তামিলনাড়ুর পুলিশি নৃশংসতায় মূর্ত ভারতীয় রাষ্ট্র
pul

তাদের কার্যধারার মধ্যে তারা যে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারকেই বহন করছে, ভারতের পুলিশ বাহিনী প্রতিদিনই তার প্রমাণ দিয়ে চলেছে। এ দেশের জনগণের সুরক্ষার চেয়ে তাদের ওপর অত্যাচার ও দমনের যে লক্ষ্য নিয়ে ব্রিটিশের পুলিশ বাহিনী চালিত হত, স্বাধীন দেশের জনগণের সাপেক্ষে সার্বভৌম রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীর মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গিতে তার চেয়ে খুব একটা ইতরবিশেষ দেখা যায় না। ভারতে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও পুলিশি হেফাজতে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে ঔপনিবেশিক আমলের পুলিশি সংস্কৃতিকে। তামিলনাড়ুর থুতুকুড়ির এক থানায় বাবা ও ছেলের ওপর অত্যাচার ও তার পরিণামে তাদের মৃত্যুকে এ ছাড়া আর কিই বা বলা যেতে পারে। মোবাইল ফোনের দোকান চালাতেন ৫৯ বছরের পি জয়রাজ। থুতুকুড়ির সাথানকুলাম থানার পুলিশ এসে ১৯ জুন তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। ঘোষিত অপরাধ — লকডাউনে যতটা সময় দোকান খুলে রাখার অনুমতি ছিল তিনি নাকি তার চেয়ে ১৫ মিনিট বেশি দোকান খুলে রেখেছিলেন। সে সময় অন্যান্য দোকানও খোলা ছিল বলে অনেকে জানিয়েছেন, আর তাই অননুমোদিত সময়সীমার পরও দোকান খুলে রাখার চেয়ে পুলিশের অন্য অভিসন্ধিই তাঁর গ্ৰেপ্তারের পিছনে কাজ করেছে বলে মনে হয়। সে যাই হোক, বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ৩১ বছর বয়স্ক ছেলে জে রেনিক্স বাবার খোঁজে থানায় গেলে পুলিশ তাঁকেও গ্ৰেপ্তার করে। এরপর থানায় নির্মম অত্যাচারে দুজনেরই অবস্থার অবনতি ঘটলে ২২ জুন তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয় — ছেলে রেনিক্স ২২ জুন রাতেই মারা যান আর বাবা পি জয়রাজ মারা যান পরদিন সকালে। পুলিশি অত্যাচারের আর পাঁচটা ঘটনার মত এটাও হয়ত দস্তুর বলেই গণ্য হত আর ধামাচাপা পড়াই তার নিয়তি হয়ে উঠত। কিন্তু অত্যাচারের অকাট্য প্রমাণ, বাড়ির পরিজনদের জোরালো প্রতিবাদ, আদালতের হস্তক্ষেপ, সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলা আলোড়ন সারা দেশকেই নাড়িয়ে দেয় এবং সরকারের পক্ষেও কিছু পদক্ষেপ গ্ৰহণ করা ছাড়া উপায় থাকে না।

torture

 

থানায় কী ধরনের অত্যাচার তাঁদের ওপর চালানো হয়েছিল? অভিযোগ, প্রথাগত প্রহার ছাড়াও মলদ্বারে লাঠি ঢুকিয়ে নির্যাতন, ছেলের পিঠ থেকে মাংস খুবলে নেওয়া, বুকের রোম ছিঁড়ে নেওয়ার মত নৃশংসতা তাঁদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছিল। ‘থার্ড ডিগ্ৰি’-র এই বাড়বাড়ন্ত স্বাধীন ভারতের পুলিশি হেফাজতে কেমন স্বাভাবিক ব্যাপারই না হয়ে উঠেছে। পুলিশ যথারীতি মিথ্যা ঘটনার অবতারণা করে অত্যাচারের অভিযোগ থেকে রেহাই পাবার চেষ্টা করে। তারা বলে — গ্ৰেপ্তার করার আগেই বাবা ও ছেলে রাস্তায় পড়ে আহত হয়েছিল আর সেটাই তাদের মৃত্যুর দিকে নিয়ে গেছে। কিন্তু স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মোবাইলে তোলা ছবি পুলিশের বয়ানকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। পুলিশি অত্যাচারের ঘটনা সামনে আসায় মাদ্রাজ হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঘটনার তদন্ত করে। ময়না তদন্তের রিপোর্টে বাবা ও ছেলের দেহে একাধিক আঘাতের চিহ্নের উল্লেখ থাকে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি উল্লেখ করেন — “অভিযুক্ত পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজুর যুক্তিসংগত কারণ এবং প্রমাণ রয়েছে”। পরিস্থিতির চাপে এক হেড কনস্টেবলও নির্মম অত্যাচার হওয়ার সাক্ষ্য দেয়। তামিলনাড়ুর রাজ্য সরকার অবশেষে কিছু ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। ঘটনার তদন্ত সিবিআই-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, দুই সাব ইন্সপেক্টর, দুই কনস্টেবল এবং অন্য দুই ব্যক্তিকে খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং থুতুকুড়ি জেলার এসপি-কেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবার মনে যে প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিকভাবেই জাগছে তা হল — দোষী পুলিশরা কি আদৌ শাস্তি পাবে?

কিছু পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। ২০০১ সাল থেকে ২০১৮র মধ্যে পুলিশি হেফাজতে ১৭২৭ জনের মৃত্যু ঘটেছে বলে সরকারী খাতায় নথিবদ্ধ রয়েছে। এরমধ্যে হেফাজতে হিংসা চালানোর জন্য মাত্র মাত্র ২৬ জন দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। আর একটা তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে পুলিশি হেফাজতে প্রায় ১০০ জনের মৃত্যু হলেও একজন পুলিশ অফিসারও দোষী সাব্যস্ত হয়নি। তথ্য আরও জানাচ্ছে, ২০১৯ সালে হেফাজতে মারা গেছে ১৭৩১ জন (এর মধ্যে পুলিশি হেফাজতে ১২৫ জন ও বিচার বিভাগীয় হেফাজতে ১৬০৬ জন)। অর্থাৎ, প্রতিদিন গড়ে পাঁচজন কোনো না কোনো হেফাজতে মারা যাচ্ছে, আর এরজন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ঘটনা যে নগন্য তা বলাই বাহুল্য। তবে, এই পরিসংখ্যানের মধ্যে দিয়ে যে প্রকৃত ছবি বেরিয়ে আসছে এমন নয়। কেননা, হেফাজতে অনেক মৃত্যুর খবরই প্রকাশ্যে আসে না বা নথিবদ্ধ হয় না। আর, দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার অবধারিত কৌশল হয়ে ওঠে হেফাজতে মৃত্যুর কারণ হিসাবে কোন ব্যাধিকে দেখানো, অর্থাৎ, মৃত্যু অত্যাচারের কারণে হয়নি বলে প্রতিষ্ঠিত করা। অবশ্য, শুধু তামিলনাড়ুর পুলিশই যে হেফাজতে নির্মম অত্যাচার চালানো, বিচার বিভাগ নির্ধারিত দণ্ডের বাইরে ঘটানো হত্যার ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির ধারক হয়ে রয়েছে, এমন মনে করাটাও ভুল হবে। রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো পুলিশ বাহিনীও শাসকদের, ধনীদের ‌সেবায় নিয়োজিত হয় এবং গোটা রাষ্ট্রটারই পুলিশি বৈশিষ্ট্য অর্জনের অভিমুখ অত্যন্ত প্রবল হয়েই সামনে এসেছে।

trr

 

ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ায় রাষ্ট্রকে মুড়ে দেওয়া হচ্ছে গণতন্ত্রহীনতার বর্মে। যে কোন সরকার বিরোধিতার ওপরই নেমে আসছে দমনের খাঁড়া। ছাত্র আন্দোলনের দমনে চলছে সুপরিকল্পিত ও সমবেত রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। সমাজ আন্দোলনের কর্মীদের ওপর চলছে পাইকারি হারে গ্ৰেপ্তারি। সিবিআই ও এনআইএ-কে আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিরোধীদের ওপর, চরিতার্থ করা হচ্ছে প্রতিহিংসা। ইউএপিএ, রাষ্ট্রদোহিতার মত দানবীয় আইনের ঘটছে আকছার প্রয়োগ। সংখ্যালঘু নিধন ও উৎপীড়নকে পুরোপুরি নগ্ন করে তোলা হয়েছে। সাংবিধানিক অধিকারকে পরিণত করা হচ্ছে বর্জনীয় বস্তুতে, মানবাধিকার হয়ে উঠছে অস্তিত্বহীন পদার্থে। আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা যাবতীয় অনাচারে মদত যোগাচ্ছেন। কি করে ভোলা যাবে ২০১৮র গোড়ার দিকে ‘বলাৎকারী বাঁচাও আন্দোলনের’ কথা, যখন জম্মু ও কাশ্মীরের বিজেপি মন্ত্রী ও বিধায়করা বাকেরওয়াল গুজ্জর সম্প্রদায়ের নাবালিকার ধর্ষকদের গ্ৰেপ্তারের বিরোধিতায় রাস্তায় নামলেন! উন্নাওয়ের অপ্রাপ্তবয়স্ক বালিকা উত্তরপ্রদেশের বিজেপি বিধায়কের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ জানালে তার বাবাকে ধরে নিয়ে এসে হেফাজতে পুলিশের মেরে ফেলার কথাও তো ভুলিয়ে দিতে চাইলেই ভোলা যাবে না। উত্তরপ্রদেশ কি পুলিশি দৌরাত্ম্যের রাজ্য হয়ে ওঠেনি যেখানে বিচার ছাড়াই ‘দুর্বৃত্ত’ অভিযোগে বহুসংখ্যক মানুষকে পুলিশের মেরে ফেলাটা প্রশাসনের কাছে শ্লাঘার ব্যাপার হয়ে উঠছে! হালফিলের দিল্লীর দাঙ্গায় যেভাবে  মূল উস্কানিদাতাদের ছেড়ে দিয়ে জড়িত না থাকাদের ওপর মিথ্যা অভিযোগে পুলিশি নিপীড়ন নামানো হল, নির্যাতন ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার যে সাক্ষ্য রাখা হল, তা তো দেশের মানুষের চোখের সামনেই ঘটল। সর্বোপরি, অবশীভূত সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমও ক্রমেই আরও বেশি করে শাসকের আক্রমণের মুখে পড়ছে। আর, আজ যাঁরা কেন্দ্রে শাসন ক্ষমতায়, গুজরাটে সংখ্যালঘু নিধন যজ্ঞ, ‘এনকাউন্টার’ তথা ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যার বিপুল অভিজ্ঞতায় তাঁরা তো নিজেদের সমৃদ্ধ করেছেন। অতএব, তামিলনাড়ুর হেফাজতে হত্যার ঘটনার মধ্যে আজকের ভারতীয় রাষ্ট্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই মূর্ত হয়ে উঠেছে। এই ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবি তোলার সাথে-সাথে সারা দেশের প্রতিও আমাদের দায়বদ্ধতার প্রমাণ রাখতে হবে। ভারতকে পুলিশ রাষ্ট্র করে তোলার যে উপক্রম চলছে, তাকে প্রতিহত করতে আমাদের, ভারতের জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে।

-- জয়দীপ মিত্র  

খণ্ড-27