স্বাধিকারের নিজস্ব অভিব্যক্তিতে উজ্জ্বল সুন্দর আজকের মেয়েরা
ggr

সম্প্রতি বহুজাতিক সংস্থা ইউনিলিভার বিশ্বে সর্বাধিক বিক্রীত ‘ফেয়ারনেস ক্রীম’ ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’-র নাম থেকে ‘ফেয়ার’ অর্থাৎ ফরসা শব্দটি বাদ দিয়েছে। আমেরিকার শাসকের ঘুম কেড়ে নেওয়া বর্ণবাদবিরোধী “ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস(বিএলএম)” আন্দোলনের বহুল-বিস্তৃত প্রভাবের ফল এই সিদ্ধান্ত, এমনটা মনে করছেন অনেকে। ইউনিলিভার উৎপাদিত ফেয়ার অ্যাণ্ড লাভলি পণ্যের বর্ণনায় ত্বকের রঙ উজ্জ্বল করার অর্থাৎ সৌন্দর্য বাড়ানো – এই বর্ণবাদী ছকে বাঁধা ভাষার প্রয়োগ প্রত্যাহার করবে বলে জানিয়েছে উক্ত সংস্থাটি।

গত জুন মাসের শেষদিকে ফেয়ার এন্ড লাভলি পণ্যের উৎপাদন রদ করার দাবিতে আঠারো হাজার মানুষের স্বাক্ষরিত দুটি পিটিশন জমা পড়ে। এই পণ্যের উৎপাদন, পরিবেশন ও বিক্রয় নীতির মূলে থেকেছে বর্ণবাদ ও পিতৃতন্ত্রের যৌথ পরিভাষা। বিএলএম আন্দোলন বর্ণবাদের নিগড়ে থাকা শ্বেতাঙ্গ শাসক শ্রেণীর আগ্রাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে নিঃসন্দেহে। পাশাপাশি পুঁজিবাদী উদারনীতির রন্ধ্রে লুকিয়ে রাখা প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদের মুখোশ খুলে দিয়েছে এই আন্দোলন। আমেরিকার মিনেসোটায় কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে উদ্বুদ্ধ বিএলএম আন্দোলনের প্রভাবে দুনিয়াজোড়া বহুজাতিক প্রসাধনী সংস্থাগুলি নিজেদের বিপননী কৌশল পুনর্মূল্যায়ন করে। এরই ফলস্বরুপ উইনিলিভারের পণ্যের বিপণনী প্রচারের অভিমুখে উপরুক্ত বদলের ঘোষণা। এই সংস্থার বিপণনের দায়িত্বে থাকা সানি জ্যানের কথায়, “‘ফেয়ার’ শব্দটি নির্দিষ্ট ত্বকের রঙকেই সৌন্দর্যের মাপকাঠি নির্ধারণ করে। আমরা এই মাপকাঠিকে সঠিক মনে করছি না। বরং বিশ্বজুড়ে সৌন্দর্যের বিভিন্নতাকে উদযাপন করার উদ্দ্যেশ্যেই আমাদের নীতি বদল।”

far

 

প্রসঙ্গত, ইউনিলিভার সংস্থার এই পণ্যের গ্রাহকদের মূল বাজার ভারত, পাকিস্থান, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড। সমাজতাত্ত্বিকদের মতে এই পণ্যগুলি বিক্রীর মূল ক্ষেত্র হয়ে এসেছে এশিয়া, আফ্রিকা ও ভারতবর্ষের অশ্বেতাঙ্গ অধিবাসীরা। হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের বাজারজাত ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’ প্রোডাক্টটি ভারতীয় বাজার থেকে বছরে লাভ করে ২,০০০ কোটি টাকা। “ইণ্ডিয়ান ফেয়ারনেস ক্রীম অ্যাণ্ড ব্লিচ মার্কেট” রিপোর্ট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল নাগাদ আলোচিত পণ্যের বার্ষিক লাভের অংক দাঁড়াবে ৫,০০০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ, পণ্যের নামের বদল ঘটলেও, ত্বকের রঙ উজ্জ্বলতর করার স্পৃহায় বদল ঘটার বিশেষ আশা নেই। এই রিপোর্ট বলছে, আধুনিক নারী চাকরি ক্ষেত্রে, বিবাহ প্রস্তাব বা সামাজিক সক্রিয়তার চাপ সামলাতে বিভিন্ন ব্রান্ডের প্রসাধনী দ্রব্যের দ্বারস্থ হয়ে থাকেন। নয়া উদারবাদের জমানায়, বিবিধের বিভিন্নতাকে সম্মানের গালভরা মিথ্যা থাকলেও, বহুলাংশে এই প্রসাধনী দ্রব্য কেনার মূলে থাকে ভারতীয় সমাজের প্রাতিষ্ঠানিকতায় নিহিত ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরুষতন্ত্র। সমাজে পুরুষের কাঙ্খিত দৃষ্টির খিদে মেটাতে ব্যর্থ নারী ব্রাহ্মণ্যবাদী সৌন্দর্যের সংজ্ঞায় সমাজে ব্রাত্য থেকে যায়। এই প্রসাধনী পণ্যাদির বিপণনী প্রচারে ত্বকের ঔজ্বল্যের সাথে নারীর ক্ষমতায়নের সমীকরণ প্রতিষ্ঠা হয়। যেমন, বিবাহের বিজ্ঞাপনে উজ্জ্বল ত্বক, স্লিম চেহারা ও উচ্চবর্ণের নারীর চাহিদা সর্বাধিক। কর্মক্ষেত্রে বা পরিবারে, সমাজের কোলাহলে বা নিভৃতে নারীর স্বীকৃতি শরীরের মেদে, চামড়ার রঙের নির্দিষ্ট মানদন্ডে নির্ধারিত।

at

 

ভারতে উপনিবেশিক শাসনকাল সাদা চামড়ার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার আদিকাল সুনিশ্চিত করে। পুঁজিবাদ ও ঔপনিবেশিকতার যৌথতায় তৈরি শ্রেণীবিভাগে সাদা চামড়া, বা ‘ফেয়ারার স্কিন’-এর অধিকারীরা সাধারণত অভিজাত বংশ বা উচ্চশ্রেণীর প্রতিনিধি। শ্রেণী-বর্ণ বিভক্ত সমাজের মানদণ্ডে রোদে, ঝড়ে, জলে খেটে-খাওয়া মানুষের চামড়ার রঙ তাই অপাংক্তেয়, অস্পৃশ্যতার প্রতীক। বৈদিক যুগ পরবর্তী সময়কালে আর্য ভারতে নারীর শরীর ও স্বায়ত্বের সীমানা টানা হয় জাতিভেদ প্রথা দ্বারা। পরবর্তীতে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বা স্বাধীনতা-পরবর্তী শাসকশ্রেণী ভারতীয় নারীর শরীরের লাগাম নিজের হাতে রাখতে চেয়েছে। তাই, সামাজিক পণ্যের মতো নারীর শরীরকে শাসক শ্রেণীর প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে রাখার দায় বর্তেছে নারীর উপর।

ms

 

বর্তমানে, মোদী জমানায় হিন্দু নারীর আদর্শ চেহারা ও গতিবিধির নিয়ম চেপে বসেছে নারীর ক্ষমতায়নের বিপ্রতীপে। ছেলেবেলা থেকে কালো মেয়েদের চামড়ার রঙের জন্য পরিবার, আত্মীয়, সমাজ থেকে পাওনা হওয়া কটুক্তি (পড়ুন, হেনস্থার) অভিজ্ঞতা সর্বজনবিদিত। ১৯৭৫ সাল থেকে ভারতের বাজারে ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’ মেয়েদের স্বাধীনতা আর স্বায়ত্বতার অধিকারের অবমাননা করেই ব্যবসা চালাচ্ছে। পুঁজিপতির লাভের ঘড়া পুর্ণ হচ্ছে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রত্যাশাকে মূলধন করে। হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের ‘ফেয়ার’ শব্দ বাদ রাখার ঘোষণা বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলনের পার্শ্বিক ফসল হলেও, এই অবস্থান যে কোনও জনপ্রিয় প্রবণতাকে পুঁজিতে পরিণত করার প্রাচীন কৌশলের দিকনির্দেশ করে। নারীর স্বাধীনতার আকাঙ্খার পরিপন্থী পুঁজিবাদ। সমাজে নির্মিত, পুঁজিবাদের টিকিয়ে রাখা শৃঙ্খল ছিঁড়ে বিভিন্নতায় ঐক্যবদ্ধ নারী বিনির্মান করছে সৌন্দর্য ও নারীত্বের সংজ্ঞা। বিএলএম আন্দোলন বা শাহীনবাগের প্রতিবাদ-সমাজকে ফ্যাসিবাদ-পুঁজিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে মেয়েরা। ইউনিলিভার সহ অন্যান্য কর্পোরেটদের নয়া বিপণন ছক তারা সহজেই বুঝবে। বহুজাতিক সংস্থার মলম দ্বারা নির্ধারিত নয়, সমানাধিকার ও সমমর্যাদার অভিব্যক্তিতে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে আজকের নারীর চেহারা।

-- সম্প্রীতি মুখার্জী 

খণ্ড-27