আজকের দেশব্রতী : বিশেষ বৈদ্যুতিন সংখ্যা (১৬ জুলাই ২০২০)

gga

যে কোনো লেখা এককভাবে খুলতে লেখার হেডিং-এ ক্লিক করুন

 

drarhir

দেশে চলছে নয়া এক হীরক রাজার শাসন। যার নারকীয়তার নজির মিলছে প্রায় প্রাত্যহিক। এর নিশানার এক অন্যতম শিকার “জনগণের কবি” পরিচয়ে প্রখ্যাত তেলুগু কবি ভারভারা রাও। প্রগতিবাদী কাব্য সৃজনে ও জন-আন্দোলনের সপক্ষে অবিচল থাকা এই রোগজর্জর বৃদ্ধ যোদ্ধা আরও কয়েকজন বুদ্ধিজীবী সহ দু’বছর ধরে কারাবন্দী। জাতীয় তদম্তকারী সংস্থা (এনআইএ) ও মহারাষ্ট্র সরকারের যোগসাজশে ‘ভীমা কোরেগাঁও’ মামলায় জড়িত অভিযোগে। এই গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে, বন্দীদশা থেকে মুক্তির দাবিতে উত্তাল হয়েছে দেশ-বিদেশের অসংখ্য গণকন্ঠ। কিন্তু মুক্তি মেলেনি। অধুনা চরম অবনতি হয়েছে কবির শারীরিক অবস্থার, তবু চূড়ান্ত অবহেলা করা হচ্ছে তাঁর চিকিৎসার প্রশ্নে। বাইরে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার বন্দোবস্ত না করে ফেলে রাখা হয়েছিল কারার ঐ কুঠুরিতে। কোনও দাবি, কোনও আবেদনের সুরাহা মিলছিল না। পরন্তু কর্তৃপক্ষ মনে করছে কবির অবস্থা নাকি ‘স্থিতিশীল’! চিকিৎসকের জায়গায় বিবৃতি দিচ্ছিলেন পুলিশ ও কারা প্রশাসনের কর্তারা! তবে প্রবল জনমতের চাপে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছে ভারভারা রাওকে বাইরের হাসপাতালে ভর্তি করতে।

var

 

এমনতর রাষ্ট্রীয় দমন ও নিয়ন্ত্রণের ঘটনা ও প্রবণতা সংঘটিত হচ্ছে অজস্র। তার কিছু যেমন সংবাদ জগতের খবর হয়, আন্দোলনের বিষয় হয়ে ওঠে, বহু কিছু থেকে যাচ্ছে অজানা, অধরা। দমন-পীড়ন চালাচ্ছ রাষ্ট্রশক্তি শুধুমাত্র নয়, রাষ্ট্র বহির্ভূত শক্তিগুলিও। কুখ্যাত আইন কানুনে যেমন কারারুদ্ধ করা হচ্ছে, বিনা বিচারে বছরের পর বছর বন্দী করে রাখা হচ্ছে, তেমনি শোনানো হয় ‘এনকাউন্টারে মৃত্যু’-র গল্প। আর রাষ্ট্রশক্তির থেকে মদত পায় রাষ্ট্র বহির্ভূত শক্তিগুলির দ্বারা পরিকল্পিত সংগঠিত সমস্ত অপরাধ। যেমন ‘ভীড় ঘটিয়ে হত্যাকান্ড’ বা বিশিষ্টজনদের হত্যার ঘটনা। যারা এর শিকার তারা রাজনৈতিক সামাজিক আন্দোলনের প্রতিনিধি, বামপন্থী-গণতান্ত্রিক-যুক্তিবাদী-প্রগতিশীল প্রতিবাদী ব্যক্তিবর্গ, দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। শিল্প সাহিত্য তথা বিজ্ঞান ও গবেষণা কাজে যুক্ত বিদ্বজ্জনও রেহাই পাচ্ছেন না। সর্বত্র গণতন্ত্রের ওপর খড়গহস্ত হচ্ছে ফ্যাসিবাদী শাসকেরা। তারা বেঁধে দিচ্ছে ‘গণতন্ত্রের সংজ্ঞা’, তার বেচাল হলেই দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’, ‘দেশদ্রোহী’, ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা! কখনও বা তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘দেশকে টুকরো টুকরো করা’র পন্থী বলে।

saf

 

সরকারের নীতি-আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুললে, তর্কবিতর্ক জুড়লে, স্বরূপ উন্মোচন করলে, সমালোচনা, বিরোধিতা করলে বা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে, নিপাত যাক আহ্বান জানালে ছাপ মেরে দেওয়া হয় একইভাবে! এমনকি দেশ যখন বিগত মার্চ মাসের গোড়া থেকে কোভিড আক্রান্ত হচ্ছিল তখন তার মোকাবিলায় একমুখী অগ্রাধিকার না দিয়ে মোদী সরকার ব্যস্ত ছিল ‘সিএএ-এনপিআর-এনআরসি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ‘দেশের শত্রু’ খোঁজার ফ্যসিস্ট উন্মত্ততাকে চরমে তুলতে, সাম্প্রদায়িক আক্রমণ নামাতে। অন্যদিকে সফরে আসা ট্রাম্প সাহেবকে ‘দেশের বন্ধু’ বানাতে! গণতন্ত্র, দেশপ্রেম, ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রগতিশীল জাতিয়তাবাদ নির্ণয় ও জনগণের জীবন-জীবিকার নির্ধারণের প্রশ্নে মোদী আমল যত বেশি পর্যুদস্ত হচ্ছে যুক্তির লড়াইয়ে, ততই কুখ্যাত সব আইন কানুনের জোরে নামাচ্ছে দমন পীড়ন। কুখ্যাত আইনগুলির বন্দোবস্ত রয়েছে কম কিছু নয়। এনএসএ, ইউএপিএ, সিডিশন এ্যাক্ট, ক্রিমিনাল ডিফেমেশন এ্যাক্ট ইত্যাদি রয়েছেই। এছাড়া রাজ্য বিশেষে রয়েছে আরও বিশেষ বিশেষ সব কুখ্যাত কানুন, যেমন কাশ্মীরে লাগু রয়েছে ‘জন সুরক্ষা আইন’। তবু মোদী সরকার বিরত হওয়ার নয়। এমনকী মারণঘাতী করোনার বিপদ আর পীড়াদায়ক লক ডাউনের পরিস্থিতিতে, যখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কারণে শাসকপক্ষকে সরাসরি চেপে ধরার উপায়গুলি হয়ে গেছে অনেকটাই অসুবিধাজনক, সেই প্রতিকূলতার সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ তৎপর হয়েছেন নয়া উদ্যোগে, দুঁদে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বানিয়েছেন এমন একটা কমিটি যার উদ্দেশ্য হল, কুখ্যাত আইনগুলির আরও কত কড়া সংজ্ঞায়ন ও এক্তিয়ারের সম্প্রসারণ ঘটানো যায় সেটাই।

carrrbiks

বিকাশ দুবে আখ্যান উত্তরপ্রদেশে সংঘর্ষ-হত্যার দীর্ঘ তালিকায় আরও একটা সংযোজন মাত্র নয়, তার অধিক কিছু। এই পরিঘটনা ভারতে রাষ্ট্রশাসনের বিদ্যমান মডেলের মূল নীতিটিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। জনপ্রিয় ভাষায় যাকে দুর্বৃত্ত-পুলিশ-রাজনীতিবিদ আঁতাত বলা হয় তার কিছু বুনিয়াদি বিষয়ের ব্যাখ্যাও হাজির করছে, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন তথা সাংবিধানিক শাসনপ্রক্রিয়ায় সংকটজনক ধ্বসের এক নতুন মাত্রাকে নির্দেশিত করছে।

প্রথমে আমরা ২-৩ জুলাইয়ের মাঝ রাতে কানপুরের একটা গ্ৰামে দুর্বৃত্ত ধরতে যাওয়া পুলিশ দলের ওপর হতবাক করে দেওয়ার মতো আক্রমণ সংগঠিত হওয়ার কথা জানলাম, কুখ্যাত উত্তরপ্রদেশের সীমা ছাড়িয়ে বিকাশ দুবের নাম অন্যান্য রাজ্যের ঘরে-ঘরে পৌঁছে গেল। পুলিশদলের ওপর এই মাত্রায় এরকম হামলা যোগী আদিত্যনাথের সরকার সম্পর্কে প্রচলিত কিংবদন্তিগুলো ধুলিসাত করে দেয়। যোগী সরকার ‘সংঘর্ষ হত্যাকে’ রাষ্ট্রশাসনের নীতি হিসাবে গ্ৰহণ করে তা সরকারের সবচয়ে বড় সাফল্য বলে তুলে ধরছে। উত্তরপ্রদেশের সংঘর্ষগুলোকে সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালে “অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু” বলে অভিহিত করার পর উত্তরপ্রদেশ সরকার প্রজাতন্ত্র দিবসের শোভাযাত্রায় সেগুলোকে প্রচারের বিষয় করে তুলে সর্বসমক্ষে জাহির করে।

আদিত্যনাথের পরিচালনায় উত্তরপ্রদেশে পাঁচ হাজারেরও বেশি সংঘর্ষের ঘটনা তথা একশোরও বেশি সংঘর্ষ-হত্যা সংগঠিত হয়েছে। তার পরও বিকাশ দুবের মতো এক দুর্বৃত্ত পুলিশ দলের ওপর আক্রমণ হানতে পারল! এই ঘটনাটা সংঘর্ষ-রাজের “কার্যকারিতার” তত্ত্বকের অসার প্রতিপন্ন করে। বস্তুত, পরের পর সংঘর্ষ হত্যাকাণ্ডগুলোর অবৈধতার কথা যদি বাদও দেওয়া যায়, ভাষ্যকাররা এইসব সংঘর্ষ-হত্যার অন্তর্নিহিত সামাজিক বৈষম্যমূলক চরিত্রের ওপরও আলোকপাত করেছেন। মার্কামারা সংঘর্ষগুলির বলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলিত বা অন্যান্য নিপীড়িত জাত বা মুসলিম সম্প্রদায়ের অসহায় প্রান্তিক নিরপরাধ নাগরিক, হত্যাকে যুক্তিযুক্ত করে তুলতে হত্যার পর তাদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন অভিযোগ লাগানো হয়। ওই সংঘর্ষের বলি কখনই এমন কোনও “মোস্ট ওয়ান্টেড” দাগি দুর্বৃত্ত হবে না যে অবাধে তার কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক যেরকম তার আত্মসমর্পণ এবং তথাকথিত সংঘর্ষহত্যার আগে পর্যন্ত বিকাশ দুবে চালিয়ে যেতে পেরেছিল।

নিজেদের সংঘর্ষ নীতি নিয়ে উত্তরপ্রদেশ সরকারের ঔদ্ধত্য এতটাই যে, দুবের মৃত্যুর “ব্যাখ্যায়” পুলিশের পেশ করা সংঘর্ষ চিত্রনাট্যের সংশয়হীন রূপের ভুয়ো চরিত্রকে গোপন করার কোনো চেষ্টাই তারা করল না। হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বানানো বিশেষ তদন্তকারী দলের (সিট) গঠনের মধ্যেও সেই একই ধরনের ধৃষ্টতা দেখা গেল। তিন সদস্যের সিট-এর একজন হলেন ডিআইজি জে রবিন্দর গৌড়, যিনি নিজেই ২০০৭ সালে বেরিলির এক তরুণ ওষুধ ব্যবসায়ী মুকুল গুপ্তর ভুয়ো সংঘর্ষ-হত্যায় অভিযুক্ত। এলাহাবাদ হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ২৬ আগস্ট ওই হত্যাকাণ্ডে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিলেও পর্যায়ক্রমে উত্তরপ্রদেশের কোনো সরকারই চার্জশীট প্রাপ্ত পুলিশদের বিরুদ্ধে মামলা চালানোর অনুমতি দেয়নি। আর, মুকুল গুপ্তর অভিভাভকরা, যাঁরা সিবিআই তদন্তের দাবিতে হাইকোর্টে মামলা করেন, তাঁরাও ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে খুন হয়ে যান। তদন্তের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এই ধরনের হওয়ায় উত্তরপ্রদেশে আজ পর্যন্ত সমস্ত সংঘর্ষ হত্যাই যে যুক্তিসংগত বলে প্রতিপাদিত হয়েছে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সরকার এখন আবার এক সদস্যের বিচারবিভাগীয় তদন্তের কথা ঘোষণা করেছে, কিন্তু সংঘর্ষ হত্যার সঙ্গে পুলিশ দলের ওপর আক্রমণকেও জুড়ে দেওয়ায় তদন্তটা সংঘর্ষ হত্যার চেয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ নিয়েই যে বেশি হবে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

রাজনীতিবিদ এবং পুলিশের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগের মধ্যেই যে বিকাশ দুবের মতো দুর্বৃত্তদের ক্ষমতার উৎস, তার উল্লেখ না করলেও চলবে। এখন বিজেপি এবং তার আগে বিএসপি-র সঙ্গে বিকাশ দুবের রাজনৈতিক সংযোগের কথা তো সুবিদিত। উত্তরপ্রদেশের আইনমন্ত্রী ব্রজেশ পাঠকের সঙ্গে বিকাশ দুবের একটা ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। যখন আমরা রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের কথা বা দুর্বৃত্ত-পুলিশ-রাজনীতিবিদ গাঁটছড়ার কথা বলব, তখন এই গাঁটছড়ার মধ্যে রাজনীতিরই সবচেয়ে কর্তৃত্বকারী ভূমিকা থাকার কথা ভুললে চলবে না।

মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে যে সমস্ত গুরুতর অপরাধের মামলা থেকে যোগী আদিত্যনাথ নিজেকে অব্যাহতি দিয়েছেন, এক ভিন্ন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সেগুলোর জন্যই তাঁকে হয়ত বা জেলে থাকতে হত। তাঁর সরকার সংঘর্ষের পরিসংখ্যানগুলো সবসময় জাহির করলেও এই বিষয়টারও উল্লেখ জরুরি যে, মুজাফ্ফরনগর সাম্প্রদায়িক গণহত্যার প্রায় সমস্ত মামলাই তারা বন্ধ করে দিয়েছে। সাংসদ সঞ্জিব বালিয়াঁ ও ভরতেন্দ্র সিং, বিধায়ক সঙ্গীত সোম ও ঊমেশ মালিক, মন্ত্রী সুরেশ রানা ও সাধ্বী প্রাচী — এই সমস্ত সুপরিচিত বিজেপি নেতা সরকারী মার্জনার ফলে লাভবান হয়েছেন। এই ধরনের ঘটনা এর আগে আমরা গুজরাটে ঘটতে দেখেছি, আর এখন ঘটতে দেখছি দিল্লীতে যেখানে অতি শক্তিশালী সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কপিল মিশ্রর মতো বিজেপি নেতাদের অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।

একটা পর্যায়ের পর দুর্বৃত্তদের বোধকরি ঝেড়ে ফেলা যায়, বিকাশ দুবের ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত ঘটানো কাণ্ড যেমনটা দেখাল। অনেকেই মনে করছেন, ওকে ধোঁকা দিয়ে মধ্যপ্রদেশে আত্মসমর্পণ করানো হয়, আর তারপর উত্তরপ্রদেশে নিকেশ করা হয়। রাজনৈতিক শাসকদের কাছে কে কতটা কাজে লাগবে তার রকমফের অনুযায়ী পুলিশ অফিসারদের সঙ্গেও আচরণের তারতম্য ঘটে। বুলন্দশহরে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল ইন্সপেক্টর সুবোধ কুমার সিংকে, আর আমরা দেখতে পাচ্ছি সমস্ত অভিযুক্তরাই জামিনে মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে এসেছে এবং বিজেপি যথারীতি তাদের সংবর্ধিত করেছে। চালু ব্যবস্থায় সঞ্জিব ভাট ও অমিতাভ দাসের মতো পুলিশ অফিসারদের তুলনায় বানজারা ও দাবিন্দার সিং-এর মতো পুলিশ অফিসারদের ভিন্ন মাপকাঠিতে বিচার হয়, অপ্রত্যাশিতভাবে এদের অনাচার ধরা পড়ার পরও এরা পুরস্কৃত ও সুরক্ষিত হতে থাকেন। আর সঞ্জিব ভাট এখন জেলে পচছেন, এবং অমিতাভ দাসকে নির্দিষ্ট সময়ের আগে অবসর নিতে বাধ্য করা হয়েছে (বিহার ক্যাডারের এই আইপিএস অফিসার রণবীর সেনা কিংবা মাফিয়া ডনদের সঙ্গে বিহারের শক্তিশালী রাজনীতিবিদদের সংযোগকে উন্মোচিত করেন)।

আরজেডি শাসিত বিহার অথবা এসপি শাসিত উত্তরপ্রদেশকে বিজেপি ‘জঙ্গলের রাজত্ব’ বলে বর্ণনা করতেই অভ্যস্ত ছিল। মণ্ডল-পরবর্তী সময়কালে পশ্চাদপদ জাতি সমূহের রাজনৈতিক উত্থানকে কলঙ্কিত করতে দীর্ঘদিন ধরেই ওরা এই উত্থানের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য হিসাবে ‘অপরাধ’ বা রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের উপমা ব্যবহার করে আসছে। আজ বিহার এবং উত্তরপ্রদেশ উভয় রাজ্যেই বিজেপি/এনডিএ শাসনাধীনে অপরাধ এবং সন্ত্রাসের বিপুল বৃদ্ধি আমরা দেখতে পাচ্ছি। নিজেদের ঢাক পেটানো ‘সুশাসন’-এর দাবি বাস্তবের প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণরূপে নাকচ হয়ে যাচ্ছে, প্রাধান্যকারী মিডিয়া যদিও ঘটে চলা দুর্বৃত্তায়নের প্রকৃত ব্যাপ্তি ও চরিত্রকে যথাযথ মাত্রায় প্রতিফলিত করছে না। সংঘ বাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে এই দুর্বৃত্তায়নকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামন্ততান্ত্রিক-সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো এবং এর নিশানা হচ্ছে নিপীড়িত সামাজিক গোষ্ঠীসমূহ এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। উত্তরপ্রদেশে এই সামন্ততান্ত্রিক-সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তায়ন এবং সংঘর্ষ-হত্যার নীতি আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের ধারণার প্রতি এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জ খাড়া করছে। এই নকশার শঙ্কাজনক পরিণাম কী হতে পারে তা আমরা গুজরাটে দেখেছি। উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারও যদি এই গুজরাট মডেল অনুসরণ করে তবে আইনের শাসনের অবক্ষয় ঘটে তা পর্যবসিত হবে প্রাতিষ্ঠানিক অরাজকতা ও নৈরাজ্যে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৪ জুলাই ২০২০)  

daearhealt

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে সম্পাদক পার্থ ঘোষ গত ১৩ জুলাই এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন, রাজ্যের চিকিৎসা ব্যবস্থা মুখ ধুবড়ে পড়ার মুখে। ইছাপুরের তরুণ শুভ্রজিতের বস্তুত বিনা চিকিৎসায় বা অবহেলায় মৃত্যু তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আজও বারুইপুরের বছর ২৬-এর এক যুবক কোন হাসপাতালেই ভর্তি হতে না পেরে অকালে চলে গেলেন। এটা এখন রোজের ঘটনা। অসুস্থ হলে মানুষ কোথায় যাবেন তা কেউ বলতে পারছে না। এলাকায় এলাকায় চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বারগুলি প্রায় বন্ধ, রাত বিরেতে অসুস্থ হলে কোন চিকিৎসকের সন্ধান পাওয়া যাবে না। সরকারী হাসপাতালে হয়রানি, হেনস্থার মুখে পড়তে হচ্ছে। বেসরকারী হাসপাতাল ও নার্সিং হোমগুলি রোগী দেখার আগে নন-কোভিড সার্টিফিকেট দাবি করছে। কোথায় গেলে ঐ সার্টিফিকেট মিলবে তাও অজানা। সরকার কোভিড পরীক্ষার দর বেঁধে দিয়েছে বলে শোনা যায়। কিন্তু বেসরকারী হাসপাতালের রেজিস্ট্রেশন ফি এবং ডাক্তারবাবুর ফি ঐ বেঁধে দেওয়া দরের বাইরে। রাজ্যে এখন একটা রোগ নিয়েই সরকার কথা বলছে। কোভিড, কোভিড! এরাজ্যে যেন অন্যান্য প্রাণঘাতী রোগ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কোনো স্পষ্ট নির্দেশিকা নেই, কোথায় গেলে কোন রোগের চিকিৎসা মিলবে, কোথায় গেলে হাসপাতালে বেড মিলবে। অসুস্থ একটিভ কোভিড রোগীও বাসে, ট্যাক্সি করে হাসপাতালে দৌড়চ্ছে। এমনকি কোভিড আক্রান্তের মৃতদেহ বাড়িতে, রেফ্রিজারেটরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকছে। এক ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে রাজ্য এগিয়ে চলেছে। কেন্দ্রের সরকারের নির্দেশ দেওয়া ছাড়া কোনো দায় নেই। ঐ সরকার এখন ব্যস্ত কত কম সময়ে, সবাইকে তাক লাগিয়ে ভ্যাকসিন বাজারে আনা যায়। উন্মাদের পাঠশালা চলছে।

এই কঠিন পরিস্থিতিতেও রাজ্যে কোনো পূর্ণ সময়ের জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী নেই। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আইন শৃঙ্খলার সমস্যা থেকে ত্রাণ দুর্নীতি দেখার অবসরে রাজ্যের মুখ থুবড়ে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দেখভাল করছেন। বাঁচার দাবিতে, স্বাস্থ্য পরিষেবার দাবিতে মানুষকে তাই পথে নামতেই হবে।

mou

১৫ জুলাই বিক্ষোভ সভাগুলি যেসব দাবি তুলে ধরে
    • হাসপাতাল থেকে রোগী ফেরানো ও হয়রানি বন্ধ কর।
    • তরুণ শুভ্রজিতের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই।
    • শুভ্রজিতের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
    • কোভিড-নন কোভিড চিকিৎসার স্পষ্ট নির্দেশিকা রাজ্য সরকারকে জানাতে হবে।
    • কোভিড-নন কোভিড সমস্ত রোগীকে জরুরি পরিষেবা দিতে হবে।
    • জরুরি ভিত্তিতে নন কোভিড চিকিৎসার জন্য মেক-শিফট হাসপাতাল চালু কর।
    • রাজ্য সরকারের অধীন ইএসআই হাসপাতালে দ্রুত কোভিড চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
    • সমস্ত কোভিড হাসপাতালে যথেষ্ট বেড, ডাক্তার- স্বাস্থ্য কর্মী, অক্সিজেন এবং ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করতে হবে।
    • কোভিড হাসপাতালে ক্ষমতাশালীদের “বেড বুক” করা বন্ধ কর।
    • কোয়ারান্টিন সেন্টারে সর্বক্ষণের ডাক্তার নিয়োগ করে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
    • মহিলা কোয়ারান্টিন সেন্টারে মহিলাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

gearpaa

মোট কোভিড সংক্রমিতের সংখ্যায় ভারত কিছুদিন আগেই তিন নম্বরে এসে পৌঁছেছে এবং আপাতত এই অবস্থানেই বেশ কিছুদিন থাকবে এটা নিশ্চিত। দুনম্বরে থাকা ব্রাজিলের সাথে ব্যবধানটা অনেকটাই বেশি। আর এক নম্বরে থাকা আমেরিকার সংক্রমণও মাঝে কিছুটা কমার পর আবার বাড়ছে ভীষণভাবে। এবং তা ব্রাজিল বা ভারতের থেকেও অনেক বেশি সংখ্যায়।

অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন বা প্রথমদিকে সংক্রমণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। মনে করা হচ্ছে আরো কিছু কারণের সঙ্গে লকডাউন সেখানে যথাযথ হয়েছে বলেই এই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে। যা আমেরিকা বা ব্রাজিলে হয়নি। ট্রাম্প এবং বোলসেনারোর বিরুদ্ধে হঠকারিতার অভিযোগও বেশ প্রবল।

ভারতে লকডাউন নিয়ে মিশ্র মতামত আছে। অনেকে মনে করেন লকডাউন করা হয়েছিল বলে অনেকদিন পর্যন্ত সংক্রমণের বাড়বাড়ন্ত কিছুটা ঠেকিয়ে রাখা গেছিল। লকডাউন পর্বের মধ্যেই পরিযায়ী শ্রমিকদের সংকটের দিকটি সামনে আসা ও তাকে মোকাবিলা করার জন্য তাদের ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করার মধ্যে দিয়ে অনেক অসংক্রমিত এলাকায় সংক্রমণ স্বাভাবিকভাবেই ছড়াতে শুরু করে। তারপর লকডাউনকে তুলেই নিতে হয় ধাপে ধাপে। বস্তুতপক্ষে লকডাউন যেভাবে গরিব নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছিল, তাতে লকডাউন না তুললে নিঃসন্দেহে রুটি-রুজির দিক থেকে কোটি কোটি মানুষের জন্য আরো অনেক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হত।

লকডাউন আরো দীর্ঘস্থায়ী যদি করতেই হত, তাহলে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির তরফে প্রান্তিক ও বিপদগ্রস্থ মানুষদের জন্য একগুচ্ছ পরিকল্পনা নিতে হত। যেমন নিখরচায় নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বিলিবণ্টন ব্যবস্থা যথাযথ করা। এটা করা গেলে তবেই হয়ত ভারতে লকডাউন চালিয়ে যাওয়া ও কঠোর করা সম্ভব ছিল।

তবে শুধু রেশন বিলির সমস্যা নয়, আমাদের দেশ ও রাজ্যের বাস্তবতা হল ছোট ছোট একটা দুটো ঘরে পরিবারের অনেকের বাস। এই সমস্যার মোকাবিলা করা নিঃসন্দেহে বেশ কঠিন।

saf

 

ফলে ভারতের মতো দেশে পশ্চিম ইউরোপের মতো কয়েক মাসের দীর্ঘ ও কঠোর লক ডাউন চালিয়ে যাওয়া অন্যান্য অনেক জটিলতা তৈরি করত। শেষদিকে মানুষ আর লকডাউন মানার জায়গায় ছিলেন না, এটা লক্ষ্যই করা গেছিল বহু জায়গায়।

বর্তমানে মূলত বাজার এলাকা সহ আরো কিছু জায়গায় আংশিক লকডাউন আবার বলবৎ করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলায়। তবে এর মধ্যে দিয়ে সমাধান আসবে তেমন দাবি প্রশাসনেরও নেই। এ গতিকে কেবল খানিকটা মন্দীভূত করার চেষ্টা। তবে সেই ক্ষেত্রেও কতটা সাফল্য পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

ভ্যাকসিন যদি না বেরোয় খুব কিছু রাস্তা খোলা নেই বলেই অনেকে মনে করছেন। ভ্যাকসিন কবে বেরোবে সেটা প্রবল অনিশ্চিত একটা ব্যাপার। ১৫ অগস্ট ভ্যাকসিন জনতার ব্যবহারের জন্য আসতে পারে বলে ICMR-এর পক্ষ থেকে ডঃ ভার্গব যা জানিয়েছিলেন, তা নিঃসন্দেহে বিভ্রান্তিকর। এটা বড়জোর তৃতীয় দফার যে পরীক্ষা একটু বেশি সংখ্যক জনগণের ওপর করা হয়, তার একটা সময়সীমা হতে পারে।

তবে ভারত বায়োটেক সহ আরো যে সব কোম্পানি এখানে স্বাধীনভাবে বা বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির জন্য চেষ্টা করে চলেছে, তাদের ভ্যাকসিন তৈরির অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা প্রমাণিত। শিশুদের ভ্যাকসিনের সিংহভাগ ভারতীয় কোম্পানিগুলিই তৈরি করে থাকে।

ভারতের বাইরেও অসংখ্য উদ্যোগ চলছে ভ্যাকসিন তৈরির। প্রায় দেড় শতাধিক উদ্যোগের কয়েকটি মার্চেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন বেশ কয়েকটি জনগণের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষার স্তরে আছে।

রাশিয়া, ব্রিটেন, চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ায় ভ্যাকসিন বেরোলেও ভারতে করোনা ভাইরাসের নির্দিষ্ট স্টেনগুলির মোকাবিলায় সেগুলি পুরোপুরি সফল নাও হতে পারে। দেশ বা অঞ্চলভিত্তিক গবেষণাকে তাই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার। দ্রুত ভ্যাকসিন বেরোলে অবশ্যই সেটা আশার কথা। কিন্তু বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মকে অতিক্রম করে এক্ষেত্রে রাজনৈতিক চমক দেবার চেষ্টা করলে তা হবে হঠকারী ও কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য আশঙ্কাজনক। সমস্ত নিয়ম ও সুরক্ষাবিধিকে যথাযথভাবে মেনেই এক্ষেত্রে এগনো দরকার।

কীভাবে ছড়ায় করোনা ভাইরাস এবং তা থেকে বাঁচার সঠিক গাইডলাইন কি তা বেশ অস্পষ্ট। মাঝে মাঝেই নতুন তথ্য ও গবেষণার আলোয় তাকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন করতে হচ্ছে। ভাইরাসের চরিত্র ঠিকমতো বুঝে উঠতে না পারার কারণেই এই বিভ্রান্তি। কোন ওষুধ কার্যকরী আর কোনটি নয়, তাই নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। যেমন হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইনকে একসময় উপশমের দাওয়াই ভাবা হয়েছিল। ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে তা মার্কিন দেশে পাড়ি দেওয়া নিয়ে রাজনৈতিক চাপান উতোরও হয়েছিল। কিন্তু তারপর দেখা গেল সংক্রমিতকে সুস্থ করে তোলার ক্ষেত্রে এর তেমন কোনও প্রভাব নেই। চিকিৎসক ও মেডিকেল স্টাফদের সংক্রমণ প্রতিরোধী ওষুধ হিসেবে এর কার্যকারিতা আছে কিনা তাও অস্পষ্ট।

test

 

এই যাবতীয় বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতা থেকেই হয়ত একটি স্পষ্ট বার্তা উঠে আসছে -- ভ্যাকসিন আবিষ্কার ছাড়া অন্য কোনওভাবে সংক্রমণের বাড়বাড়ন্তকে আমাদের দেশে এবং রাজ্যে রোধ করা সম্ভব নয়। যতদূর সম্ভব সতর্কতা মেনে অবশ্যই চলতে হবে কিন্তু ভ্যাকসিন হাতে আসার আগের পর্বে কোভিড অতিরিক্ত অন্যান্য নানা রোগ ব্যাধির মোকাবিলা, জীবন-জীবিকার বিভিন্ন সঙ্কটের দিকগুলির মোকাবিলা যেন যতটা সম্ভব মসৃণ হতে পারে, সেই চেষ্টা করা দরকার।

কিন্তু এই ক্ষেত্রে যথেষ্ট ব্যর্থতাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একদিকে দেখা যাচ্ছে কোভিড চিকিৎসা বা কোয়ারান্টাইন সেন্টারের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো এখনো সরকারগুলি তৈরি করে উঠতে পারেনি। অনেক আক্রান্তকেই সুস্থ হয়ে ওঠার আগে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হচ্ছে এবং তারা ও তাদের পরিবার নানা সামাজিক সমস্যার মুখোমুখী হচ্ছেন। অনেকে কোভিড আক্রান্ত অসুস্থ ব্যক্তি আবার হাসপাতালে বেড-ই পাচ্ছেন না। হাসপাতালে না রেখে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার ফলে রাজ্য সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা এক তরুণীর বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর খবর সাম্প্রতিককালে আলোড়ন তুলেছে। মানুষ আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে ভাবছেন যে উচ্চ পদস্থ সরকারী আমলাই যদি এইভাবে মারা যান, তাহলে সাধারণ মানুষের অসহায়তা কতটা। আমতার এক কলেজ অধ্যাপক থেকে ইছাপুরের এক কিশোর ছাত্র সহ অনেকেই এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরে কোথাও ঠাঁই না পেয়ে মারা গেছেন গত কদিনে। এরকম বেদনাদায়ক খবর একের পর এক আসছে।

একদিকে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার যখন এই হাল, তখন অন্যদিকে অন্যান্য রোগ ব্যাধিতে আক্রান্তদেরও সমস্যার শেষ নেই। বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থাই যে শুধু ভেঙে পড়েছে তা নয়, এলাকাগুলিতে স্থানীয় চিকিৎসকদের অনেকেই এখন আর রোগী দেখছেন না। অসুস্থ রোগী ও তাদের পরিজনেরা গভীর উদ্বেগ ও আশঙ্কা নিয়ে অসহায়ভাবে পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।

buss

 

চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্কট ছাড়াও নানা বিষয় নিয়ে গোটা সমাজ জুড়ে সঙ্কট, অস্থিরতা ও আতঙ্ক ক্রমশ ছড়াচ্ছে। তা সে গণপরিবহনই হোক কী বয়স্কদের একান্ত প্রয়োজনীয় ডোমেস্টিক হেল্প। কোটি কোটি মানুষের আর্থিক দুরবস্থাই হোক, কী শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষের মানসিক সঙ্কট।

সবচেয়ে বড় কথা কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকার কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে এখনো অবধি ব্যর্থ। কেন্দ্রের সরকার ও শাসক দল করোনা সঙ্কটের প্রথম দিনগুলি থেকেই সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও সরকার বদলের লক্ষ্যে ঘোড়া কেনাবেচায় ব্যস্ত থেকেছে। অন্যদিকে রাজ্যের শাসক দলের নেতারা বিভিন্ন জায়গায় সরকারী ত্রাণ প্যাকেজকে নিজেদের পকেট ভরানোর উপায় হিসেবে ব্যবহার করে চলেছেন।

প্যানডেমিক প্যানিক দেশ ও রাজ্য জুড়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। একে আটকানোর জন্য জরুরিভিত্তিতে একগুচ্ছ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার বদলে অনেক সময়েই একে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দল ব্যবহার করছে তাদের স্বৈরতন্ত্রী শাসনের বিরুদ্ধে ওঠা যে কোনও প্রতিবাদ আন্দোলনকে দমন করার কাজে। এভাবে শাসকেরা নিজেদের সঙ্কটকে পেরিয়ে যাবার কথা ভাবছেন ও জনগণকে আতঙ্কের মধ্যেই রেখে দিচ্ছেন।

কিন্তু প্যানডেমিক প্যানিক বা মহামারী আতঙ্ক যদি নাগরিক ও অর্থনৈতিক জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রগুলিকে বিপর্যস্ত করতে থাকে, ছড়াতে থাকে, তাহলে তা কোভিড সংকটের পাশাপাশি অন্যান্য হাজারো নতুন সমস্যার জন্ম দেবে ও প্যান্ডেমোনিয়ামের পরিস্থিতি তৈরি করবে। এইটাকে আটকানোর চেষ্টা অবশ্যই করা দরকার সরকার ও প্রশাসনের তরফে। প্যান্ডেমিক প্যানিক যেন প্যান্ডেমোনিয়াম তৈরি না করে, সে জন্য জরুরি ভিত্তিতে অনেক ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে।

- সৌভিক ঘোষাল 

adwalaoa

লকডাউনের প্রথম পর্যায়ে শুরু হয়েছিল পোলবা-দাদপুরে, ঋণ মুক্তির আন্দোলন এখন দানা বাঁধতে শুরু করল হুগলি জেলার পাণ্ডুয়া, ধনেখালি, জঙ্গীপাড়া, সিঙ্গুর, বলাগড় ইত্যাদি ব্লকগুলি ছাড়াও হুগলি সংলগ্ন বর্ধমানের জামালপুর, ঝাপানডাঙ্গা, দেবীপুর, জৌগ্রামের মতো এলাকাগুলিতে। গত ৯ ও ১০ জুলাই যথাক্রমে পাণ্ডুয়া ও ধনেখালি ব্লক দপ্তর উত্তাল হয়ে উঠল বেসরকারী ব্যাঙ্কগুলির এজেন্টদের জুলুমবাজির বিরুদ্ধে, সব ধরনের ঋণ থেকে মুক্তির দাবিতে। হাজার হাজার মানুষের সংগঠিত ও স্বতস্ফূর্ত উদ্যোগে কার্যত অবরুদ্ধ হল প্রশাসনিক ভবন।

পথে নেমেই ঋণমুক্তির আকাক্ষাকে বুঝে ওঠা; বুঝে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া মাটির সোঁদা গন্ধ মেখে। নিরুপায় পরিবারগুলোকে প্রতিবাদে সংগঠিত করার তাগিদ ছিল। কিন্তু শুরুতে সংগঠকদের কাছে ছিল না রিজার্ভ ব্যাংকের গাইডলাইন, জানা ছিল না আরবিআই ও কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্টের তিরস্কার সংক্রান্ত কোনো খবর, মরাটোরিয়ামের মতো অর্থনীতির পরিভাষাও সবার ঠিকঠাক বোঝা ছিল না। আক্ষরিক অর্থে, শুরুর সেদিন ছিল একটাই চেতনা-মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষের পাশে দাঁড়াও!

ক্রমশ আমরা বুঝতে থাকছি, বুর্জোয়া অর্থনীতির মূল মূল স্তম্ভগুলি কিভাবে প্যানডেমিকের ঝাপটায় দুলতে শুরু করেছে! সামাল, সামাল রব উঠছে; আরবিআই, সর্বোচ্চ আদালত, কোম্পানি মহল থেকে মাইক্রো ফাইন্যান্স-এর নিচুতলা পর্যন্ত!

উপরতলায় আরবিআই, সুপ্রিম কোর্ট, কর্ণাটক হাইকোর্ট, বহুজাতিক ও কোম্পানি মহলে যা চলছে

সুপ্রিম কোর্টে ঋণ মকুব সংক্রান্ত কোন মামলা চলছে না। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মরাটোরিয়াম সংক্রান্ত যে গাইডলাইন সমস্ত ব্যাঙ্ককে প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে পাঠিয়েছে, তার দুটি গুরুত্বপূর্ণ ফাঁক (সব ব্যাঙ্ক মরাটোরিয়াম মানবে কিনা এবং মরাটোরিয়ামে সুদ মকুব হবে কিনা) নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ও কর্ণাটক হাইকোর্টে মামলা।

looo

 

কেন্দ্রীয় সরকার লকডাউন ঘোষণা করে ২৪ মার্চ। এর তিন দিনের মাথায়, ২৭ মার্চ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রকাশ করল, মরাটোরিয়াম সংক্রান্ত গাইডলাইন। কারণ সমস্ত অর্থনৈতিক কার্যকলাপ যখন বন্ধ থাকছে, সেসময় নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ সম্ভব নয়। বহু অ্যাকাউন্ট সিজ হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক বলল, কোভিড পরিস্থিতিতে ৩১ মে পর্যন্ত টার্ম লোনের ইএমআই প্রদান স্থগিত রাখা হচ্ছে। এনপিএ (নন পারফর্মিং অ্যাসেট/ অনাদায়ী লোন) যাতে না বাড়ে, তা দেখাই সম্ভবত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্দেশ্যে ছিল। আরবিআই সাথে এটাও বলল, গ্রাহকদের মরাটোরিয়ামের সুযোগ দেওয়াটা ব্যাঙ্কগুলির ইচ্ছাধীন। কোভিড পরিস্থিতি আরো ঘোরালো হলে আরবিআই মরাটোরিয়ামের সুযোগ বর্ধিত করে ৩১ অগাষ্ট পর্যন্ত। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক বলল যে ইএমআই সংগ্রহ স্থগিত থাকলেও এই সময়ের সুদ দিতে হবে ঋণগ্রহীতাকে!

এই পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা করলেন আগ্রার অপটিক্যাল শপ মালিক জনৈক গজেন্দ্র শর্মা। তিনি বেসরকারী একটি (আইসিআইসিআই) ব্যাঙ্ক থেকে ৩৭ লক্ষ টাকা লোন নিয়েছিলেন। মোরাটোরিয়ামের জন্য আবেদন করতে, ব্যাঙ্ক জানায় ইএমআই স্থগিতের ৬ মাস সময়ও সুদ দিতে হবে। গজেন্দ্রের পক্ষে সিনিয়র অ্যডভোকেট রাজীব দত্তের যুক্তি যে আরবিআই গাইডলাইনে, প্যানডেমিকের কারণে ইএমআই স্থগিত সুতরাং কোর্ট এই সময়ের সুদ মকুব করার নির্দেশ জারি করুক।

এই প্রেক্ষিতে ৪ ও ১২ জুন সর্বোচ্চ আদালতে শুনানি চলে। ৪ জুন বিচারপতি অশোকভূষণ, কাউল ও এম আর শাহ’র বেঞ্চ মরাটোরিয়ামে সুদ চাপানো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। অভিমত ব্যক্ত করেন বিচারপতিরা যে লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পক্ষে এই সিদ্ধান্ত ‘আরো ক্ষতিকারক’।

১২ জুন কোর্ট আবার জানতে চায়, সুদের উপর সুদ চাপানো হবে কিনা। পরবর্তী শুনানি অগাস্ট মাসের গোড়ায়।

ইতিমধ্যে কর্ণাটক হাইকোর্টে, ১০ জুলাই বিচারপতি সুরাজ গোবিন্দরাজ আরবিআইকে লোন মরাটোরিয়াম সংক্রান্ত সার্কুলারের প্রয়োগ মনিটর করার নির্দেশ দেন। ব্যবসার স্বার্থে গ্রহীতাদের এটা অধিকার। কেউ মরাটোরিয়ামের সুযোগ দেবে, আর কেউ দেবে না, এটা হয় না।

সম্প্রতি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড সিনিয়র ব্যাঙ্কারদের অভিমত নিয়ে একটি খবরে জানিয়েছে যে মরাটোরিয়াম ডিসেম্বর পর্যন্ত আরো বাড়ানো ছাড়া রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে অন্য অপশন নেই। কারণ তা না বাড়ালে আর্থিক মন্দার এই পরিবেশে বহু অ্যাকাউন্ট সিজ হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা আরো মুখ থুবড়ে পরবে।

এসবিআই সুপ্রিম কোর্টকে জানায় যে ৯০ শতাংশই মরাটোরিয়াম করেনি। এরা হলেন সেই সব সাধারণ দরিদ্র পরিবারের ঋণগ্রহীতা, মরাটোরিয়াম কি সেটাই যাদের জানা নেই। ব্যাঙ্কও আগ বাড়িয়ে এঁদের জানায়নি যে প্যানডেমিক গাইডলাইন অনুসারে এ কিস্তি প্রদান বন্ধ রাখলে, সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হবে।

pand

সবমিলিয়ে এটাই দাঁড়ালো যে --

১) প্যানডেমিক ও লকডাউনের কারণে টার্ম লোনের কিস্তি অনেকের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয় বুঝে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রথমে তিন মাসের জন্য, পরে আরো তিন মাস বাড়িয়ে ৩১ অগাষ্ট পর্যন্ত মোট ৬ মাস স্থগিত করে কিস্তি প্রদান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটা আরো বাড়িয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হতে পারে।

২) রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই সার্কুলারে বড় গণ্ডগোল থেকে গেল — (ক) কিস্তি পরিশোধ বন্ধ রাখতে হলে, সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের কাছে (মরাটোরিয়াম) জানাতে হবে। (খ) মরাটোরিয়ামের সুযোগ ঋণগ্রহীতাদের দেবে কিনা, তা ঠিক করবে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক। (গ) মরাটোরিয়ামের সুযোগে কিস্তি পরিশোধ ৬ মাস স্থগিত করা হলেও সেই সময়ের সুদ ছাড় হবে না!

৩) এই ৬ মাসের কিস্তি স্থগিতের সময় সুদ কেন নেওয়া হবে, এই বিচার চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা দায়ের করা হয় এবং অন্য একটি মামলা হয় কর্ণাটক হাইকোর্টে এই যুক্তিতে যে একটি ব্যাঙ্ক মরাটোরিয়ামের সুযোগ দিলে, অন্য একটি ব্যাঙ্ক কেন দেবে না। ২টি মামলাই রিজার্ভ ব্যাংকের বিরুদ্ধে যাচ্ছে।

সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুলেছে, কেন সুদের উপর সুদ নেওয়া হবে। সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ককে এই বলেও তিরস্কার করেছে যে এনপিএ-তে হাজার হাজার কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়, অথচ সাধারণ ঋণ গ্রহিতাদের কিস্তি স্থগিতকালে কেন সুদের ছাড় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না! কোর্টের মন্তব্য, এই ছাড় হয় ব্যাঙ্ক দিক অথবা কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। এ নিয়ে পরবর্তী শুনানি অগাস্ট মাসের গোড়ায়।

অন্য মামলায় কর্ণাটক হাইকোর্ট রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে নির্দেশ দেয় যে মরাটোরিয়ামের সুযোগ যাতে সকলেই দেয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ কোর্টে যারা মামলা করেছেন, তাঁরা ব্যবসাদার, কারো ঋণ ৩৭ লক্ষ টাকা কারো ৪৭৫ কোটি টাকা। এরা মামলা করছেন ঋণ মকুবের জন্য নয়, এঁদের মামলা মরাটোরিয়ামের সুযোগ পাওয়ার জন্য এবং মরাটোরিয়াম পর্বে যেন সুদ আদায় না করা হয়, সেই লক্ষ্যে। এই সময়েই আরবিআই কোর্টকে জানিয়েছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সুদ ছাড়েরও পক্ষপাতী নয়। আবার এই পর্বেই তারা মাত্র ৫০ জন শিল্পপতির (ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি) ৬৮,৬০৭ কোটি টাকার বকেয়া ‘রাইট অফ’ করেছে। এই সময়েই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক শিল্পপতিদের ঋণ পুনর্গঠনের জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে অনুরোধ করেছে।

মরাটোরিয়ামের সময়কাল কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ককে দফায় দফায় বাড়াতে হচ্ছে কারণ না হলে বহু অ্যাকাউন্ট সিজ হওয়ার আশংকা থাকছে।

বাজারের কোভিড পরবর্তী ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তার হাত থেকে বহুজাতিক ঋণগ্রহিতা কোম্পানিগুলিকে বাঁচাতে, তারা যাতে ইনসলভেনসি প্রসেডিংএ না আটকায় তা দেখতে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক ১৭/৫ এ রিলিফ প্যকেজ ঘোষণার সময় এটাও বলে যে নতুন করে ইনসলভেন্সি কেস শুরু করা এখন এক বছর স্থগিত করা হচ্ছে।

loa

গরিব ঋণগ্রহিতাদের তাহলে কী দশা?

ঋণগ্রহিতাদের উপর তলায় যদি এই অবস্থা হয়, তবে দেখা যাচ্ছে, নিচের তলায় মরাটোরিয়ামের জন্য আবেদনই করেছে মুষ্টিমেয় কয়েকজন! গ্রামীণ দরিদ্র ঋণগ্রহিতারা ব্যাপারটা বোঝেনও না।

লকডাউনের প্রথম দিকে এরা কেউ কেউ জমানো যা সঞ্চয় ছিল, তা থেকে কিছু কিছু কিস্তি পরিশোধ করার চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু যত দিন অতিবাহিত হচ্ছে, ততই ঋণগ্রস্তদের সেই ক্ষমতাও হারিয়ে যাচ্ছে।

এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে বন্ধন ব্যাঙ্ক নতুন করে ঋণ দিচ্ছে। এই ঋণে পুরানো বকেয়া শোধ করে হাতে সামান্যই অবশিষ্ট থাকছে, যা ২/১ মাসের মধ্যে সংসার খরচে ঢুকে যাওয়ার সম্ভাবনা! এমনই একজনের বন্ধনে বকেয়া ছিল ৬১ হাজার। বন্ধন নতুন করে ঋণ দিল ৮০ হাজার। এরপর ৬১ হাজার কেটে নিয়ে হাতে তুলে দিল মাত্র ১৯ হাজার! এতে ওই পরিবারের ঋণের বোঝা বাড়লো মাত্র। একারণে অনেকে আপৎকালীন কিছু নগদের প্রয়োজনে নতুন ঋণ নিলেও অনেকে ঋণ-ফাঁদ এড়াতে এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিচ্ছেন।

aadee

আমাদের দাবি

১) ঋণফাঁদের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে আমাদের কেন্দ্রীয় শ্লোগান অবশ্যই সব ধরনের ঋণ থেকে মুক্তির আকাংখাকে তুলে ধরবে। যা হতে পারে (ক) দরিদ্র পরিবারের সমস্ত ধরনের সরকারী/বেসরকারী ঋণ মকুব করতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দরিদ্রদের বেসরকারী ঋণ(ফাঁদ?) মকুবের অর্থনৈতিক দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় সরকারকে নিতে হবে। (খ) লকডাউন ডেকেছে সরকার, এখন সংবিধানের ২১ ধারা মোতাবেক ‘জীবনের অধিকার’ ও ‘জীবিকার অধিকার’ রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। (গ) শিল্পপতিদের ঋণ মকুব হল, কেন্দ্রীয় সরকারকে দরিদ্র পরিবারগুলির ঋণ মকুব করতে হবে।

২) (ক) কমপক্ষে ১ বছর দরিদ্র পরিবারের লোনের কিস্তি গ্রহণ স্থগিত রাখতে হবে। (খ) ঋণ আদায়ের নামে বেসরকারী ব্যাঙ্ক এজেন্টদের জুলুমবাজি বন্ধ করো।

৩) ঋণগ্রস্ত কৃষকদের সমবায় ঋণ ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ঋণ মকুব করতে রাজ্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

৪) উজ্জীবন, বন্ধনের মতো বেসরকারী সংস্থার থেকে দরিদ্রদের চড়া সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে কেন? রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার জবাব দাও।

৫) দরিদ্র মানুষের জন্য নামমাত্র সুদে সরকারকে ঋণ প্রদান করতে হবে।

৬) বেসরকারী ব্যাঙ্কগুলির মহাজনী কারবারে সুদের হার সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের বেশি সুদ নেওয়া চলবে না।

৭) স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির স্বনির্ভরতা সৃষ্টি করতে সরকারী পরিকাঠামো নেই কেন? রাজ্য সরকার জবাব দাও।

dda

 

ধনেখালি বিডিও ডেপুটেশনের সময় পঞ্চায়েত সমিতি ভবনে আটকে পরেন মন্ত্রী অসীমা পাত্র। তাঁকে পিছনের গেট দিয়ে বের হতে হয়। ধনেখালিতে ওইদিন বিকেলে পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে তাঁর দলের  মিছিল-সমাবেশ ছিল। আমাদের ডেপুটেশন শেষে ফেরার পথে মাইকে ভেসে আসছিল টিএমসির শ্লোগান, ওঁরাও বলছেন আমাদের শ্লোগান ‘শিল্পপতিদের ঋণ মকুব হয়, গরিব মানুষের হয় না কেন, কেন্দ্রীয় সরকার জবাব দাও।’

দিল্লির বিজেপি সরকারকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। পাশাপাশি আগামী বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্য সরকারকেও নিশ্চিতভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, কেন গরিব মানুষ আজ লাখে লাখে বন্ধন, উজ্জীবনদের চড়া সুদের ঋণফাঁদে? কেনই বা তারা সরকারী ব্যবস্থায় কম সুদে প্রয়োজনীয় ঋণ পায় না! স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির স্বনির্ভরতা কোথায় গেল?

caaa

 

রাষ্ট্র ও শাসকদের এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাতে প্রস্তুতি বাড়াচ্ছেন প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলি। তাঁদের সাথে থাকতে হবে আমাদের; বৃহত্তর পরিধিতে-দেশজুড়ে।

আপাতত হুগলিতে প্রস্তুতি চলছে আগামী ১৭ জুলাই কার্যক্রমের। ওইদিন ডিএম ডেপুটেশন। সামিল হতে চলেছেন হাজারে, হাজারে প্যানডেমিক পরিস্থিতির জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত ও সামাজিক দায়-দায়িত্বকে মাথায় রেখেই।

- সজল অধিকারী 

mand

পুর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর ব্লকের মামুদপুর ২নং গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর তথা বন্ধন সহ অন্যান্য মহাজনী সংস্থার কাছে ঋণগ্রস্ত মেহনতিদের, বিশেষ করে মহিলাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ব্রহ্মপুর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনে বৈঠক অনুষ্ঠিত হল। শতাধিক মহিলা জমায়েত হন। বৈঠকে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক কমরেড সলিল দত্ত উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন আয়ারলার জেলা সম্পাদক কমরেড আনসারুল আমন মন্ডল। এর আগেও একবার বৈঠক হয়। ঋণফাঁদে জর্জরিত মানুষগুলো তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন। সাধারণভাবেই এই ধরনের মহাজনী সংস্থাগুলো যে ধরনের চুক্তিতে ঋণ দিয়ে থাকে সেভাবে পরিশোধ করে লাভবান হওয়া অসম্ভব। গরিব মেহনতিদের অর্থনৈতিক অসহায়তার কারণেই এই ঋণ নিতে বাধ্য হন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসুস্থতার কারণে, মেয়ের বিয়ে, অভাবের কারণে ও চাষের দেনা শোধ করার জন্য এই ধরনের ঋণ নেওয়া হয়ে থাকে এবং প্রতিদিন মজুরির থেকে সংসার খরচ বাচিয়ে এই ঋণ শোধ করার ব্যবস্থা হয়ে থাকে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ব্যাংকের ঋণ ও এর থেকে আলাদা বড় কিছু নয়। বর্তমান লকডাউনের পরিস্থিতির মধ্যে মেহনতিদের মজুরি থেকে কিস্তির টাকা পরিশোধ অসম্ভব হয়ে উঠেছে। অনেকেই তাদের সমস্যার কথা তুলেছেন। ঋণমুক্তির আন্দোলনে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। তাই ঠিক হয় আগামী রবিবার আবার আরও বেশি সংখ্যক মানুষের জমায়েত করে আলোচনার মাধ্যমে একটি ঋণ মুক্তি কমিটি গঠন করা হবে।

docbib

রাজ্যের করোনা পরিস্থিতি বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছে গেছে। যে হারে প্রতিদিন সংক্রমণ এবং মৃত্যু বাড়ছে তাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। দীর্ঘ লকডাউনে প্রস্তুতি না নিয়ে, বেসামাল সরকার আবার দুঃসহ লকডাউনের রাস্তায় হেঁটে দায় এড়াতে চাইছে।

কোভিড পরীক্ষা....

করোনা নিয়ন্ত্রনের মূল চালিকা শক্তি “পরীক্ষা-আরও পরীক্ষা-রোগ নির্ণয়-আইসোলেশন” এই পদক্ষেপে গুরুতর ঘাটতি আছে। পরীক্ষার হার আরও অনেক বাড়ানো দরকার। সংক্রমিত এলাকা গুলোতে বাড়ি বাড়ি সার্ভে করার দরকার।

সরকারী ক্ষেত্রে নমুনা পরীক্ষা কোথায় হবে, কিভাবে হবে সাধারণ মানুষ জানে না। যে হাসপাতালগুলোতে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে সেখানেও প্রতিদিনের পরীক্ষার সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। ফলে অসংখ্য সাধারণ মানুষকে বেসরকারী ক্ষেত্রে দৌড়তে হচ্ছে। হাজার হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। নমুনা পরীক্ষায় কোভিড ধরা পড়লে শুরু হচ্ছে আরেক ভয়ঙ্কর হয়রানি। শুধু জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে তিনি করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু এরপর তার কি করনীয় জানানো হচ্ছে না। তার ভর্তি হওয়া দরকার কিনা, দরকার হলে কোথায় ভর্তি হবে, কিভাবে ভর্তি হবে সেটা সাধারণ মানুষকে সামাজিক প্রচারের মাধ্যমে জানানো হচ্ছে না। এখনই করোনা রুগী ভর্তি হতে চূড়ান্ত হয়রানির স্বীকার হচ্ছেন। কিছুদিনের মধ্যেই এই হয়রানি দুঃসহ হবে। সরকারী বেসরকারী সব ক্ষেত্রেই শয্যার অভাব দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্যভবনে কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেলে ফোন করলেও কেউ ফোন ধরছে না। সরকারী ওয়েবসাইটের সঙ্গে বাস্তবে ফাঁকা থাকা শয্যার হিসাবে বিস্তর ফারাক থাকছে। বেশির ভাগ কোভিড হাসপাতালে সরকার ঘোষিত শয্যা চালু হয়নি। মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি বাড়ছে। দুঃখজনক মৃত্যু ঘটছে। মনিটরিং সেলের নাম্বারও পাড়া, মহল্লার মানুষ জানে না। স্থানীয় প্রশাসন এই বিষয়ে সাহায্যে এগিয়ে আসছে না। সংক্রমণ হয়েছে জানার পর অসহায় অবস্থায় পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সেফ হোম অবৈজ্ঞানিকভাবে তৈরি হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় খুবই কম। কর্পোরেট হাসপাতালগুলোর স্যাটেলাইট সেন্টার ব্যবসার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

কোভিড হাসপাতাল ......

ঘোষিত কোভিড হাসপাতালগুলোর পরিষেবা সব জায়গায় এখনো চালু হয়নি। ঘোষিত শয্যা সংখ্যার সঙ্গে বাস্তবের বিস্তর ফারাক আছে। বহু জায়গায় পরিষেবার মান খুবই খারাপ। মানুষ ভর্তি হতে চাইছেন না। বেশিরভাগ লেভেল ৩/৪ কোভিড হাসপাতাল উপসর্গহীন বা অল্প উপসর্গ যুক্ত রুগীতে ভর্তি হয়ে আছে, যাদের বড় বড় মেকশিফট হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করা যেত। ক্রিটিকাল চিকিৎসার শয্যা অতি অল্প। কলকাতার সরকারী কোভিড হাসপাতালগুলোতে সব মিলিয়ে ১০০র কম। জেলাতে প্রায় কোথাও কোভিড রুগীর জন্যে ক্রিটিকাল কেয়ার চালু নেই। পৃথক হাই-ফ্লো অক্সিজেন শয্যার ব্যবস্থা করা হয়নি। স্বাভাবিক কারণে ক্রিটিকাল কোভিড রুগীর ভর্তি/ চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাওয়ার একাধিক খবর আসছে। দ্রুত হারে এই ঘটনা বাড়বে বলেই আমাদের আশংকা। এই পরিস্থিতিতে যখন প্রতিদিন কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে সেখানে উপসর্গযুক্ত ও ক্রিটিকাল রুগী যাতে বেড পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। উপসর্গহীন ও স্বল্প উপসর্গ রুগী যাদের পক্ষে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা সম্ভব তাদের যাতে বাড়িতে রাখা যায় তারজন্য প্রচার করতে হবে যাতে এই নিয়ে সাধারণের মধ্যে ভীতি দূর হয়। পাড়ার লোক যাতে এই ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে।

ste

 

স্টিগমা দূরীকরণ .… স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী .....

মানুষের স্টিগমা কাটানোর কোনো সংগঠিত উদ্যোগ নেই প্রশাসনের। পুলিশের সাহায্যে রুগী ভর্তি করা এই স্টিগমা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষ উপসর্গ লুকিয়ে রাখছে। রোগ গোপন রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। যে কোনো ওষুধের দোকানে নজর রাখলে বোঝা যাবে কত মানুষের মধ্যে উপসর্গ আছে। এবং তারাই সংক্রমণ বাড়িয়ে চলছে। স্টিগমা কাটানো এবং কোভিড রুগীর চিকিৎসা সহায়তায় পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় স্বল্প দিনের ট্রেনিং দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়া হয়নি। সরকারী অনুদান প্রাপ্ত/ অপ্রাপ্ত ক্লাব গুলোর যুব অংশকে এই কাজে লাগানো যেত।

নন কোভিড চিকিৎসা ....

একই সঙ্গে সঙ্কটে নন কোভিড চিকিৎসা .... বিশেষ করে স্পেশালিটি/সুপার স্পেশালিটি চিকিৎসা এবং মেডিক্যাল কলেজগুলোর পড়াশুনা, প্রশিক্ষণ। আদেশনামা দিয়েই সরকার দায় সারছে। নন কোভিড রুগীর চিকিৎসায় সরকারী হাসপাতাল গুলোয় কোনো সুসংহত পরিকল্পনা/পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। ক্যান্সার চিকিৎসা/ডায়ালিসিস, হার্ট, ব্রেন, ফুসফুসের রোগের চিকিৎসা না পেয়ে অসংখ্য রুগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। জরুরি অপারেশনও অনেক হাসপাতালে হচ্ছে না।

চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সমস্যা ...

চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীরা ভয়ঙ্কর ঝুঁকির মধ্যে কাজ করছে। পরিস্থিতি যা তাতে গোষ্ঠী সংক্রমণ হচ্ছে বলেই আমাদের ধারণা। উপসর্গহীন নন-কোভিড রুগীর চিকিৎসা করা বেশি ঝুঁকির হয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ সরকারী হাসপাতালে এই ঝুঁকি কমানোর জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। রুগী/পরিজন ভিড় করে থাকছেন আউটডোর গুলোতে। তাদের হাত ধুয়ে, হাত স্যানিটাইজ করে, মাস্ক পরে হাসপাতালের আউটডোরে/ ক্যাম্পাসে/ ইনডোরে ঢোকানোর বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। ইনডোরে ভর্তি থাকা অন্যান্য রুগীদের মধ্যেও এক বড় অংশ উপসর্গহীন কোভিড আক্রান্ত। তাদের পরীক্ষা হলেই ধরা পড়ছে। ভর্তি থাকা রুগীর কোভিড পরীক্ষা/ ভর্তির আগে কোভিড পরীক্ষা বেশিরভাগ সরকারী হাসপাতালে করা হচ্ছে না। ফলে প্ৰতিটি চিকিৎসককে অসুরক্ষিত অবস্থায়, ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে নন-কোভিড রুগীর চিকিৎসা দিতে।

dddec

 

এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে সরকারের কাছে আমাদের দাবি, প্রস্তাব, পরামর্শ ....

১) কোভিড টেস্ট আরও অনেক বাড়াতে হবে, বিশেষ করে রেড জোনে, কন্টেনমেন্ট এরিয়ায়। গ্রীন জোনে, রিপিট টেস্ট বেশি করে নমুনা পরীক্ষা অনেক করা হচ্ছে বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী জেলায় নমুনা সংগ্রহের অলিখিত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করতে হবে। সংক্রমিত এলাকায় বাড়ি বাড়ি সার্ভেইল্যান্স করতে হবে। “পরীক্ষা-আরও পরীক্ষা-রোগ নির্ণয়-আইসোলেশন-সার্ভিলেন্স” নিশ্চিত করতে হবে। রাপিড আন্টিজেন পরীক্ষা দ্রুত চালু করে, সমস্ত স্তরে, পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে হবে।

যে কোনো স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে গত আইএলআই উপসর্গ যুক্ত সমস্ত রুগী যাতে বহির্বিভাগ থেকেই একই দিনে নমুনা জমা করতে পারেন তার ব্যবস্থা করতে হবে।

২) কোভিড পরীক্ষা করানোর জন্যে মানুষ কোথায় যাবেন সেটা প্রতিটি পাড়া/মহল্লা/গ্রামে জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পরীক্ষা কেন্দ্রের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। মোবাইল নমুনা সংগ্রহ ভ্যান এবং মেডিক্যাল কলেজ/জেলা হাসপাতাল গুলোতে নমুনা সংগ্রহের কীয়স্ক বানাতে হবে।

৩) রুগী ভর্তির হয়রানি কমাতে প্রতিটি পাড়ায়, মহল্লায় মনিটরিং শেলের নাম্বার জানিয়ে দিতে হবে। মনিটরিং সেলকে ৭x২৪ কার্যকরী থাকতে হবে। যে কোনো মানুষ, যে কোনো সময় ফোন করলে যেন সহায়তা পায় সেটা সুনিশ্চিত করতে হবে। জেলার সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে সমন্বয় রাখতে হবে।

৪) প্রতিটি পাড়া মহল্লায়, গ্রামে সরকারী অনুদান প্রাপ্ত/অপ্রাপ্ত ক্লাবের যুব অংশ, এলাকার যুব অংশ, কোভিড থেকে সেরে ওঠা মানুষকে অল্পদিনের ট্রেনিং দিয়ে, সাম্মানিক দিয়ে, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। যারা কোভিড রুগী চিকিৎসা/পরিবহন এবং সার্ভিলেন্সে সাহায্য করবে। হোম আইসোলেশন, সেফ হোমে থাকা রুগীদের খাবার/প্রয়োজনীয় পৌঁছানো, খোঁজ রাখার কাজ করবে। এলাকার স্টিগমা কাটাতে সাহায্য করবে। মনিটরিং সেলের সাথে যোগাযোগ সাহায্য করবে।

৫) কোভিড রুগী পরিবহনের সমস্যা (১০২ এম্বুলেন্সের ঘাটতি) মেটাতে বিভিন্ন ক্লাব/প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় থাকা এম্বুলেন্স প্রয়োজন অনুযায়ী অধিগ্রহণ করে কোভিড রুগী পরিবহনের ডেডিকেটেড ব্যবস্থা করতে হবে। নন্-কোভিড পরিষেবায় যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেটাও নজরে রাখতে হবে।

dec

 

৬) ক্রিটিকাল কোভিড রুগীর চিকিৎসার জন্যে, প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে লেভেল ৩/৪ কোভিড ব্লক তৈরি করতে হবে। জেলাতেও একইভাবে ক্রিটিকাল কোভিড চিকিৎসার পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

৭) প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ ও জেলা হাসপাতালগুলোতে নন-কোভিড চিকিৎসা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করতে হবে। বিশেষ করে স্পেশালিটি/সুপার স্পেশালিটি চিকিৎসা।

৮) প্রতিটি হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল কলেজে ইনফেকশন কন্ট্রোল মেকানিজম শক্তিশালী করতে হবে। হাসপাতালগুলো যেন করোনা সংক্রমণের উৎসকেন্দ্রে পরিণত না হয় তার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে। অযথা ভিড় কমাতে হবে। কোভিড/নন-কোভিড রুগীর ঢোকা বেরোনোর রাস্তা আলাদা করতে হবে। হাসপাতালে ঢোকার আগে প্রতিটি রুগী/পরিজনের হাত ধোয়া, হাত স্যানিটাইজ করা, মাস্ক পরা সুনিশ্চিত করেই ঢোকাতে হবে। ভর্তি থাকা রুগীদের ২৪ ঘণ্টা মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। দরকারে সরকারকেই প্ৰতিটি ভর্তি রুগীকে মাস্ক সরবরাহের দায়িত্ব নিতে হবে। দরকারে প্রতিটি চিকিৎসক/স্বাস্থ্যকর্মীকে পিপিই দিতে হবে।

৯) প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজের পড়াশোনা, প্রশিক্ষণ স্বাভাবিক করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

১০) প্রতিটি কর্পোরেট হাসপাতালে নুন্যতম ২৫ শতাংশ শয্যা কোভিড চিকিৎসার জন্যে সংরক্ষিত করতে হবে। প্রয়োজনে অধিগ্রহণ করতে হবে। প্রাইভেট/কর্পোরেট হাসলাতালের চিকিৎসা ব্যয়ে স্বচ্ছতা আনতে কঠিনতম নজরদারী রাখতে হবে।

১১) প্রত্যেক সরকারী বেসরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ফার্মেসি, ওষুধের দোকান, ল্যাবরেটরি সার্ভেইল্যান্সের আওতায় আনতে হবে। যাতে দ্রুত ইনফ্লুয়েঞ্জা উপসর্গযুক্ত রুগী চিহ্নিত/আইসোলেশন/পরীক্ষিত/চিকিৎসিত হতে পারেন।

১২) উপসর্গহীন, অল্প উপসর্গযুক্ত রুগীর জন্যে, কলকাতা, জেলার স্টেডিয়াম, স্কুলবাড়ি, সরকারী ভবনে বৃহদাকার “মেক শিফট” হাসলাতাল গড়ে তুলতে হবে। স্যাটেলাইট কেন্দ্রের চিকিৎসা খরচ সরকারকে বহন করতে হবে।

ঘন ঘন সেফ হোম না বানিয়ে, মানুষের চাহিদা মেটাতে কেস লোডের সাথে সাযুজ্য রেখে ২৪x৭ মেক শিফট আইসোলেশন সেন্টার গড়তে হবে। তাতে লোকবলের সুরাহা হবে এবং মানুষের নিরাপত্তা বোধ বৃদ্ধি পাবে।

vac

 

এছাড়া, কেন্দ্রীয় ওয়েবসাইটে কার্যকরী শয্যা ও ভ্যাকেন্সি প্রশ্নে কোনো রকম অস্বচ্ছতা থাকা চলবে না। মানুষের বিভ্রান্তি বাড়ছে। চিকিৎসকদের সাথে মানুষের ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হচ্ছে।

স্কুল, কলেজ বাড়ি, কমিউনিটি হল গুলোকে সেফ হোম/ কোভিড আইসোলেশন সেন্টারে পরিণত করা যেতে পারে।

ব্লক স্তর পর্যন্ত প্রতিটি হাসপাতালে ইনফ্লুয়েঞ্জা লাইক ইলনেস ক্লিনিক চালু করতে হবে। আইসোলেশন ওয়ার্ড চালু করতে হবে। নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে।

১৩) প্রতিটি চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশকর্মী, সাফাইকর্মী, স্যানিটাইজেসন কর্মীদের আইসিএমআর গাইডলাইন অনুযায়ী অন্যান্যদের, নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে আন্টিবডি টেস্ট চালু করতে হবে। এতে অহেতুক ভীতি কাটতে পারে। পরিষেবার মান উন্নত হতে পারে। সার্ভেইল্যান্সেও সাহায্য করবে।

১৪) রেশনের মাধ্যমে প্রতিটি মানুষকে মাস্ক, স্যানিটাইজার, সাবান সরবরাহ করতে হবে।

১৫) সরকারের ব্যর্থতার দায় কোনোভাবেই চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীদের ঘাড়ে চাপানো যাবে না।

১৬) প্রতিটি পাড়া, মহল্লা, ওয়ার্ড, গ্রাম প্ৰতিদিন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, স্যানিটাইজ করার ব্যবস্থা করতে হবে।

১৭) পরিবহনের সমস্যা মেটাতে বেসরকারী বাস অধিগ্রহণ করতে হবে। প্ৰতিটি বাস প্রতিদিন স্যানিটাইজ করা সুনিশ্চিত করতে হবে।

(অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স, ওয়েস্ট বেঙ্গল)  

১৩/০৭/২০২০  

esexbid

মার্চ মাসের শেষ দিক থেকে টানা লকডাউন ঘোষিত হওয়ার পর দীর্ঘ দু’মাস সিইএসসি-র কর্মীরা সরাসরি মিটার রিডিং নিতে পারেনি। এই সুযোগে এই সংস্থাটি কয়েকমাস অস্বাভাবিক হারে বিদ্যুত বিল গ্রাহকদের কাছে পাঠিয়েছে। আম্ফান ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যুৎ পরিষেবা গুরুতরভাবে বিপর্যস্ত হয়। বেশ কিছুদিন যাবত বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিদ্যুৎ বিহীন থাকায় অশেষ দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন সাধারণ মানুষ। তার উপর এই চড়া বিদ্যুৎ বিল ব্যাপক মানুষকে সিইএসসি-র বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ করে তোলে।

পার্টির কলকাতা জেলা কমিটির তরফ থেকে এই বিষয়টা নিয়ে পথে নামার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এলাকার সিইএসসি-র ক্যাশ কাউন্টারগুলোতে বিক্ষোভ, স্বাক্ষর সংগ্রহ প্রভৃতি পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

as

 

আইসা-র তরফ থেকে ২ এবং ৪ জুলাই যথাক্রমে কলেজ স্ট্রিট ও শ্যামবাজারে, যাদবপুরে ৪ জুলাই এবং তারাতলায় ৮ জুলাই সিইএসি-র কাউন্টারগুলোতে পার্টি, আইপোয়া, এআইসিসিটিইউ ও আইসা-র পক্ষ থেকে বিক্ষোভগুলো চলে। এরপর ৬ জুলাই, দঃ কলকাতাস্থিত ম্যান্ডেভিলা গার্ডেনে সিইএসসি-র আঞ্চলিক দপ্তরে জেলা কমিটির তরফ থেকে বিক্ষোভ দেখানো হয়। বিক্ষোভ চলাকালীন তিন সদস্যের এক প্রতিনিধি দল কমার্শিয়াল ম্যানেজারের সাথে দেখা করে স্মারকপত্র ও গণস্বাক্ষর জমা দেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন, চন্দ্রাস্মিতা, এবি চৌধুরী ও অতনু চক্রবর্তী। স্মারকপত্রে দাবি জানানো হয় :

c9l

 

১) লকডাউনের সময়কার ৩ মাসের বিল মুকুব করতে হবে।
২) প্রথম ২০০ ইউনিট মুকুব করতে হবে। ২০১ ইউনিট থেকে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত ৫০ শতাংশ ছাড় দিতে হবে -- দিল্লি সরকার যা করেছে।
৩) ধোঁয়াশাভরা স্ল্যাব পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
৪) এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বিল বাতিল করে নতুন বিল পাঠাতে হবে।
৫) ঠিকা শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ করতে হবে।

এ ছাড়া প্রচার চালানোর সময় কেন্দ্রীয় সরকার যে “নতুন বিদ্যুৎ বিল, ২০২০” আনতে চলেছে, তা বাতিল এবং রাজ্য সরকার কর্তৃক সিইএসসি-র অধিগ্রহণের দাবিও করা হয়। পরবর্তীতে রাসবিহারী এভেনুয়ের অফিস সহ কলকাতার আরও কয়েকটি এলাকায় সিইএসসি দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ দেখানো হয়।

bak

কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও বামপন্থী কৃষক সংগঠনগুলির ডাকে ৩ জুলাই দেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবসে বাঁকুড়ার কেরানি বাঁধে বাঁকুড়া-দুর্গাপুর জাতীয় সড়ক সকালে এক ঘণ্টা অবরোধ করে সভা চলে। সভায় বক্তব্য রাখেন সিটু নেতা প্রতীপ মুখার্জি, এআইটিইউসি-র ভাস্কর সিনহা ইউটিইউসি-র গঙ্গাধর গোস্বামী আয়ারলার জেলা সভাপতি বাবলু ব্যানার্জি, খেতমজুর ইউনিয়নের রাজ্য সভাপতি অমিয় পাত্র সহ আরো অনেকে। সভা থেকে দাবি করা হয় শ্রম আইন সংশোধন করে শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নেওয়া চলবে না। ৮ ঘণ্টার কাজের অধিকার লড়াই করে বজায় রাখতে হবে। কৃষি ও কৃষক বিরোধী ‘কৃষি ও অত্যাবশকীয় পণ্য আইন’ বাতিল করতে হবে। লকডাউনের দরুন  গরিব মানুষদের সবাইকে মাসে ১০,০০০ টাকা ভাতা দিতে হবে, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সবার বিদ্যুৎ বিল মকুব করতে হবে। চাষি সহ সবার সব ধরনের কৃষি-ঋণ মকুব করতে হবে। সভা থেকে কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা কয়লাখনি ও রেলের এক বড় অংশ কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার তীব্র বিরোধিতা করা হয়। কেরানি বাঁধ ছাড়াও ওই দিন একই দাবিতে বিষ্ণুপুরে সভা করে এসডিও-র কাছে যৌথ ডেপুটেশন দেওয়া হয়। প্রতিনিধিদলে উপরোক্ত সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সহ এআইসিসিটিইউ-র পক্ষে ছিলেন ফারহান হোসেন খান। ছাতনাতে যৌথ কর্মসূচীতে বক্তব্য রাখেন আযারলার জেলা সম্পাদক রামনিবাস বাস্কে। হীড়বাঁধ ব্লকে ডেপুটেশনে যৌথ নেতৃত্বে ছিলেন এআইকেএম সম্পাদক সুধীর মুর্মু।

caawcka

গত ১৩ জুলাই কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে নিউটাউনে কোল ইন্ডিয়া ভবনে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়। কয়লা শিল্প বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে কোল ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যানের কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হয়। তার আগে বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ-র বাসুদেব বসু সহ অন্যান্য টিইউ নেতৃবৃন্দ।

edveco

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক ২০২০ সালের মার্চ মাসে পরিবেশের ওপর প্রভাব মূল্যায়ন সম্পর্কে একটি খসড়া বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এই বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে সিপিআই(এমএল)-এর পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবাদ নীচে দেওয়া হল:

১) এই নতুন খসড়া পরিবেশের ওপর প্রভাব মূল্যায়ন প্রক্রিয়াকে(এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) লঘু করে তুলতে চায়; মহামারী এবং লকডাউন আমাদের অর্থনীতিতে যে ক্ষতিসাধন করেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিতে উদ্দীপনা সঞ্চারের অছিলায় শিল্প প্রকল্পগুলি এবং তাদের “ব্যাবসার পথকে সহজ করে তোলা”-র পক্ষে দাঁড়াতে এই নয়া খসড়া। প্রস্তাবিত প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার আগে পরিবেশের ওপর তা কি ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে তা মূল্যায়ন করতে স্থানীয় জনগণের মতামত নেওয়ার একটা ব্যবস্থা মূল্যায়ন নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় এখনও পর্যন্ত রয়েছে এবং আমাদের ভুললে চলবে না যে, কোভিড-১৯ অনেকাংশেই বিশ্বজুড়ে চলা পরিবেশ ধ্বংসেরই পরিণাম। পরিবেশের সুরক্ষাকে লঘু করে না তুলে তাকে আরও শক্তিশালী করাই এই ধরনের মহামারীর মোকাবিলায় আমাদের পথ হবে।

২)  মহামারী এবং লকডাউনের সময় এই খসড়া বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ফল হয়েছে এই যে, ওই খসড়া সেই সমস্ত মানুষদের কাছে পৌঁছায়নি যারা প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলোর জন্য সরাসরি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্ৰস্ত হবেন। ওরা এই পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে কিছুই জানেন না, আর তাই নিজেদের মানুষজনের সঙ্গে আলোচনা করে নিজেদের মতামত এবং আপত্তি জানানোর কথাতো ওঠেই না। অতএব, শুধু এই কারণেই এই খসড়াকে তুলে নেওয়া দরকার, মহামারী যতদিন চলবে অন্তত সেই সময়কালের জন্য একে মুলতুবি রাখা দরকার। যতদিন এবং যদি না প্রান্তিক মানুষজন, কৃষক সম্প্রদায় এবং উপকূল অঞ্চলে ও বনে বসবাসকারী জনগণ সমবেত আলোচনায় এবং সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে সক্ষম হয়, সেই সময় পর্যন্ত পরিবেশের ওপর প্রভাব মূল্যায়নের বর্তমান রীতিতে কোনো পরিবর্তন আনা চলবে না।

comn

 

৩) খসড়া অনেক প্রকল্পের ক্ষেত্রেই জনশুনানি/ আলোচনাকে বর্জন করার প্রস্তাব রেখেছে। ছোট বাঁধ নির্মাণ, শিল্প-কমপ্লেক্স, খনি-প্রকল্প, প্রধান সড়কগুলোর সম্প্রসারণ এবং ট্যানিং, হ্যালোজেন, পেট্রোলিয়ামের মতো স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক কিছু শিল্পের ক্ষেত্রেও আর জনগণের সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন হবে না। এর অর্থ হল, স্থানীয় যে সমস্ত সম্প্রদায়ের জনগণ জমি, বন বা জীবিকা হারাবেন, অথবা প্রকল্পের জন্য দূষণের শিকার হবেন, তাদের কাছে নিজেদের উদ্বেগ ও আপত্তি জানানো এবং তার সমাধানের কোনো উপায় আর থাকবে না। এই পরিবর্তন চূড়ান্ত রূপে গণতন্ত্র-বিরোধী, কেননা, তা প্রকল্প সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ প্রক্রিয়ায় মতামত দান থেকে স্থানীয় জনগণকে দূরে রাখবে। স্থানীয় জনগণের সঙ্গে কোন ধরনের আলোচনা না করেই দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পসমূহ এবং কর্পোরেশনগুলো ও তার সাথে অন্যান্য প্রকল্পগুলো ছাড়পত্র পেয়ে যাবে।

৪) যে সমস্ত ক্ষেত্রে এখনও জনশুনানির প্রয়োজন হবে, সেগুলোর ক্ষেত্রে জনগণের সঙ্গে আলোচনার জন্য সময়সীমাকে কমিয়ে মাত্র ২০ দিনে নামিয়ে আনা হয়েছে। এই সময়কাল অত্যন্ত কম, বিশেষভাবে গ্ৰামাঞ্চল এবং দূরবর্তী এলাকাগুলোর ক্ষেত্রে যেখানে যাতায়াত করতে, সংযোগ, তথ্য আদানপ্রদান এবং আলোচনার জন্য সময় অনেক বেশি লাগে।

৫) প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলো বিভিন্ন প্রকল্পের এমন সমস্ত কাজকে বৈধ করে তুলবে যেগুলো বর্তমানে নিষিদ্ধর তালিকাতেই রয়েছে (যথা, বৈধ ছাড়পত্র ছাড়াই নির্মাণের কাজ শুরু করা)। এই খসড়া এখন অবৈধর সংজ্ঞা পাল্টে তাকে বৈধতে পরিণত করছে, যার উদ্দেশ্য হল পরিবেশের স্বার্থর বদলে কর্পোরেটদের এবং বাণিজ্যিক স্বার্থকে রক্ষা করা।

৬) অনলাইন/ডিজিটাল মাধ্যমে অনুমোদন দেওয়ার সংস্থানটা অত্যন্ত বিপজ্জনক, কেননা, যে এলাকার ক্ষতিগ্ৰস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেই এলাকা পরিদর্শন না করে এবং কাছ থেকে ক্ষেত্রটি এবং তার ওপর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সমীক্ষা না চালিয়ে কারুরই পরিবেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ নয়।

ect

 

৭) খসড়াটা “ইকো সেনসিটিভ জোন”-এর (পরিবেশগত দিক থেকে সংবেদনশীল অঞ্চল) সংজ্ঞাকে দুর্বল করে তুলতে চায় যাতে করে পরিবেশের অনিষ্টকারী প্রকল্পগুলো ছাড়পত্র পেতে পারে।

8) খসড়া অনেক প্রকল্পেরই “পোস্ট-ফ্যাক্টো ছাড়পত্র” পাওয়ার পথ প্রশস্ত করেছে, অর্থাৎ, ইতিমধ্যেই পরিবেশের ধ্বংসসাধন করেছে এমন সমস্ত প্রকল্পের জন্য ছাড়পত্র প্রদান। এটা পরিবেশের ওপর প্রভাব মূল্যায়নের উদ্দেশ্যটাকেই ব্যর্থ করে দেয়। এই মূল্যায়নের এটাই সুনিশ্চিত করার কথা যে, উন্নয়নের নকশা এবং শিল্প প্রকল্পগুলো এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে পরিবেশ এবং স্থানীয় জনগণের ন্যূনতম ক্ষতি না হয়। পরিবেশের ক্ষতি হলে তার আর পূরণ হয় না।

৯) খসড়াটি শিল্পগুলোকে অনুমতি দিয়েছে, পরিবেশ বিধির লঙ্ঘন হলে সে কথা তারা “নিজের থেকেই জানাবে”। এটা মূলত পরিবেশ সুরক্ষাকারী বিধিকে লঙ্ঘনের লাইসেন্স। এছাড়াও, এখন থেকে প্রকল্প মালিকদের পরিবেশ বিধি মানা সম্পর্কিত রিপোর্ট ছ-মাস অন্তরের বদলে বছরে একবারই দিতে হবে। কাজেই, এই সময়ে ঘটা গ্যাস লিক, আগুন লাগা, দুর্ঘটনা এবং অন্যান্য বিপর্যয় বা লঙ্ঘনের ঘটনা কম করে দেখানো বা একেবারেই না দেখানো হতে পারে।

১০) খসড়ায় বর্ণিত পন্থা অনুসারে, পরিবেশ বিধি মেনে চলা সম্পর্কিত ব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে প্রকল্প-মালিক/প্রোমোটারদের পেশ করা নথির ভিত্তিতে পরিবেশের ওপর প্রকল্পের প্রভাবের মূল্যায়ন করা হবে। এর অর্থ হল, প্রোমোটাররা নিজেদের সুবিধা মতো এমন সমস্ত নথি ও তথ্যকে গোপন করতে পারবে যেগুলো পরিবেশের ক্ষতিসাধনের সম্ভাবনাকে প্রকাশ করে।

১১) খসড়াতে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞদের ভূমিকাকে কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে এবং যে সমস্ত জনগণ/সংগঠনকে কমিটিগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় তাদের তালিকাকেও হ্রাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

পরিবেশের ওপর প্রভাব মূল্যায়নের প্রস্তাবিত খসড়ার লক্ষ্য হল বিনিয়োগকারী এবং কর্পোরেটদের স্বার্থকে রক্ষা করা, পরিবেশ বা স্থানীয় জনগণের স্বার্থ রক্ষা তার আদৌ অভিপ্রায় নয়। এই খসড়া পরিবেশের এবং ভারতের জনগণের ওপর সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলবে। আর তাই সিপিআই(এমএল) পরিবেশের ওপর প্রভাব মূল্যায়নের এই নয়া খসড়া অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।

dadecede

চীন ও ভারতের মনোনীত বিশেষ প্রতিনিধিদের মধ্যে ৫ জুলাইয়ের আলোচনার পর লাদাখে চীন-ভারত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় সেনা সমাবেশ কমানো এবং উত্তেজনা প্রশমনের প্রাথমিক কিছু বহুবাঞ্ছিত সূচনা দেখা গেছে। ভারতের পক্ষে মনোনীত বিশেষ প্রতিনিধি হলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল আর চীন মনোনীত বিশেষ প্রতিনিধি হলেন বিদেশ মন্ত্রী ওয়াং-ই। ওই আলোচনার পর উভয় পক্ষের দেওয়া বিবৃতিতে সীমান্ত এলাকাগুলোতে শান্তি ও সুস্থিতি স্থাপন এবং উন্নত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে; উভয় তরফে ধাপে-ধাপে সেনা সরিয়ে পিছু হঠা নিয়ে আলোচনা চালানোর কথাও বলা হয়েছে। আলোচনার সূত্রে মীমাংসায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা উভয় পক্ষই উল্লেখ করেছে।

পারস্পরিকভাবে পিছুহঠার প্রস্তাব প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখাকে ধরে একটা বাফার জোন সৃষ্টিরই ইঙ্গিত করেছে। এই ব্যবস্থা উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ সম্ভাবনাকে কমিয়ে আনবে বলেই মনে হয়; তবে গালোয়ান উপত্যকা, প্যাংগং সো এবং ডেপসাং সমভূমি অঞ্চলে কিছু এলাকার ওপর ভারত নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, এমন একটা ধারণা কিন্তু রয়ে যাচ্ছে। স্পষ্টতই, ভারতীয় এলাকায় কোন অনুপ্রবেশের বা এলাকা জবরদখলের কথা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে মোদী ২১ জুনের “সর্বদলীয় বৈঠকে” যে বিবৃতি দেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত সেনা অপসারণকে বিচার করলে এই অপসারণ কখনই ভারতকে মুখোমুখি সংঘর্ষের আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না। সেনা অপসারণে পারস্পরিকভাবে সম্মত হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় যথাযথ পরিস্থিতি সম্পর্কে মোদী সরকারের বিভ্রান্তিকর নীরবতা আরও অনুসন্ধিৎসাই জাগাতে পারে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনা প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু হওয়ায় তাকে স্বাগত জানানোর সাথে-সাথে আমরা তাই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় এখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা শ্বেতপত্র প্রকাশের আমাদের দাবির প্রতি  অবিচল থাকছি।

সেনা সমাবেশকে কমিয়ে আনা এবং উত্তেজনা প্রশমনই যদি প্রকৃত উদ্দেশ্য হয়, মতানৈক্যকে যদি বিবাদে পর্যবসিত হতে না দেওয়া হয়, তবে সেটা কেবলমাত্র চীনের কাছ থেকেই প্রত্যাশা করাটা ঠিক হবে না। এই লক্ষ্যে ভারতকেও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। আমরা এমন একটা সীমান্ত বিবাদের মধ্যে রয়েছি যেটা তীব্র হয়ে উঠে আরও একটা যুদ্ধে পরিণতি লাভ করতে পারে, আর তা ঘটলে ভারত বা চীন কারুরই ভালো হবে না। ভারত এবং চীন উভয়ে বর্তমানে সঠিকভাবেই সেই পথকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু বাণিজ্য যুদ্ধ চালিয়ে সীমান্ত বিবাদকে আরও জটিল করে তোলার কোনো প্রয়োজন কি রয়েছে? সীমান্ত বিবাদকে শুধুই সীমান্ত বিবাদ বলে গণ্য করে চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের সামগ্ৰিক ব্যাপ্তিকে বিপর্যস্ত করে তোলাটাকে কি আমরা আটকাতে পারি না?

চীনা কোম্পানিগুলোর তৈরি ৫৯টা অ্যপকে নিষিদ্ধ করার যে অপরিণামদর্শী প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে, ঠিক সেই ধরনের প্রত্যুত্তরই পরিণত ভারতকে এড়িয়ে যেতে হবে। রবিশঙ্কর প্রসাদ যখন “ভারতের নিরাপত্তা, সুরক্ষা, প্রতিরক্ষা, সার্বভৌমত্ব ও সংহতি এবং … ভারতের জনগণের তথ্য ও ব্যক্তিগত পরিসর” রক্ষার পদক্ষেপ হিসাবে এই নিষেধাজ্ঞার কথা ঘোষণা করেন (স্বভাবগতভাবে চীনের নাম না করেই), তখন তিনি নিজেকে হাসির এক খোরাক করে তোলেন। এই সেদিন ১৭ মার্চ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী জি কিসান রেড্ডি সংসদে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছিলেন – টিকটক-এর কাছ থেকে বিপদের কোনো সম্ভাবনা নেই আর তাই তাকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবও নেই। এরপরও রবিশঙ্কর প্রসাদ ওই দাবি করলেন। আর তথ্য চুরি এবং ব্যক্তিগত পরিসরে হানাদারির কথা যদি বলতেই হয় তবে আমেরিকা ও ভারতের বেশকিছু কোম্পানি ও অ্যপও এ ব্যাপারে কম অপরাধী নয়।

চীনা পণ্য বয়কটের জন্য বিকারগ্ৰস্ত জিগির এ ব্যাপারে আর একটা নজির। চীন হল ভারতীয় বাণিজ্যের বৃহত্তম অংশিদার এবং চীন থেকে আমদানি করা পণ্য ভারতীয় উৎপাদনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষভাবে ওষুধ তৈরি শিল্পে যাতে ভারত বিশ্বক্ষেত্রে এক বড় রপ্তানিকারক। চীনের বা বলতে গেলে অন্য যে কোনো দেশের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতাকে কমানো এবং আমাদের আত্ম-নির্ভরতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া একটা ব্যাপার। কিন্তু বয়কটের ডাককে কাজে লাগিয়ে ভারতের নিজের উপভোক্তা এবং ব্যবসাদারদের নিশানা বানানো এবং ভারতে চালু প্রকল্পগুলো ও বিনিয়োগকে বিপর্যস্ত করে তোলা, এবং শ্রমিক বা ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারী হিসাবে লক্ষ-লক্ষ ভারতবাসীর অর্থনৈতিক স্বার্থের ক্ষতি করাটা কখনই ভারতের স্বার্থের অনুকূল নয়।

dad

 

লেহ থেকে দেয়া তাঁর সাম্প্রতিক ভাষণে মোদী সম্প্রসারণবাদকে ধিক্কার জানান এবং উন্নয়নবাদকে তুলে ধরেন। ঘটনা হল, মূলত অর্থনৈতিক এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের এজেণ্ডাকে কাজে লাগিয়েই চীন তার প্রভাব ও স্বার্থের সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে এবং চীন জড়িত আছে এমন প্রতিটি মঞ্চ বা উদ্যোগ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলেই চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভারত এঁটে উঠবে না। ভারতই হল সন্নিহিত অঞ্চলের একমাত্র দেশ যা বিতর্কিত এবং বহু দেশ ও একাধিক মহাদেশকে যুক্ত করা বিপুলাকায় বেল্ট ও রোড প্রকল্পে যোগ দেয়নি। এছাড়া, আশিয়ানভুক্ত দেশগুলির যুক্ত থাকা আঞ্চলিক সামগ্ৰিক অর্থনৈতিক অংশিদারিত্ব (আরসিইপি) থেকেও ভারত এখন বেরিয়ে এসেছে (এই জোটটাতে যুক্ত রয়েছে ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, ফিলিপাইনস, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম) এবং আশিয়ানের সঙ্গে অবাধ বাণিজ্যের পাঁচ অংশিদারের সঙ্গেও ভারত নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেছে (এই দেশগুলো হল অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া)। পরিহাসের ব্যাপার হল, ভারত প্রথম থেকে আরসিইপি পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত থেকেছে, ২০১৩ থেকে তার ২৮টা বৈঠকে অংশ নিয়েছে এবং মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এর দুটি পর্ব এই দেশে অনুষ্ঠিতও করেছে (ষষ্ঠ পর্ব, যা দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ১-৫ ডিসেম্বর, এবং ১৯তম পর্ব যা হায়দারাবাদে অনুষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালের ২৪-২৮ জুলাই), এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আশিয়ানভুক্ত অনেক দেশই এই অঞ্চলকে ইদানিং ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল বলে উল্লেখ করছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলের সঙ্গে রণনৈতিক সমন্বয়কে ক্রমেই বাড়িয়ে চলাটা আমাদের নিজেদেরই সন্নিহিত অঞ্চলে এবং বৃহত্তর ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমাদের বিচ্ছিন্নতার বিকল্প হতে পারে না। আমাদের বুঝতে হবে যে, ইউরোপ থেকে তার সেনা সরিয়ে ভারতের সন্নিহিত অঞ্চলে ওই সেনাদের সমাবেশিত করার মার্কিনের পরিকল্পনা আসলে ঘোলা জলে মাছ ধরার তার প্রয়াসেরই অঙ্গ (এবং এই উদ্দেশে জলটাকে ঘোলা করেই রাখা)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিত্র হিসাবে ভারতকে ঠিক কতটা মূল্য দেয় তা বারবারই উন্মোচিত হয়েছে, অতি সম্প্রতি যা স্পষ্ট হয়েছে অনলাইন শিক্ষায় ভিসা বাতিলের ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষণায়, যে সিদ্ধান্ত ভারতীয় ছাত্রদের বড় আকারে ক্ষতিগ্ৰস্ত করবে।

আত্মনির্ভরতা কখনই এমন একটা বাছাই করা শ্লোগান হতে পারে না যাকে শুধু চীনের পরিপ্রেক্ষিতেই এবং বিশেষভাবে মার্কিনের কাছে ভারতের ক্রমবর্ধমান এবং গ্লানিকর অধীনস্থতাকে আড়াল করতে এবং এমনকি তাকে যুক্তিযুক্ত করতেই ব্যবহার করা হবে। বাণিজ্য এবং অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক বন্ধন থেকে চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদকে আলাদা করা এবং বিদেশ নীতির দীর্ঘ-মেয়াদী গুরুত্বকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বল্প-মেয়াদী হিসেবনিকেশ থেকে বার করে আনাটাই সময়ের দাবি। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং বিদেশ নীতির এমন একটা মিশেল যা প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের আগে ভারতকে যুদ্ধের মত পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়, তা ভারতীয় জনগণ এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য বিপর্যয় ডেকেই আনতে পারে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৭ জুলাই ২০২০) 

ddesbard

পুর্ব বর্ধমান জেলার বর্ধমান সদর ১নং ব্লকের বন্ডুল গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার কামারকিতা গ্রামে ২০১৫/১৬ সালে ১৫ দিন একশো দিনের কাজ করানো হয়েছিল। শতাধিক মানুষকে এখনও তার মজুরি দেওয়া হয়নি। বারবার বলার পরও মজুরি পাওয়ার ব্যবস্থা হয়নি। উল্টে তৃণমূল নেতারা সন্ত্রাস দেখিয়ে মানুষের মুখ বন্ধ করে রেখেছিল। পঞ্চায়েত নির্বাচনে জোর করেই ক্ষমতাসীন হয়েছে। কিন্তু তারপর থেকে আর কাজ দেওয়া হলনা, পুরনো মজুরিও দেওয়া হল না। বর্তমান লকডাউনের পরিস্থিতি ও আমফান ঝড়ের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর মানুষের চরম দুর্ভোগের মধ্যেও তৃণমূল নেতারা মানুষকে বঞ্চিত করে চলেছেন। তাই মানুষের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। মানুষ সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নেতৃত্বে শাসকের সন্ত্রাস অগ্রাহ্য করেই বিক্ষোভে সামিল হন। প্রধানকে চাপ দেওয়া হয়। কোনো সদুত্তর না পেয়ে বিডিও-কে জানানো হয়। এবং ডেপুটেশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তারিখ জানানো হয়। খবর পেয়ে বিডিও সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রধান ও পঞ্চায়েত সমিতির লোক নিয়ে বৈঠক করেন। ডেপুটেশনের আগেই গ্রামে কাজ দিতে শুরু করে। গ্রামে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক সলিল দত্তর নেতৃত্বে জনগণকে নিয়ে বৈঠক করা হল। ১৩ জুলাই ডেপুটেশন সংগঠিত হয়। দাবি ছিল,

১) ১০০ দিনের কাজের বকেয়া মজুরী অবিলম্বে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যাদের জবকার্ড নেই তাদের জবকার্ড দিতে হবে। ১০০ দিনের কাজ চালু রাখতে হবে।

২) প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার ঘর নিয়ে দলবাজী দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। প্রকৃত পাপকদের তালিকা অনুযায়ী অগ্রাধিকার দিতে হবে।

৩) বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

det

 

ডেপুটেশনে ৪০ জন, বিশেষ করে ভাল সংখ্যক মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল। উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদক সলিল দত্ত ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। সমীর হাজরা ও কমরেড করুনা মুখার্জি, এই দুই জন প্রতিনিধির সাথে বিডিও আলোচনা করেন। বিক্ষোভে খালি গলায় বক্তব্য রাখেন জেলা কমিটির সদস্য শ্রীকান্ত রানা। ডেপুটেশন শেষে করুনা মুখার্জির বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে সভার কাজ সমাপ্ত হয়। বিডিও বকেয়া মজুরির ব্যপারে তদন্ত করে মজুরী দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন বলেন। কাজ চালু রাখার চেষ্টা করবেন। বার্ধক্য ভাতার ফরম জমা দিতে বললেন। অন্যান্য দাবির বিবেচনা করবেন বলেন। এই ডেপুটেশন এলাকার মানুষের মধ্যে ভালো উৎসাহ সৃষ্টি করেছে।

ddar

প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন কারখানাগুলোকে কর্পোরেটাইজেশন করার জন্য ‘ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স প্রোডাকশনের’ পক্ষ থেকে ভারতীয় কনসালট্যান্সি সার্ভিস এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে  “এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেষ্ট কাম রিকোয়েষ্ট ফর প্রোপোজাল” আহ্বান করা হয়েছে। কাশীপুর জিএসএফ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন (এনপিডিইএফ ও এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত) পক্ষ থেকে এর তীব্র বিরোধিতা করা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে জাতীয় স্তরে প্রতিরক্ষা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অন্য ফেডারেশনগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আগামী দিনে লড়াইয়ে প্রস্তুতি জারি রেখেছে। কোভিড-১৯ অতিমারী পরিস্থিতিকে কাজে লগিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার একের পর এক শ্রমিক-বিরোধী নীতিগুলো প্রয়োগ করে চলেছে। ইতিমধ্যে কয়লা ক্ষেত্রে ৪১টি ব্লক এবং রেলের ১৫১টি ট্রেনকে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে। প্রতিরক্ষা শিল্পের ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপের ফলে সরকারের মুখোশটা খুলে পড়ছে। একদিকে ফেডারেশন, ইউনিয়ন ও এ্যাসোসিয়েশনগুলোর সঙ্গে হাই লেভেল অফিসিয়েল কমিটি (HLOC)-র মিটিং চলছে, আর অন্যদিকে সরকার একতরফা ভাবে OFB-র কর্পোরেটাইজেশন করার জন্য কনসালট্যান্সি সার্ভিস এজেন্সির সহায়তা চাইছে। কেন্দ্রীয় সরকার যে শ্রমিক কর্মচারিদের সঙ্গে প্রহসন করছে ও ধোঁকাবাজির খেলা খেলছে তা আজ সবার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। আরও একবার আমরা সরকারকে জানিয়ে দিতে চাই, প্রতিরক্ষা শিল্পে কর্পোরেটাইজেশনের সিদ্ধান্তকে ৮২ হাজার শ্রমিক কর্মচারি নাকচ করে দিয়েছে অনির্দিষ্ট কালের ধর্মঘটের ডাকে স্ট্রাইক ব্যালটে মতদানের মাধ্যমে। শ্রমিক কর্মচারিদের এই মতদানকে উপেক্ষা না করে সরকার প্রতিরক্ষা শিল্পে কর্পোরাটাইজেশনের সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহার করুক।

- জয়দেব দে, সভাপতি, কাশীপুর গান ও শেল ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন 

taggtad

কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে লকডাউন চলা কালে তামিলনাড়ুতে দলিত-বিরোধী অপরাধের বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সিপিআই(এমএল) ৬ জুলাই সেখানে রাজ্যব্যাপী প্রতিবাদ সংগঠিত করে। লকডাউনের সময় দলিত-বিরোধী নিপীড়নের অন্ততপক্ষে ৭০টা ঘটনা সরকারের কাছে নথিবদ্ধ হয়েছে। অপরাধের ঘটনাকে বাড়িয়ে তোলার পিছনে সরকারের একটা অপরিণামদর্শী পদক্ষেপের ভূমিকা রয়েছে। মেলাভালাভুর হত্যাকাণ্ড ঘটে ১৯৯৬ সালে। মাদুরাই জেলার মেলাভালাভু পঞ্চায়েতে সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন মুরুগেসন। সমাজে আধিপত্য করা জাতগুলো এটা মেনে নিতে পারেনি। প্রকাশ্য দিবালোকে চলন্ত বাসে মুরুগেসনকে খুন করা হয়। খুনে জড়িতদের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের সাজা হয়। কিন্তু এআইডিএমকে প্রশাসন এ বছরের জানুয়ারি মাসে এমজি রামচচন্দ্রনের জন্মদিনে এদের মুক্তি দেয়, অজুহাত হল, জেলে এরা ভালো আচরণ করেছে। এই পদক্ষেপ দুর্বৃত্তদের স্পর্ধিত করেই তোলে।

দুর্বৃত্তদের উৎসাহ জোগানো আর একটা নজিরের কথা বিচার করা যাক। উচ্চবর্ণের মেয়ে কৌশল্যা দলিত যুবক উদুমালাই শঙ্করকে ভালোবেসে বিয়ে করে। কৌশল্যার অভিভাবকরা এটা মেনে নিতে না পেরে উদুমালাই শঙ্করের সম্মান হত্যাকে সংঘটিত করতে গুণ্ডা লাগায়, গুণ্ডারা শুধু তাকেই প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসভাবে হত্যা করে না, কৌশল্যাকে হত্যারও চেষ্টা করে। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে পাওয়া এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য গোটা দেশকে আলোড়িত করে। এই হত্যাকাণ্ডে মূল ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন কৌশল্যার বাবা চিনাস্বামী। কিন্তু মাদ্রাজ হাইকোর্ট একটা আবেদনের ভিত্তিতে এ বছরের ২২ জুনের একটা রায়ে তাকে বেকসুর খালাস দেয়। এইভাবে প্রশাসনের অবাঞ্ছিত পদক্ষেপ এবং ন্যায়বিচার দিতে আদালতের ব্যর্থতা উভয়ই দুর্বৃত্তদের মনোবল বাড়িয়ে তোলে। তামিলনাড়ুর রাজ্য সরকার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করুক – প্রতিবাদীরা এই দাবি তুলেছেন।

taa

 

উপাসনার অধিকার থেকে দলিতদের বঞ্চিত করা হচ্ছে, সাধারণ কবরস্থানে তাদের কবর দেওয়ার অধিকার নেই, পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করা জল সহ গ্ৰামের সম্পদে তাদের অধিকার নেই, দলিত নারী ও শিশুদের ওপর যৌন হিংসা ও আক্রমণ বেড়ে চলেছে এবং হাতে করে ময়লা সাফ করতে গিয়ে সেপটিক ট্যাঙ্কে তাদের মৃত্যু অব্যাহত রয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে সিপিআই(এমএল) ৬ জুলাই সারা রাজ্যে প্রতিবাদের ডাক দেয়। দলিতদের ওপর আক্রমণ বন্ধের এবং তাদের ওপর হিংসার সংঘটকদের শাস্তি সুনিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে অনলাইনে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন সংগঠিত করছে ন্যায়বিচারের জন্য জনগণের আন্দোলন মঞ্চ। তামিলনাড়ুর বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোও এই আবেদনে আন্দোলনে অংশ নেয়। সেদিন, অর্থাৎ, ৬ জুলাই প্রতিবাদ সংগঠিত হয় চেন্নাই-চেংলাপাট্টু, কাঞ্চিপূরম, থিরিভাল্লুর, পুডুকোট্টাই, ভিল্লিপূরম এবং আরও বেশকিছু জেলায়। এই প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে যে দাবিগুলোকে সেদিন তুলে ধরা হয় সেগুলো হল – দলিতদের ওপর নিপীড়নের সংঘটকদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে, নির্যাতন নিবারণ আইনকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে, লকডাউনকালে চালানো অপরাধগুলোর বিচার ও দণ্ডদান প্রক্রিয়া তিন মাসের মধ্যে শেষ করতে হবে।

brfgaf

সিপিআই(এমএল)-এর বিহার রাজ্য সম্পাদক কুনাল গত ২ জুলাইয়ের এক বিবৃতিতে বলেছেন, বিজেপি-জেডিইউ সরকার তাদের সমস্ত দায়িত্ব-কর্তব্যকে পরিত্যাগ করেছে। নীতীশ কুমার বলেছিলেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের যাদের যেমন দক্ষতা ও সামর্থ্য রয়েছে সেই অনুযায়ী বিহারের মধ্যেই তাদের কাজ দেওয়া হবে। এই ধরনের কিছুর দেখা এখনও মেলেনি। সরকার যথেষ্ট সংখ্যায় করোনা পরীক্ষাও করছে না; আবার পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কাজের ব্যবস্থাও করছে না। এমএনআরইজিএ-তে কাজ পাওয়াটাও দুর্লভ হয়ে উঠেছে। ফলে বিহারে একদিকে লাফিয়ে-লাফিয়ে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে পরিযায়ী শ্রমিকরাও আবার বিভিন্ন রাজ্যে ফিরতে শুরু করেছেন যদিও ওই সমস্ত রাজ্যে কাজ পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা তাঁদের নেই।

প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর সাম্প্রতিক ভাষণে দরিদ্র ও পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজ, জীবিকা বা আয় নিয়ে একটা কথাও বলেননি। দরিদ্রদের জন্য সামান্য দানা শস্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের সম্পর্কে হাত ধুয়ে ফেলাটা এক নির্মম রসিকতা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। বেশ কিছুদিন ধরেই দেশের মানুষের দাবি হল, যে পরিবারগুলো আয়করের আওতার বাইরে তাদের আগামী ছ-মাস নগদ ৭,৫০০ টাকা করে দিতে হবে; ছ-মাস ধরে মাথাপিছু ১০ কেজি খাদ্যশস্য দিতে হবে; এমএনআরইজিএ-তে ২০০ দিনের কাজ ও ন্যূনতম মজুরি ৫০০ টাকা দিতে হবে; এবং কাজ ও জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। এ সবের ধারকাছ দিয়ে না গিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশের জনগণকে হতাশই করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী বললেন, প্রতিটি মানুষকে মাসে ৫ কেজি করে খাদ্যশস্য দেওয়া হবে। এতে গড়ে প্রতিদিন মাথাপিছু খাদ্যশস্যের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১৬৬ গ্ৰাম। দেশের মানুষের কাছে প্রধানমন্ত্রীকে অতএব বলতে হবে, ১৬৬ গ্ৰাম খাদ্যশস্য দিয়ে একজন মানুষের তিনবার খাবারের ব্যবস্থা কী করে হবে।

দরিদ্রদের এবং এবং তাদের ছেলেমেয়েদের যে নুন, তেল, শাকসব্জি, জামাকাপড়, চিকিৎসা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার  দরকার আছে, সরকারের বিবেচনায় তা আছে বলে মনে হয় না। প্রত্যেকটা মানুষেরই পুষ্টি এবং পেট ভরে খাবার প্রয়োজন রয়েছে। যে সরকার “আত্ম-নির্ভরতা” নিয়ে বড়-বড় কথা বলে, তাকে সবার আগে দেশের জনগণের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে কৃষকদের ঋণ মকুব নিয়েও কোনো কথা বললেন না।  

প্রধানমন্ত্রী সরকারী প্রকল্পকে যে একটি মাত্র সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে যুক্ত করলেন, সেটাও যথেষ্ট আপত্তিকর। তাঁর কথাগুলো সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন করল যে, জনগণের কল্যানের চেয়ে বিহার নির্বাচন নিয়েই সরকারের যা কিছু মাথাব্যথা।

noxxxcoll

ভারতবর্ষে অবৈতনিক শিক্ষার  অধিকার সার্বজনীন ভাবে আদৌ স্বীকৃত না হলেও বিনা বেতনে শিক্ষার্থীদের সংশয়, উদ্বেগ ও আতঙ্ক বিতরণের ব্যবস্থা করতে পুরোদস্তুর সক্ষম শাসকগোষ্ঠী। সব সামাজিক অবস্থার ছাত্রছাত্রীদেরকে শিক্ষাঙ্গনে টেনে আনা নয় বরং কত বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীকে শিক্ষাঙ্গন থেকে ছেঁটে ফেলা যায় নানা ছুঁতোনাতায় তার ছক প্রতিনিয়ত কষে চলে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার মাথারা। নইলে খেলার শাটল কক হিসাবে কেনই বা ছাত্রছাত্রীদেরকে বেছে নেয় সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)? চলতি করোনা সংক্রমণ ও লকডাউনের অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে অনেক ব্যতিক্রমী ও নজিরবিহীন সিদ্ধান্তই নেওয়া হচ্ছে সমাজের সর্বস্তরে সর্বক্ষেত্রে। তারই গতিতে গত ২৯ এপ্রিল প্রকাশিত এক গাইডলাইনে ইউজিসি জানায় যে, দেশের সমস্ত কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল ইয়ার/সেমেস্টারের পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা যাবে ৮০%/২০% পদ্ধতিতে অর্থাৎ এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে কাগজে-কলমে পরীক্ষা দেওয়া কার্যত অসম্ভব তাই পরীক্ষার্থীদেরকে মূল্যায়নের ৮০% নম্বর দেওয়া হবে তাদের দেওয়া বিগত বর্ষ/সেমেস্টারগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ পাওয়া মার্কসের ভিত্তিতে আর বাকি ২০% দেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন ব্যবস্থা থেকে। কিন্তু মোদী সরকার তো ভারতবর্ষের শ্রমিক, কৃষক, মহিলা, ছাত্র-যুব ইত্যাদির মতো দেশ গঠনের স্তম্ভগুলোকে বরাবরই মারণ ঝটকা দেওয়াটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে! কোভিড মোকাবিলার পরীক্ষায় সবদিক থেকেই চূড়ান্ত ব্যর্থ অপদার্থ মোদী সরকার নিজে তাই এখন ছাত্রসমাজকে পরীক্ষার ‘গুরুত্ব’ বোঝানোর মাস্টারি শুরু করেছে।

guri

 

গত ৬ জুলাই বিকালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক হঠাৎই মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের পরামর্শক্রমে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে পরীক্ষা নেওয়ার ‘ছাড়পত্র’ ঘোষণা করলো। সীমান্তের গুরুগম্ভীর আওয়াজেও যখন আর মানুষের চমক লাগছেনা তখন নতুন কোনো ধামাকা না করে কিভাবে টিকতে পারে এই সরকার, তাই লাগাও ফরমান। অমনি এই ‘ছাড়পত্র’কে হাতিয়ার করে মাঠে নেমে পড়লো ইউজিসি। জারি হয়ে গেল সর্বনেশে গাইডলাইন, যাতে ঢালা হল প্রচুর নীতিবাক্য -- হাতে-কলমে পরীক্ষা না নিয়ে চূড়ান্ত বর্ষের/সেমেস্টারের ছাত্রছাত্রীদের নাকি প্রমোট করানো বড়ই ভুল; পরীক্ষা দিলেই নাকি ছাত্রছাত্রীরা একমাত্র আত্মবিশ্বাস পায়। তাই স্নাতক স্তরের ফাইনাল ইয়ার/সেমেস্টারের পরীক্ষা সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে নিতেই হবে এবং প্রয়োজনে অনলাইন + অফলাইন জগাখিচুড়ি পদ্ধতিতেই পরীক্ষা নিতে হবে। ‘ম্যাজিশিয়ান’ সরকারের কোনও এক মন্ত্রবলে কিছুদিন আগেই আইসিএমআর বলে দিয়েছিল, ১৫ আগস্টের পুণ্য প্রভাতেই নাকি ভারতে উদয় হতে চলেছে করোনার ভ্যাকসিন! পরবর্তীতে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের রীতিমতো সোচ্চার প্রতিবাদে এমন সময় বেঁধে অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক ভবিষ্যদ্বাণী গোছের অদ্ভুতুড়ে দাবি থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় তারা।

এরকমই কোনো মন্ত্রবলে কি মোদী সরকার ও ইউজিসি কোনো ‘স্বপ্নাদেশ’ পেয়েছে যাতে তারা সেপ্টেম্বরের মধ্যে করোনামুক্ত ভারত গঠনের সম্ভাবনা দেখছে? নাহলে যে স্বাস্থ্য সংকটের কারণে মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়কদের প্রাণ সংশয় থেকে বাঁচাতে ১০০ দিনের উপর বন্ধ থাকে পার্লামেন্ট সেই একই ঝুঁকির মধ্যে কিভাবে ছাত্রছাত্রীদেরকে পরীক্ষা দিতে ঠেলে দেওয়া যায়? কোনো মানবিক, বিবেচক সরকার ও শিক্ষা ব্যবস্থা এটা করতে পারে? তারা কি ধরেই নিয়েছে যে ভারতবর্ষের কোটি কোটি পরনে একটা চলনসই পোষাক না জুটলেও ছাত্রছাত্রীরা সবাই করোনাপ্রুফ জ্যাকেট পরে বসে আছে? নাকি অগ্রাধিকার দিয়ে মদের দোকান খুলে দেওয়া সরকার গোটা ছাত্র-যুব সমাজকে পেটের ভিতর থেকে আপাদমস্তক অ্যালকোহলিক করে ‘স্যানিটাইজড শরীর’ তৈরির কোনো অলীক স্বপ্ন দেখছে? যে দেশের মোটের উপর মাত্র ৪০% (IAMAI) ও নিয়েলসনের ‘ডিজিটাল ইন ইন্ডিয়া’ সমীক্ষা, ২০১৯-এর রিপোর্ট অনুসারে) মানুষের কাছে ইন্টারনেট সংযোগ লভ্য সেখানে কোন যুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একই স্তরের পরীক্ষা ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে নেওয়া চলতে পারে? পরিষ্কার ভাবেই এটা একটা ডিজিটাল বৈষম্যকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করে দেওয়ার চক্রান্ত!

asa

 

এই তুঘলকি গাইডলাইনের বিরুদ্ধে ব্যপকভাবে ফুঁসছে আসমুদ্র-হিমাচল ছাত্রসমাজ অথচ আরএসএস-বিজেপির ছাত্রশাখা এবিভিপি এই ছাত্রস্বার্থ-বিরোধী গাইডলাইনকে স্বাগত জানিয়েছে! আইসার মতো ছাত্র সংগঠন গোটা দেশ জুড়েই ইতিমধ্যে এই গাইডলাইনের কপি জ্বালিয়ে জোরালো ভাবে সংগঠিত করেছে প্রতিবাদ দিবস। পশ্চিমবঙ্গ সহ বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই ইউজিসিকে চিঠিপত্র দিয়ে এই গাইডলাইনের প্রতি আপত্তি জানিয়ে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদন জানিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। যে সরকার নিজে সব বিষয়েই পরীক্ষা দিতে ফাঁকিবাজি করে সেই কিনা আজ দেশের ছাত্রসমাজকে ‘পরীক্ষায় ভীত’, ‘ফাঁকিবাজ’ ইত্যাদি বলে অপমান করতে উদ্যত। এই অবস্থায় যদি সরকার ও ইউজিসি শিক্ষার্থীদের জীবনের গ্যারান্টি দিতে না পারে তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদের জীবন ও ভবিষ্যত নিয়ে তামাশাবাজ এই শাসককে সহবৎ শেখানোর গ্যারান্টি দিতেই পারে।

- সৌরভ  

rtrarat

সীমান্তে “দ্রিমিকি দ্রিমিকি, বাজে রণবাদ্য”, অর্থনীতির বেহাল অবস্থা, লকডাউন পর্যায়ে ছাঁটাই, শ্রম সংকোচন, কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে শ্রম আইন সংশোধন, পরিযায়ী শ্রমিকদের হাহাকার – এ সবই এনডিএ সরকারের দেশবিরোধী, জনবিরোধী, শ্রমিক বিরোধী নীতির ই প্রতিফলন। জাতীয় সংকট ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তুলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণীর ঘামে ও রক্তে গড়ে তোলা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থাকে জলের দরে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। কয়লা শিল্প থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা, এলআইসি, বিপিসিএল, এয়ার ইন্ডিয়া সহ সমস্ত রাষ্ট্রীয় শিল্পকে ঢালাও বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে দেশের শ্রমিকশ্রেণী প্রতিদিন ঐক্যবদ্ধ লড়াইতে সমাবেশিত হচ্ছে। করোনা মহামারীতে দেশ যখন বিপর্যস্ত তখনই দেশী-বিদেশী কর্পোরেটদের কাছে ভারতীয় রেলকে বেচে দেওয়ার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হল। ভারতীয় রেলে কর্মরত দক্ষ শ্রমিক দেশের অর্থনীতি কে সচল রাখতে রাতদিন কাজ করে চলেছে। রুটি রুজির জন্য প্রতিদিন প্রায় দুকোটি সাধারণ জনগণ প্রত্যহ রেলে যাতায়াত করেন এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে, গ্রাম থেকে শহরে। রেল বেসরকারীকরণ হলে শুধু ভাড়া বৃদ্ধিই নয় রেল সুরক্ষা ও পরিষেবা বিরাট প্রশ্নের মুখে দাঁড়াবে।

রেল বেসরকারীকরণের প্রেক্ষাপট:

পরিকল্পনা কমিশন সামাজিক দায়বদ্ধতার দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যন্ত এলাকায় রেললাইন সম্প্রসারনের কাজে সক্রিয় থেকেছে, যদিও প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। এমনকি উদারিকরণের যুগেও কেন্দ্রে আসীন বিভিন্ন সরকার জনপ্রিয় জাতীয় পরিবহন ব্যবস্থা রেল কে বেসরকারী পূঁজির হাতে তুলে দিতে পারেনি এবং ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে যাত্রীভাড়ায় ভর্তুকি তুলে দেওয়ার পদক্ষেপ ও গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু মূল কাঠামো কে অক্ষুন্ন রেখে নন-কোর কাজগুলো আউটসোর্সিং করতে শুরু করে। আর মোদী সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে এসে ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক শত্রু সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণী তথা রেল শ্রমিকের ওপর নগ্ন আক্রমণ সংগঠিত করে। প্রথমেই কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে যোজনা কমিশন তুলে দিয়ে নীতি আয়োগ গঠন করে এবং দেবরায় কমিটির সুপারিশে স্বাধীন পৃথক রেল বাজেট তুলে দিয়ে ভারতীয় রেলের স্বায়ত্বতাকে খর্ব করে। মোদী সরকার দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফিরে এসে রেলে বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে ১০০ দিনের এ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করে। প্রথম বেসরকারী ট্রেন তেজস এক্সপ্রেস লক্ষ্ণৌ ও দিল্লির মধ্যে চালু হয়। ভাড়া দ্বিগুণ বৃদ্ধি হয়। তেজস এক্সপ্রেস কে অগ্রাধিকার দিতে বহু ট্রেন উক্ত রুটে বাতিল করা হয় ও গোমতী এক্সপ্রেস কে স্টেশনে দাঁড় করিয়ে রেখে তেজস কে আগে ছাড়া হয়। এই ঘটনা থেকে প্রমানিত যে আগামী দিনে ভারতীয় রেলে বেসরকারী পুঁজিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

trra

 

করোনা মহামারী রুখতে লকডাউন শেষ হতেই ১ জুলাই ২০২০ থেকে মোদী সরকার ১০৯টি লাভজনক ও ব্যস্ততম রুটে ১৫১টি ট্রেনের জন্য আরএফকিউ (Request for Qualification) অর্থাৎ প্রাইভেট অপারেটরের কাছ থেকে টেন্ডারপত্র আহ্বান করেছে।

২০২৩ সাল থেকে ভারতীয় রেলের রেডিমেড পরিকাঠামো কে ব্যবহার করে প্রথম কিস্তিতে উক্ত ট্রেনগুলি চালু হবে। বেসরকারীকরণের পক্ষে মোদী সরকারের যুক্তি হল রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে এছাড়া কোন বিকল্প নেই। এর ফলে ৩০ হাজার কোটি টাকার দেশী-বিদেশী পুঁজি (রেলে ১০০% এফডিআই এর অনুমতি দিয়েছে সরকার) বিনিয়োগ হবে। সরকার পরিচালিত ট্রেনের সাথে প্রতিযোগিতা শুরু হবে এবং তারা নিজেদের ইঞ্জিন, কামরা রক্ষণাবেক্ষণ করবে। (১) আধুনিক প্রযুক্তির ট্রেন হওয়ার ফলে রক্ষণাবেক্ষণের সময় কম লাগবে। (২) গন্তব্য স্থলে পৌঁছানোর সময় (Transit Time) ও কম লাগবে। (৩) ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে। (৪) নিরাপত্তা সুরক্ষিত হবে ও দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে। (৫) চাহিদা ও যোগানের ক্ষেত্রে ঘাটতি কমবে। মোদী সরকারের কোন যুক্তিই ধোপে টেঁকে না। সবচেয়ে মিথ্যাচার হল ‘আচ্ছে দিন’ এর মতো কর্মসংস্থানের গল্প। প্রথমতঃ অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ট্রেনে কামরা ও ইঞ্জিনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ মূল কাঠামোর সাথে অন্তর্গ্রথিত থাকে। ফলে প্রতিদিন রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয় না এবং খুব কমসংখ্যক দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। অতি মুনাফার জন্য প্রতিনিয়ত নিরাপত্তা বিধি লঙ্ঘিত হয় ও ট্রেন দূর্ঘটনার কবলে পড়ে। চাহিদা যোগানের সামঞ্জস্য আনতে সরকার নিজেই বিনিয়োগ করে নতুন ট্রেন চালু করতে পারে। গত ছয় বছরে বন্দে ভারত (১৮টি ট্রেন) বা তেজস এক্সপ্রেস এর মতো ট্রেন ছাড়া জনতার স্বার্থে উল্লেখযোগ্য কোন ট্রেন চালু হয়নি।

ইতিমধ্যে ৫০টি বড় বড় লাভজনক স্টেশন বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নির্মাণ শিল্পের হাঙরদের হাতে তুলে দেওয়া হবে রেল কলোনির জমি। ছোট ছোট স্টেশন, ডিজেল শেখ বন্ধ করে দেওয়া হবে, বন্ধ হবে রেলওয়ে স্কুল ও হাসপাতাল।

bas

৭টি রেলওয়ে উৎপাদন কেন্দ্রের কর্পোরেটকরণ:

গত ৩০ শে জুন ২০২০, রাইটস (রেল ইন্ডিয়া টেকনিক্যাল এন্ড ইকোনমিক সার্ভিস) লিমিটেড রেল বোর্ডের কাছে রেলের উৎপাদন কেন্দ্র গুলির কর্পোরেট করণ তথা বেসরকারীকরণের জন্য তার রিপোর্ট পেশ করেছে। উৎপাদন কেন্দ্রগুলির কর্পোরেটকরণ তথা বেসরকারীকরণ এখন মন্ত্রীসভার অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। উৎপাদন কেন্দ্রগুলিতে দেশী-বিদেশী পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটবে এবং সস্তা শ্রমে তৈরি কোচ, ইঞ্জিন, চাকা প্রাইভেট ট্রেন অপারেটর কে সরবরাহ করবে। এ্যালস্থম, বোম্বার্ডিয়ার, সিমেন্স-এর মতো বহুজাতিক সংস্থা নতুন প্রযুক্তি ও পুঁজি বিনিয়োগ করবে। বিপন্ন হবে স্থায়ী কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা। তৈরি হবে কন্ট্র্যাক্ট শ্রমিকদের এক বিশাল বাহিনী। সামাজিক সুরক্ষা, ন্যূনতম মজুরি বা ৮ ঘণ্টা কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমার মতো শ্রম আইনগুলি লঙ্ঘিত হবে।

একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা (RRAI) বা ব্যবস্থার অধীনে দুটি সমান্তরাল পদ্ধতির (সরকারী ও বেসরকারী ট্রেন পরিচালন পদ্ধতি) অন্তর্বিরোধ উক্ত রেগুলেটরের অনেক কাজের মধ্যে অন্যতম হলো বেসরকারী মালিকরা যাতে রেলের পরিকাঠামো ব্যবহার করতে পারে তার তত্ত্বাবধান করা। সুপরিকল্পিতভাবে প্রশাসন বেসরকারী সংস্থাকে বেশি সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দিয়ে সরকারী ব্যবস্থা কে অসম প্রতিযোগিতার মুখে ফেলে দেবে। বেসরকারী ট্রেনগুলি যাতে যথেষ্ঠ যাত্রী পায় ও দ্রুত ছুটতে পারে তার জন্য দেশজুড়ে অন্তত শ’খানেক ধীর গতির ট্রেন বসিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেল। এমনকি বেসরকারী ট্রেন ছাড়ার ১৫ মিনিট আগে ও পরে একই রুটের কোনো ট্রেন যাবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে সরকার। ক্রমশ বেসরকারী ট্রেনকে জায়গা করে দিতে সরকারী ট্রেনকে ক্রমেই পিছনের সারিতে ঠেলে দেওয়া হবে। এটি একটি জাপানি মডেল। ১৯৬৪ সাল থেকে জাপানি রেলে দুটি ব্যবস্থা চালু হয় ও ক্রমশ এক দশকের মধ্যে সরকারী ট্রেন পরিষেবা ভেঙে পড়ে এবং বেসরকারীকরণের হাত ধরে সেই জায়গায় কর্পোরেট পুঁজি প্রবেশ করে। মোদী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতীয় রেল ও ১০০% প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের হাত ধরে দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিদের হাতে চলে যাবে।

gw

রেল বেসরকারীকরণ কি আদৌ আমজনতার স্বার্থ সুরক্ষিত করবে?

বর্তমানে প্রতি যাত্রী পিছু প্রতি কিলোমিটারে ৪৩ পয়সা ভর্তুকি দেয় রেল। ভাড়া নির্ধারণের ক্ষমতা বেসরকারী হাতে গেলে তাতে ভর্তুকির সুযোগ থাকবে না। ফলে টিকিটের প্রকৃত মূল্য ও বেসরকারী সংস্থার লাভ মিলিয়ে টিকিটের যা দাম হবে তা সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। বয়স্ক নাগরিক, প্রতিবন্ধী, ক্যানসার রোগী প্রভৃতিদের বিশেষ অনুদান বা কনসেশন তুলে দেওয়া হবে। বেসরকারী মালিক নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ, যেমন ঠিকা শ্রমিক, সবজি বিক্রেতা, ছোট দোকানদার, যারা ভেন্ডার ও মাসিক টিকিট কেটে যাতায়াত করেন তাদের ওপর বাড়তি বোঝা চাপাবে। প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা যাত্রী ও মাল পরিবহনে ভর্তুকি দেওয়া হয়। কিন্তু এর মাত্র ১০% পায় শ্রমজীবী গরিব জনগণ, বাকিটা ভোগ করে রাষ্ট্র ও পুঁজিপতিরা। এবারে এই দশ শতাংশ ভর্তুকিও উঠে যাবে। লোকাল ট্রেন বেসরকারী মালিকের হাতে চলে গেলে বহু অলাভজনক রুটে ট্রেন বন্ধ হয়ে যাবে। গরিব শ্রমজীবী মানুষ বিপদে পড়বে।

বেসরকারীকরণ ও কর্মীসংকোচন:

যেহেতু রেক রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বেসরকারী সংস্থা করবে সেহেতু ব্যাপক রেলকর্মী উদ্বৃত্ত হবে। ইতিমধ্যে ২.৫ লাখ শূণ্যপদ পূরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে এবং ২০২১-২২ এ অবসরের ফলে আরও ১ লক্ষ পদ খালি হবে। ইতিমধ্যে ১.২৫ লক্ষ (৫০%) শূন্যপদের অবলুপ্তি ঘটেছে। অবসরের পর চুক্তি ভিত্তিক পুনর্বহাল করবে রেল মন্ত্রক। বর্তমানে রেলকর্মী সংখ্যা ১২ লক্ষ ৭৭ হাজার। উক্ত সংখ্যা কে ৫ লক্ষে নামিয়ে আনার নীল নকশা তৈরি হয়েছে। মাল্টি স্কিলিং এর নামে এবং বিভিন্ন বিভাগকে একত্রিত করে কর্মী সংখ্যা কমানো হচ্ছে। যাদের বয়স ৫৫ বছর বা চাকরি ৩০ বছর হয়েছে তাদের কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন করে বাধ্যতামূলক অবসরের নির্দেশ জারি করা হয়েছে।

prov

 

এই সমস্ত দেশ বিরোধী, শ্রমিক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে গত ২২ মে ট্রেড ইউনিয়নগুলি দেশব্যাপী সংযুক্ত প্রতিবাদ দিবস পালন করে। রেল শ্রমিক ও রেলে কর্মরত ঠিকা শ্রমিকরা ঐ কর্মসূচীতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। রেলশিল্পে এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত সর্বভারতীয় ফেডারেশন, আইআরইএফ (ইন্ডিয়ান রেলওয়ে এম্প্লয়িজ ফেডারেশন) ১৯ জুন থেকে ২৬ জুন সারা দেশে প্রতিবাদ সপ্তাহ পালন করে। কয়লাখনি নিলাম, রেল বেসরকারীকরণ, প্রতিরক্ষা শিল্পের কর্পোরেটকরণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে রেল শ্রমিক সোচ্চার হন। গত ৩ জুলাই সংযুক্ত ট্রেড ইউনিয়নের ডাকা দেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবসে রেলশ্রমিকরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ধর্মঘটী কয়লা শ্রমিকদের সংহতিতে সারা দেশে আইআরইএফ কর্মসূচী পালন করে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারীকরণ, শ্রম আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে ও অন্যান্য দাবিতে এই প্রতিবাদ দেশজুড়ে অসহযোগ, আইন অমান্য, অবরোধ, অবস্থান ইত্যাদি বিভিন্ন রূপে সংগঠিত হয়। ৫টি বামপন্থী দল ও কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠন সমর্থন জানিয়ে উক্ত কর্মসূচীতে সামিল হয়।

মোদী জমানায় কর্পোরেট লুঠ ও মুনাফা, অতি-মুনাফার জন্য ভারতীয় রেলকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। রেল সুরক্ষার বদলে মুনাফাই হবে একমাত্র লক্ষ্য। তাই ভারতীয় রেলের জনস্বার্থবাহী কাঠামো কে ধ্বংস করে এক নতুন কর্পোরেট মুখী কাঠামো তৈরি করতে মোদী সরকার বদ্ধপরিকর। এমতাবস্থায় রেলশ্রমিক, শ্রমজীবী যাত্রী সাধারণ, যুব-ছাত্র, কৃষিশ্রমিক-এর সর্বাত্মক ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। মোদী সরকারের এই দেশবিরোধী, জনবিরোধী, শ্রমিক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ভারতীয় রেলের ছোট বড়, জেসিএম অন্তর্ভূক্ত, জেসিএম বহির্ভূত সব সংগঠনকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসতে হবে এবং জাতীয় স্তরে সমন্বয়ের মাধ্যমে এক নির্ণায়ক লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। জেসিএম অন্তর্ভুক্ত না হলেও, নতুন ফেডারেশন ইন্ডিয়ান রেলওয়ে এম্প্লয়িজ ফেডারেশন (IREF)-কে উক্ত দিশায় নেতৃত্বকারী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।

লেখা : নীরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী 

vbarNav

(দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেসবুক পাতায় প্রকাশিত এই লেখাটি দেশব্রতীর পাঠকদের জন্য তুলে আনা হল)

ধারাবাহিকভাবে তাঁর কাছের মানুষদের ইন্টারভিউ প্রকাশিত হচ্ছে আমার প্রোফাইলে। আজ বলছেন নীতীশ রায়

গণমানুষের ভিড়ে আজীবন গান গেয়েছেন নীতিশবাবু। গণমানুষের গান গেয়েছেন। মানুষের রাজনীতির গান, সংস্কৃতির গান। ঘাম-রক্ত-কোষের ভেতর মিশে গেছেন। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সদস্য নীতীশবাবুর সাথে নবারুণের ঘনিষ্ঠতা হয়, নবারুণের জীবনের শেষ পর্যায়ে। নবারুণও এই পর্যায়ে মানুষের ভেতর মিশতে চাইছেন আরও। ভালোবাসতে চাইছেন প্রবল। কোনও এক অজানা টানে যেন তিনি তাই বুদ্ধের কথা ভাবছেন। আর সদস্য না হলেও সভাপতিত্ব গ্রহণ করছেন লিবারেশানের সংস্কৃতি সেলের। শরীর খারাপ নিয়েও ছুটে যাচ্ছেন নানা কনফারেন্সে। সে-সব কথাই আজ বললেন নীতীশবাবু। তাঁর গানের মতোই সহজ ভাষায়, ......

জীবনের একেবারে শেষদিকে আমাদের পার্টি সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দলের ঘনিষ্ঠ হন নবারুণদা। আজীবন বাম রাজনীতির প্রতি আসক্ত ছিলেন। কিন্তু কোনওদিন সদস্য হননি। শিল্পী হিসেবে বরাবর পাশে থেকেছেন আমাদেরও। এই পর্যায়ে আমরাও চেয়েছিলাম, একজন ক্রিয়েটিভ মানুষ হিসেবে কখনওই যেন দলীয় নিয়মে আটকে না পড়েন তিনি। যেন স্বাধীনভাবেই আমাদের পরামর্শ দেন।

এরপর মহাজাতি সদনে পার্টি কংগ্রেসে বক্তব্য রাখেন নবারুণদা। এরপর মেট্রো চ্যানেলে আয়োজিত সাংস্কৃতিক সমাবেশেও আসেন। ভাষণ দেওয়ার পাশাপাশি নানা বুদ্ধিজীবীদেরও আসতে বলেন সেখানে। এ সময়টা থেকেই ক্রমশ সিঙ্গুরের পটভূমি বিস্তার পেতে থাকছিল। আমরা সিঙ্গুরে যাচ্ছিলামও বারবার।

২০০৭-এ পঞ্চায়েত নির্বাচনে হুগলির পোলবা-দাদপুরে গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করে লিবারেশন৷ সেবারের বিজয় অনুষ্ঠানেও নবারুণদা এসে কবিতা পড়লেন সাধারণের ভিড়ে। সবাই উচ্ছসিত। নবারুণদাও খুব খুশি হলেন।

এরপর, বেনারসে জনসংস্কৃতি মঞ্চের অনুষ্ঠানে হাজির হলেন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে নানা ভাষার কবি-সাহিত্যিক-মানুষদের ভিড়ের মাঝে পড়লেন তাঁর বিখ্যাত “মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না”। প্রথমে হিন্দিতে পড়া শুরু করে মাঝপথে বাংলাতেই পড়তে থাকলেন। ফেটে পড়ল উচ্ছাসে সামনের অগণিত মানুষ৷ তাঁরা নিজের নিজের ভাষায় উচ্চারণ করলেন এই ইতিহাস হয়ে যাওয়া পংক্তিগুলি। আমরা বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ!

বরাবর বলতেন, ভাষার জোরের কথা। যে ভাষা উনি খুঁজছিলেন। এই পুতুপুতু এলিট শ্রেণির ভাষা পেরিয়ে শ্রমিকের ভাষার কাছে পৌঁছনোর তাগিদ ছিল নবারুণদার বরাবর। তাই যে কোনও জায়গাতেই তাঁর ভাষণ বা কবিতাপাঠ সবার মনের মণিকোঠায় কড়া নাড়ত। লিবারেশনের অমলেন্দুভূষণ চৌধুরী, মানস ঘোষেদের সাথে ওঁর ঘনিষ্ঠতা ছিলই। পরে ক্রমশ আমাদেরও কাছের হয়ে উঠলেন। হয়ে উঠলেন সবার নবারুণদা!

nab

 

২০০৭ সালেই বজবজ কনফারেন্সে যোগ দিলেন। খুব সুন্দর সময় কাটল একসাথে। বন্ধুতা বাড়তে থাকল। এরপর ভিলাই কনফারেন্সে যাওয়ার পথে কয়েকটা মজার ঘটনা ঘটে। তখন জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের ঘটনায় কড়াকড়ি চলছিল ট্রেনে। চক্রধরপুরের কাছে আমাদের ট্রেন দাঁড়িয়ে যায়। নবারুণদা আর বৌদি বাড়ি থেকে মাংস এনেছিলেন। রুটি ছিল না। আমাদের আরেক বন্ধু অরিন্দমকে নিয়ে রুটি কিনতে বেরলেন তিনি অগত্যা। বৌদির কথা শুনলেন না। বৌদি বলে দিলেন, “তোমরা ওকে দেখো একটু, ও কিন্তু হঠাৎ কোথাও আড্ডা জমিয়ে দেবে!”

আর, সেটাই হল। হঠাৎ স্টেশনের পাশের একটা হোটেলে গিয়ে নবারুণদা রুটি বেলতে আরম্ভ করলেন। অরিন্দমকে পরে রুটি বেলার দায়িত্ব দিয়ে, নিজে রুটি ভাজতে লাগলেন। সামান্য মদ্যপানও হল। সে এক কাণ্ড। নবারুণদা মেতে গেলেন আড্ডায়। ভিলাইতে গিয়ে এক চিত্রশিল্পীর ছবি দেখে তিনি চিত্তপ্রসাদের কথা গভীরে বলেছিলেন মনে আছে। এ ছাড়া বাবা বিজন ভট্টাচার্য বা ঋত্বিক ঘটকের নাম তো প্রতি নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করতেন। নানা লেখায় তাঁদের কথা বারবার বলেছেন। বইমেলাতে ভাষাবন্ধনে গেলেই, তাঁদের কথা বলতেন।

নন্দীগ্রামের ঘটনার পর ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটে ভাষণ দিলেন। সংহতি জানালেন অশোকনগর ও যাদবপুরের কনভেনশানেও। কিষেণজি মারা যাওয়ার খবরে লিখলেন “চড়ুই” নামের অনবদ্য কবিতা। সেদিন ঘটনাচক্রে আমরা তাঁর বাড়িতে গেছিলাম। আমাদের একটি পত্রিকার জন্য পরবর্তীতে একটি কবিতা দিলেন কমিউনিস্ট পার্টি ও তাঁর সম্পর্ক নিয়ে। (এ লেখার সাথে কবিতাটি নীচের ছবিতে দেওয়া হল)

pot

 

আমাদের দলের সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের সাথেও ঘনিষ্ঠতা ছিল নবারুণদার। পরে যখন দিল্লি বা কেরালা গেলেন চিকিৎসার জন্য, আমাদের সদস্যরা ছুটে এসেছেন তাঁর কাছে।

কিন্তু লিবারেশনের তরফে কখনও সদস্য হতে পীড়াপীড়ি করা হয়নি। অতীতে বাবা নাগার্জুন যেমন সদস্য না হয়েও, জনসংস্কৃতি মঞ্চের সভাপতি ছিলেন, আমরা সেভাবেই তাঁকে পাটনা কনফারেন্সে জানাই, আপনি সদস্য না হলেও সমস্যা নেই। আমরা চাই আপনি স্বাধীন মনেই আমাদের পাশে থাকুন। পরামর্শ দিন। তিনি কিন্তু বারবার সে কথা রেখেছেন।

জীবনের প্রতি অমোঘ টান ছিল নবারুণদার। বারবার বলতেন, “অনেক কাজ বাকি আছে রে। শেষ করে যেতে হবে।” লেখার পাশাপাশি বারবারই রাস্তায় নেমেছেন। সাউথ সিটিতে ওঁকে একবার অপমান করায় রীতিমতো প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এ ছাড়াও, সোভিয়েত দেশ কার্যালয়ের সামনে তাঁর শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদের ও স্লোগানিংয়ের কথা তো সবাই জানেন আজ।

শিলিগুড়ি কনফারেন্সে সারারাত আড্ডার স্মৃতি আজও মনে পড়ে। কত গান গাইলেন নবারুণদা। বৌদিও গাইলেন। মুকেশ বড় প্রিয় ছিল নবারুণদার। বৌদি সব সময় শিশুর মতো আগলে রাখতেন ওঁকে। বাবাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন নবারুণদা। আগেই বললাম। বলতেন, “আমি বাবার ছেলে”। শুধু লিখে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই সম্ভব না। সেই তাগিদ থেকেই শরীর খারাপ নিয়েও ছুটে গেছেন দূরের কনফারেন্সগুলোয়। লোকাল ট্রেনে সাধারণ যাত্রীর ভিড়ে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। কখনও একটুও বিরক্ত হননি।

শেষ দিকের শরীর খারাপেও বারবার বলতেন, “দ্রুত সেরে উঠেই আদিবাসীদের মধ্যে চলে যাব বুঝলি। তারপর তোর বৌদিকে ওঁদের সাথে নাচতে পাঠিয়ে, লুকিয়ে আমরা মহুয়া খাব।” (হাসি) নবারুণদা লিখেছিলেন, কমিউনিস্টরা ফিরবেই। এবং দশ না দশ হাজার দিন ধরে দুনিয়া কাঁপাবে। চলে যাওয়ার কিছুদিন আগেও এ বিশ্বাস প্রতি নিঃশ্বাসে ছিল ওঁর রক্তে-মজ্জায় চোখে-নাকে। ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপালে বারবার সেন্সলেস হয়ে পড়ছেন, তার মধ্যেও একটু সজাগ হলেই আমাদের রাশিয়ার কথা বলছে ... এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে!

লাল পতাকা যুদ্ধে না গেলেও লাল হতে পারে। এই বিশ্বাসের প্রতি সম্মানে আমরা তাঁর চলে যাওয়ার পর দেহে জড়িয়ে দিলাম সেই পতাকা। নানা দলের তাতে সে সময় অসুবিধে সত্ত্বেও ওঁর ঘনিষ্ঠরা আমাদেরকেই সমর্থন করেছিলেন। আমরা স্লোগান দিয়েছিলাম, “লাল সেলাম”। তাঁকে নানা জন বলেছিলেন, বেলভিউতে চিকিৎসা করানোর কথা। বলেছিলেন, “না। মরলে সাধারণের মতোই মরব।” এবং তাই ঘটল।

আমার একটি গান নবারুণদার বড় প্রিয় ছিল। প্রায়ই গাইতে বলতেন। ফেরিওলার গান। ওঁর যাদবপুরের স্মরণসভায় সে গান গেয়েছিলামও। মানুষকে এড়িয়ে কোনও উন্নয়ন হতে পারে না। নবারুণদার এ বিশ্বাসের কথাই আছে আমার এ গানেও। আজ তাঁর স্মৃতিতে সে গান সবার জন্য তুলে দিলাম –

gam

 

“গামছা চাই গামছা নিন
হকারদের বাঁচতে দিন
ধ্বংসের মুখে তাঁতশিল্প
তাঁতিদের মুখে অন্ন দিন।
গামছা চাই, গামছা
গামছা চাই, গামছা
বিশ্বায়নের ফলে
কলে-মিলে তালা ঝোলে
হাজার শ্রমিক বেকার হচ্ছে
বেকার শ্রমিক হকার হচ্ছে
হকারেরা সব ছড়িয়ে পড়ছে
ফুটপাতে আর রেলে
গামছা চাই, গামছা
হকারের পোড়ো ঘরে
বৌটা সেলাই করে
ছেঁড়াখোড়া এই সংসারটা
জুড়তে চেষ্টা করে।
হকারের ছোট ছেলে
শিশুর হাসপাতালে
চিকিৎসাবিনা হারিয়ে গেছে
টাটা-বাইবাই বলে।
এঁদের জন্য হয় আইন
অপারেশান সানশাইন
মন্ত্রী-পুলিশ-বুলডোজার
মিলেমিশে সব একাক্কার
কলকাতা আজ লণ্ডন হবে
পেপসির বোতলে।
(ভাষ্য)
এসব দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমাদের কি আছে? আছে শুধু ভাঙা গলায় গান আর আছে গামছা।
(গান)
সে গামছা কোমরে কোষে
মাঝে মাঝে উঠি ফুঁসে
রাষ্ট্র যখন সন্ত্রাস করে
গরিবের ভাত-রুটি নেয় কেড়ে
রাষ্ট্রদোহী হয়ে উঠি আমি
দারুণ ক্ষোভে ও রোষে
গামছা চাই গামছা
গামছা চাই গামছা।।

(কথোপকথনের ভিত্তিতে অনুলিখন)
লেখা -- দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়

খণ্ড-27
সংখ্যা-24