষের শাসনের হিমশীতল কাঠামোতেই কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল রুশ বিপ্লব। দেশে দেশে গড়ে উঠেছিল বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, যারা লড়াই শুরু করেছিল মেহনতি মানুষ এবং সমগ্র জাতি ও দেশের মুক্তির জন্য। একদিকে লড়াই এবং অন্যদিকে সেই লড়াইকে আটকানোর নানাবিধ প্রচেষ্টা – পরবর্তী প্রায় সাত দশক ধরে এটাই হয়ে থেকেছে বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক। লড়াই চলেছে কখনো সামরিক অস্ত্রসজ্জায়, কূটনীতিতে, কখনো সাংস্কৃতিক যুদ্ধে, আবার কখনো প্রচারাভিযানের মতো নানা বিচিত্র রাস্তায়। দুনিয়ায় ডান ও বাম রাজনীতির নানা ধরন এবং তাদের বিচিত্র মিশ্রণ আমরা লক্ষ্য করেছি। এমন কী সোভিয়েত ভাঙনের তিরিশ বছর পরেও তা বহমান।

অনেক বিশ্লেষক, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বিভিন্ন সময়ে বলার চেষ্টা করেছেন বুর্জোয়া রাজনীতির মধ্যে যে বিচিত্র দ্বন্দ্বসংঘাত এবং প্রাণস্পন্দন আছে, বাম রাজনীতি বিশেষত কমিউনিস্ট রাজনীতির মধ্যে তার বেশ অভাব। এখানে শ্রেণীসংগ্রামের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়কে কেন্দ্র করেই যাবতীয় ডিসকোর্স আবর্তিত বলেই এমনটা হয়, একথাও বলার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল দুনিয়াজোড়া কমিউনিস্ট ও বাম আন্দোলনের বিচিত্র গতিপথকে এই তত্ত্ব একেবারেই মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করেনি। দেশে দেশে অর্থনীতি, রাজনৈতিক কাঠামো, সংস্কৃতি ইত্যাদির যে ভিন্নতা তাকে স্বীকার করেই কমিউনিস্ট আন্দোলন ও বাম আন্দোলন বহু বিচিত্র ধারায় বিকশিত হয়েছে। এমন কী দুনিয়াজোড়া যে সমাজতান্ত্রিক/নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবগুলি সম্পন্ন হয়েছে, তার গতিপথ ও চরিত্রে রয়েছে অনেক বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা। রুশ বিপ্লব, চীন বিপ্লব, কিউবার বিপ্লব বা ভিয়েতনামের কথা স্মরণ করলেই আমরা এগুলো বুঝতে পারি।

রাশিয়ার বিপ্লব প্রচেষ্টা প্রসঙ্গেই লেনিন মার্কসবাদের সৃজনশীল দিকটির কথা তুলেছিলেন। একটি গুরূত্বপূর্ণ রচনায় লেনিন লিখেছিলেন, “আমরা মার্কসের তত্ত্বকে পরিসমাপ্ত ও স্পর্শাতীত কিছু একটা বলে দেখি না। উল্টে আমরা বরং মনে করি যে তা একটা বিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি করেছে। জীবন থেকে পিছিয়ে পড়তে না চাইলে তাকে সব দিক থেকে আরো বিকশিত করতে হবে সমাজতন্ত্রীদের।” মার্কসীয় তত্ত্বের প্রতি এই ধরনের সৃজনমূলক মনোভাব রুশ বিপ্লবের সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি ছিল। মার্কস-এঙ্গেলস মনে করেছিলেন উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব এবং একগুচ্ছ ধনতান্ত্রিক দেশে বিপ্লব না হলে তাকে রক্ষা করা কঠিন। লেনিনবাদ তার সৃজনীশক্তি দিয়ে রাশিয়ার মতো তুলনামূলকভাবে পশ্চাদপদ একটি পুঁজিবাদী অর্থনীতির দেশ, যেখানে সামন্ততন্ত্রের প্রবল উপস্থিতি থেকে গিয়েছে, সেখানেও যে প্রলেতারিয়েতের নেতৃত্বে শ্রমিক ও গরিব কৃষকদের মধ্যে মৈত্রীর ভিত্তিতে বিপ্লব সফল করে তোলা যায় – তা দেখাল। সেইসঙ্গে অন্য কোনও সমাজতান্ত্রিক দেশের উপস্থিতি ছাড়াই কেবলমাত্র দেশের ভেতরের শ্রমিক, কৃষক, সেনাবাহিনী ও জনগণের ব্যাপকতম অংশের আস্থা জয় করে দেশের মধ্যেকার কুলাক ও প্রতিবিপ্লবী শক্তি এবং বাইরের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে (জাপান, ফ্রান্স, ইংলন্ড, জার্মানি ইত্যাদি) লড়াই করে বিপ্লবকে টিঁকিয়ে রাখতে সক্ষম হল। ইউরোপীর রাশিয়া থেকে শুরু করে এশীয় রাশিয়ার কোণে কোণে তাকে ছড়িয়ে দিতে পারল। এই ব্যবহারিক অর্জনগুলি হয়ে উঠল নতুন তাত্ত্বিক শিক্ষা।

মার্কসবাদের এই সৃজনশীল দিকটির বিকাশের জন্য ব্যাপক অধ্যয়নের ওপর জোর দিয়েছিলেন লেনিন। নিজেই শুধু সমকালীন জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই পারঙ্গম হয়ে উঠেছিলেন তাই নয়, বলশেভিক কমরেডরা যেন এই বিষয়ে দক্ষ হয়ে ওঠেন, সেজন্য তাঁর আন্তরিক প্রয়াস ছিল। ১৯১১-তে প্যারিসে পার্টি স্কুলের এক বড় আয়োজন ছিল গুরূত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কাজ। পিটার্সবুরগ, মস্কো, সরমোভো, বাকু, তিফলিস সহ রাশিয়ার অনেকগুলি শহরের অগ্রণী বলশেভিকরা এই পার্টি স্কুলে অংশগ্রহণ করেন। এই পার্টি স্কুলে লেনিন অর্থশাস্ত্র নিয়ে ২৯টি, কৃষি প্রশ্নে ১২টি, রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব ও প্রয়োগ নিয়ে ১২টি বক্তৃতা দেন। লেনিনের বক্তৃতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল বোধগম্যতা ও প্রাঞ্জলতা। অর্থশাস্ত্র ও দর্শনের দুরূহতম প্রশ্নগুলিকেও লেনিন আলোচনা করতেন শ্রমিকদের আয়ত্তাধীন ও বোধগম্য রূপে। পাঠের চরিত্র প্রায়ই হত সজীব আলাপের মতো। উপস্থিত সকলেই তাতে যোগ দিতেন। পড়াশুনো হতো অনেক এবং বেশ খাটাখাটনি করে প্রস্তুতি নিয়ে। স্কুলের কাজে লেনিন খুব খুশিি ছিলেন। এই পার্টি স্কুলটি ছিল ভবিষ্যতের বলশেভিক পার্টি স্কুল কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসূরী। লেনিনের সারাজীবনের লেখালেখি লক্ষ্য করলেও পার্টি শিক্ষার দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নজরের দিকটি আমরা অনুধাবন করি।

lenin

 

লেনিনবাদের সৃজনী শক্তিই মার্কসবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে, দেশে দেশে মেহনতি মানুষের জয়ের ক্ষেত্রে বারবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, চীন বিপ্লবের ক্ষেত্রে মাও সে তুং চিন্তাধারার মধ্যে যার এক ভিন্ন প্রকাশ আমরা দেখেছি। মূলত কৃষক সমাজকে ভিত্তি করে চীন বিপ্লবের যে অগ্রগতি তা মার্কসীয় বীক্ষায় নতুন সৃজনমূলক দিক ছিল লেনিনের পর।

লেনিনবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অনাপোষী মনোভাব। মতাদর্শের প্রতি দৃঢ় থেকে স্রোতের বিরুদ্ধে পথ হাঁটার ব্যাপারে লেনিন ছিলেন অত্যন্ত সাহসী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পরেই প্রলেতারিয় আন্তর্জাতিকতার ক্ষেত্রে পিছু হটার একটা পর্ব শুরু হয়। ইউরোপের বিভিন্ন সমাজ গণতান্ত্রিক দলগুলো নিজ নিজ দেশের যুদ্ধস্বার্থ তথা জাতীয় বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তি শুরু করে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে যায় কেননা শ্রমিক শ্রেণির বিভিন্ন দল নিজ নিজ দেশের পুঁজির স্বার্থে পরস্পরের শত্রু শিবিরে দাঁড়িয়ে যায়। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবং বেলজিয়ামে সোশালিস্টরা সরাসরি সরকারে যোগ দেয়। জার্মানিতে সরকারে যোগ না দিলেও যুদ্ধ চালানোর জন্য ব্যয়বরাদ্দের পক্ষে ভোট দেয়। তারা প্রচার করে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, সমস্ত দেশের শ্রমিকদের শ্রেণী ঐক্য, তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধ হল শান্তিকালীন সময়ের ব্যাপার। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে নিজ দেশের বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা তাদের ভুলতে হবে। সব কিছুকে হতে হবে যুদ্ধের অধীন। রাশিয়ায় প্লেখানভের মতো সম্মানীয় মার্কসবাদীও এই ভুল পথ নেন। বলশেভিক পার্টি ও তার নেতা লেনিনের নেতৃত্ব এই নিরিখে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছিল। লেনিন ও বলশেভিকরা যুদ্ধের প্রথম থেকেই দ্বিধাহীনভাবে এই যুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলে বর্ণনা করেন ও এটা স্পষ্ট করে দেন যে শ্রমিকদের কাজ নয় জাতিয়তাবাদের নামে নিজ নিজ দেশের বুর্জোয়াদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে মদত দেওয়া। দেশ বিদেশের প্রতিকুল স্রোত এবং অজস্র ধরপাকড় অত্যাচার নির্যাতনের মুখে দাঁড়িয়েও বলশেভিকরা তাদের যুদ্ধবিরোধী অবস্থানে অটুট থাকে। লেনিনের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কর। তিনি বললেন অপর দেশের যে সমস্ত মজুরি-দাসেরা আমাদের ভাই তাদের বিরুদ্ধে নয়, অস্ত্র ঘুরিয়ে ধরতে হবে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া সরকারের বিরুদ্ধে। যুদ্ধের সময়েও প্রলেতারিয় বিপ্লবের আহ্বানকে ভুলে যাওয়া চলে না। লেনিন আহ্বান রাখলেন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করার পক্ষে, যা সংগঠিত হবে নিজ নিজ দেশের বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণি ও মেহনতি জনতার বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে। ‘ইউরোপীয় যুদ্ধে বিপ্লবী সোশ্যাল ডেমোক্রেসির কর্তব্য’, ‘সমাজতন্ত্র ও যুদ্ধ’ প্রভৃতি বইতে লেনিনের এই সমস্ত চিন্তা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের যে নতুন সময়ে দুনিয়া প্রবেশ করল তাকে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে লেনিন লেখেন ‘ইম্পিরিয়ালইজম : দ্য হায়েস্ট স্টেজ অব ক্যাপিটালিজম’ (সাম্রাজ্যবাদ : পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়) নামক ক্লাসিকটি। এই বইতে লেনিন দেখান সাম্রাজ্যবাদের আমলে দেখা দেয় বড় বড় একচেটিয়া কারবার ও পুঁজিপতিদের জোট। এই সাম্রাজ্যবাদকে তাই লেনিন বলেন একচেটিয়া পুঁজিবাদ। বিশ্বের কাঁচামালের উৎস, পণ্যোৎপাদন ও বাজারের একটা বৃহৎ অংশ দখল করে নেয় একচেটিয়া মালিকেরা। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রভুত্ব করতে থাকে তারা, সরকারগুলির ওপর নিজেদের অভিপ্রায়কে চপিয়ে দেয়। মুষ্টিমেয় সাম্রাজ্যবাদী দেশ নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেয় প্রায় সারা বিশ্বকে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশের অসমতা বৃদ্ধি পায়। মুনাফার তাড়ণায় সাম্রাজ্যবাদীরা শ্রমিক ও সমস্ত মেহনতিদের শোষণ বাড়িয়ে তোলে, তাদের অবস্থা হয়ে ওঠে অসহ্য। বিপ্লবের আবশ্যিকতা বুঝতে শুরু করে প্রলেতারিয়েত। সেই সঙ্গে মুষ্টিমেয় সাম্রাজ্যবাদী দেশের দ্বারা নিপীড়িত যে উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশে কোটি কোটি লোকের বাস তাদের সঙ্গে বিরোধ প্রখর হয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির। লেনিন দেখান কীভাবে পুঁজিবাদ ক্রমশ হয়ে উঠেছে প্রতিক্রিয়াশীল, সমাজের বিকাশের পথে এক মহা বিঘ্ন। মানবসমাজের সামনে অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজতন্ত্রের পথে হাঁটা অথবা উপনিবেশ, একচেটিয়াদের বিশেষ সুবিধা, সব ধরনের জাতীয় পীড়নে অভ্যস্ত হয়ে পড়া। সাম্রাজ্যবাদ মানবসমাজকে এক বিশেষ অর্থে সমাজতন্ত্রের কাছাকাছি নিয়ে আসে। এর সঙ্গে সমঝোতার ভুল পথ দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের বহু দল নিলেও লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার বলশেভিকরা কখনো নেননি। তাঁরা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মূল স্রোতের বিরুদ্ধে মতাদর্শে দৃঢ় থেকে চলতে পেরেছিলেন বলেই রাশিয়ায় বিপ্লবের কাজটা এগিয়ে যেতে পেরেছিল। লেনিনবাদের দুটি বিশেষ দিক – সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অনাপোষী সংগ্রাম এবং নিজের দেশকালের নিরিখে মার্কসবাদের সৃজনশীল প্রয়োগ আজকের দিনের কমিউনিস্টদের জন্যও আলোকবর্তিকা।

press

দেশজুড়ে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে চরম ব্যর্থতা, আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসায় চরম অব্যবস্থা, আক্রান্ত মানুষের মধ্যে বিভাজনের রাজনীতি এবং অন্ধবিশ্বাস ও অস্পৃশ্যতার রাজনীতির প্রসারে সদা তৎপর কেন্দ্রের মোদি সরকারের এখন একমাত্র হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে লকডাউন আর রাজ্যে-রাজ্যে হস্তক্ষেপ ঘটিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করা। করোনা প্রতিরোধে যথেষ্ট সময় পেয়েও ভেঙে পড়া সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে প্রস্তুত করে তোলা, সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে যারা লড়াই করবেন সেই চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও সাফাই কর্মীদের সুরক্ষার জন্য পিপিই-এর ব্যবস্থা করা, কোভিড-১৯ প্রতিরোধের একটি জাতীয় রূপরেখা তৈরি করার বিপরীতে বেশি ব্যস্ত ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্মর্ধনায়। আজ তার খেসারত দিচ্ছে গোটা দেশ।

এরাজ্যও তার ব্যতিক্রম নয়। এই রাজ্যের মাটিতেই বঙ্গসন্তান উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী কালাজ্বর প্রতিরোধের ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন, এই মাটিতেই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, সিস্টার নিবেদিতা, ডঃ রাধাগোবিন্দ কর, ডঃ নীলরতন সরকার ১৮৯৭’র ভয়াবহ কলেরা মহামারী প্রতিরোধে গণউদ্যোগ, নাগরিক উদ্যোগের মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, আজ সেই মাটিতেই চলে মৃত্যু বা আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে কারচুপি, তা সে ডেঙ্গি নিয়েই হোক, আর করোনা নিয়েই হোক। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ও একদল আমলার হাতে করোনা মহামারী প্রতিরোধের সমস্ত ঔষধি। লালারসের টেষ্টের জন্য আরও পরীক্ষা কেন্দ্র কেন খোলা হচ্ছে না, পিপিই এত অপ্রতুল বা নিম্নমানের কেন, করোনা সংক্রমণ চিহ্নিত করণে রক্ত পরীক্ষা বা পুল টেষ্ট কেন হচ্ছে না, তা স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ও কতিপয় অচিকিৎসক আমলা ঠিক করবেন। মুখ্যমন্ত্রী কালিঘাট থেকে কসবা, বেহালা থেকে বাঁশবেড়িয়া সদলবলে ত্রাণ বিলি করবেন; পুলিশ, আমলা, সরকারী-বেসরকারী ক্যামেরাম্যান নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে বেড়িয়ে নিয়মভঙ্গ করবেন, প্রশ্ন তুললেই দমনমূলক মহামারী আইনের এ ধারা বা সে ধারা প্রয়োগের হুমকি।

পশ্চিমবঙ্গে এমনই আবহাওয়া গড়ে ওঠার অপেক্ষায় ছিল কেন্দ্রের মোদি-অমিত শাহ জুটি। প্রতিদিন এই আবহাওয়া সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে আছেন রাজভবনের মহামান্য কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি রাজ্যপাল মহোদয়। তাকে নিয়মিত সহযোগিতা করে গেছে বিজেপির স্বনামধন্য সাংসদরা।

সাধারণ মানুষের জীবন যখন ক্ষুধার তাড়নায় বিপন্ন, করোনা রোগ ও আতঙ্ক যখন মাথার উপর, মানুষ যখন দিশেহারা, তখন কলকাতার রাজপথে রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয় পরিদর্শক দলের গাড়ি ঘুরছে, আর স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী রাস্তায়-রাস্তায় করোনা লকডাউনের নিয়মাবলী শেখাচ্ছেন যুগপৎ পুলিশ ও জনতাকে।

আমরা কেন্দ্রীয় বাহিনীর এই অনভিপ্রেত রাজপথে ভ্রমণের বিরুদ্ধে, বরং যদি সহযোগিতার বিন্দুমাত্র আকাঙ্ক্ষা থাকে তবে নবান্নে বসে আলোচনা করুন, নচেৎ দিল্লি ফিরে বিশ্রাম নিন। আর মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি আবেদন উত্তেজনা পরিহার করে মানুষের প্রাণ বাঁচানোর কাজে মনোনিবেশ করুন। করোনা ভাইরাস আমজনতা বা মুখ্যমন্ত্রী কাউকেই আলাদা করে চিনতে পারে না। শিরোনামে থাকা কথাটা আমাদের সকলের জন্য প্রযোজ্য।

– পার্থ ঘোষ
সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি, সিপিআই(এমএল)

dolar

 

h6

অপরিসীম দারিদ্র্য বিপর্যয়ের অভিঘাতকে কতটা ভয়ঙ্কর চেহারা দিতে পারে, শহরে, কাজের ক্ষেত্রে রুজি-রুটির বন্দোবস্ত বন্ধ হওয়ায় নিজেদের গ্রামের উদ্দেশ্যে অভিবাসী শ্রমিকদের মাইলের-পর-মাইল পায়ে হেঁটে চলার মর্মন্তুদ ছবিগুলি সেই সত্যকেই সামনে নিয়ে আসে। সংক্রমিত হবার ভয় সকলেরই, তবু দরিদ্রশ্রেণির মানুষের ঝুঁকি অনেক বেশি, কারণ এই লকডাউন-অবস্থা সহ্য করে বেঁচে থাকার ক্ষমতা তাঁদের অনেক কম। হয় রোগে ভুগে মরা, নয় না-খেতে-পেয়ে — এ ভিন্ন এঁদের পথ নেই।

করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব-জনিত স্বাস্থ্যসঙ্কট ও তার ফলে সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর বাড়তে থাকা চাপই শুধু নয়, বিপদটা আরও ব্যাপ্ত এবং গভীর। ভূমিকম্প পরবর্তী ঝটকার (aftershock) মতো এই ভাইরাস আক্রমণও নানাবিধ পরোক্ষ সঙ্কটের সম্ভাবনা নিয়ে আসে, যা মূল বা প্রত্যক্ষ বিপদের ফলের সঙ্গে তুলনীয়। এই সঙ্কট সকলকেই স্পর্শ করে বটে, তবে এর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি ভোগ করেন সমাজের দরিদ্রশ্রেণী ও অরক্ষিত জন (এই দুই গোষ্ঠীকে এক মনে করে নেবার কারণ নেই, যেহেতু অরক্ষিতজনের মধ্যে দরিদ্র নন অথচ বয়স্ক ও অশক্ত মানুষও থাকতে পারেন)। এই অপ্রত্যক্ষ বিপদ চাহিদা ও জোগান-সমস্যার জোড়া ফলা নিয়ে একযোগে আঘাত করে। জোগান-প্রবাহ ব্যাহত হলে ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হন। আপনি যদি বিত্তবান হন অথবা আপনার যদি আয়ের নিশ্চয়তা থাকে (যা বাঁধা মাইনের চাকরিতে থাকে), তাহলে আপনি বিপদের দিনে আঘাত কিছুটা সামলে উঠতে পারবেন। কিন্তু মোট দক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিকশ্রেণীর কত শতাংশের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য? অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকের অনুপাত হল মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৮০-৯০%, তাই এই আর্থিক নিরাপত্তার সুরক্ষা খুব অল্প সংখ্যার মানুষেরই থাকে। বাকিদের পরবর্তী বিপদ আসে আয়ের ওপর আঘাতের মাধ্যমে। দরিদ্রের কাছে বিপদ তাই দুদিক থেকেই সমান।

এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের ত্রাণ প্যাকেজকে, এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকারের (বিশেষ করে কেরলের, তার সঙ্গে আমাদের রাজ্যেরও উল্লেখ করা উচিত) নেওয়া পদক্ষেপগুলিকে স্বাগত জানাতেই হয়। এই ত্রাণ প্যাকেজ-ব্যাতিরেকে তিন সপ্তাহের লকডাউনের পরোক্ষ ফলাফল কোভিড-১৯-এর প্রত্যক্ষ বিপদকে ছাপিয়ে যেতে পারত। সবথেকে বড় কথা, একটি মূল বিষয়কে এই প্যাকেজ প্রাপ্য মান্যতা দিয়েছে। দরিদ্র ও অরক্ষিত মানুষের হাতে নগদ টাকা হস্তান্তর ও গণবণ্টন ব্যবস্থায় জোগান দ্বিগুণ করে খাদ্য-সুরক্ষার নিশ্চয়তা – এই দুই পদক্ষেপ একসঙ্গে নিয়ে সরকার জোগান ও চাহিদার দ্বিমুখী সমস্যার সমাধানের প্রচেষ্টা দেখিয়েছেন। জোগানশৃঙ্খলা ব্যাহত হলে শুধু নগদ অর্থ কোন কাজে আসবে? একইরকম ভাবে, দোকানে জিনিসের অভাব না থাকলেও ক্রেতার অর্থের অভাব সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। সাধারণভাবে, দরিদ্রশ্রেণীর মানুষকে সহায়তা নগদ অর্থের মাধ্যমে দেওয়া উচিত, না সম-অর্থের ব্যবহার্য বস্তু (যেমন, রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্য) এ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে এই বিপুল বিপর্যয়ের মোকাবিলায় এই বিতর্ক অবান্তর– এই দুইয়ের মেলবন্ধনেই কার্যকরী সমাধান সম্ভব।

pack

 

তবু কিছু বিষয়ে আশঙ্কা থেকেই গেল।

প্রথমত, বিপর্যয়ের দীর্ঘ সময়কালে এই বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন ও জীবিকা সুরক্ষিত করার মতো যথেষ্ট অর্থ এই প্যাকেজে বরাদ্দ করা হল কি? এক কোটি সত্তর লক্ষ টাকা আমাদের জিডিপি-র এক শতাংশেরও কম (ফেব্রুয়ারী মাসে প্রকাশিত ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের জিডিপি-র আগাম অনুমানের পরিমার্জিত হিসাব-অনুযায়ী)। তদুপরি এই প্যাকেজে এমন বেশ কিছু প্রকল্প আছে যেগুলি আগে থেকেই বলবৎ রয়েছে। সুতরাং সেই সব প্রকল্পের জন্য বণ্টিত অর্থও আগে থেকেই সরকারের তরফে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি যোজনা, বা পিএম-কিষাণ প্রকল্প এমনই একটি প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি কৃষক পরিবারকে বছরে ছয় হাজার টাকা, অর্থাৎ মাসে পাঁচশো টাকা করে দেওয়া হয়। হতে পারে যে এটা সূচনা। তবু যেখানে প্রাণ বাঁচানোটাই মুখ্য, সেখানে অর্থের বরাদ্দ, সাময়িকভাবে হলেও, বাড়ানোটা জরুরি কারণ এই অঙ্ক প্রয়োজনের তুলনায় নেহাতই স্বল্প।

দ্বিতীয়ত, এই প্যাকেজে জন-ধন অ্যাকাউন্ট আছে এমন মহিলাদের (২০.৮ কোটির মতো) আগামী তিন মাসের প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে দেওয়া হবে। তা ছাড়া, তিন কোটি বরিষ্ঠ নাগরিক ও বিধবাকে এককালীন এক হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। এখন, অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন এমন বহু মানুষের জন-ধন অ্যাকাউন্ট নেই (মোট অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ৩৮.৩ কোটির মতো, যেখানে মোট জনসংখ্যা ১৩৩ কোটি, আর কর্মরত বা কর্মসক্ষম জনসংখ্যা অন্তত ৫০ কোটি)। সুতরাং, প্রকৃতপক্ষে দীনদরিদ্র এমন অনেকেরই এই ব্যবস্থায় বাদ পড়ে যাবার অবকাশ থাকছে। তাই এই অবস্থায় ইউনিভার্সাল ইনকাম ট্রান্সফার বা সার্বিক আয় হস্তান্তর সবথেকে কার্যকর হতে পারত – প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক একটা থোক টাকা পাবেন (এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে তাদের মাতা বা পিতা বা ভারপ্রাপ্ত অভিভাবকও একটা থোক টাকা পাবেন)। ঠিক, দরিদ্র নন এমন কিছু মানুষও এর সুবিধা পেয়ে যাবেন। কিন্তু অর্থনীতি তার নিজের ছন্দ ফিরে পেলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর আদায়ের মাধ্যমে এই বর্ধিত খরচ তুলে নেওয়া যেতে পারে, আর তার ভার পড়বে তুলনায় সচ্ছল শ্রেণীর লোকেদের ওপরে বেশি। তাই আখেরে এই অর্থ সচ্ছল শ্রেণীর লোকেদের থেকে দরিদ্র শ্রেণীর লোকেদের কাছেই বণ্টিত হত। কিন্তু বিপর্যয়ের সময় কার সাহায্য প্রাপ্য কার নয়, সেটা দেখতে গিয়ে সময় ও সম্পদের অপচয় হত না।

food

 

প্রকৃতপক্ষে মানুষের প্রাণ বাঁচানোই যখন মুখ্য উদ্দেশ্য, তখন বজ্র-আঁটুনি দিতে গিয়ে কিছু অভাবগ্রস্তকে সুরক্ষাবলয়ের বাইরে রেখে দেবার ঝুঁকি নেওয়ার থেকে যারা অভাবী নন, তাঁদের কাছেও সাহায্য পৌঁছে গেলে ক্ষতি নেই। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে আমি ও কার্তিক মুরলীধরন সম্প্রতি একটি নিবন্ধে লিখেছি, যে সমস্ত পরিবারকে পিএম-কিষাণ প্রকল্পের আওতায় আনা উচিত, এবং আমাদের হিসাব অনুযায়ী এতে খরচ পড়বে জিডিপি-র শতকরা এক শতাংশ। বর্তমানে পিএম-কিষাণ বাবদ সরকারের খরচ হচ্ছে জিডিপি-র ০.৫ শতাংশ। প্রদেয় অর্থের পরিমাণ দ্বিগুণ করলেই সুবিধাভোগীদের চিহ্নিতকরণ বাবদ খরচ ও প্রকৃত অভাবীকে বাদ দেওয়ার মত ভুল থেকে বাঁচা যায়।

তৃতীয়ত, বণ্টন ব্যবস্থার একটি প্রধান সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রাখতে হবে। আমরা যেমন জানি, যে এই ধরনের একটা বিপর্যয়ের সময় জোগান দিয়ে চাহিদা পূরণের জন্য শুধুমাত্র বাজারের ওপর নির্ভর করে থাকলে চলে না, আমরা এও জানি যে রাষ্ট্রের ক্ষমতারও সীমাবদ্ধতা আছে। ১৩০ কোটির দেশে, যেখানে দুই-তৃতীয়াংশের বাস গ্রামে, আর খেটে-খাওয়া মানুষজনের মধ্যে মাত্রই দশ শতাংশ যুক্ত আছেন সরকারী দপ্তরে অথবা সংগঠিত ক্ষেত্রে, সেখানে অসংগঠিত ক্ষেত্রের (যেমন বাজারের সব্জিবিক্রেতা) এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্য-ব্যতিরেকে বণ্টনব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠে এই বিপুল পরিমাণ মানুষের কাছে তাঁদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়া কীভাবেই বা সম্ভব? এই বিপদের দিনে এই জোগান-শৃঙ্খলাকে ধারণ এবং চালনা করবার ক্ষমতা রাষ্ট্রের বা সংগঠিত ক্ষেত্রের নেই। এর আশু অর্থ, লকডাউন ব্যবস্থা কার্যকর করতে আইন রক্ষকদের আরও কিছুটা ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় রাখতে হবে। ঘরের বাইরে কাউকে দেখলেই অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে (সংবাদমাধ্যমে পরিবেশিত তথ্য অনুযায়ী বলপ্রয়োগ করে, এবং কমপক্ষে একজন মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে) তাকে ঘরে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিলে ফল হিতে বিপরীত হবে। কঠোরভাবে লকডাউন নিশ্চিত করতে গিয়ে আপৎকালীন জোগান-শৃঙ্খলা যদি বিঘ্নিত হয়, তবে তার ফল হবে মারাত্মক, এবং তার অভিঘাত হবে জনস্বাস্থ্য সঙ্কটের থেকে অনেক বেশি তীব্র। অনাহারে মৃত্যুই যদি ভবিতব্য হয়, তবে রোগ ভোগের থেকে বাঁচিয়ে কী লাভ?

এমন সঙ্কটকালে মানুষের প্রাণ বাঁচানো আর ক্লেশ কমানোই স্বাভাবিকভাবে অগ্রাধিকার পাবে। অবশ্যই এসবের জন্য চোকাতে হবে অর্থনৈতিক মূল্য। তবে “অর্থনীতি” শব্দের অর্থ কী? চাহিদা ও জোগানের পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এ এমন এক শৃঙ্খল যা আমাদের সবাইকে বেঁধে রেখেছে পারস্পরিক প্রয়োজন ও নির্ভরতার বন্ধনে। এই সংযোগের শৃঙ্খলের অঙ্গ যে মানুষ, অনাহারে বা জ্বরাগ্রস্ত হয়ে সে-ই যদি ধ্বংসের মুখোমুখি হয়, তবে শেয়ার বাজারের সূচকই হোক বা জিডিপি – শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যাবে না কোনোটাই। আজ আমাদের সকলের একটাই শত্রু, যদিও খালি চোখে তাকে দেখা যায় না। নানান মতের বিভেদ সরিয়ে রেখে এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়াই আমাদের আশু কর্তব্য। হয় সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ভেসে থাকা, নয় মৃত্যু। যে কোনও যুদ্ধের মত এই লড়াইয়েও আক্রমণকারীকে প্রতিহত করে চলার সঙ্গে দুর্বলের রক্ষা করাও আমাদের সমান কর্তব্য। অন্যথায় আমাদের জয় হবে অসার, নিরর্থক।

(মূল রচনাটি ইংরাজিতে গত ২৮ মার্চ এনডিটিভির ই-কাগজে প্রকাশিত হয় এবং তারপর লেখকের অনুমত্যনুসারে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম  ই-ম্যাগাজিনে এই বাংলা অনুবাদটি প্রকাশিত হয়।)

copro

 

h7

করোনা — এই ছোট্ট শব্দটি সারা বিশ্বে ভয়ঙ্কর ত্রাস সৃষ্টি করেছে। যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া অমূলক নয় কারণ বিশ্বের উন্নত দেশগুলি গত পঞ্চাশ বছরে এইরকম ভয়াল সংক্রমণের মুখোমুখি হয়নি। এর কারণ বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি অবাঞ্ছিত তথ্য বেরিয়ে আসে। সেগুলি হল :

১) চীনের ভূমিকা;
২) WHO-এর ভূমিকা;
৩) উন্নত দেশগুলির প্রতিবিধানমূলক পরিষেবার অভাব ও তথ্য বিশ্লেষণে গাফিলতি;
৪) ওষুধ বিক্রেতাদের অবাধ রাজনৈতিক প্রসাদ লাভ; এবং
৫) মহামারীটিতে ক্রমশ অবাধ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও তথ্য বিকৃতি।

চীনের উহান শহরে প্রথমবার রোগটির প্রসার শুরু হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত এই ভাইরাসটির উৎপত্তির কারণ রহস্যময় হয়ে রইল। বাদুড় থেকে এটা মানুষের মধ্যে এসেছে নাকি কোনও ল্যাবরেটরি থেকে, এটা আমরা এখনও সঠিক জানি না। প্রাথমিক পর্যায়ে চীন এই গোপনীয়তা বজায় রেখেছিল এবং সামগ্রিকভাবে WHO-র নজরদারিও সেই সময় ছিল খুবই দুর্বল। তাছাড়া, এর আগের করোনা ভাইরাসঘটিত রোগগুলিরও উৎপত্তিস্থল ছিল চীন, তাই এবারেও সেখানে নজরদারি প্রখর রাখাই সঙ্গত হত। এরপর রোগটি বিশ্বের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়লে WHO চীন থেকে অন্যান্য দেশে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল। ভারতবর্ষ একই পদক্ষেপ নিল, তবে তা আরও অনেক পরে। এই ধরনের ভাইরাল রোগ যেন ছড়াতে না পারে, তার একটা মান্য কার্যপ্রণালী আছে WHO-র কাছেই, যা পূর্বের বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, সার্স (SARS) ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছিল। এক্ষেত্রে তা মানা হল না।

প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে তাদের উন্নত পরিকাঠামো, শিক্ষাব্যবস্থা, নাগরিকদের মধ্যে বহুদিন ধরে গড়ে ওঠা সচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি এবং এই সমস্ত কিছুর সমন্বয়ে এক উন্নত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এই উন্নত জনস্বাস্থ্য তাদের ছোঁয়াচে রোগগুলি — অপেক্ষাকৃত অনুন্নত তৃতীয় বিশ্ব মূলত যেসব রোগে ভোগে — থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। একই চিত্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতেও। এইসব দেশে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টির ক্রমান্বয়ে গুরুত্ব হারানো এবং স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের ক্রমহ্রাসের কুফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে। ঠিক এইরকম অপ্রস্তুত অবস্থায় দাঁড়িয়েও এই রোগটির সংক্রমণের বিপদকে যে উন্নত দেশগুলি লঘু করে দেখেছিল তা ট্রাম্প, বরিস জনসন বা ইটালির প্রধানমন্ত্রীর কথা থেকে আমরা সবাই জানতে পেরেছি।

আগামী বছর ভারতবর্ষে নানা রাজ্যে নির্বাচন। মাত্র কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমাদের দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তারা নির্বাচন বা নির্বাচনী রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। এনআরসি, শাহিনবাগ এগুলোই ছিল আমাদের দেশের প্রধান ইস্যু। করোনা যখন এ দেশে প্রথমবার প্রবেশ করল এবং সে খবর জানা গেল, তখন পূর্বতন সরকার যা যা ঠিক কাজ করেছিলেন, সেসব কিছুই অনুসরণ করা হল না। পরিবর্তে যা যা করা হল তা মোটের ওপর চীনের নকল। ICMR বা WHO এক্ষেত্রেও তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করলেন না। রাজ্যের ক্ষেত্রে দেখা গেল নামজাদা চিকিৎসকেরা হঠাৎ জনস্বাস্থ্য নিয়ে, মহামারীবিদ্যা নিয়ে নানা কথা বলছেন, যা তাঁদের এর আগের মহামারীগুলিতে কখনও বলতে শুনিনি৷ মহামারী-বিশারদেরা সেই পিছনের সারিতেই থেকে গেলেন। NICED, যারা আগের মহামারিগুলিতে ত্রাতার ভূমিকা পালন করেছিলেন, তারাও অপাংক্তেয় হয়ে রইলেন। রোগ ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে।

অন্য প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমণ

ভাইরাস যখন কোনও প্রাণীর মধ্যে আশ্রয় নেয় ও বংশবৃদ্ধি করে, চরিত্রগতভাবে তা সহজে বদলায় না। এর জন্য কোনও ভাইরাস সাধারণত প্রাণীদের থেকে মানুষে সংক্রামিত হয় না।

hiv

 

কিন্তু মানুষের কিছু বদ-অভ্যাসের দরুণ এইচআইভি-র ক্ষেত্রে প্রথম এই ধরনের সংক্রমণ দেখা গেল। ১৯৫৯ সালে, বেলজিয়ান কঙ্গোতে। তা সত্ত্বেও এই ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ সম্বন্ধে ১৯৮০ সালের আগে আমরা জানতে পারিনি। ১৯৮৬ সালে কেরল ও তামিলনাড়ুতে যৌনকর্মীদের মধ্যে প্রথমবার এইচআইভি সংক্রমণ ধরা পড়ে ও এইডস কথাটি ভারতবর্ষে প্রবেশ করে৷

এর বেশ কিছুদিন পর আমাদের রাজ্যে, শিলিগুড়িতে হঠাৎ বেশ কিছু মানুষ জ্বরে আক্রান্ত হলেন ও পরে এনকেফালাইটিস নিয়ে মারাও গেলেন৷ একে বলা হল ‘শিলিগুড়ি জ্বর’। ক্রমে এর কারণ হিসাবে জানা গেল একটি ভাইরাসের নাম — NIPHA — যা বাদুড় থেকে লিচুর মাধ্যমে মানুষে সংক্রমণ ঘটিয়েছে৷ সেটা ২০০১ সাল। এর পরে ২০০২-০৩ সালে সার্স, ২০০৭ সালে বার্ড ফ্লু, ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু এবং ২০১২ সালে মার্স (MERS)। এর সবগুলিই এই রাজ্যে বেশ ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল৷

পূর্বের অভিজ্ঞতা

যে রোগগুলির বিবরণ দিলাম, সেগুলির প্রাদুর্ভাব ঘটার সময় আমি স্বাস্থ্যবিভাগে কর্মরত, তাই এই রোগগুলির বিষয়ে কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার আছে।

NIPHA ভাইরাসের সংক্রমণ রোখার অভিজ্ঞতা হওয়ার পর এল সার্স, ওই চীন থেকেই। আমরা আমাদের চিকিৎসকের দল নিয়ে কলকাতা ও বাগডোগরা বিমানবন্দরে কড়া নজরদারি শুরু করলাম। এর আগে আমরা সকলের সঙ্গে আলোচনা করলাম — করপোরেশন, রেলওয়ে, এয়ারপোর্ট অথরিটি, প্রতিরক্ষা দপ্তর, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং এঁরা ছাড়াও Community Medicine-এর প্রধানদের সঙ্গে৷ NICED অবশ্যই সঙ্গে ছিল৷ ছিলেন বেলিয়াঘাটা আইডি-র সুপার (তখনও ওই প্রতিষ্ঠানটি মেডিকেল কলেজ-এ রূপান্তরিত হয়নি)। সকলে মিলে, রাজ্য সরকারের পদাধিকারীদের নেতৃত্বে একটা কার্যপ্রণালী তৈরি করা হল, যাতে সকলেই যথাযথ সাহায্য করার অঙ্গীকার করলেন।

এই মিলিত দল নিয়ে আমরা বিমানবন্দর, হাওড়া-শিয়ালদা স্টেশন এবং কলকাতা বা হলদিয়া পোর্ট ট্রাস্ট-এ নজরদারি করতাম। কারও জ্বর, সর্দিকাশি ইত্যাদি উপসর্গ থাকলে বা কোনও সংক্রামিত দেশ বা রাজ্য থেকে আসার ইতিহাস থাকলে তাকে সোজা আইডি হাসপাতালে পৌঁছনো এবং তার swab নেগেটিভ হলে ছেড়ে দেওয়া, পজিটিভ হলে চিকিৎসা করা — এই সমস্ত কাজের তত্ত্বাবধান করতাম। বলে রাখা ভালো, এই কাজে এমনকি শিলিগুড়ি জ্বরেও PPE-র অভাবের কথা কেউ বলেননি। জেলাগতভাবে একজন উচ্চপদস্থ স্বাস্থ্য আধিকারিক এক একটি জেলার দায়িত্বে থাকতেন — কর্মপ্রণালী মানা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য৷ তখন সব নমুনা NICED-এ পাঠানো হত। এবং দরকার হলে সেখান থেকে পুনায়৷

এই রোগগুলির ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে রোগ প্রতিরোধে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ভারতবর্ষের প্রথম তিনটি রাজ্যের মধ্যেই ছিল। মৃত্যুহার ছিল স্বল্প। যদিও ওই রোগগুলির fatality বা মারণক্ষমতা ছিল ৫০%-এর কাছাকাছি৷ বার্ড ফ্লু-র সময়ে প্রাণীসম্পদ দফতর আমাদের সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করেছে। সারাদিনের তথ্য নিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমাদের বৈঠক হত এবং আগামী দিনের রূপরেখা তৈরি করা হত। একজন নির্দিষ্ট জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আধিকারিক দলের মুখপত্র ছিলেন — একমাত্র তিনিই সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের কাছে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সমস্ত তথ্য দিতেন৷

tb

যেভাবে এগোনো উচিত ছিল

পূর্বের এই অভিজ্ঞতা নিয়েই একইভাবে এবারেও রোগ প্রতিরোধ পরিকল্পনা করলে হয়তো ভালো হত। এইচআইভি সংক্রমণে প্রথমে র‍্যাপিড টেস্ট করা হত সন্দেহভাজনকে শনাক্ত করার জন্য। এবারেও তা করা যেত। NICED সাহায্যের হাত বাড়িয়ে বসে আছে। কয়েকদিন আগে NICED-এর অধ্যক্ষ প্রকাশ্যে বললেন, পরীক্ষা আরও অনেক বাড়া উচিত। তিনি আরও বললেন, লকডাউন এই সংক্রমণের প্রধান এবং একমাত্র হাতিয়ার মনে হতে পারে, কিন্তু একদিন না একদিন তা তুলতেই হবে৷ ভাইরাল রোগ সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে তার মারণক্ষমতা ক্রমশ হারায় ও জনজীবনে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। এর আগের মহামারীগুলি বায়ুবাহিত ছিল, সরাসরি বাতাসের মাধ্যমেই সংক্রমণ ছড়াত। কিন্তু তখন পৃথিবীর কোথাও লকডাউন করা হয়নি।

কোভিড অনেক বেশি সংক্রামক কিন্তু অনেক কম মারক, ধরা যাক, ২-৫%। তা হলে একে নিয়ে এত বেশি উদ্বেগের কারণ কী? আমাদের জনসংখ্যার প্রায় ৮% মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি রোগে আক্রান্ত। টিবি বা যক্ষ্মা সবচেয়ে মারক রোগ। কিন্তু সেটা নিয়ে আমাদের, না রাজনৈতিক না প্রশাসনিক, এর কণামাত্র উদ্বেগ নেই। এমনকি চিকিৎসকেরাও একথা মানতে চান না৷ কোভিড নিয়ে আরও গবেষণা হবে, টীকা নিশ্চয়ই বেরোবে, কিছু চিকিৎসাও। কিন্তু এখন শুধু ভয় নয়, লোকলজ্জাও কাজ করছে। ঠিক যেমন কুষ্ঠ বা টিবি-র ক্ষেত্রে করে৷ একদল PPE-র অভাবের কথা বলছেন। কিন্তু PPE তো সকলের জন্য নয়। এই পোশাক সঠিকভাবে পরতে গেলেও ট্রেনিং দরকার। একজন ইন্টার্ন বা একজন জুনিয়র নার্স তা জানেন না।

এ ছাড়াও জেলা বা ব্লক স্তরে পঞ্চায়েতের সহযোগিতা নিয়ে নজরদারি দল গঠন করতে হবে৷ তাদের সকলকে ট্রেনিং দিতে হবে। এরপর জোনাল সমীক্ষা অর্থাৎ এক বা একাধিক রোগী যেখানে পাওয়া গেছে, সেখানে বাইরে থেকে কেউ এসেছেন কিনা তাদের চিহ্নিত করা ও পরীক্ষা করা আবশ্যক৷ এবং তার চারিপাশের কমপক্ষে ৫০০টি পরিবারে খোঁজখবর নেওয়া ও দরকার হলে পরীক্ষা করার ব্যবস্থাও করা দরকার।

heal

অবহেলিত জনস্বাস্থ্য

WHO বললেন স্বাস্থ্য মানে অসুস্থতা বা পারগতার অভাব নয়, দেহে, মনে ও সামাজিক দিক থেকে সুস্থ থাকা। কোর কমিটি বললেন কুস্বাস্থ্যের কারণ দেশের অধিকাংশ জনসাধারণের দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও অশিক্ষা৷ কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এর নিদানে স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করার কথা বললেন, যেখানে চিকিৎসা হবে, তার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধমূলক পরিষেবা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা হবে। আমাদের দেশে জিডিপির এক নগণ্য অংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হয়। শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্যখাতে মোট ব্যয়ের ১০ শতাংশও জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রকৃত অর্থে ব্যয় হয় না। একটা পরিসংখ্যান দেওয়া যাক — ১৯৫০ সালে সরকার স্থির করলেন এক লক্ষ লোকের জন্য ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ৩০,০০০ জনের জন্য সহকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি হবে৷ এখন পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ১০ কোটির ওপর। তবু স্বাস্থ্যকেন্দ্র ৮০০-রও কম। আটের দশকে বলা হল ৫০০০ জনের জন্য (জনজাতি অধ্যুষিত পাহাড়ি দুর্গম জায়গায় ৩০০০ জনের জন্য) উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করা হবে৷ সেখানে একজন ANM (Auxilliary Nurse Midwife) থাকবেন যিনি ওই গ্রামেরই একজন অবিবাহিত মেয়ে৷ রাজনৈতিক নেতারা এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে সব ওলটপালট করে দিলেন৷ নদিয়ার মেয়ে গেল পুরুলিয়ায়, নেতার চিঠির দাপটে তার চাকরি হল। পরবর্তীতে ASHA (Accredited Social Health Activist) নির্বাচনেও সেই একই গল্প। এই কাজটাই কেরল, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র অন্যভাবে করল।

জনস্বাস্থ্যের সূচক ভালো হতে সময় লাগে। কিন্তু সরকার চান পাঁচ বছরের মধ্যে কিছু করে দেখাতে। মাত্র পাঁচ বছর জনস্বাস্থ্য সূচকের ক্ষেত্রে ভীষণ কম সময়। হয়ত তাই আমাদের দেশ ১৫ বছর বয়সিদের মধ্যে পৃথিবীতে সর্বাধিক অপুষ্টিতে ভুগছে। ICDS (Integrated Child Development Services) পরিষেবা বেশ কিছু দশক ধরে আমাদের দেশে থাকা সত্ত্বেও জনস্বাস্থ্য গবেষণাগার কোনও জেলাতেই গড়ে ওঠেনি। তাহলে কল্পিত লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে কী করে? সামাজিক ন্যায়, গরিবি হঠাও এসব শুধুই শ্লোগান হয়ে থেকে যায়৷

সবশেষে বলি, শত সমস্যা সত্ত্বেও আমাদের মতো দেশে এ জাতীয় সংক্রমণ রোধ করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। তার জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটাতে হবে, রাজনৈতিক-সামাজিক দূরত্ব হটিয়ে হাতে হাত ধরে সংক্রমণ ঠেকাতে হবে। এবং তা সম্ভবও হবে। আমি আশাবাদী।

(লেখাটি চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম নামক ই-ম্যাগাজিন থেকে গৃহীত)

women

 

aip

প্রতি
প্রধানমন্ত্রী
ভারত সরকার

বিষয়: লক ডাউনের দ্বিতীয় পর্যায়ে মহিলাদের অধিকার,পুষ্টি ও নিরাপত্তা

মহাশয়

গতকাল আপনি করোনা বিশ্ব মহামারীকে রোখার জন্য ৩ মে, ২০২০ পর্যন্ত লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর কথা ঘোষণা করেছেন। আপনি যখন লকডাউনের দ্বিতীয় পর্যায়ের কথা ঘোষণা করছিলেন, আমরা আশা করেছিলাম যে বিগত ২১ দিনের লকডাউনে মহিলারা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, আপনি নিশ্চয়ই তার সমাধানের লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপের কথাও ঘোষণা করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আপনার ভাষণে তেমন কোনো পদক্ষেপের কথা ছিল না। আজকের প্রকাশিত নির্দেশিকায়, ২০ এপ্রিল থেকে কিছু অর্থনৈতিক কার্যকলাপের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সেটিতেও মহিলারা উপেক্ষিতই রয়ে গেলেন।

মহাশয়, গত ২৫ দিনে এমন কিছু ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে,যাতে ধরা পড়েছে মহিলারা কী ভয়ঙ্কর জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। বিহারের জেহানাবাদ এক মা চোখের সামনে কোলের সন্তানকে মারা যেতে দেখলেন, স্রেফ একটি অ্যাম্বুল্যান্সের অভাবে। পাঞ্জাব থেকে গয়ায় ফিরে আসার পর এক যক্ষ্মারোগিনী কোয়ারেন্টাইন ওয়ার্ডে ভর্তি থাকাকালীন ধর্ষিতা হন ও পরে মারা যান (তার টেস্ট রিপোর্ট করোনা নেগেটিভ ছিল)। ‘করোনা যোদ্ধা’ মহিলাদের উপর আক্রমণের খবরও আসছে। আপনার কাছে প্রত্যাশা ছিল, আপনি এমন কিছু পদক্ষেপ নেবেন যাতে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।অ্যাপোয়ার পক্ষ থেকে আমরা বলতে চাই,এই বিশ্বমহামারির বিরুদ্ধে ও অনশনের বিরুদ্ধে লড়াই এবং মহিলা ও শিশুদের উপর আক্রমণ পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। তাই নিম্নোক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে আপনার পক্ষ থেকে পদক্ষেপ দাবি করছি :

১) এটা আশ্চর্যজনক যে সরকার এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যেগুলি মহিলাদের প্রতি বৈষম্যকে প্রশ্রয় দেবে। আমরা সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে এটা জেনে স্তম্ভিত হয়ে গেছি যে সরকার জুন মাস পর্যন্ত পিএনপিডিটি আইনের বিধি শিথিল করেছে, অত্যন্ত সহজ ভাষায় যার মানে, সরকার লিঙ্গ নির্ণয় পরীক্ষার উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের জন্য যে হাস্যকর যুক্তিটি দেওয়া হয়েছে তা হল – এতে নাকি  মহিলাদের, চিকিৎসকদের, যে সব হাসপাতালে ও বেসরকারি ক্লিনিকে এই আলট্রাসাউন্ড টেস্ট হয় তাদেরও সময় বাঁচবে। আমরা এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি । আমরা দাবি করছি – অবিলম্বে স্বাস্থ্যমন্ত্রক যাতে পিএনপিডিটি আইনের বিধিগুলি কঠোরভাবে কার্যকর করে তার জন্য নির্দেশ দিতে হবে। এই আইন কার্যকর করতে বিশেষ নজরদারি রাখার জন্য জেলা প্রশাসনগুলিকেও নির্দেশ দিতে হবে।

২) লকডাউনের মধ্যে গার্হস্থ্য হিংসার বিরুদ্ধে মহিলাদের সুরক্ষার জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেই। আমাদের দাবি, প্রত্যেক জেলায় ২৪×৭ হটলাইন চালু করতে হবে এবং সাহায্যপ্রার্থী মহিলাদের কাছে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য একটি বিশেষ টিম গঠন করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হলে মহিলা সংগঠনগুলির সাহায্য নিতে হবে।

৩) আপনার ১৪ এপ্রিলের ভাষণে আপনি বলেছেন, দেশে খাদ্যশস্য এবং ওষুধের কোনো অভাব নেই। তাই যদি হয়, তাহলে মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে কেন? শিশু, গর্ভবতী মা এবং প্রসূতি মা, যারা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি থেকে পুষ্টিকর খাদ্য সামগ্রী পেয়ে থাকেন, তারা বেশিরভাগ জায়গাতেই এপ্রিল মাসের অর্ধেক পেরিয়ে যাবার পরেও, কিছুই পাননি। কয়েকটি রাজ্য (উদাহরণস্বরূপ বিহার) পুষ্টির পরিবর্তে উপকারভোগীদের অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়ার কথা বলেছে। এই তালিকা তৈরির জন্য অঙ্গনওয়াড়ি সহায়িকাদের উপকারভোগীদের অ্যাকাউন্ট নম্বর, মোবাইল নম্বর,আধার নম্বর সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। অঙ্গনওয়াড়ি থেকে যারা পুষ্টিযুক্ত খাবার পান তাদের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। সরকার কী করে আশা করে যে এই মহিলাদের কাছে সমস্ত নম্বর থাকবে? দ্বিতীয়ত খাদ্য এবং পুষ্টি এমন একটি প্রয়োজন যা অবিলম্বে মেটাতে হবে। তৃতীয়ত তারা সরকারি হারেই খাদ্যমূল্যবাবদ নগদ অর্থ পাবেন। কিন্তু বাজার থেকে তাদের বাজারদামেই কিনতে হবে যা সরকারি দামের থেকে বেশ খানিকটা বেশি। তাই আমাদের দাবি,খাদ্য ও পুষ্টি অবিলম্বে বণ্টন করা হোক। এবং মহিলারা আগে যে পরিমাণে এটা পেতেন, তার দ্বিগুণ পরিমাণে তাদের তা দিতে হবে কারণ তাদের পরিবার এখন তাদের যত্ন করার জন্য নূন্যতম অর্থ ব্যয় করার অবস্থায় নেই।

৪) আপনার ভাষণে আপনি দরিদ্রদের খাওয়ানোর জন্য সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন রেখেছেন। অনেক সমাজকর্মী ও সংগঠনসহ বহু মানুষ ইতিমধ্যেই এই কাজে নেমে পড়েছেন যদিও কোথাও কোথাও তাদের প্রশাসনের বাধার মুখে পড়ে কাজ থামিয়ে দিতে হচ্ছে । কিন্তু সরকারকে নিজের দায়িত্ব পালন করতে হবে।গুদামে মজুত খাদ্যশস্য না পচিয়ে, সরকারের দেশের সমস্ত গরিব বস্তিতে আগামী তিন মাসের জন্য কমিউনিটি খাদ্যকেন্দ্র খুলে দেওয়া উচিত এবং এটাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

৫) লকডাউনে মহিলা ও শিশুদের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে,সরকারি রেশন দোকান থেকে বিনামূল্যে মহিলাদের স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং শিশুদের জন্য দুধ বণ্টন করতে হবে।

৬) আশা এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন সরকারের কাছ থেকে একটা মাস্ক পর্যন্ত পাচ্ছেন না,তখন ‘করোনা যোদ্ধাদের’ সম্মান জানানোর কথা নিছক পরিহাস বলে মনে হয়। আপনার ‘গামছা চ্যালেঞ্জ’ তাদের জন্য চমৎকার যারা বাড়িতে থাকে, কিন্তু যারা ফিল্ডে কাজ করছেন তাদের কোনো কাজে লাগবে না। একইভাবে, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের করোনা যুদ্ধে কাজে লাগানো হচ্ছে,কিন্তু তাদের স্বাস্থ্য বিমার অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আমরা দাবি করছি, আশাকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী এবং সাফাই কর্মীদের অতিরিক্ত তিন মাসের বেতনের সমতুল বা ১০০০০ টাকার সাম্মানিক ভাতা (অনার মানি) দিতে হবে। আশা এবং অন্য সমস্ত প্রকল্প কর্মীদের স্বাস্থ্য বিমার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অন্য যোদ্ধা – চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ কর্মীদেরও পদ অনুযায়ী সাম্মানিক ভাতা দিতে হবে।

৭) আমাদের দাবি, দেশের সাম্প্রদায়িক বিভাজনকামী শক্তি ও লুঠেরা রাজকে নিয়ন্ত্রণে আনা হোক।

মহাশয়, আমাদের অনুরোধ, উপরি উক্ত সমস্ত বিষয়ে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হোক।

আপনার বিশ্বস্ত
রতি রাও, সভানেত্রী
মীনা তেওয়ারি, সাধারণ সম্পাদক
কবিতা কৃষ্ণাণ, সম্পাদক
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি

baby

 

lin

গত ৪ এপ্রিল, ২০২০ সালে প্রকাশিত ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ধারণে ছাড় সংক্রান্ত সার্কুলারটি সম্পর্কে এতদিনে অনেকেই জেনেছেন। ভারতের মতো দেশে, যেখানে নিয়মিত কন্যাভ্রূণ হত্যা হয় ও লিঙ্গানুপাত ভয়াবহ, সেখানে ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ধারণে ছাড় দেওয়া যায় নাকি? বলা বাহুল্য, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ইউএন, ইউনেস্কো ও অন্যত্র ছিঃ ছিঃ পড়ে যাবে। তাই আঙুল খানিক বেঁকানো হয়েছে। বলা হয়েছে, জুন মাস পর্যন্ত, করোনা-পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যস্ততার কারণে, আল্ট্রাসাউন্ডে যে ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ধারণ হচ্ছে না, সে সংক্রান্ত নথি জমা করতে হবে না।

ভ্রূণের আল্ট্রাসাউন্ড করতে গেলে কিছু ফর্ম ফিল আপ করতে হয়। নিশ্চিত করা হয় যে মা জানেন, কী হতে চলেছে। নিশ্চিত করা হয় যে কোনওভাবে ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ধারণ করা হচ্ছে না। এই ফর্মগুলি ফিল আপ করতে কিছুটা সময় খরচ হয়। ওয়ার্ক ফোর্স কম থাকলে সময় লাগবে আরও বেশি। সুতরাং ফর্ম ফিল আপ আর বাধ্যতামূলক থাকবে না ৩০শে জুন অবধি৷ এপ্রিল, মে, জুন, তিন মাস।

আপাতদৃষ্টিতে হয়ত মনে হচ্ছে জরুরি একটি আপৎকালীন সিদ্ধান্ত। কিন্তু বাস্তবে, এই তিন মাস লিঙ্গ-নির্ধারণ ও সেই অনুযায়ী গর্ভপাতের পোয়াবারো। বলে রাখা ভালো, মোটামুটি ১০ মিলিয়ন কন্যাভ্রূণ দু-দশকে ভারতে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করা হয়, ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ধারণ বিরোধী কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও। আর এদেশে প্রতি ১২ মিলিয়নে ১ মিলিয়ন মেয়ে জন্মালেও এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যায় বা তাদের মেরে ফেলা হয়। ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ সংক্রান্ত বে-আইনি চক্রও এদেশে যথেষ্ট সক্রিয়। রাজস্থানের অখ্যাত গাঁয়ের মানুষটিও জানেন, শহরের কোন নির্দিষ্ট সেন্টারটিতে গেলে বে-আইনিভাবে ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ধারণ করা যাবে৷ গ্লোবাল অ্যাভারেজের চেয়ে ভারতে রোজ সাত হাজার মেয়ে কম জন্মায়।

প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লিঙ্গ-নির্বাচনের আরও নানা পদ্ধতি বেরিয়েছে। যেমন ইন ভিটরো ফার্টিলাইজেশন, প্রি-ইমপ্লান্টেশন জেনেটিক ডায়াগনোসিস ও প্রি-ইমপ্লান্টেশন জেনেটিক স্ক্রিনিং, স্পার্ম-সর্টিং। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসেছে মোবাইল সেক্স সিলেকশন ক্লিনিক, যারা পৌঁছে যাচ্ছে গ্রামে গ্রামে। ধনীরা হুশ করে থাইল্যান্ড-এ উড়ে গিয়ে লিঙ্গ-নির্ধারণ করিয়ে আনছেন, কারণ সেখানে তা নিষিদ্ধ নয়। আরও বেশি রেস্ত থাকলে যাচ্ছেন আমেরিকায়।

ভারত এবং কন্যাভ্রূণ হত্যার বাস্তবতা

হরিয়ানার নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী যখন কাশ্মীর-সংক্রান্ত ৩৭০ ধারা খারিজ হওয়ার পর হরিয়ানভি ভাই-বেরাদরদের কাশ্মীরী মেয়ে এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তখন সেই প্রতিশ্রুতিতে ‘কাশ্মীরী’ বিশেষণটি আমাদের নজরে পড়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম, কাশ্মীরী-তনয়াদের চূড়ান্ত অবজেক্টিফিকেশন! ঠিকই। কিন্তু সমস্যাটির আরও একটি পরত আছে। আসলে হরিয়ানায় বিবাহের জন্য বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে সত্যিই মেয়ের বড় আকাল। তাই ‘বউ আমদানি করা’ ভোট-লোভীদের একটি প্রচলিত আশ্বাস। এভাবে চলতে থাকলে ‘মাত্রুভূমির’ ডিস্টোপিয়া ঘনিয়ে আসা অসম্ভব নয়৷

হরিয়ানার জিন্দ জেলার বিবিপুর গ্রামের উদাহরণ দেওয়া যাক। গোটা জিন্দ জেলাতেই ১০০০ জন ছেলে পিছু ৮৭০ জন মাত্র মেয়ে (২০১১ জনগণনা অনুযায়ী)। তাই পশ্চিমবঙ্গ বা বিহারের দরিদ্র এলাকা থেকে বউ আমদানি হয় এখানে। এমনকী কেরল থেকেও বধূ আসে৷ বিবিপুরেও তেমনই ব্যবস্থা। যে মেয়েদের অন্য রাজ্য থেকে বিয়ে করে আনা হয়, তাদের সংসারে প্রায় ক্রীতদাসীর দশা। বিদেশী বউ-এর নাম এখানে ‘পারোস’৷ তারা না এখানকার ভাষা বোঝে, না বোঝে রীতিনীতি। তাদের পারিবারিক সম্পদে কোনও অধিকার নেই। বরের (কখনও কখনও শ্বশুরবাড়ির অন্য পুরুষদেরও) যৌন সম্ভোগের উপকরণ হয়ে ওঠা, বাচ্চা বিয়োনো, আর উদায়স্ত খেটে চলা — এভাবেই এদের দিন কাটে। ‘অ্যাকশন এইড ইন্ডিয়া’ এই আমদানি-কৃত বধূদের নিয়ে সুদীর্ঘ কাল কাজ করেছে। বিবিপুর এমন এক গ্রাম, যেখানে বউ আমদানি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট জেতেন সরকার। এখানকার অন্যতম সংগঠনের নাম ‘কুঁয়ারা ইউনিয়ন’।

অথচ এই দুর্গতির পরেও জিন্দ জেলার মানুষের মেয়েদের প্রতি মনোভাব একই থেকে গেছে৷ এই আমদানি-কৃত বধূদের পেটে কন্যাসন্তান এলে সেই সন্তানকেও মেরে ফেলা হয়। ফলে লিঙ্গানুপাতের উন্নতি ঘটে না৷ এই গ্রামে গেলেই মানুষজনের কাছে পাওয়া যায় হরিয়ানা আর রাজস্থানের সেই সব ডাক্তার ও ক্লিনিকের নাম, যেখানে বে-আইনি লিঙ্গনির্ধারণ ও গর্ভপাত দুই-ই চলে৷

ভারতবর্ষের এই লিঙ্গানুপাতিক অসাম্য কিন্তু একদিনে আসেনি। মেয়েরা রাতারাতি উধাও হয়ে যায়নি৷ দশকের পর দশক ধরে লিঙ্গনির্ধারণ করে ভ্রূণহত্যা করা হয়েছে। আজ তা প্রায় মহামারীর আকার ধারণ করেছে এদেশে৷ ইউনিসেফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট বলছে, এটি পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, গুজরাট বা হিমাচল প্রদেশের সমস্যা শুধু নয়, উড়িষ্যা বা ব্যাঙ্গালোরেও বাড়ছে কন্যাভ্রূণ হত্যা। পরবর্তী জনগণনাতে শিশু-জনসংখ্যার ক্ষেত্রে পুরুষ-নারী অনুপাতের আরও অধঃপতন ঘটবে বলে মনে করা হচ্ছে৷

শিশুদের জনসংখ্যার তুলনা করলে দেখা যাবে, ১৯৯১ সালে ১০০০ জন ছেলে পিছু ছিল ৯৪৭ মেয়ে। ২০০১ সালের জনসংখ্যা বলছে, ১০০০ জন ছেলে পিছু আছে ৯২৭ জন মেয়ে। ১৯৯১ সাল থেকে নানা ভারতীয় জেলায় মেয়েদের সংখ্যা কমেছে আর পাঞ্জাবের জেলাগুলোতে কমেছে সবচেয়ে বেশি। মহারাষ্ট্র, গুজরাট, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানাতেও চাইল্ড সেক্স রেশিও-তে পঞ্চাশ সূচক অবনমন দেখা যাচ্ছে। নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও লিঙ্গ-নির্ধারণ ও লিঙ্গ-নির্বাচনমূলক গর্ভপাত আজ কোটি টাকার ব্যবসা এদেশে।

গুজরাটের অপতিদার ও রাজপুতদের মধ্যে, উত্তরপ্রদেশে রাজপুত ও গুজ্জরদের মধ্যে, পাঞ্জাবের মোয়াল ব্রাহ্মণ ও খুত্রিদের মধ্যে কন্যা ভ্রূণহত্যার প্রবণতা মারাত্মক। ১৯৯০ সালে আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন আসার পর নারীবিদ্বেষে ও কন্যাভ্রূণ হত্যায় এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল।

girls

কেন কন্যাভ্রূণ হত্যা?

Indian Ministry of Health and Family Welfare বলছে, কন্যাভ্রূণ হত্যা “has its roots in India‘s long history of strong patriarchal influence in all spheres of life.”

মেয়ের বিয়ে দিতে গেলে পিতামাতাকে যৌতুক দিতে হয়। ফলে পরিবারের কাছে কন্যারা সবসময়ই বোঝা হিসেবে বিবেচিত। ভারতে গর্ভের শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ ও কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যার প্রধান কারণই এই যৌতুক।

২০১১ সালের জনগণনার কালে জয়পুরের এক রিক্সাওয়ালা বলেছিলেন, তিনি গরিব মানুষ। তাই মেয়ের বিয়ের পণ দিতে অপারগ। তাঁর মতো বাড়িতে মেয়ে না হওয়াই ভাল। অথচ পণবিরোধী আইন পাশ হয়েছে সেই ১৯৬১ সালে!

শুধু নিম্নবিত্ত পরিবারেই যে মেয়ে চাওয়া হয় না, তা নয়। দিল্লির পেডিয়াট্রিশিয়ান মিতু খুরানার কথাই ধরা যাক। ২০০৫-০৬ সাল নাগাদ মিতু খুরানাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তাঁর অজান্তেই তাঁর আল্ট্রাসাউন্ড করা হয়। তারপর যমজ কন্যার অস্তিত্ব জেনে তাঁকে চাপ দেওয়া হতে থাকে গর্ভপাতের জন্য। মিতু জেদ করে ২০০৫ সালে বাপের বাড়িতে চলে আসেন, মেয়েদের জন্ম দেন। পরে শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেলে শাশুড়ি তাঁর মেয়েদের একজনকে মেরে ফেলতে চায়। মিতু সময়মতো এসে পৌঁছনোয় দুধের শিশুটি বেঁচে যায়।

পুত্রসন্তানই বংশরক্ষা করে, পুত্রই মুখাগ্নি করার অধিকারী — এসব লিঙ্গ-বৈষম্যমূলক ধারণাগুলোর মধ্যেই আছে কন্যাভ্রূণ হত্যার বীজ। কিছুদিন আগেও উত্তর চব্বিশ পরগণায় পুকুর থেকে উদ্ধার হয়েছে ডজন দুয়েক ভ্রূণ৷ খেতে-খামারে, নদীতে এরকম লাশ ভেসে যেতে প্রায়শই দেখা যায়৷

রক্ষণশীল পরিবারেই কন্যাভ্রূণ হত্যার ঝোঁক বেশি৷ মজার ব্যাপার, এদেশে মেয়েকে আবার ‘ঘরের লক্ষ্মী’-ও মানা হয়৷ অর্থাৎ, মেয়েদের দেবী যত সহজে ভাবা যাচ্ছে, সহমানবী হিসেবে তার বেঁচে থাকার অধিকার তত সহজে মানা যাচ্ছে না।

low

আইন-কানুন

১৯৯৪ সালে Pre-conception and Pre-natal Diagnostic Techniques (Prohibition of Sex Selection) Act চালু হয়। ২০০৩ সালে এর বদল ঘটানো হয়, আসে Prenatal Diagnostic Techniques (Regulation and Prevention of Misuse) Act। কিন্তু কোনওটিই যথাযথ ভাবে প্রয়োগ হয়েছে কি?

এই আইন মোতাবেক রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে সুপারভাইসারি বোর্ড থাকার কথা, এক যোগ্য কর্তৃপক্ষ থাকার কথা, আর থাকার কথা সহায়ক অ্যাডভাইজারি কমিটি। প্রথমবার আইন অমান্য করলে ১০০০০ টাকা জরিমানা ও তিন বছর কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। পরের বার থেকে আরও অনেক বেশিদিন জেল ও বেশি জরিমানা হতে পারে। এই কর্তৃপক্ষ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় মেডিকাল কাউন্সিলের উপর ফরমান জারি করে এবং জন্মপূর্ব লিঙ্গ-নির্ধারণ নিষিদ্ধ করে। যে ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীরা এ কাজ করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কাউন্সিলকে ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়। জন্মপূর্ব যে কোনও পরীক্ষা করার আগে মায়ের লিখিত অনুমতি (আঞ্চলিক ভাষায়) নিতে বলা হয়।

কিন্তু সমীক্ষায় দেখা যায়, দক্ষিণ দিল্লিতে মাত্র ৪০ শতাংশ পুরুষ ও ৩০ শতাংশ মহিলা এইসব আইনকানুন সম্পর্কে জানেন৷ তারপর লিখিত বোর্ড ঝোলানো বাধ্যতামূলক হয়৷ তা সত্ত্বেও সচেতনতা যথেষ্ট বেড়েছে কি? এমনকি যাঁরা আইনটি জানেন, তাঁদের মধ্যেও অনেকে বিশ্বাস করে, যাঁদের ছেলে জন্মায়নি, সে দম্পতি বড়ই দুর্ভাগা।

PCPNDT অ্যাক্টের উদ্দেশ্য ছিল, ১) লিঙ্গি-নির্ধারণ প্রক্রিয়া বন্ধ করা ২) লিঙ্গ-নির্বাচনমূলক গর্ভপাত আটকানো ৩) এই জাতীয় অপরাধের শাস্তি বিধান করা৷ এই আইনের ৬ নং সেকশন অনুযায়ী ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ধারণ শাস্তিযোগ্য। সেকশন ২২ বলে, ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ধারণ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন অবৈধ। ২৩(৩) সেকশনে বলা আছে জেনেটিক ল্যাব, জেনেটিক কাউন্সেলিং, জেনেটিক ক্লিনিক, বা কোনও ডাক্তারের সাহায্যে নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কোনও প্রি-ন্যাটাল ডায়গনস্টিটিক টেকনিক প্রয়োগ করা (নির্দিষ্ট কারণ ব্যতিরেকে) নিষিদ্ধ। মুম্বাই হাইকোর্টের একটি রায় এই অ্যাক্টকে আরও প্রসারিত করেছে। ঘোষণা করেছে, লিঙ্গ-নির্ধারণই এ দেশে কন্যাভ্রূণ হত্যার সমান অপরাধ৷ কারণ তা নারীর অস্তিত্বের অধিকার খর্ব করে৷

তবুও, আইনের প্রয়োগে যথেষ্ট গাফিলতি আছে। হরিয়ানার মতো সঙ্কটাপন্ন লিঙ্গানুপাতের রাজ্যে কোনও অনলাইন পোর্টালের ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত করা যায়নি, যার মাধ্যমে সরাসরি লিঙ্গ-নির্ধারণ ও গর্ভপাতের ব্যাপারে অভিযোগ জানানো যায় সত্বর, যদিও এমন পোর্টাল তৈরির আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে বহুদিন যাবৎ। ২০১৪-১৬র মধ্যে নাকি হরিয়ানায় মাত্র সাতটি লিঙ্গ-নির্ধারণের অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছিল। বলা বাহুল্য, সংখ্যাটি হাস্যকর রকমের অবাস্তব।

beti

‘বেটি বচাও’ ইত্যাদি, একটি অসম্পূর্ণ প্রকল্প

প্রধানমন্ত্রী ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’ কর্মসূচী ঘোষণা করেন ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারী, আন্তর্জাতিক শিশুকন্যা দিবসে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল লিঙ্গবৈষম্যের দিক থেকে প্রথম সারিতে থাকা রাজ্যগুলিতে, যে রাজ্যগুলিতে লিঙ্গ-অনুপাত অতি সঙ্কটজনক অবস্থায় পৌঁছেছে বা পৌঁছচ্ছে, সেখানে নানা জনসচেতনতামূলক কর্মসূচী গ্রহণের মাধ্যমে কন্যা-শিশুর মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করা, গর্ভকালীন লিঙ্গনির্ধারণ আটকানো, লিঙ্গভিত্তিক ভ্রূণ নির্বাচন আটকানো, শিশুকন্যাকে সযত্নে ভূমিষ্ঠ হতে দেওয়া, তার শিক্ষায় উৎসাহ-প্রদান। প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়৷ পাখির চোখ ধরা হয় উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব, বিহার, দিল্লির মতো রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে।

কিন্তু সমাজকর্মী বিহার দার্ভে উদ্যোগ নিয়ে ‘রাইট টু ইনফর্মেশন অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে যে সব নথি পেলেন এবং প্রকাশ করলেন ‘সিএজি’ রিপোর্টে, তাতে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় শিশু ও নারীকল্যাণ মন্ত্রক বরাদ্দ টাকার ২০ শতাংশের বেশি উল্লিখিত রাজ্যগুলিতে পাঠাতেই পারেনি। যেটুকু টাকা পাঠানো হয়েছে খেপে খেপে, তা-ও হয়েছে আগের বছরের কাজের খতিয়ান না দেখে। প্রাথমিক বরাদ্দ ১০০ কোটি হলেও, ২০১৬-১৭ সালেই কেন্দ্র থেকে মাত্র ১৯৯৯৯ লক্ষ টাকা দেওয়া হয় ১০০টি বাছাই করা জেলার জন্য। যার মধ্যে মাত্র ৫৪৮৯ লক্ষ টাকা বিভিন্ন রাজ্যে বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পাঠানো গেছে। তার মধ্যে আবার মাত্র ১৮৬৫ লক্ষ টাকা খরচ করা গেছে বলে খবর৷ কী খাতে সেটুকুও খরচ হল, তা জানার জন্য কোনও নথি তলব করেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক। ফলে উক্ত অর্থের অনেকখানিই ব্যয় হয়েছে বিজ্ঞাপনে আর ঢক্কানিনাদে। সে বিজ্ঞাপনের ভাষা ও ভাষ্যও অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক। যেমন বহুল সমালোচিত হয়েছে এক বিজ্ঞাপনী দেওয়াল-লিখন, যা আসলে এই প্রকল্পেরই জয়গান গাইতে চেয়েছিল। ‘জন্মাতেই যদি না দাও মেয়েকে, তবে কার হাতের রুটি খাবে?’ — এই ছিল সেই দেওয়াল-লিখনের ভাষা। ‘বেটি’ ও ‘রোটি’-র ‘অবশ্যম্ভাবী’ অন্ত্যমিল সচেতন নাগরিককে হতচকিত করেছিল। বোঝা গেছিল, কন্যা-শিশুর বেঁচে থাকা ও শিক্ষার অধিকার নিয়ে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচী যাদের হাত ধরে বাস্তবায়িত হবে, তাদের নিজেদেরই সচেতনতা প্রশ্নাতীত নয়।

অডিটে দেখা যাচ্ছে, ‘বেটি বচাও ...’-এর টাকা সব থেকে কম ব্যবহৃত হয়েছে লাল কালিতে মোটা দাগে চিহ্নিত সেই বিপদসঙ্কুল রাজ্যগুলিতেই — হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীর, দিল্লি, উত্তরাখণ্ডে। ‘নিধি আয়োগ’-এর সমীক্ষা দেখাচ্ছে ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’-এর পরে সেক্স রেশিও-র খুব একটা উন্নতি হয়নি এইসব জায়গায়। ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’ দেখাচ্ছে, এই রাজ্যগুলিতে শিশুর প্রতি অপরাধ-অত্যাচারও কমেনি। নারী-শিক্ষার হার বেড়েছে, তবে খুব সামান্য, গড়ে ১ শতাংশ মতো৷

পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা অক্ষুণ্ণ রেখে কন্যাভ্রুণ হত্যা আটকানো যাবে না। এমনকী সরকারী মুখপাত্ররাও যদি বেটির রুটি বানানো নিয়ে দেওয়াল লেখেন, এমনকি স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকরাও যদি পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে বেরোতে না পারেন এবং লিঙ্গ-নির্ধারণে সাহায্য করেন, তবে সাধারণ মানুষের আর দোষ কী? আবার অন্যদিকে, কন্যাভ্রূণ হত্যাই পিতৃতন্ত্রকেও চিরস্থায়ী করে। মেয়েদের সংখ্যা হ্রাসের সঙ্গে বাড়তে থাকে যৌন হিংসা। বাড়ে ট্র‍্যাফিকিং ও নারী পণ্যায়ন।

অতএব…

উপরে তথ্যনিষ্ঠভাবে ভারতে লিঙ্গ-নির্ধারণমূলক ভ্রূণহত্যার খতিয়ান দেওয়ার চেষ্টা হল মাত্র। সারা পৃথিবীতে লিঙ্গানুপাতে অসাম্যের দিক থেকে ভারতের স্থান চতুর্থ।

‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’ প্রকল্পের হোতাদের এইসব সরল তথ্য ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ফর্ম ফিল আপে যেটুকু ‘অসুবিধে’ এই কোভিড-ঊনিশ-আক্রান্ত সময়ে, তার চেয়ে ফর্ম ফিল আপ বন্ধ হলে অসুবিধে বা ক্ষতির আশঙ্কা অনেক বেশি৷ বিকল্পও হয়ত ছিল। শুধু ফর্ম ফিল আপ-এর জন্য প্রতি সেন্টারে একজন বা দুজন বাড়তি কর্মী রাখা যেত। অনেক ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী কিন্তু নিজেরাই প্রশ্ন তুলছেন যে সব কিছুর আগে, স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিই বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেখার আগে, এই ‘সুবিধে’-টি করে দেওয়ার জন্য সরকার এত উদগ্রীব কেন? তিনমাস পরে সেক্স রেশিও আরও বিসদৃশ হয়ে উঠতে পারে৷ এ সম্ভাবনা সরকারের মাথায় আসেনি, এমনটা অসম্ভব ঠেকছে। তাহলে? এ কি ইচ্ছাকৃত শৈথিল্য? নাকি এ উদাসীনতা, সমস্যার গুরুত্ব বোঝার ব্যর্থতা?

দুটির কোনওটিই অভিপ্রেত ছিল না৷
 

(লেখাটি চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম নামক ই-ম্যাগাজিন থেকে গৃহীত)

cty


বিহারে শিক্ষক ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে সিপিআই(এমএল) সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য গত ১৩ এপ্রিল বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারকে একটি চিঠি লেখেন। ঐ চিঠিতে তিনি ধর্মঘটী শিক্ষকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে অচলাবস্থার অবসানের অনুরোধ জানান।

ঐ চিঠিতে কমরেড দীপঙ্কর বলেছেন, বিহারে লক্ষাধিক প্রাথমিক ও মধ্য স্তরের শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছেন। ধর্মঘটী শিক্ষকদের সম্পর্কে সরকার যে ‘কাজ না করলে বেতন নয়’ নীতি নিয়েছে তার ফলে এখনও পর্যন্ত অনেক শিক্ষক মারা গেছেন। শিক্ষকদের পরিবারগুলো অনাহারের মুখে পড়েছে এবং অন্যান্য সমস্যাতেও তারা বিপর্যস্ত হচ্ছে।

আজ গোটা দেশই যখন কোভিড-১৯ এবং লকডাউনের কারণে এক অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে, আমাদের সবাইকেই তখন একসাথে চলতে হবে। এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই চালালে তবেই আমরা সংকটকে জয় করতে পারব। যে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা অথবা অচলাবস্থা সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথকেই কন্টকিত করবে।

বিহারের মুখ্যমন্ত্রীকে অবিলম্বে ধর্মঘটী শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা সংগঠিত করতে হবে, তাঁদের ন্যায্য দাবিগুলো শুনতে হবে এবং যতদিন না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে ততদিন তাঁরা যাতে বর্তমান মাসের সঙ্গে আগের মাসের বেতনও পান তা সুনিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে গৃহীত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নিতে হবে এবং মৃত শিক্ষকদের পরিবারগুলোর জন্য যে ক্ষতিপূরণ ঘোষিত হয়েছে তারা অবিলম্বে যাতে তা পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে।

ad

মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী,
পশ্চিমবঙ্গ সরকার
নবান্ন, হাওড়া

মহাশয়া,

বিষয় - রাজস্থানের কোটায় আটকে পড়া পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রছাত্রীদের অবিলম্বে ফেরৎ আনতে হবে।

আমরা, অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে আপনার জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই যে, এই সময়ে লকডাউনের মধ্যে রাজস্থানের কোটায় প্রায় এক হাজারের অধিক পশ্চিমবঙ্গ থেকে পড়তে যাওয়া ছাত্রছাত্রী আটকে আছে। সেই সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত খাবার না পেয়ে শারীরিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। উপরন্তু রাজস্থানে করোনা সংক্রমণের প্রভাব অত্যধিক হওয়ার ফলে ছাত্রছাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে মানসিক ভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্যান্য রাজ্য সরকার সেইসব রাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই বিষয়ে এখনো কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেনি।

এই অবস্থায়, আমাদের দাবি, পশ্চিমবঙ্গ সরকার অবিলম্বে সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে পর্যাপ্ত টেস্ট করিয়ে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুক এবং তার পাশাপাশি রাজস্থান সরকারের সাথে কথা বলে ছাত্রছাত্রীদের পর্যাপ্ত খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সুনিশ্চিত করুক।

ধন্যবাদান্তে,
আইসা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি

st

 

aisa

অপরিকল্পিত লকডাউনের ফল ভোগ করছেন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী ও পরিযায়ী শ্রমিকরা। এক চরম সংকটের সম্মুখীন তারা। এই প্রেক্ষিতেই আগামীকাল ১৯ এপ্রিল অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (আইসা) গোটা দেশব্যাপী বারো ঘণ্টার প্রতীকী অনশনে সামিল হয় ছাত্র-ছাত্রী এবং পরিযায়ী শ্রমিক সহ সমস্ত শ্রমিকদের জন্য বিশেষ ত্রাণ প্যাকেজ ঘোষণার দাবিতে। ইতিমধ্যেই এআইসিসিটিইউ গোটা দেশে শ্রমিকদের জন্য বিশেষ ত্রাণ প্যাকেজ ঘোষণার দাবিতে ১৮ এবং ১৯ এপ্রিল যে অনশন এবং আন্দোলন কর্মসূচী নিয়েছে আইসা তার প্রতিও সংহতি জানাচ্ছি। সকলেই শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে একটি নির্দিষ্ট স্থানে জমায়েত না করে এই প্রতীকী অনশনে সামিল হবে। এই রাজ্যেও আইসা-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আহ্বান জানায় শারীরিক দূরত্বকে বজায় রেখে এই অনশন আন্দোলনে সামিল হতে।

ae

আইসা-র দাবি --

১) লকডাউন ও লকডাউন পরবর্তী অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে দুটো সেমেস্টার একসাথে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে পরীক্ষা নিলে ছাত্রছাত্রীদের উপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হবে এবং অর্থনৈতিক, সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল/পরিবার থেকে আসা পড়ুয়াদের পক্ষে তাঁদের শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবেনা অর্থাৎ এই পদক্ষেপ শিক্ষার অধিকার বিরোধী পদক্ষেপ। লকডাউন পরবর্তী সময়ে সরকারকে সমস্ত ছাত্র সংগঠন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ইউনিয়নের প্রতিনিধি ও শিক্ষাবিদদের সাথে কথা বলে যে সেমেস্টারগুলোর পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, সেই সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণ করতে হবে।

২) বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ ব্যবস্থাকে উৎসাহ দেওয়ার ফলে সমস্ত ক্লাস এবং পরীক্ষা অনলাইন মাধ্যমে করানোর ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে বঞ্চিত বর্গ এবং গ্রামীণ ক্ষেত্র থেকে আসা বহু পড়ুয়া ল্যাপটপ অথবা স্থিতিশীল ইন্টারনেট পরিষেবার অভাবে গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে অবিলম্বে এই বিষয়গুলিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

৩) সারাদেশে মেস অথবা ভাড়াবাড়িতে থাকা সমস্ত শিক্ষার্থীর ভাড়া অবিলম্বে মুকুব করতে হবে। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারের অধীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারকে বাড়ির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

৪) স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিস্ কাঠামো পুনর্গঠন করতে হবে। কোনো পড়ুয়া যাতে অর্থাভাবে পড়াশুনা ছেড়ে না দেয় তার জন্য সরকারকে হস্তক্ষেপ করে আগামী সেমিস্টারের ফি মুকু্ব করতে হবে।

৫) বহু রাজ্যেই ইতিমধ্যে কোবিড-১৯ এর কারণে দ্বাদশ শ্রেণী অথবা সমস্ত স্তরের পরীক্ষা বাতিল হয়েছে। এই অবস্থায় প্রত্যেক রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে আলোচনা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে স্নাতক স্তরের বিভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষাগুলির মধ্যে সঙ্গতি স্থাপন করতে হবে।

ae

 

৬) এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত সমস্ত গবেষক এবং অন্যান্য পড়ুয়াদের বকেয়া বৃত্তি ও ফেলোশিপ অবিলম্বে মেটাতে হবে। শিক্ষাবর্ষের সম্প্রসারণ ঘটলে সেই অনুযায়ী ফেলোশিপের সময়সীমা বৃদ্ধি করতে হবে।

৭) বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্রছাত্রীরা যাতে লকডাউনের সময় পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারেন, তার জন্য সরকারকে পরিকল্পনা করতে হবে।

৮) যে সব পড়ুয়া বাড়ি ফিরতে পারেনি তাদেরকে যথাযথ টেস্ট করিয়ে নিরাপদভাবে বাড়ি ফেরানোর দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।

৯) বেকারদের সাহায্যার্থে সব বেকারদের জন্য বেকার ভাতা চালু করতে হবে।

১০) স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

১১) আগামী ৬ মাসের জন্য সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাঋণ মুকুব করতে হবে এবং পরবর্তী ২ বছরের জন্য শিক্ষাঋণের কোনো সুদ নেওয়া চলবে না।

১২) পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসুরক্ষার ব্যবস্থা ও তাদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা এবং যথাযোগ্য টেস্টের ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে।

১৩) লকডাউনের ক্ষতিপূরণ হিসাবে পরিযায়ী শ্রমিক সহ সমস্ত শ্রমিককে ন্যূনতম ১০,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

১৪) সমস্ত শ্রমিকের মজুরি এবং কাজের নিশ্চয়তা দিতে হবে। কোনওরকম মজুরি কাটা বা ছাঁটাই চলবে না।

১৫) বর্তমানে ভিনরাজ্যে আটকে পড়া সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সরকারকে নিয়মিত রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

১৬) পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর পুলিশী নৃসংশতা বন্ধ করো।

ধন্যবাদান্তে
অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস্ অ্যাসোসিয়েশন (আইসা) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির তরফে
নীলাশিস বসু (রাজ্য সভাপতি), স্বর্ণেন্দু মিত্র (রাজ্য সম্পাদক)

jute

 

chat

(এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে রাজ্যের মুখ্য সচিবকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নীচে তার প্রতিলিপি দেওয়া হল।)

আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করলাম কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের ৪টি জেলা কলকাতা, পূর্ব মেদিনীপুর, উত্তর ২৪ পরগণা ও হাওড়া জেলাকে ‘হটস্পট’ এলাকা বলে ঘোষণা করেছে। চটকল শ্রম নিবিড় শিল্প। এই চটকলগুলো প্রধানত উত্তর ২৪ পরগনা ও হাওড়া জেলায় অবস্থিত। আমাদের শঙ্কা মিল চালু হলে করোনা সংক্রমণ বাড়ার সম্ভবনা আছে।

আপনি জানেন, গত ১৩ এপ্রিল কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী স্মৃতি ইরানি পশ্চিমবঙ্গের ১৮টি চটকলের তালিকা প্রকাশ করে জানান, এই মিলগুলাতে ২৫% শ্রমিক নিয়ে উৎপাদন শুরু করা যাবে। এই ছাড়পত্রের চিঠি তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকেও দিয়েছেন। এরই প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী ১৫ এপ্রিল ঘোষণা করেন সব চটকলগুলিতে ১৫% শ্রমিক নিয়ে ২০ এপ্রিল থেকে কাজ চালু হবে। শ্রমিকদের রোস্টারের মাধ্যমে কাজ করতে বলেছেন। ১৫ শতাংশ শ্রমিক নিয়ে চটকল চলা প্রায় অসম্ভব। এতে সিংহভাগ শ্রমিকই কাজ পাবেন না এবং চটকলগুলিতে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ এবং বিশৃঙ্খলা বাড়বে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশিকায় চটকল শ্রমিকদের লকডাউন পিরিয়ডের পূর্ণ মজুরি দেওয়ার বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। শ্রমিকরা অনাহার অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এই মুহূর্তে করোনা সংক্রমণের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা এবং শ্রমিকদের মেডিকেল কেয়ার-এর বিষয়টিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

jute

 

সরকারের পক্ষ থেকে চালু হতে যাওয়া মিল কর্তৃপক্ষকে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট গাইডলাইন দেওয়া উচিত।

১) সরকারের ঘোষণা ১৫% শ্রমিক নিয়ে কাজ হবে। যারা কাজ পাবেন না, তাদের লক ডাউনের সময়ের পূর্ণ মজুরি দিতে হবে।

২) চটকলে নথিভুক্ত পার্মানেন্ট, স্পেশাল বদলি, বদলি শ্রমিক সংখ্যা খুব কমই আছে। এর বাইরে সিংহভাগ শ্রমিক অনথিভুক্ত (অনথিভুক্ত বদলি, অবসর প্রাপ্ত কিন্তু কর্মরত, ঠিকা ইত্যাদি) এদের সম্পর্কে সরকারকে ভাবনা চিন্তা করে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে।

৩) শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করাবার কথা বলা হয়েছে, এই বিষয়ে সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে।

৪) চটকল এলাকাগুলো ঘন বসতিপূর্ণ, এখানে গোষ্ঠী সংক্রমণ হলে শুধুমাত্র এই এলাকাগুলো নয়, আপনারা রাজ্যকে করোনা প্রকোপ থেকে মুক্ত রাখার জন্য যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছেন তাও ব্যর্থ হবে। শ্রমিক ও তাদের পরিবারকে সাবান, মাস্ক, স্যানিটাইজার দেওয়া। মিল ও সমগ্র অঞ্চল জীবাণুমুক্ত করার জন্য দিনে দুবার বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া।

নবেন্দু দাশগুপ্ত
সভাপতি, বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরাম, এআইসিসিটিইউ
২১/১/ক্রীক রো, কলকাতা ৭০০০১৪, যোগাযোগ ৬২৯০০০৮২৫৪

cons

 

sra

মাননীয়,
মলয় ঘটক, শ্রমমন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গ,
নব মহাকরন, ১২তল,
কোলকাতা-৭০০০০১,

বিষয়: করোনা ভাইরাসে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় নির্মাণ শ্রমিকদের আর্থিক অনুদান প্রদান প্রসঙ্গে।

মহাশয়,

বর্তমান পরিস্থিতিতে তিন সপ্তাহের বেশি নির্মাণ শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তাদের পরিবারে নেমে এসেছে চরম দুর্দশা। তারা বিনিদ্র নয়নে সরকারের উদ‍্যোগের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু নির্মাণ শ্রমিকরা সঠিক সংবাদ পাচ্ছেন না। তারা বিভ্রান্ত।

২৬/০৩/২০২০ তারিখ মাননীয়া মুখ‍্যমন্ত্রীর নিকট নির্মাণ শ্রমিকদের দাবিসনদ পেশ করেছিলাম।

যাই হোক, আমাদের দাবি

(১) পশ্চিমবঙ্গ গৃহ ও অন‍্যান‍্য নির্মাণ শ্রমিক কর্মচারি কল‍্যাণ পর্ষদের তহবিল থেকে প্রত‍্যেক নির্মাণ শ্রমিকদের ৫০০০ টাকা প্রদান করা হোক।

(২) প্রত‍্যেকের ব‍্যাঙ্ক একাউন্টে টাকা প্রদান করা হোক।

(৩) এসএসওয়াই-২০১৭ অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিক কল‍্যাণ পর্ষদ, সামাজিক সুরক্ষা যোজনা লাগু করার সময় আপনার সরকারের ছাপানো পুস্তকে লিপিবদ্ধ করেন ২০১৭ সাল পর্যন্ত নথিভূক্ত নির্মাণ শ্রমিক সংখ‍্যা (ক) ২৯৯৫১৫০। (খ) ২০১৭-১৮/২০১৮-১৯/২০১৯-২০ নথিভূক্ত নির্মাণ শ্রমিক যুক্ত হবে। এছাড়া (গ) অন লাইনে ফর্ম ফিলাপ করার পর এখনো পর্যন্ত এসএসআইএন নং পাইনি। (ঘ)২০১৫-র নাগাদ অন লাইন চালুর শুরুতেই জটিলতায় হতাশগ্রস্ত/অসুস্থ/ভিনরাজ‍্যে কাজ করার ফলে যে সমস্ত নির্মাণ শ্রমিকরা পরিচয় পত্রের পুনর্নবিকরণ করতে পারেনি মানবিকতার কারণে তাদের নথিভূক্ত হিসাবে ধরে নিতে হবে।

আশাকরি, আপনি আমাদের ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত সুসংবাদ দেবেন।

অভিনন্দন সহ
কিশোর সরকার
সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ গৃহ ও অন‍্যান‍্য নির্মাণ শ্রমিক কর্মচারি ইউনিয়ন (AICCTU-অন্তর্ভূক্ত)

grd

কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০ এপ্রিল থেকে কিছু ক্ষেত্রে লক ডাউন শিথিল করা হবে। গুজরাট সরকার 'হটস্পট' এলাকায় লক ডাউন শিথিল করছে না। কিন্তু কর্পোরেটদের লক ডাউনের সময়ের ঘাটতিকে মিটিয়ে অধিক মুনাফার রাস্তাতো ফেলে রাখা যায় না। তাই গুজরাট সরকার শ্রমিকদের কাজের ঘণ্টা বাড়িয়ে দিয়ে মজুরি সংকোচনের নির্দেশিকা জারি করল।

গুজরাট সরকার ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট ১৯৪৮, ৫ ধারা মোতাবেক ৫১, ৫৪, ৫৫ এবং ৫৬ ধারাকে ছাড় দিল রেজিস্টার্ড ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকদের সাপ্তাহিক কাজ, কাজের ঘণ্টা ও বিশ্রামে। গুজরাট সরকারের এই নির্দেশিকা ২০ এপ্রিল থেকে ১৯ জুলাই ২০২০ পর্যন্ত চলবে। এই নির্দেশিকায় বলা হল –

১) শ্রমিকরা দিনে ১২ ঘণ্টার বেশি বা সপ্তাহে ৭২ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে পারবেন না।
২) দৈনিক ৬ ঘণ্টা কাজ ৩০ মিনিট বিশ্রামের পর করতে হবে আবার দ্বিতীয় স্পেলের কাজ।
৩) মহিলাদের সন্ধ্য ৭টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কাজ (রাতে) করানো যাবে না।
৪) বর্তমানে যে মজুরি পান তা ঘণ্টা প্রতি (৮ ঘন্টায় ৮০ টাকা পেলে ১২ ঘণ্টায় ১২০ টাকা) পাবেন।

ফলে ৮ ঘণ্টা কাজের সময়কে ১২ ঘণ্টা করে দেওয়া হল। যে আইন ছিল তা হল ৮ ঘণ্টায় ৮০ টাকা পেলে পরের ৪ ঘণ্টায় দ্বিগুণ অর্থাৎ ১২ ঘণ্টায় ১৬০ টাকা পেতেন। এখন ১২০ টাকা পাবেন অর্থাৎ ওভার টাইম তুলে দিয়ে ১২ ঘণ্টা কাজের নির্দেশিকা জারি হল এবং টাকাও অনেক কমিয়ে দেওয়া হল।

capital

 

bho

ভোগবাদ মিতব্যয়িতাকে একটি অসুস্থতা বলে মনে করে। পুঁজিপতিদের মুনাফাচক্র চালু রাখার জন্য ভোগবাদী মানসিকতা গড়ে তোলা হয়। সব কিছুই পণ্য হয়ে রায়। নতুন নতুন পণ্য ভোগ করাই জীবনের লক্ষ্য ও সার্থকতা বলে মনে হতে থাকে। টিভি খুলে হয়তো প্রথম যে বিজ্ঞাপনটা আপনার চোখে পড়লো সেটা কর্পোরেট সংস্থার তৈরি করা সুস্বাদু খাদ্যের, আর তার পরের বিজ্ঞাপনটিতেই হয়তো দেখছেন মেদাধিক্য কমানোর উপায় হিসেবে তুলে ধরা পণ্য। প্রতিদিন কোনো না কোনো ভাবে গড়ে এইরকম অন্তত ১৬০০ বাণিজ্যিক বার্তা আমাদের সামনে এসে হাজির হচ্ছে, আমাদের বলছে : কেনো, হয় এটা নয় ওটা অথবা অন্য আরেকটি, কেনো। বিশ্বের অভুক্ত মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে যে পরিমান অর্থের প্রয়োজন, মার্কিন জনগোষ্ঠী তার থেকে বেশি অর্থ ব্যয় করে নিজেদের মেদাধিক্য কমাতে এবং খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে। ভোগবাদ অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্যকেও অপরিহার্য পণ্যে পরিবর্তিত করেছে।

সমগ্র খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাটাই সাধারণ কৃষকদের পেশা থেকে বহুজাতিক সংস্থার মুনাফা উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। আর খাদ্য উৎপাদনে পরিবেশ রক্ষার দায়কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের বিপর্যয় সৃষ্টিকারী প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও তার বিস্তৃত ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের সাথে সংহতিপূর্ণ কৃষিপদ্ধতির বিরুদ্ধে পুঁজিবাদী কৃষি পদ্ধতি প্রকৃতপক্ষে রাসায়নিক সমরাস্ত্র শিল্পকেই সবুজ বিপ্লবের নামে কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিল। ধীরে ধীরে এই ধ্বংসাত্মক পদ্ধতি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে একদিকে ক্রমাগত অস্থির হয়েছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য, আর অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির থাবা ক্রমশ গ্রাস করেছে ভারত বা ল্যাটিন আমেরিকার মতো বৃহৎ কৃষিক্ষেত্রগুলিকে।

গত বছরের নভেম্বরে, ১৮৪টি দেশের ১৫,০০০-এরও বেশি বিজ্ঞানী মানব সভ্যতা নিয়ে এক ভয়ঙ্কর সাবধানবাণী জারি করেছিলেন। আমাদের বিশ্বের সম্পদ উৎসের অত্যধিক ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে তারা ঘোষণা করেছিলেন যে, প্রতিদিন আমরা নিজেরাই ঘোর দুর্বিপাক ডেকে আনছি এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে এক চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে চলেছি। তারা সতর্ক করে বলেছিলেন যে, “হাতে আর সময় নেই, প্রতিনয়ত আমরা যে পথে চলে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছি, অবিলম্বে সেই পথ ত্যাগ করতে হবে।” পরিবেশ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট বলছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দশ লক্ষ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে, যে প্রজাতিগুলি কোনো না কোনো ভাবে ভোগবাদ দ্বারা প্রভাবিত। আর যারা এই ভোগবাদের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকবে, তারা “যোগ্যতমের উদ্বর্তন”-এর নিয়মে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত নিজেদের অভিযোজিত করবে, তার নিজস্ব গঠনের পরিবর্তন হবে, খুঁজে নেবে অন্য বাসা। যে অণুজীব গভীর জঙ্গলে বসবাস করতো, জঙ্গল উজাড় করে তৈরি করা পশু খামারগুলির শুকরের দেহে সে প্রবেশ করে শুকরের মড়ক ঘটাচ্ছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পুরো একটি প্রজাতির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। যে অণুজীব মুরগীর দেহে বসবাস করতো, অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ও রাসায়নিকের ব্যবহার এবং অতিরিক্ত ডিম পাওয়ার উদ্দেশ্যে মুরগীকে না খাইয়ে রাখার কারণে সেই অণুজীবটির অস্তিত্ব বিপর্যস্ত হওয়ায় সে এবার খুঁজে নিচ্ছে খামারি শ্রমিকের দেহ। শস্য চাষের সময় জমিতে কীটনাশক বিষের ব্যাপক ব্যবহার হাজার হাজার বছর ধরে জমিতে বসবাসকারী জীবাণুকে তার দীর্ঘদিনের বাসস্থান ছাড়তে বাধ্য করেছে, নিজের গঠন পরিবর্তন করতে হয়েছে তাকে, সে হয়তো খুঁজে নিয়েছে অন্য কোনো প্রাণীর দেহ। অর্থাৎ শস্য ও প্রাণীর পুঁজিবাদী শিল্পোৎপাদন পদ্ধতি একের পর এক মহামারীর সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছে। বিজ্ঞানীরা সাবধানবাণী উচ্চারণের সাথে সাথে অন্তত এক ডজন পথও বাতলে দিয়েছিলেন, যে পথে চললে মানব সভ্যতা বেঁচে যাবে। যেমন বাস্তুতন্ত্রের অন্তর্গত প্রাকৃতিক আবাসগুলিকে খামারে পরিণত করার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে, প্রকৃতি তথা বাস্তুতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে হবে, উদ্ভিজ্জ খাবার বেশি গ্রহণ করতে হবে ইত্যাদি।

এর আগে ৯৬ সালেও বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতি এই সাবধানবাণীকে এড়িয়ে গেছে। মিডিয়া গুলি এই সংক্রান্ত খবর প্রায় প্রচারই করেনি। ২০০৯ সাল থেকে একের পর এক প্রাণঘাতী ভাইরাসের উত্থান প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষকে মেরেছে, বহুজাতিক পুঁজিপতিরা সেই দাস ব্যবসায়ীদের মতোই নিষ্ঠুর নির্লিপ্ততায় আরো আরো মারাত্মক উৎপাদন পদ্ধতিতে তাদের মুনাফা বাড়িয়ে চলেছেন। আরো স্পষ্ট করে বললে ভোগবাদ এই নতুন নতুন প্রাণঘাতী ভাইরাসগুলি উঠে আসার একমাত্র কারণ। সুতরাং করোনা ভাইরাস সহ সাম্প্রতিক কালের প্রাণী বা উদ্ভিদ যে কোনো জগতের মহামারী কোনো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, বরং তা মনুষ্য সৃষ্ট।

12hr

 

kok

লকডাউন যত এগিয়ে চলেছে, দরিদ্র জনগণের কাছে যেটুকু টাকা-পয়সা ছিল তা শেষ হয়ে যাচ্ছে। যাদের সাহায্য প্রয়োজন তাদের আবেদন গ্রাহ্য করা হচ্ছে না বলে ক্রমেই আরও বেশি সংবাদ এসে পৌঁছচ্ছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলো হল শহর ও গ্রামের টোলা ও মহল্লাগুলো। বঞ্চিত অংশের মানুষদের এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার কথা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু সত্যিটা হল, তাদের দুর্দশা লাঘবে প্রকৃত কাজটা করছে সামাজিক সংগঠনগুলো, সাধারণ জনগণ এবং রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। সরকার যে সমস্ত ঘোষণা করেছে সেগুলো প্রধানত প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে।

সহায়তা চাওয়ার জন্য যে নম্বরগুলো দেওয়া হয়েছে, বিভিন্ন রাজ্যেই সেই নম্বরগুলো কাজ করছে না বলে খবর এসেছে। অনেক ক্ষেত্রেই আবার সাহায্য এত দেরিতে পৌঁছেছে যে ততদিনে জনগণের অনাহারে থাকার সময়কাল এক বা দু-দিন পেরিয়ে গেছে। যে সমস্ত স্থান থেকে জনগণকে খাদ্যদ্রব্য বিতরণ করা হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই সেই সমস্ত স্থানে লাইন অতি দীর্ঘ বলে দেখা গেছে। বাড়ির কাছাকাছি বিতরণ কেন্দ্র না থাকায় অনেক অঞ্চলেই জনগণকে দূর থেকে এসে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। সরকার এবং প্রশাসনিক কতৃপক্ষ বিতরণের ব্যাপারে একটু পরিকল্পনা করলে জনগণকে এত দুর্ভোগ সইতে হত না। বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রেণী বিদ্বেষও অত্যন্ত প্রকট হয়ে সামনে আসছে, এবং ঘৃণাবর্ষী প্রচার ও ধর্মীয় বিদ্বেষও প্রবল রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। যাঁরা এই সমস্ত কাণ্ড করছেন তাদের বোঝা উচিৎ যে, মহামারী শ্রেণী বা ধর্মের ভাগাভাগি বোঝে না, আর তারা যা করছে তা মহামারীর বিস্তারের পথকেই প্রশস্ত করবে।

সরকার আমাদের থালা বাজাতে এবং মোমবাতি ও প্রদীপ জ্বালাতে বলেছিল। এগুলো না হয় হল। এখন কিন্তু মোদী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হল লকডাউন যতদিন চলবে ততদিন বিভিন্ন রাজ্যে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের, গ্ৰামে তাদের পরিবারগুলোকে এবং অন্যান্য দরিদ্র ও অভাবী জনগণকে খাদ্য ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য সরবরাহ করা।

“কারুর থালা যেন খালি না থাকে”, এই দাবিকে সামনে রেখে ১২ এপ্রিল শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং লকডাউনের অন্যান্য বিধি মেনে বিভিন্ন রাজ্যেই কর্মসূচী পালন করা হয়। জনগণ দুয়োর ও চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কর্মসূচীতে অংশ নেন। ঐ কর্মসূচীর অন্যতম বিষয় হিসাবে একদিন অনাহার পালনের আহ্বান জানানো হয়, উদ্দেশ্য সংহতি জ্ঞাপন। মোদী সরকারকে বলা হয় – সবার খালি থালায় খাবার দিতে হবে, ঘরে খাবার, রেশন ও জ্বালানি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে কোনো মানুষই নিজেকে অবহেলিত ও অসুরক্ষিত না মনে করেন।

tn

 

তামিলনাডুতে পুলিশি নিপীড়ন : ১২ এপ্রিল তামিলনাড়ুর দিন্দিগুল জেলার বসন্ত কদিরপালায়াম গ্রামের জনগণ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে থালা বাজাতে লাগলেন। একটু পরেই পৌঁছে গেল তহশিলদার ও পুলিশ। কিন্তু গোটা গ্রামই কর্মসূচীতে শামিল হয়েছিল, আর তাই জনগণের কথা শোনা ছাড়া পুলিশ ও তহশিলদারের কাছে অন্য উপায় রইল না। জনগণ থালা বাজিয়েই তাঁদের প্রয়োজনগুলো তাঁদের কাছে রাখলেন।

মাদুরাইয়ে তামিলনাড়ুর পুলিশ ১২ এপ্রিলের আগের দিন আরওয়াইএ কর্মী কমরেড তামিল এবং এআইএসএ কর্মী কমরেড কলিস্বরমকে গ্রেপ্তার করে ১২ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত আটকে রাখে। কমরেড তামিলের মোবাইল ফোনটিও পুলিশ নিয়ে নেয়। সিপিআই(এমএল) রাজ্য কমিটি সদস্য এবং বস্তিবাসী আন্দোলনের নেতা কমরেড ভেল মুরুগানকে কোয়েম্বাটুরে গ্রেপ্তার করে থানায় বেশ কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখা হয়, তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে রাতে ছাড়া হয়। সিপিআই(এমএল)-এর আর এক নেতা এবং ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী গোবিন্দরাজকে গ্ৰেপ্তার করে নিয়ে গিয়ে তাঁর হেনস্থা ঘটাতে ধরমপুরি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে জোরজবরদস্তি করোনা পরীক্ষা করানো হয়। আরো কয়েকজন কমরেডকেও ধরে নিয়ে গিয়ে হয়রানি করা হয়। কিন্তু পুলিশের এই সমস্ত পদক্ষেপ সত্ত্বেও কমরেডরা মনোবল না হারিয়ে সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে এবং লকডাউনের বিধি মেনে কর্মসূচীকে সফল করার পথে অটল থাকেন।

উত্তরপ্রদেশেও সিপিআই(এমএল) কমরেডদের পুলিশি হয়রানির মুখে পড়তে হয়। যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ সীতাপুরে সিপিআই(এমএল) নেতা অরুন লালকে ১১ এপ্রিল তাঁর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে, উদ্দেশ্য জনগণকে আতঙ্কিত করা যাতে তাঁরা ১২ এপ্রিলের কর্মসূচীতে যোগদান না করেন। তবে, সোনভদ্র, বারানসী, পিলভিট, মির্জাপুর, রায়বেরিলি, খিরি, বালিয়া, লক্ষ্ণৌ ও অন্যান্য জেলায় দরিদ্র জনগণ থালা বাজিয়ে তাঁদের দাবিগুলোকে তুলে ধরেন।

অন্ধ্রপ্রদেশে এবং কর্নাটকেও কিছু স্থানে জনগণ থালা বাজিয়ে তাঁদের দাবিগুলোকে তুলে ধরেন।

punj

 

পাঞ্জাবের গুরুদাসপুরের বাটালায় পুলিশ পার্টি অফিসে ভাঙচুর চালায় এবং নেতৃবৃন্দকে সারাদিন থানায় আটকে রাখে। কিছু জিনিসপত্র নষ্ট করা ছাড়াও পার্টি অফিসে বসানো সিসিটিভি ক্যামেরার ডিভিআর-টাকেও বাজেয়াপ্ত করে এবং সিপিআই(এমএল)-এর পাঞ্জাব রাজ্য সম্পাদক গুরমিত সিং বখতপুরা এবং আইনজীবী অভিষেক হানিকে থানাতে বেশ কয়েক ঘন্টা আটক রাখে। ওরা হুমকি দেয়, লকডাউনের ফলে ক্ষতিগ্ৰস্ত শ্রমিকদের তালিকা প্রশাসনের  কাছে  পাঠিয়ে এবং মিডিয়ার কাছে প্রকৃত ঘটনা বিবৃত করে তাঁরা যেন “সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে প্ররোচিত না করেন”! কমরেড গুরমিত তাদের সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, তিনি ও তাঁর কমরেডরা যা করছেন সেটা প্রতিটি নাগরিকেরই ন্যায়সঙ্গত কর্তব্য এবং গ্রেপ্তার করে তাঁদের ওপর মামলা চাপালেও তাঁরা এটা করা থেকে বিরত হবেন না। ভয় দেখানোর কৌশল কাজে না দেওয়ায় এসএসপি অবশেষে তাঁদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হন, অবশ্য তার আগে তাঁদের কারফিউ পাশ বাতিল করে দেন এবং স্থানীয় পুলিশকে নির্দেশ দেন যে তাঁদের যেন বাড়ির বাইরে বেরোতে না দেওয়া হয়। এ সত্বেও সিপিআই(এমএল)-এর পাঞ্জাব শাখা ১২ এপ্রিলের কর্মসূচী চালিয়ে যায় এবং সাংরুর, ভাতিন্ডা, বারনালা, মানসা, অমৃতসর এবং গুরুদাসপুরের অনেক স্থানে থালা বাজিয়ে দাবি তুলে ধরার কর্মসূচী পালিত হয়। বাটালা, কলনৌর, ধারিওয়াল এবং অন্যান্য স্থানে শ্রমিক ও কৃষকরা ১৪ এপ্রিল পুলিশি নিপীড়ন এবং লকডাউন সৃষ্ট দুর্দশার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দিবস পালন করেন।

অনাহারের বিরুদ্ধে এবং খাদ্যের জন্য কর্মসূচীর অঙ্গ হিসাবে একদিন অনাহারে থাকাটা পালন করেন উত্তরাখণ্ডের সমস্ত কমরেড এবং বিভিন্ন জেলার সমর্থকরা। বন সংলগ্ন প্রায় এক ডজন গ্রামের কৃষকরা এবং শিল্প শ্রমিক, ছাত্র ও যুবকরাও এই উদ্যোগে অংশ নেন।

jkh

 

ঝাড়খণ্ডের সুদূর গ্রামের আদিবাসীরা এবং শিল্প শহরাঞ্চলের কমরেডরাও এদিনের কর্মসূচীতে অংশ নেন।

উড়িষ্যার কোরাপুট ও রায়গড়া জেলার আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামাঞ্চলগুলি থেকেও এদিনের কর্মসূচী উদযাপনের খবর পাওয়া গেছে। ভুবনেশ্বর এবং অন্যান্য স্থানে পার্টি কর্মীরা অনাহার পালন করেন।

beg

 

বিহারের হাজার-হাজার গ্রামে জনগণ থালা বাজিয়ে জনগণের দুর্দশার প্রতি প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রায় সমস্ত জেলার শহর ও গ্রামের দরিদ্ররা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে থালা বাজিয়ে এবং পোস্টার তুলে ধরে তাঁদের বক্তব্য পেশ করেন। বিহার রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ভাষণ না দিয়ে রেশন দেওয়ার আবেদন জানিয়ে রাজ্য রাজধানী পাটনায় নজরকারা কর্মসূচী পালিত হয়। পার্টির সমস্ত নেতাই একদিনের অনশনে বসেন। ভোজপুর, আরোয়াল, সিওয়ান, জাহানাবাদ, গয়া, মুজাফফরপুর, এবং অন্যান্য জেলায় কর্মসূচী সংগঠিত হয়।

left

 

lef

১) কলকাতায় বাম দলগুলির রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ –

রেশনে দুর্নীতিমুক্ত খাদ্য সরবরাহ ও পরিমাণ বৃদ্ধি, গরিব মানুষের হাতে নগদ অর্থ প্রদান, পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানো, করোনা টেস্ট বাড়ানো ইত্যাদি একপ্রস্থ দাবিতে গত ১৮ এপ্রিল কলকাতায় জরুরী কর্মসূচী নেয় বাম ও সহযোগী দলগুলি। প্রথমে স্থির ছিল শারীরিক দূরত্ব যথাযথ বজায় রেখে দাবিসমূহের প্ল্যাকার্ড সহ কিছু সময়ের জন্য বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে এন্টালি মার্কেটের সামনে। কিন্তু জায়গাটা ইতিমধ্যে রেড জোন ঘোষিত হওয়ায় কর্মসূচীর স্থান পরিবর্তিত হয় ময়দান এলাকায় আম্বেদকরের মুর্তির সামনে। সেখানে প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদ কর্মসূচী চলছিল। কর্মসূচী শেষ হতে মমতা সরকারের পুলিশ বাহিনী সকলকেই গ্রেফতার করে লালবাজারে নিয়ে যায় এবং সেন্ট্রাল লক আপে না ঢুকিয়ে বাইরে দূরত্ব রেখে বসিয়ে রাখে। পরে ঘন্টাদুয়েক বাদে সকলকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ধৃতদের মধ্যে ছিলেন বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র, মহঃ সেলিম (সিপিআইএম), বাসুদেব বসু (সিপিআইএমএল), নরেন চ্যাটার্জী (ফরওয়ার্ড ব্লক) সহ ৪০ জন। বাম দলগুলি এই অন্যায় গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা জানায়।

২) অনুগ্রহ নয়-চাই খাদ্যের অধিকার। নদীয়ার খাদ্য দপ্তরে বামদলগুলির যৌথ ডেপুটেশন

রেশনের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো গ্রামের গরিব মানুষদের যদি জিজ্ঞেস করা যায়, আপনার কার্ডে কতটা মাল বরাদ্দ জানেন? অধিকাংশ মানুষেরই উত্তর পাওয়া যাবে – ঠিক জানি না! শহরের যে নিম্নবিত্তরা এতদিন রেশন দোকানমুখী হতেন না, মাঝে মধ্যে গেলেও ডিলার যতটুকু চাল গম দিতো সেটা নিয়েই চলে আসতেন। এখন করোনা লকডাউনের পরিস্থিতিতে সংকটগ্রস্ত সেই মানুষরাও বিনামূল্যের চাল-গম নিতে রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে! শহর শহরতলীর রেশন দোকানগুলিতে আজকাল ডাল, তেল, বিস্কুট সাবান, এমনকি ধূপকাঠিও পাওয়া যায় কিছুটা “ন্যয্য মূল্যে”। সেখানে ৪২/৪৫ টাকার মিনিকিট চাল কেনার ভিড়ে ২ টাকার চাল পাওয়া মানুষেরা কদাচিৎ জিজ্ঞেস করে থাকেন তাঁদের কার্ডে কতটা মাল পাওয়া যাবে! এখন ডিলার বলছে পুরো মাল সাপ্লাই আসেনি। অগত্যা যেটুকু পাচ্ছেন বিনা বাক্য ব্যায়ে নিয়ে চলে আসছেন। তাঁদের অনেকেই জানেন না রাজ্য যোজনায় থাকা নিজের রেশন কার্ডে প্রাপ্য কতটা? করোনা লকডাউনের জন্য টিভিতে এখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় চলছে সরকারী বিজ্ঞাপন। নানা ধরনের কার্ডে বিনামূল্যে খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যাবে সেই কথা ঘনঘন প্রচার করা হচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে “নিজ নিজ স্কেল অনুযায়ী” চাল গম পাবেন। কোনো কার্ডে কতটা পরিমাণ প্রাপ্য সেটা কিন্তু টিভির বিজ্ঞাপনে আদৌ বলা হচ্ছে না। নদীয়ার গ্রামাঞ্চলে নাকাশীপাড়া ব্লকের শিবপুর গ্রাম থেকে শুরু করে কলকাতার যাদবপুর বা বিজয়গড় – রেশনে বরাদ্দ চাল-গম কম পেলে কুণ্ঠাভরে প্রশ্ন করলে উত্তর মেলে না। আমাদের কম দেওয়া হচ্ছে কেন? কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ চিত্র। রেশন পাওয়াটাকে সাধারণ মানুষ প্রায়শই সরকারী অনুগ্রহ বলেই বিবেচনা করে থাকেন। যেমন রাজ্য সরকারের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর মেলে না যে কেন্দ্রীয় ঘোষণার অতিরিক্ত চাল কি রাজ্যের এফসিআই গোডাউনে মজুত করা হয়েছে? তাহলে সেটা অতিরিক্ত পরিমানে দেওয়া হচ্ছে না। তাই অনুগ্রহ নয় রেশনে খাদ্য পাওয়া আমাদের অধিকার – এই দাবিকে সামনে রেখে গত ১৭ এপ্রিল কৃষ্ণনগরে নদীয়া জেলা খাদ্য দপ্তরে সংগঠিত হলো বামপন্থী দলগুলির যৌথ ডেপুটেশন। প্রধান দাবি ছিলো প্রতিটি রেশন দোকানে কত পরিমাণ মাল দেওয়া হচ্ছে এবং কোন কার্ডে প্রাপ্য কতটা সেটা লিখিত ভাবে টাঙিয়ে দিতে হবে। এ বিষয়টি গ্রামে গ্রামে মাইকে প্রচার করতে হবে। গ্রাহকদের ক্যাশমেমো বাধ্যতামূলক ভাবে দিতে হবে। রেশন দুর্নীতি রোধে তদারকী কমিটি গঠন করতে হবে। এছাড়া অন্যান্য যে দাবিগুলি ছিলো তা হলো –

সমস্ত গরিব পরিবারকে মাসে ৩৫ কেজি খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করতে হবে।

স্পেশাল রিলিফের চাল রেশন দোকানের মাধ্যমে বিলি করতে হবে। কোনো মতেই শাসকদলের মাধ্যমে “ত্রাণ” হিসাবে বিলি করা চলবে না। এপিএল বিপিএল বিভাজন নয়,সকল পরিবারকে বিনামূল্যে রেশন দিতে হবে। পরিযায়ী শ্রমিক-বিড়ি-পরিবহন-নির্মান-হকার-মিড ডে মিল কর্মী সহ সমস্ত শ্রমজীবী মানুষদের এবং যাদের কার্ড নেই তাদেরকে বিনামূল্যে রেশন দিতে হবে। যারা টোকেন পায়নি এমন গরিব মানুষ এবং আরকেএসওয়াই ২নং গ্রাহকদের বিনামূল্যে রেশন দিতে হবে ইত্যাদি। ডেপুটেশনে নেতৃত্ব দেন সিপিআই(এমএল)-এর অমল তরফদার, প্রভাস সাহা, সিপিএমের সুমিত দে, এম সাদী এবং ছিলেন সিপিআই ও পিডিএসের নেতৃবৃন্দ।

এরপর এআইসিসিটিইউ-র পক্ষ থেকে জেলা শাসকের কাছে ত্রাণ সাহায্যের জন্য গরিব শ্রমজীবী মানুষের ৩৫৫ জনের তালিকা জমা দেওয়া হয়।

রিপোর্ট - জয়তু দেশমুখ

rati

৩) নদীয়ার ধুবুলিয়ায় ত্রাণ বিলি -

১৭ এপ্রিল নদীয়া জেলার গাছা এলাকার গাছাগ্রাম-ঘোষপাড়া-পশ্চিমপাড়া- আদিবাসীপাড়ায় ২০০-র অধিক পরিবারকে ত্রাণ বিলি করা হয়। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের গাছা অফিস থেকে বিলিবণ্টন করেন মুড়াগাছা লোকাল কমিটির সম্পাদক ভুলু সাহেব, লোকাল কমিটি সদস্য ধীরেন বিশ্বাস, আছারুদ্দিন সেখ, কাওছার সেখ, নিমাই মন্ডল প্রমুখ। ধুবুলিয়া লোকাল কমিটি তিন কুইন্টাল চাল ও চার প্যাকেট আলু পাঠায়, বাকি তিন কুইন্টাল চাল ও তিন প্যাকেট আলু গাছার স্থানীয় কমরেডরা সংগ্রহ করেন। এই ত্রাণ বিলিবণ্টন এলাকায় ভালো প্রভাব ফেলেছে।

৪) ১৮ এপ্রিলের রিপোর্ট - বলাগড়ের গুপ্তিপাড়া ২নং অঞ্চলের রথসরক পাড়ার ভানু হালদার দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। মাস তিনেক আগে কল্যাণী হাসপাতালে ভর্তি হলে ডাক্তারবাবু জানান, ক্যানসার হয়েছে বলে মনে হয়। তিনি বলেন কলকাতায় পিজি/এনআরএস/কলকাতা মেডিকেল তিনটির মধ্যে যেকোনো একটিতে দেখাতে পারেন। তাই পরিবারটি এনআরএস-এ ডাক্তার দেখিয়ে ৪ দিন আগে বাড়ি ফেরেন। এরপরে স্থানীয় আরএসএস ও বিজেপি নেতা মৃদুল সুর, সোমা সুর কিছু সমর্থক নিয়ে ভানু হালদারের বাড়িতে চড়াও হয়। তাঁর পুত্র প্রদীপ হালদার, পুত্রবধূ নয়না হালদারদের নিদান দেয়, তোমাদের বাড়ির মধ্যেই থাকতে হবে। পরিবারটি কৃষক পরিবার হওয়ায় জানায়, তাঁরা বাড়িতে থাকবেন তবে কাউকে চাষের কাজের দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু বিজেপি নেতারা সেই দায় নিতে অস্বীকার করে এমনকি কৃষক পরিবারটির জমিতে কেউ যাতে কাজে না লাগে তার জন্য গ্রামের আশেপাশে প্রচার করে যে, ওদের জমিতে কাজ করলে করোনা হবে। পরিবারটিকে অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে ফেলে দেয়। পরিবারটির সদস্য নয়না হালদার সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের হুগলী জেলা কমিটির সদস্যা শোভা ব্যানার্জির সাথে যোগাযোগ করেন। ফোন পেয়ে আজ ১৮ এপ্রিল সকাল ১০টা নাগাদ পার্টির বলাগড় ব্লক সম্পাদক শেখ আনারুল, শোভা ব্যনার্জি ও কমরেড অভিজিৎ ঐ গ্রামে পৌঁছে যান। ভানু হালদারের পরিবার সহ পাড়ার আরও তিনটি পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলার পরই বলাগড় থানার ওসি-কে ফোন করে ঘটনাটি জানানো হয় পরিবারের সদস্যা নয়না হালদারের একটি ভিডিও বার্তা ওসি-কে পাঠানো হয়। তিনি বিষয়টি গুপ্তিপাড়া থানার আইসি কে জানান। সিপিআই(এমএল)-এর সদস্যরা উপস্থিত থাকাকালীনই আইসি পরিবারটির সাথে দেখা করে কথা বলেন যারা গুজব ছড়িয়েছে তাদের নামগুলো নোট করেন। পার্টির তরফ থেকে নিম্নলিখিত তিনটি বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আইসি-কে বলা হয়েছে –

ক) গুজবের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রশাসনকে মাইকিং করতে হবে।
খ) গুজব রটনাকারী বিজেপি সদস্যদেরকে গ্রেফতার করতে হবে।
গ) কৃষি কাজ যাতে ব্যহত না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে।

আইসি সকলের সামনে জানান যে তিনি ব্যবস্থা নেবেন। সিপিআই(এমএল) লিবারেশান পরবর্তী পদক্ষেপের উপর নজর রাখছে।

hg

৪) রেশন দুর্নীতির বিরুদ্ধে বৈঁচিগ্রামে বিক্ষোভ -

এক রেশন ডিলারের বড় মাত্রায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে গত পরশু বিডিও-র কাছে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের তরফে অভিযোগ জানানো হয়েছিল । যেমন RKSY-1 কার্ড হোল্ডারদের কাউকে ৩ কেজি গম দেওয়া হয়েছে তো তার প্রাপ্য বাকি ২ কেজি চাল তাকে দেওয়া হয়নি। কারো বেলায় ঠিক বিপরীতটা অর্থাৎ ২ কেজি চাল দেওয়া হয়েছে অথচ প্রাপ্য আটা দেওয়া হয়নি। পার্টির অভিযোগের ভিত্তিতে প্রশাসনের তরফে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যারা বঞ্চিত হয়েছিলেন তারা এখন রেশন শপে গিয়ে আগে যা পাননি এবার পেয়ে যাচ্ছেন । ডিলার বলছেন, “উপর তলায় বলবার কী দরকার ছিল? আমার কাছে এলেই তো আমি দেখতাম।” মানুষ পার্টির উদ্যোগে খুশিি।

৫) ১৮ এপ্রিল বাঁশদ্রোণীতে পরিযায়ী শ্রমিকদের সমর্থনে বিক্ষোভ -

পরিযায়ী শ্রমিকদের দাবিতে বিক্ষোভ পরিযায়ী শ্রমিকদের দাবি সনদ নিয়ে আজকের এই বিক্ষোভ প্রদর্শনীতে সিপিআই(এমএল) কর্মী-সমর্থক এবং নির্মাণ শ্রমিক সদস্য নিয়ে মোট ১২ জন উপস্থিত ছিলেন। সকাল দশটা নাগাদ বাঁশদ্রোণী মেট্রো স্টেশনের সামনে এই কর্মসূচী নেওয়া হয়। সকাল দশটা থেকে দশটা কুড়ি পর্যন্ত প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে এই বিক্ষোভ প্রদর্শন চলে। পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানো এবং লকডাউন  ভাতা সহ বিভিন্ন দাবি সনদের পোস্টার হাতে এবং শ্লোগানের মধ্য দিয়ে প্রায় কুড়ি মিনিট বিক্ষোভ চলে। পথচলতি বিভিন্ন মানুষ, রিকশাচালক এবং উপস্থিত অন্যান্য শ্রমিকরা আমাদের দাবি এবং আহ্বানকে প্রশংসার সাথে পর্যবেক্ষণ করে। এর মধ্যে পুলিশের সক্রিয়তা যথেষ্ট পরিমাণেই চোখে পড়ে। পুলিশ ভ্যানের টহল, ইনফর্মারা  গোটা কর্মসূচী নজরে রাখে। প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে বিক্ষোভ প্রদর্শন চলার পর দাবি সনদ বিভিন্ন দেয়ালে টাঙিয়ে দিয়ে  কর্মসূচী শেষ করে স্থান ত্যাগ করা হয়। দূর থেকে নজরে আসে, কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশাল পুলিশবাহিনী এলাকা থেকে ঘিরে ফেলে।

kol

৬) নদীয়ার তাহেরপুরে পৌরসভায় ডেপুটেশন -

করোনা লকডাউনের পরিস্থিতিতে সংকটগ্রস্ত মানুষের কয়েকটি জরুরি দাবিকে তুলে ধরে তাহেরপুর নোটিফায়েড এরিয়া কর্তৃপক্ষের কাছে পার্টির পক্ষ থেকে এক ডেপুটেশন সংগঠিত হয়। গত ২০ এপ্রিল স্থানীয় পার্টির ৫ জনের এক প্রতিনিধিদল ডেপুটেশনে যায়। বর্তমান রেশন নিয়ে যে নানারকম অনিয়ম চলছে এবং গরিবমানুষ সঠিক পরিমানে খাদ্য দ্রব্য পাচ্ছেন না। এই পরিপ্রেক্ষিতে দাবি তোলা হয় যে প্রতিটি রেশন দোকানে বণ্টিত খাদ্যদ্রব্যের পরিমাণ লিখিতভাবে বোর্ডে টাঙ্গিয়ে দিতে হবে -- পৌরসভাকে এই নির্দেশ জারি করতে হবে। বিষয়টি পৌর কর্তৃপক্ষ মেনে নেয়। দাবি জানানো হয় সকল গরিব মানুষ – কার্ড থাকুক বা না থাকুক রেশন দিতে হবে। যারা নানাবিধ কারণে রেশনে মাল পাচ্ছেন না তাঁদের রেশন দেওয়ার দায়িত্ব পৌরসভাকে নিতে হবে। কর্তৃপক্ষ জানায় এ ধরনের বঞ্চিত গরিবদের নাম পাঠালে তাঁরা মানবিক জায়গা থেকে অবশ্যই বিবেচনা করবেন। এছাড়া ১ হাজার টাকা আর্থিক সাহায্যের প্রকল্প “প্রচেষ্টা” সরকারী ভাবে ঘোষিত হলে তারা এ বিষয়ে সবরকম সহযোগিতা করবেন। পুরসভা এলাকা জীবানুমুক্ত করার ব্যবস্থাবলী পরিচালনা করবেন। দাবি জানানো হয় এই সমস্ত প্রশ্নে সার্বিক ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। আরেকটি জরুরি বিষয় তুলে ধরা হয় যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নির্মাণ কর্মীদের এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হবে না – এই ধরনের একটা সাম্প্রদায়িক ঘৃণা প্রচার তাহেরপুরে কোনো কোনো মহল থেকে করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পার্শ্ববর্তী মুর্শিদাবাদ জেলার নির্মাণকর্মীরা নিয়মিতভাবে তাহেরপুরে নির্মাণকাজ করে থাকেন। লকডাউনের পরিস্থিতিতে তাঁদের অনেক কাজ বকেয়াও পড়ে আছে। পৌরসভার কাছে দাবি জানানো হয় আগামীতে ঐ নির্মাণকমীরা যাতে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। করোনাকে কাজে লাগিয়ে সাম্প্রদায়িক প্রচার বন্ধ করতে পৌরসভাকে পাল্টা প্রচার করতে হবে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন নদীয়া জেলা সদস্য জীবন কবিরাজ, তাহেরপুর ব্রাঞ্চ সম্পাদক যোগেশ শিকদার, স্থানীয় পার্টি কর্মী শিবশংকর দাস, আশীষ দত্ত, অমিয় দাস।

aicc

 

19a

দেশব্যাপী পরিযায়ী শ্রমিকদের নিখরচায় ঘরে ফেরানো, ১০,০০০ টাকা লকডাউন ভাতা, তিন মাস রেশন এবং তাঁদের জন্য একপ্রস্থ অ্যাকশন প্ল্যান এর দাবিতে ১৮-১৯ এপ্রিল অবস্থান অনশনের ডাক দেওয়া হয়। বলা হয় – কর্মীদের গ্রেপ্তার ও পুলিশী হেনস্থাকে এআইসিসিটিইউ নিন্দা করছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের দিয়ে বাধ্যতামূলক শ্রম করানোর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশিকাকে এআইসিসিটিইউ নিন্দা করছে। অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে। এআইসিসিটিইউ-র পক্ষ থেকে বলা হয়, কোনও ধরনের ছাঁটাই বা মজুরি হ্রাস চলবে না। শ্রমিকদের দোরে দোরে রেশন, খাদ্য দ্রব্য সরবরাহ করতে হবে, তাঁরা যে সমস্ত আশ্রয়স্থলে বর্তমানে রয়েছেন, সেগুলোকে পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত করতে হবে। অসংগঠিত শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।

কর্মসূচী পালিত হয় কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে।

সকাল দশটায় বাঁশদ্রোণী তে সূর্য সেন মেট্রো স্টেশনের সামনে উল্লিখিত ওই সমস্ত দাবিতে প্রায় কুড়ি মিনিট পর্যন্ত বিক্ষোভ কর্মসূচী চলে। পোস্টার প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে শ্লোগান চলে। পথচলতি কিছু মানুষ, এবং অন্যান্য কিছু নাগরিক ঔৎসুক্যের সাথে গোটা প্রোগ্রামটা পর্যবেক্ষণ করে। পুলিশের সক্রিয়তা ক্রমে বেড়ে ওঠায়, বিশাল পুলিশবাহিনী এসে পড়ায় দাবি সনদ সম্বলিত পোস্টার দেওয়ালে টাঙিয়ে কর্মসূচী শেষ হয়। সৌরভ, গণেশ, রাজিব সহ নির্মাণ শ্রমিকরা এই কর্মসূচীতে অংশ নেন। বেহালার ১২১ নং ওয়ার্ডে এই কর্মসূচী পালিত হয়। পোস্টার প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে কমরেডরা পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখে, শ্লোগান দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বিক্ষোভ দেখান। মিথিলেশ, কমলেন্দু, সৈকত, রঞ্জিত সহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন। গাঙ্গুলিপুকুর পার্টি অফিসের সংলগ্ন রাস্তার ধারে এই কর্মসূচী পালিত হয়। একইরূপে, পোস্টার প্লাকার্ড সহ কমরেডরা জড়ো হয়ে শ্লোগান দেন। আইসার কয়েকজন কমরেড ও সামিল হয়। বাসুদেব বোস, প্রবীর দাস, জয়তু দেশমুখ, বাবুন চ্যাটার্জি, রণজয়, ঋতম, শ্যামল, সহ অন্যান্য কমরেডরা উপস্থিত ছিলেন। বাঘাযতীনের ১০২নং ওয়ার্ডে শীলা দে সরকার ও রামগড়-এর মিড-ডে-মিল কর্মীদের নিয়ে গতকাল ১৯ এপ্রিল বাহাদুর মাঠে ৫০ জন গরিব মানুষকে কিছু খাদ্য সামগ্রী যেমন চাল, আলু, সোয়াবিন, বিস্কুট, মুড়ি বিতরণ করা হয়। পার্টির পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন কমরেড ভরত দাস ও কমরেড  মন্টু ঘোষ। এছাড়া  এলাকার কিছু স্থানীয় যুবক ও ত্রাণ বিলিতে অংশ গ্রহণ করেন।

gf

 

উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বিভিন্ন জায়গায় কর্মসূচী পালিত হয়। অশোকনগরে এআইসিসিটিইউ নির্মাণ শ্রমিকদের সামিল করে পরিযায়ী শ্রমিকদের খাদ্য ভাতা নিরাপত্তার দাবিতে স্টেডিয়াম মোড়ে ব্যানার প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ দেখায়। নৈহাটির শিবদাসপুর গ্রামে নির্মাণ ও কৃষিমজুর সংগঠনের পক্ষ থেকে এই দিন গ্রামে ত্রাণ বিলি করার পাশাপাশি পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর দাবিতেও সোচ্চার হয়। এই দিন দুপুরে সিপিআই, সিপিআই(এম) ও সিপিআই(এম‌এল) লিবারেশন পার্টির পক্ষ থেকে বসিরহাট এসডিও-র কাছে ডেপুটেশন দেওয়া হয় এবং গতকাল বামপন্থী নেতাদের গ্রেপ্তারের বিরোধিতা করা হয়। আমাদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দলে ছিলেন বসিরহাট আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাস। তিনি পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করেন। ১৯ এপ্রিল বেলঘরিয়ার শহীদ বেদী মোরে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও সিপিআই(এম) যৌথভাবে প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করে। এই প্রতিবাদী কর্মসূচী থেকেও সার্বজনীন রেশন ও আরো বেশি টেস্ট কিটের ব্যবহারের পাশাপাশি পরিযায়ী শ্রমিকদের দাবিগুলোও তুলে ধরা হয়। এই জেলার ছাত্র কমরেডরা এই দিন আইসার ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্র ও পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য বিশেষ প্যাকেজের দাবিতে সকাল থেকেই লকডাউনের মধ্যেই নিজ নিজ বাড়িতে প্রতীকী অনশনে সামিল হয়। ২০ এপ্রিল মধ্যমগ্রামে লিবারেশন সহ বাম দলসমূহের রাস্তায় নেমে যৌথ কর্মসূচী গ্রহণ করে। খাদ্য, ভাতা, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তা প্রভৃতি দাবিতে দীর্ঘক্ষণ প্রতিবাদ জানানো হয়।

nad

 

এই রাজ্যের পাশাপাশি গোটা দেশজুড়েই পরিযায়ী শ্রমিকদের সংহতিতে প্রতিবাদ দিবস পালিত হল। লকডাউনের বিধি নিষেধ মেনেই, বিভিন্ন জায়গায় ধর্ণা, অনশন ধর্মঘট, প্ল্যাকার্ড হাতে প্রদর্শন করে বিভিন্ন দাবি সামনে আনা হয়। এই সমস্ত প্রতিবাদী কর্মসূচীগুলোতে পরিযায়ী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ভালই ছিল। এমনকি, বহু জায়গায় আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের সদস্যরাও সামিল হন। তামিলনাড়ুর বেশ কয়েকটা জায়গায় ঘরের মধ্যে অনশনরত কর্মীদের পুলিশী হেনস্থা ও হুমকির মুখে পড়তে হয়। সিপিআই(এমএল)-এর নেতা অতিখ অহমেদ ও চারজন কর্মীকে অযোধ্যা জেলার পুলিশ গ্রেফতার করে ঘরের মধ্যে অনশন চালানোর ‘অপরাধে’। পরে অবশ্য তিনজন ব্যক্তিগত জামিনে ছাড়া পায়।

দেশজুড়ে এআইসিসিটিইউ ও আয়রালার কয়েক হাজার কর্মী অনশনে অংশ নেন। সিপিআই(এমএল)-এর নেতা ও বিধায়কবৃন্দ, নাগরিক সমাজের ব্যক্তিবর্গ এবং ছাত্ররাও পরিযায়ী শ্রমিকদের সংহতিতে অনশনে সামিল হন।

নির্মাণ, গ্রামীণ ও কৃষি শ্রমিক, পাওয়ার লুম, বিড়ি, পরিবহন, স্বাস্থ্য কর্মী ও কারখানার শ্রমিক, হকার, বিভিন্ন জায়গায় আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিক এই কর্মসূচীতে যোগ দেন। নানান রাজ্য ও রাজ্য রাজধানীতে এই কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়।

aunty

 

aunty

দীর্ঘদিন অসুস্থতা ভোগের পর ২১ এপ্রিল ভোর ৪.৪৫ মিনিটে বামপন্থী ও মানবিক মাসিমা আল্পনা অধিকারী (৮২) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার আগের রাতে যখন কমরেড সজল অধিকারীর সাথে যোগাযোগ হল তখনই কথা মনে হল মাসিমা কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে চলছেন।

কমরেড মাসিমা দীর্ঘদিন বামপন্থী ও আমাদের পার্টির বিপ্লবী আন্দোলনে দৃঢ ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। আমাদের পত্রপত্রিকা পড়তেন এবং খোঁজ খবর নিতেন। প্রয়াত মেসোমশায় কমরেড বীরেন্দ্র নাথ অধিকারী ধনেখালি ব্লক ও বেলমুড়ি অঞ্চলের বামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। সিপিএমের ভেতরে অনেক বাম নেতা ও কর্মীর আমাদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার ভূমিকা নিয়েছিলেন। বিশেষ করে আইপিএফ-এর কর্মকাণ্ড চলার সময়ে তিনি এই কাজটা করেছিলেন। মাসিমা অনেক রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অত্যাচার মোকাবিলা করেছেন, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। অতীতে কংগ্রেস, সিপিএম, বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেসের অত্যাচারের সাক্ষী ছিলেন। এই ধরনের দৃঢ়চেতা ও মানবিক মাসিমারা পার্টির বিস্তার ও রক্ষার জন্য অনেককিছু নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ করার কারণে আমাদের সকলের কাছে শ্রদ্ধেয় হয়ে থাকবেন। দিনের পর দিন কমরেড সজলের জন্য রাত জেগে বসে থাকতেন। এটা তিনি মেনে নিয়ে ছিলেন। সেই কমরেড আল্পনা অধিকারী মাসিমা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমার মাসিমা ও মেসোমশায়ের সঙ্গে অনেক দিন গল্প হয়েছে, অনেক দিন বাড়িতে থেকেছি, কিন্তু কোনোদিনই সজলকে নিয়ে কিছু বলেননি, শুধু বলতেন তোমরা সাবধানে থেকো। খুবই বড় মনের পরিচয় দিতেন। সেই বামপন্থী ও মানবিক মাসিমাকে আমাদের হাজার হাজার লাল সেলাম। কমরেড সজল ও তার তিন বোন এবং পরিবার-পরিজনদের শোকের সাথে সহমর্মী হয়ে আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি।

- কার্তিক পাল

kah

এক যৌথ বিবৃতিতে সিপিআই(এমএল) বিহার সম্পাদক কমরেড কুনাল এবং পলিটব্যুরো সদস্য ও খাগারিয়া জেলা দায়িত্বশীল কমরেড রাজারাম সিং সিপিআই(এম)-এর খাগারিয়া জেলা কমিটির সদস্য এবং মেঘোনা পঞ্চায়েতের পূর্বতন মুখিয়া কমরেড জগদীশ চন্দ্র বসুর হত্যার ঘটনায় তীব্র ধিক্কার জানিয়েছেন। সিপিআই(এমএল) নেতারা বলেছেন, লকডাউন বলবৎ হওয়ার পর বিহারে সামন্ততান্ত্রিক দুর্বৃত্তদের মনোবল বেড়ে গেছে এবং তারা বিভিন্ন স্থানেই দলিত, মুসলিম ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর আক্রমণ হানছে।

এটা অত্যন্ত পরিতাপের যে, করোনা ও লকডাউন সংকটের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই না করে সামন্ততান্ত্রিক দুর্বৃত্তরা এটাকে দলিত, মুসলিম ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর লাইসেন্স করে তুলেছে। আমরা ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে সতর্ক করলেও তিনি এতে কোনো গুরুত্বই দেননি। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।

হত্যার ঘটনার খবর পেয়ে খাগারিয়া জেলা সম্পাদক অরুণ দাস ঘটনাটির তদন্ত করেন এবং বলেন, করোনা সংক্রমণ সম্পর্কে সচেতনতার একটি প্রচারে অংশ নিয়ে ফেরার সময় ১১ এপ্রিল জগদীশ চন্দ্র বসুকে হত্যা করা হয়। রাস্তায় ওৎ পেতে থাকা দুর্বৃত্তরা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।

সিপিআই(এমএল) কমরেড বসুর শোকগ্ৰস্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক শোক জ্ঞাপন করেছে, এবং অবিলম্বে সমস্ত অপরাধীদের গ্ৰেপ্তার করা ও ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধের দাবি জানিয়েছে।

খণ্ড-27