আজকের দেশব্রতী : ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২২ (অনলাইন সংখ্যা)
Ajker-Deshabrati-24-February-2022

Political Terror in West Bengal

কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও সিএএ বিরোধী প্রতিবাদের পরিচিত মুখ আনিস খানকে যেভাবে হাওড়া জেলার আমতায় তাঁর নিজের তিনতলা বাড়ির ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিয়ে ভয়ানকভাবে হত্যা করা হল তা যথোচিতভাবেই পশ্চিমবঙ্গে বিপুল গণক্রোধের সৃষ্টি করেছে। তাঁর বাবা বলেছেন, ১৮ ফেব্রুয়ারির মাঝরাতে পুলিশের পোশাকে একটি দল তাঁদের বাড়িতে জোর করে ঢুকে পরে এবং যখন তাদের মধ্যে একজন তাঁকে বন্দুক ঠেকিয়ে আটকে রাখে তখন অন্যরা উপরে উঠে আনিসকে ছাদ থেকে ফেলে দেয়। যখন আহত আনিস আঘাতের ফলে মারা যায়, ওই বাহিনী আনিসের পরিবারকে আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।

এই জঘন্য খুন বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে ধরেছে। জেলা পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় থানা সরকারিভাবে ওই ঘটনায় পুলিশের জড়িত থাকা অস্বীকার করেছে। তাহলে কি গুন্ডারা পুলিশের পোশাক পরে খুন করেছিল? নাকি এটি স্থানীয় পুলিশের একটি অংশের অননুমোদিত অংশগ্রহণ ও পৃষ্ঠপোষকতায় একটি যৌথ আক্রমণ ছিল? হত্যাকারীরা কি শাসক টিএমসি’র স্থানীয় সংগঠনের সহায়তা পেয়েছিল? অঞ্চলে টিএমসি’র তুলনামূলকভাবে খারাপ নির্বাচনী ফলের জন্য তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে উত্যক্ত করার বিরুদ্ধে ২০২১’র ২৪ মে আমতা থানায় আনিসের করা অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্দিষ্টভাবে এই প্রশ্নটির জন্ম। ওই অভিযোগপত্রের বয়ান অনুসারে নিজের নিরাপত্তার জন্য আনিসকে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছিল।

আমতা থানা ওই চিঠির ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা জানা যায়নি। আনিসের ভয়ানকতম আশঙ্কাটি সত্যি হল। আনিস খানের খুন থেকে ওঠা প্রশ্নগুলি দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি করছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই যখন স্বরাষ্ট্র দফতরের দায়িত্বে, তখন সরকারকে সর্বোচ্চস্তরে এব্যাপারে মুখ খুলতে হবে। এই জঘন্য খুনের ক্ষেত্রে ন্যূনতম পক্ষে একটি বিশ্বাসযোগ্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও দ্রুত বিচার সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় পুলিশের যোগসাজশ ও গাফিলতিরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করতে হবে এবং প্রশাসনিক দায়বদ্ধতার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আমতার ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও পুলিশী স্বেচ্ছাচারিতার পুনর্নবীকৃত নকশার একটি উদাহরণ। এই জঘন্য খুনের কিছুদিন আগেই দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার নরেন্দ্রপুর থানায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার কর্মীদের উপরে থানা হাজতে হাড় হিম করা অত্যাচার প্রত্যক্ষ করেছিল পশ্চিমবঙ্গ। সামাজিক মাধ্যমে লেখার জন্য একজন দলিত লেখককে থানায় উত্যক্ত করার প্রতিবাদে থানার সামনে জড়ো হওয়া এআইএসএ, এআইপিডব্লিউএ ও এপিডিআর কর্মী ও ছাত্রদের কয়েক ঘন্টা ধরে বর্বরভাবে আঘাত ও দুর্ব্যবহার করা হয়। ৩ জন মহিলাসহ অন্ততপক্ষে ১১ জন কর্মীর উপরে বর্বর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করা হয়। একজন পরীক্ষার্থী ছাত্রী সমেত ছাত্রদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য এমনকি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আবেদনকেও পুলিশ রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। ওই কর্মীদের আদালতে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়।

Alarming Signs of Police Highhandedness

বীরভূম জেলা আরেকটি সন্ত্রাসের নাট্যশালা হিসেবে উদিত হয়েছে যেখানে ক্রমবর্ধমান জনবিরোধিতা সত্ত্বেও একটি কয়লাখনি প্রকল্পের জন্য সরকার উঠে পড়ে লেগেছে। দেউচা-পাঁচামী-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙ্গা এলাকায়, ভারতের সর্ববৃহৎ কয়লার ব্লক হিসেবে বিজ্ঞাপিত কয়লাখনি প্রকল্প বিপুল সংখ্যক স্থানীয় অধিবাসীকে উচ্ছিন্ন করবে, যাদের অর্ধেক হল আদিবাসী, এবং পরিবেশের বিপুল মাত্রায় ক্ষতি করবে। অনুরূপ বিপুলাকার প্রকল্পের জন্য আইন অনুসারে সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাবের সমীক্ষা এবং জনশুনানি ও জনআলোচনা আবশ্যিক। কিন্তু দেউচা-পাঁচামী’তে এপর্যন্ত প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়েছে ও সেবিষয়ে তথ্যানুগ জনমতের সুব্যবস্থিত কণ্ঠরোধ করে চলেছে।

আশঙ্কা ও বিরোধিতা প্রদর্শনকারী আদিবাসীরা বীরভূমের টিএমসি’র পেশীপ্রদর্শক অনুব্রত মন্ডলের অনুগত গুন্ডা ও পুলিশের সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন। নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত এবং অধিবাসীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য এলাকায় পরিদর্শনে যাওয়া নাগরিক সমাজের কর্মীরা নিয়মিত হুমকি ও মারধরের সম্মুখীন হচ্ছেন। অতি সম্প্রতি ২০ ফেব্রুয়ারি দেওয়ানগঞ্জে একটি শান্তিপূর্ণ জনসভার পরে জমি, জীবিকা এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য তৈরি হওয়া একটি মঞ্চের বেশ কয়েকজন কর্মী ও স্থানীয় অধিবাসীদের আটক করা হয় ও ভুয়ো মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখাতে ব্যস্ত আদানি গোষ্ঠির এই লোভনীয় কয়লা খনি প্রকল্পের উপর দৃষ্টি পড়েছে।

গত এপ্রিল-মে ২০২১-তে রাজ্যে বিজেপি’র ক্ষমতা দখলের চেষ্টাকে বিফল করতে পশ্চিমবঙ্গ সজোরে ভোট দিয়েছিল। এই বিজেপি বিরোধী রায়ের সর্বোচ্চ সুবিধা লাভ করেছিল টিএমসি এবং বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্টতা ও ভোট শতাংশ নিয়ে পরপর তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফিরেছিল। টিএমসি’র এই জয় পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক যাত্রাকে বিপরীতমুখী করেছিল — যেসব দলবদলুরা নির্বাচনের আগে বিজেপি’তে যাওয়ার জন্য লাইন দিয়েছিল তারা এখন পালে পালে টিএমসি’তে ফিরছে। রাজনৈতিক হিংসা ও পুলিশী স্বেচ্ছাচারিতার নতুন নকশা ইঙ্গিত করছে যে আত্মতুষ্ট শাসকদল জনগণকে পাত্তাই দিতে চাইছে না।

যদি এই ধারা চলতে থাকে তাহলে পশ্চিমবঙ্গে আইনের শাসন বিপন্ন হবে এবং রাজ্য অনাচার, সন্ত্রাস এবং পুলিশী স্বেচ্ছাচরিতার রাজত্বে নিমজ্জিত হবে। সেটাই হবে ২০২১’র নির্বাচনী রায়ের সর্বাধিক উপহাস। বিজেপি যাতে জল ঘুলিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরতে না পারে সেইজন্য প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিকেই গণতন্ত্রের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে ও জনগণের ক্রোধ ও আকাঙ্খাকে ইতিবাচক অভিমুখে নিয়ে যেতে এগিয়ে আসতে ও উদ্যোগ বাড়িয়ে তুলতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের অলিগলিতে রাজপথে জনগণের উদ্দীপ্ত এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ উত্থানই কেবল রাজ্যে দানা বাঁধতে থাকা সঙ্কটের প্রত্যুত্তর দিতে পারে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২)

CPIML Statement

রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্তে সামরিক আগ্রাসন জাহির করায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বর্তমান সংকটের নিরসন আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবেই করতে হবে, এবং ইউক্রেনের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ভিত্তিতেই তা হতে হবে।

এই সংকটের আশু প্রশমনে রাশিয়াকে ইউক্রেন সীমান্ত থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিতে হবে। রাশিয়া এবং তার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোকেও ইউক্রেনে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে। রাশিয়া এবং ইউক্রেন যে দুটো মিনস্ক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে তার ভিত্তিতেই তাদের কূটনৈতিক সমাধানে পৌঁছতে হবে।

ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গ্রেট ব্রিটেন সরকার যুদ্ধে যে প্ররোচনা দিয়ে চলেছে আমরা তাকে ধিক্কার জানাচ্ছি। ন্যাটোকে তার পূবমুখী সম্প্রসারণ থামাতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গ্ৰেট ব্রিটেন যে ন্যাটোকে আত্মরক্ষামূলক জোট বলে দাবি করছে, তার বিপরীতে বিগত এক প্রজন্মকাল ধরে আফগানিস্তান, যুগোস্লাভিয়া এবং লিবিয়ায় তাদের কীর্তিকলাপ সুস্পষ্ট রূপেই তাদের সাম্রাজ্যবাদী অভীপ্সাকেই প্রতীয়মান করে, ইরাকের ওপর মার্কিন-ব্রিটিশ হানাদারির কথা না হয় না বলাই হল। রাশিয়া সহ সারা ইউরোপের যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলনগুলোর প্রতি আমরা সংহতি জানাচ্ছি, এবং ইউরোপে নতুন করে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিতে পৌঁছানোর ও পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের দিকে এগিয়ে যাবার যে উদ্যোগগুলো গোটা মহাদেশে চলছে আমরা সেগুলোকে স্বাগত জানাচ্ছি।

- সিপিআই (এম-এল) কেন্দ্রীয় কমিটি

Statement on Ukraine

(পুনশ্চঃ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দুই অঞ্চল ডোনেৎস্ক ও লুহানস্ক-কে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করেছেন এবং এই দুই অঞ্চলে প্রবেশ করতেও রুশ সেনাদের নির্দেশ দিয়েছেন। দুই অঞ্চলে রুশ ভাষাভাষী মানুষের বাস এবং তারা মস্কোর প্রতি অনুগত হলেও এই আগ্ৰাসন মেনে নেওয়া যায় না। রাশিয়ার এই পদক্ষেপ খুব স্বাভাবিক ভাবেই ইউক্রেন পরিস্থিতিকে জটিলতর ও আরও সংকটময় করে তুলেছে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অন্যান্য আরো কয়েকটা অঞ্চলের মতো ইউক্রেনও সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৯১ সালে। এরপর ২০১৪ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইউক্রেনের রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ সরকারের পতন ঘটানো হয় এবং তার জন্য রাশিয়া আঙুল ওঠায় আমেরিকা এবং পশ্চিম দুনিয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে। ইউক্রেনে সরকারের এই পরিবর্তনের পর রাশিয়া ২০১৪ সালে ইউক্রেনের অংশ ক্রাইমিয়া দখল করে তাকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আবার আমেরিকা-ব্রিটেনের বশংবদ বলেই সমধিক পরিচিত।

ইউক্রেনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আমেরিকা এবং ব্রিটেন ও পশ্চিম দুনিয়ার অন্যান্য দেশ রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সংসদে জানিয়েছেন, ইউক্রেনে সেনা ও যুদ্ধ সরঞ্জাম পাঠিয়ে তাঁরা ইউক্রেন সরকারকে সাহায্য করছেন। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রাশিয়া এবং পশ্চিম দুনিয়ার সংঘাত কি প‌থিবীকে আবার বিপন্ন করে তুলবে? আগামী বৃহস্পতিবার ২৪ ফেব্রুয়ারি জেনিভায় মার্কিন বিদেশ সচিব ব্লিঙ্কেন এবং রুশ বিদেশ মন্ত্রী সের্গেই লাভারভের মধ্যে বৈঠক হওয়ার কথা। আমরা চাই, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে যুক্ত করে আলোচনা হোক এবং সেই আলোচনায় ইউক্রেনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকার করে নিয়ে রাশিয়া এবং পশ্চিম দুনিয়া ইউক্রেনে হস্তক্ষেপ থেকে দূরে থাকুক। — সম্পাদকমন্ডলী, আজকের দেশব্রতী)

BJP is busy slandering

আনিস হত্যাকাণ্ডোর বিচার চাই, হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই দাবিতে কলকাতা থেকে শুরু করে দক্ষিণবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গ যখন উত্তাল, এই পরিস্থিতি থেকে শাসক তৃণমূল যখন পরিত্রাণ কিভাব মিলবে বুঝে উঠতে হিমসিম খাচ্ছে, তখন রাজ্য বিধানসভায় বিরোধীদল হয়ে থাকা বিজেপিকে এই উথাল পাথাল ইস্যুতে রাস্তায় দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে না। বিজেপির বিধায়ক ইতস্তত বলছেন, দলনেতা আনিসের পরিবার চাইলে পাশে থাকবেন। কিন্তু সেটা আসলে চূড়ান্ত ভেক। গত বিধানসভা নির্বাচনে ‘সংখ্যালঘু তোষণমুক্ত’ বাংলা তৈরির বাজি ধরে ব্যর্থ হওয়ার পর কি আনিস হত্যার বিচার চাওয়া যায়? মানুষ সেটা বরদাস্ত করবে না। ওনাদের দলও অনুমোদন করবে না। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিজেপির উত্তর কলকাতা জেলা সভাপতি ভাষা আন্দোলনের দিবসে আনিস হত্যার ইস্যুতে একটা কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু তিনি দলের রাজ্য কোর পরিচালনবর্গের অন্তর্ভুক্ত নন এবং যথারীতি সেখান থেকে অনুমোদন পাননি। বরং দলে ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতাবান নেতারা দিবসের কর্মসূচির বিষয়টি দিলেন ঘুরিয়ে। দল অবশেষে আনিস হত্যার ইস্যু খারিজ করে পালন করল সাড়ে তিন বছর আগের দাড়িভিটার আন্দোলনে নিহত ছাত্রদের স্মরণ কর্মসূচি। বিজেপির কাছে ঐ ইস্যুটা ছিল বাংলা মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উর্দু পড়ানোর শিক্ষক নিয়োগের বিরোধিতার নামে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সেইমতো এবারও একই মনোভাব থেকে বিজেপি আনিস হত্যাকান্ডের ইস্যুতে কুৎসা প্রচার জুড়তে ছাড়েনি। আনিস আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা তরুণ তুর্কী। প্রগতি আন্দোলনের সহচর। একইসঙ্গে এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনে সামনের সারির এক সাহসী পরিচিত মুখ। ২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে বাংলায় রুখে দেওয়ার পেছনেও আনিসের ভূমিকা ছিল নির্ভীক সক্রিয়। বিজেপি এসব যথেষ্ট নজরদারিতে রেখেছিল। আর ওরা ক্ষমতায় আসতে পারলে নিশ্চিতভাবেই আনিসদের নিশানা করত। তাই বিজেপির পক্ষে আনিস হত্যার বিষয়ে বিহিত চেয়ে সরব হওয়া মুশকিল। বরং বিরত থাকার অবস্থান সম্পর্কে দলের প্রভাবিত সামাজিক ভিত্তিকে বশে রাখতে প্রচার করতে হচ্ছে জঘন্য কুৎসা। সামাজিক মাধ্যমে আনিসের ও আনিস সম্পর্কে বিভিন্ন পোস্ট থেকে নাকি বুঝে নেওয়া যায় তার সাথে নাকি ‘ভারতবিরোধী শক্তির যোগাযোগ ছিল!’ সেই একই মিথ্যাচার! ভূয়ো প্রচারের শয়তানি! এইসব বলেই ওরা উত্তরের সীমান্ত উপত্যকার যুবশক্তিকে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদে আন্দোলনে আপসহীন একরোখা থাকা ছাত্রসমাজকে অহরহ ‘দেশবিরোধী’ ‘দেশকে টুকরো টুকরো করা’র অভিযোগে দাগিয়ে দিতে চায়। তাই বিজেপির কাছে আনিস হত্যার ঘটনায় ন্যায়বিচারের দাবি তোলার কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই। বরং চেষ্টায় থাকবে যাতে আনিসের মৃত্যুকে স্মরণ করে এনআরসি-সিএএ বিরোধী প্রচার যাতে দানা বেঁধে অব্যাহত থাকতে না পারে। এই সময়ে দেখাও গেল, রাজ্য বিজেপি নেতারা বলে বেড়াচ্ছেন, ‘একজন মুসলিম মারা গেছে, তাই সবাই এখন খুব ঝাঁপাচ্ছে ...’। আর জেলায় জেলায় সফরের প্রচারে বিজেপি রাজ্য সভাপতি দর্প দেখাচ্ছেন, আজ হোক-কাল হোক সিএএ-এনআরসি করা হবে।

এর বিপরীতে, তাই সমান নাগরিকত্বের অধিকারকে সংখ্যালঘু বিদ্বেষী কোপে টুকরো করার অভিলাষ কখন কি রূপ নেয় সে বিষয়ে মোকাবিলায় এতটুকু শিথিলতা দেখালে চলবে না। এই চেতনায় আনিস হয়ে থাকুক প্রেরণার নজির।

Karnataka Hijab Row

উত্তরপ্রদেশ এবং অন্য চারটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যে, বিজেপি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীব্র করে তোলার পথ খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। হরিদ্বারে আমরা দেখেছি ‘ধর্ম সংসদের’ ছদ্ম-আবরণে এক বিদ্বেষ-জমায়েত থেকে প্রকাশ্যে গণহত্যার আওয়াজ তোলা হয়েছে। সেই আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি প্রকাশ্য সভায়। ইতিমধ্যে, সঙ্ঘ-বিজেপি বাহিনীর দক্ষিণী গবেষণাগার কর্ণাটক, মুসলিম মহিলাদের পরিধেয় হিজাবে এক শক্তিশালী হাতিয়ার আবিষ্কার করে ফেলেছে! উদুপি’র একটি কলেজ থেকে শুরু হয়ে এখন হিজাব-পরা কার্যত নিষিদ্ধ হল কর্ণাটকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে। কারণ হাইকোর্ট সরকারি আদেশনামার উপর স্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকার করেছে। আর অন্যদিকে কর্ণাটক জুড়ে উচ্ছৃঙ্খল ভীড়-তাণ্ডব হিজাব-পরিহিতা মহিলাদের পিছু ধাওয়া করে উত্যক্ত করে চলেছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলিম মহিলাদের হিজাব পরার অধিকার অস্বীকার করাকে ইতিমধ্যেই ‘হিজাব জিহাদ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে, ঠিক যেমনটা ভিন্নধর্মের মধ্যে বিয়েকে ‘লাভ জিহাদ’ আখ্যা দিয়ে তার অপরাধীকরণ করা হয়েছে। উত্তরাখণ্ডের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারে ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর উত্তরপ্রদেশের এক বিজেপি এমএলএ তো মুসলিমদের টুপি পরা বন্ধ করে তাদের কপালে ফোঁটা তিলক কাটিয়ে ছাড়বেন বলে ভোট চাইছেন! এথেকেই অত্যন্ত পরিষ্কার যে, এই হিজাব-হাঙ্গামা ভোট-মুখী রাজ্যগুলিতে বিজেপি’র নির্বাচনী প্রচারকে ‘উৎসাহিত’ করার জন্যই খুব ঠাণ্ডা মাথায় হিসেব কষে শুরু করা হয়েছে। হিজাব ও টুপি মুসলিম-পরিচিতির বিশিষ্টতম চিহ্নগুলোর অন্যতম। তাই ‘অভিন্ন দেওয়ানীবিধি’ নিয়ে বিজেপি’র এই হৈচৈয়ের মূল উদ্দেশ্য মুসলিম-পরিচিতির এই স্বাতন্ত্র্য চিহ্নগুলিকে অদৃশ্য করে দেওয়া এবং এইভাবে বৈচিত্র্যময় ‘ভারতীয়’ পরিচয়কে মুছে দিয়ে আরএসএস-নির্দেশিত এক অভিন্ন পরিচিতি সবার জন্য সবক্ষেত্রে চাপিয়ে দেওয়া।

হিজাব-নিষেধাজ্ঞা বেশ কয়েকটি প্রশ্নে সংবিধান-সুরক্ষিত মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করেছে। এক্ষেত্রে খুব স্পষ্টভাবেই একজন মহিলার নিজের পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরার মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে। স্কুল এবং কলেজ ইউনিফর্ম সবসময়ই সিঁদুর, মঙ্গলসূত্র, পাগড়ি এবং হিজাব সহ বিভিন্ন ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য চিহ্নগুলো মেনে নিয়েছে। কিন্তু মহিলাদের পোশাক বিধিনির্দেশ করে দেওয়ার প্রবণতা সাম্প্রতিককালে স্পষ্টভাবে বাড়ছে। এই হিজাব-নিষেধাজ্ঞা ঠিক একইভাবে মেয়েদের পছন্দমত পোশাক পরার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করছে। যেমনটা জিনস পরিহিতা মেয়েদের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝেই শুনতে পাওয়া যায় খাপ পঞ্চায়েতের ফতোয়া। হিজাব ধর্মীয় বিশ্বাস ও পরিচিতির সঙ্গে অনেকটাই সম্পর্কিত, শিখ পুরুষদের ক্ষেত্রে যেমন পাগড়ি। এই নিষেধাজ্ঞা তাই ধর্মীয় স্বাধীনতারও লঙ্ঘন।

Southern Laboratory of bjp

কর্ণাটক সরকার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে বন্ধ করেছে। কলেজে হিজাব পরে আসা মেয়েরা কখনও শান্তি শৃঙ্খলার কোনও সমস্যা সৃষ্টি করেনি। এবিভিপি এবং সঙ্ঘ বাহিনীর অন্যান্য সংগঠনের উচ্ছৃঙ্খল ভীড়-তাণ্ডব মানবাধিকার এবং ক্যাম্পাসের শান্তি — উভয়কেই বিপন্ন করেছে। একলা মেয়ে মুস্কান খানকে গেরুয়া চাদর উড়িয়ে হেনস্থা করতে করতে তাড়া করে চলেছে এক দঙ্গল পুরুষ — এই ভিডিও অত্যন্ত প্রকট করে তুলেছে এই বাস্তবতাকে গোটা পৃথিবীর সামনে। তবুও কর্ণাটক হাইকোর্ট তার অন্তর্বর্তী আদেশে এই নির্লজ্জ বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেছে এবং কার্যত রাজ্য সরকারের জারি করা নিষেধাজ্ঞাকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে, যদিও বিভিন্ন আদালতের বেশ কয়েকটি রায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মহিলাদের হিজাব পরার অধিকারকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে।

ধর্ম এবং শিক্ষা অথবা স্বাধীনতা ও তারজন্য শিক্ষা — এই দু’টির মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বাধ্য করা — এক চরম নিষ্ঠুরতা। আর সেটাই করে কর্ণাটক হাইকোর্ট নারীর শিক্ষার প্রশ্নে এক ক্ষতিকারক অবস্থান নিয়েছে। তারফলে ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি, পড়ুয়ারা ক্লাসরুম, পরীক্ষা ছেড়ে বেরিয়ে আসাটাকে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশের আপাত নিরপেক্ষতা এক মিথ্যা সমতুল্যতার উপর ভিত্তিশীল। হিজাব মুসলিম মহিলাদের প্রথাগত পরিচ্ছদের অংশ। আর গেরুয়া উত্তরীয় প্রদর্শিত হয়েছিল প্রতিবাদের নামে আক্রমণাত্মক হওয়া বা ভীতিপ্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। আমরা কলেজ প্রাঙ্গণে গেরুয়া পতাকা তোলার ঘটনাও দেখেছি। স্পষ্টতই গেরুয়া উত্তরীয় বা গেরুয়া পতাকার প্ররোচনা এসেছে আরএসএস মতাদর্শ থেকে, কোনো ঐতিহ্য বা প্রথাগত অভ্যাস থেকে নয়! বৈষম্য এবং অবমাননার শিকার মুসলিম মহিলাদের প্রতি সংহতি জানাতে, কিছু ছাত্র নীল উত্তরীয় পরে ‘জয় ভীম’ শ্লোগান দিচ্ছিলেন। কর্ণাটক হাইকোর্ট আলাদা বিচার-বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে সব কিছুকে একই বন্ধনীর মধ্যে নিয়ে এসে, শুধু হেনস্থাকারীদের উৎসাহিত করেছে আর বলা বাহুল্য, হিজাব-হেনস্থার শিকার যারা, তদের হতাশ করেছে।

বিভ্রান্ত একটি উদারপন্থী ভাবনা হিজাব হাঙ্গামার গোটা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতকে এড়িয়ে গিয়ে, এই নিষেধাজ্ঞাকে মুসলিম মহিলাদের ক্ষমতায়নের পথে এক-পা এগিয়ে যাওয়া বলে স্বাগত জানাচ্ছে। সত্যকে অনুধাবন করতে হবে। ভারতে মুসলিম মহিলারা হিজাব-পরা নিয়ে কোনো তালিবানি ফতোয়ার সম্মুখীন নন। তবে তালিবান-সদৃশ কোন আক্রমণ যদি এক্ষেত্রে ঘটে থাকে, তা হল হিজাব-পরা মহিলাদের উপর রাজ্যের আরোপিত চাপ এবং রাস্তায় উচ্ছৃঙ্খল ভীড়ের হেনস্থা-তাণ্ডব। এমনকি এক হিন্দু আইনজীবী যিনি হিজাব পরার অধিকারের সমর্থনে আবেদনের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন, তাকে সামাজিক মাধ্যমে ‘হিন্দু আদর্শের’ শত্রু বলে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। আর বিজেপি, মুসলিম আবেদনকারীদের ভয় দেখানো, এমনকি আক্রমণের মুখে ঠেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে, তাদের সম্পর্কে বিশদ তথ্য প্রকাশ করে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, এই পরিস্থিতিতে মুসলিম মহিলাদের উপর পরিবার ও ঐ সম্প্রদায়ের রক্ষণশীল অংশ থেকে আরও বড় পাল্টা চাপ আসবে সম্প্রদায়ের মর্যাদা এবং বিধান মেনে চলার জন্য।

ইসলাম-ভীতি ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনৈতিক এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সঙ্ঘ-বিজেপি পরিবারের চাই নানা হাতিয়ার, চাই বহুমুখী সংঘাত-সংঘর্ষ চালানোর নানা অস্ত। আর সেসব তৈরির পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য, ঠিক গুজরাট আর উত্তরপ্রদেশের মতো, কর্ণাটককেও তারা বিশেষ গবেষণাগার হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এই অশুভ উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রশক্তির পুরো মদত পাওয়ার জন্য বিজেপি প্রথমে রাজ্যের অ-বিজেপি সরকারকে ফেলে দেয়। তারপর নিচুতলায় এক ভয়ঙ্কর উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি সমাবেশের মাধ্যমে পুরোমাত্রায় ফ্যাসিবাদী আক্রমণ শানানোর জন্য দু’বছরের মাথায় শীর্ষে পরিবর্তন ঘটায়। আইন পাল্টানো হচ্ছে। নতুন নিয়ম তৈরি হচ্ছে। আর মুসলিম সম্প্রদায়কে নিশানা করা ও প্রতিবাদী কণ্ঠকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য নির্ভেজাল সন্ত্রাসের এক রাজত্ব কায়েম করে। এম এম কালবুর্গী এবং গৌরী লঙ্কেশের হত্যার পর, হিজাব-হাঙ্গামা সঙ্ঘী-বিজেপি’র দক্ষিণী গবেষণাগার থেকে জেগে ওঠার আরেকটি হুঁশিয়ারি!

কুড়ি বছর আগে গুজরাট গবেষণাগার এক গণহত্যার জন্ম দিয়েছিল, আর তারপরেই, তৈরি হয়েছিল মারাত্মক দুর্নীতির পাঁকে নিমজ্জিত এক পুলিশ রাষ্ট্র। উত্তরপ্রদেশ গবেষণাগার আমাদের সামনে আরেকটা পুলিশ রাষ্ট্র আর সবচেয়ে নিষ্ঠুর নির্মম এক শাসন হাজির করেছে। কর্ণাটক থেকে আসা হুঁশিয়ারিতে ভারতকে জেগে উঠতেই হবে।
আর কাল-বিলম্ব নয়!

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২)

catastrophic coal mine project

দেউচা-পাঁচামির কয়লাখনির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্রমশ সংগঠিত চেহারা নিচ্ছে। গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে গ্রামবাসীদের ছোট ছোট প্রতিবাদ সামনে আসছিল। জানুয়ারিতে গঠিত হয় “বীরভূম জমি জীবন জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা”। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কলকাতায় প্রেস ক্লাবে ৩৬ জন গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে মহাসভা এক জোরালো সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের কথা তুলে ধরে এবং ঘোষণা করে যে ২০ ফেব্রুয়ারি দেওয়ানগঞ্জ ফুটবল মাঠে জনসভা সংগঠিত করবে। এই সংবাদ সম্মেলন থেকে মহাসভার নেতানেত্রীরা অত‍্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেন যে সরকারের পক্ষ থেকে চালানো প্রচার আদতে ভিত্তিহীন, গ্রামবাসীরা কোনও কিছুর বিনিময়েই এই কয়লা প্রকল্প মেনে নিচ্ছে না। ২০ ফেব্রুয়ারির সভায় সমস্ত গণসংগঠনের প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকার আহ্বান জানান তাঁরা।

গ্রামবাসীরা যত সংগঠিত প্রতিবাদের দিকে এগোতে থাকে, সরকারি সন্ত্রাসও তত তীব্র হয়। ডিসেম্বরের শেষে প্রথম সংঘাত হয়। একদিকে গ্রামের মহিলারা, অন‍্যদিকে শাসকদলের কর্মী ও পুলিশের যৌথ বাহিনী। কয়লাখনি-বিরোধীদের প্রতি হুমকিমূলক শ্লোগান তুলে টিএমসির মিছিল দেওয়ানগঞ্জে ঢুকতে দেখে বিভিন্ন পাড়া থেকে কয়েকশ মহিলা ছুটে এসে মিছিলকে চ‍্যালেঞ্জ করে। বিশাল পুলিশ বাহিনী মহিলাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ২৫ জন বিভিন্ন মাত্রায় আহত হন। পুলিশের লাঠির ঘায়ে একজন আদিবাসী মহিলা তাঁর গর্ভস্থ সন্তানকে হারান। এই হামলার নেতৃত্বে ছিল বিজেপি থেকে সদ‍্য টিএমসিতে আসা নেতা সুনীল সরেন।

২০ ফেব্রুয়ারি দেওয়ানগঞ্জ ফুটবল ময়দানে দেওয়ানগঞ্জ, হরিণসিঙা, কেন্দ্রাপাহাড়ি, হাবরাপাহাড়ি, মথুরাপাহাড়ি সহ প্রায় সমস্ত গ্রাম থেকে মানুষেরা জমায়েত হন। বিশেষত আদিবাসী মহিলারা সোচ্চারে জানিয়ে দেন যে তাঁরা কেউ কয়লাখনি চাইছেন না। দেওয়ানগঞ্জে ২৩ ডিসেম্বর আদিবাসী মহিলাদের ওপর পুলিশের সন্ত্রাসের প্রসঙ্গ বারবার উঠে আসে। ২০ ফেব্রুয়ারির সভা ব‍্যর্থ করতে সবরকম প্রচেষ্টা চালিয়েছিল টিএমসি ও পুলিশ। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অপপ্রচার ও হুমকি দেয়। সভার আগের রাতে তৈরি হওয়া সভামঞ্চ ভেঙে দেওয়ার চেষ্টাও করে। পুলিশ সুপার ফোন করে ক্রাশার মালিককে নির্দেশ দেয় দুপুর থেকে ক্রাশার চালু রেখে সমস্ত শ্রমিকদের আটকে রাখার। কয়েকটি গ্রামের মাঝি হারামকেও ফোনে হুমকি দেয়। তবু সমস্ত প্রতিকুলতা অতিক্রম করে জমায়েত সফল হয় এবং সরকারের অন‍্যায় কার্যকলাপের বিরুদ্ধে জোরালো বার্তা দেন গ্রামবাসীরা।

against the catastrophic coal mine project
মৌলালী মোড়ে সভা

সভা শেষ হওয়ার পর পুলিশ ও শাসকদল প্রতিবাদীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মহাসভার আহ্বানে কলকাতা থেকে আসা প্রতিবাদীরা যখন ফিরছিলেন তখন মহম্মদবাজারের কাছে টিএমসি সমর্থকেরা তাঁদের আটকে রেখে দীর্ঘক্ষণ লাঞ্ছিত করতে থাকে। পরবর্তীতে পুলিশ তাঁদের থানায় নিয়ে যায় ও সারা রাত আটক রাখে। অন‍্যদিকে টিএমসি নেতা সুনীল সরেনের নেতৃত্বে একটি বাহিনী সভা-ফেরত গ্রামবাসীদের ওপর চড়াও হয়। কিন্তু ব‍্যাপক আদিবাসী মহিলা এই টিএমসি নেতা ও তার দুই সাগরেদকে ঘিরে ফেলে। মহিলাদের চরম ক্রোধের মুখে পড়ে এই টিএমসি নেতা। পাঁচ গাড়ি পুলিশ গ্রামে ঢুকেও শেষ পর্যন্ত মহিলাদের ক্ষোভ আঁচ করে সভাস্থলে না গিয়ে ফিরে যায়। ধৃত টিএমসি নেতাকে জুতোপেটা করে মহিলারা। লিখিতভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা পাওয়ার পর সুনীল সরেনকে পুলিশের হাতে তুলে দেন তাঁরা। ভোর রাতে বিশাল পুলিশ বাহিনী গ্রামে ঢোকে। মহাসভার সংগঠক কর্মীদের বাড়ি বাড়ি হানা দেয় পুলিশ। আট জনকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। এই সমস্ত গ্রামবাসী, থানায় আটক কলকাতার প্রতিবাদীরা ও অন‍্যান‍্য “১০০-১৫০ জন”-এর নামে পুলিশ “খুনের চেষ্টা” সহ বিভিন্ন ধারায় মামলা সাজিয়েছে। দুজন গ্রামবাসী, মোহন মার্ডি ও কালিচরণ বাস্কে, পুলিশ হেফাজতে এবং প্রসেনজিৎ বসু ও আব্দুল মালিক মোল্লা সহ কলকাতার ৭ জন জেল হেফাজত আছেন। পরের রাতেও পুলিশ গ্রামে ঢুকে সন্ত্রাস চালিয়েছে।

২০ ফেব্রুয়ারির সমাবেশ গ্রামবাসীদের ভয়ভীতি ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব অনেকাংশে দূর করে দিয়েছে। তারপর থেকে প্রতিদিনই ক্রমবর্ধমান হারে মানুষ রাস্তায় নেমেছেন এবং সব গ্রাম ঘুরে মাইলের পর মাইল মিছিল সংগঠিত হয়েছে। এলাকার সমস্ত পাথর খাদান ও ক্রাশার বন্ধ করে দিয়েছে গ্রামবাসীরা। এসব অধিকাংশই বেআইনি এবং এই ব‍্যবসার তোলাবাজি চক্রকে হাতিয়ার করেই টিএমসি নেতারা এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখে। ২০-২১ ফেব্রুয়ারির সরকারি সন্ত্রাসের প্রতিবাদে রাজ‍্যের বিভিন্ন আদিবাসী সামাজিক সংগঠন দেওচা কয়লাখনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে অবস্থান জোরালো করতে শুরু করেছে। এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে রাজ‍্যস্তরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন উদ‍্যোগের মধ‍্যে ঐক‍্য প্রসারিত হচ্ছে, ২৩ ফেব্রুয়ারি মৌলালি মোড়ে প্রতিবাদসভায় যা প্রতিফলিত হয়েছে।

- মলয় তেওয়ারি

Kawakhali-Porajhar

শিলিগুড়ি সন্নিহিত কাওয়াখালি পোড়াঝাড় অঞ্চলের প্রায় ৩০২ একর জমি থেকে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ২০০৪ সালে জনস্বার্থের ট্যাগ লাগিয়ে সেখানকার মানুষদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এরমধ্যে এক বড় অংশই অনিচ্ছুক কৃষক পরিবার। কিন্তু কিছু ইচ্ছুক পরিবার এককালীন ক্ষতিপূরণ পেলেও তৎকালীন সরকার যখন মুখে জনস্বার্থের কথা বলে উপনগরী তৈরিতে হাত দেয় তখন থেকেই ক্রমশ আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এরই মধ্যে তৈরি হয় কাওয়াখালি-পোড়াঝাড় ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। ২০০৭ সালে আন্দোলনের ফলে সরকারের পক্ষ থেকে একটি উপদেষ্টা কমিটি তৈরির কথা হলেও সেখানে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির কোনো প্রতিনিধিদের রাখা হয়নি। নিম্ন আদালত এবং হাইকোর্টে মামলাও করা হয় অনিচ্ছুক কৃষক পরিবারগুলোর তরফ থেকে, কিন্ত সেই মামলা সম্ভবত অনেক মামলার ভিড়ে কার্যত হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে বিষয়টি যেহেতু এখনও বিচারাধীন, ফলে প্রশ্ন থেকেই যায় কিভাবে একটি বিচারাধীন বিষয়কে সরিয়ে রেখে উপনগরীর কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে?

অন্যদিকে কখনো কখনো থিতিয়ে গেলেও এতগুলো বছরে আন্দোলন কিন্তু অব্যাহত থেকেছে। ক্ষমতার পালাবদল হওয়ার পর তৃণমূল সরকারের এতগুলো বছরেও অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। বরঞ্চ তৃণমূল সরকার এই জমি তুলে দিয়েছে নেওটিয়াদের হাতে, যে জমির বাজার মূল্য ৩৫৩ কোটি টাকা, সেখানে তারা মাত্র ৮৩ কোটি টাকায় তা কিনে নেয়। সরকার এখানে সাধারণ মানুষ, অনিচ্ছুক পরিবারগুলির স্বার্থ চিন্তা না করে কার্যত জমির দালালির ভূমিকা পালন করছে বলা যায়। এই অবস্থায় এলাকার অনিচ্ছুক মানুষদের আন্দোলন স্বাভাবিকভাবেই আরও তীব্র হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে ভূমি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সহ এলাকার এক বড় অংশের মানুষেরা শিলিগুড়ি শহরে বিভিন্ন কর্মসূচি সংঘটিত করেছেন। বিভিন্ন পর্যায়ে কৃষক সংগঠন এআইকেএম, শ্রমিক সংগঠন এআইসিসিটিইউ সহ সিআইটিইউ, এআইকেএমএস, ইউটিইউসি সহ পিসিসি সিপিআই (এম-এল), সিপিআই (এম-এল) এনডি সকল প্রতিনিধিরা সংহতি কর্মসূচির শরিক। আলোচনা বৈঠক চলছে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কর্মপন্থা নিয়ে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফরের অজুহাত দেখিয়ে ১৩ জন আন্দোলনকারীকে পুলিশ জোর করে তুলে নিয়ে যায়। যেখানে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন মানুষের সঙ্গে কথা না বলে রাজ্যের কোথাও বলপূর্বক জমি নেওয়া হবেনা, সেখানে পুলিশ (মুখ্যমন্ত্রী নিজেই আবার পুলিশমন্ত্রী) তাঁরই আসার অজুহাত দেখিয়ে আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করছে! এসব থেকে পরিস্কার ধরা পড়ে সরকারের উদ্দেশ্য। পূর্ব ঘোষণা মতোই ১৮ ফেব্রুয়ারি জমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি, এআইকেএম, এআইকেএস, সিআইটিইউ, ইউটিইউসি’র নেতৃত্বে বিশাল মিছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম গেট থেকে শুরু হয়ে এসজেডিএ অভিযানের উদ্দেশ্যে শিলিগুড়ি জংশন অভিমুখে রওনা দিলে এসজেডিএ অফিসের গেটে উপস্থিত বিশাল পুলিশ বাহিনী মিছিল আটকে দেয়। সকলে সেখানেই বসে পড়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। সাফ জানিয়ে দেয় পুলিশ গ্রেপ্তার করলে করুক, তারা শেষ দেখে ছাড়বেন।

পরবর্তীতে আলোচনার মাধ্যমে সকলকে বুঝিয়ে এআইকেএমএ’র তরফে অভিজিৎ মজুমদার, সিআইটিইউ’র গৌতম ঘোষ, ইউটিইউসি’র তাপস গোস্বামী, এআইকেএমএস’এর অমল রায় এবং জমি উচ্ছেদ কমিটির দুজন প্রতিনিধির নেতৃত্বে ছ’জনের প্রতিনিধি দল এসজেডিএ আধিকারিককে স্মারকলিপি দেয়, দাবি জানানো হয় অবিলম্বে ডিএম-এসডিও সহ জমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির প্রতিনিধি এবং কৃষক ও শ্রমিক সংগঠনসমূহের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে। ইচ্ছুক জমিদাতাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন এবং পরিবারের অন্তত একজনকে চাকরি দিতে হবে, এবং অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দিতে হবে। বিক্ষোভ চলাকালীন বক্তব্য রাখেন, এআইকেএম’এর পক্ষে অভিজিৎ মজুমদার, পবিত্র সিংহ, শ্রমিক কৃষক সংগ্রামী মঞ্চের রতন দে, ইউটিইউসি’র তাপস গোস্বামী, সিআইটিইউ’র গৌতম ঘোষ, এআইকেএমএস’এর অমল রায় সহ প্রতিরোধ কমিটির প্রতিনিধিরা। দাবি না মানা হলে আন্দোলন শিলিগুড়ির সীমানা ছাড়িয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যাবে সকলেই এই হুঁশিয়ারি দেন। যতদিন না সরকারের প্রতিনিধিরা বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনায় বসছেন, ততদিন উপনগরীর কাজ বন্ধ রাখতে হবে।

আন্দোলনকারীদের আটদফা দাবি হল

১) অবিলম্বে অনিচ্ছুক জমির মালিকদের জমি ফেরত দিতে হবে।
২) সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৩) দীর্ঘদিন জমিতে কাজ করা আদিবাসী কৃষক, বর্গাদারদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৪) সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের প্যাকেজ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ ও অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষার বন্দোবস্ত করতে হবে।
৫) মামলা-যুক্ত জমির কেনাবেচা বন্ধ করতে হবে।
৬) পূর্বঘোষিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী অবিলম্বে উপদেষ্টা কমিটি তৈরি করতে হবে, উপদেষ্টা কমিটিতে জমিহারা ও ভূমিহারা রক্ষা কমিটির প্রতিনিধিকে উপদেষ্টা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে একমাসের মধ্যে উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক করতে হবে।
৭) প্রতিটি জমিহারা পরিবারকে অধিগ্রহণ সার্টিফিকেট দিতে হবে।
৮) সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সরকারী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

Protest rally in Uluberia

আমতার প্রতিবাদী ছাত্রনেতা আনিস খাানের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের দোষীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও সমগ্র ঘটনার বিচার-বিভাগীয় তদন্তের দাবিতে ২২ ফেব্রুয়ারি উলুবেড়িয়া স্টেশন থেকে মহকুমা শাসক দপ্তর পর্যন্ত সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের হাওড়া জেলা কমিটির আহ্বানে সংগঠিত হয় এক জঙ্গী মিছিল।

মিছিলে ছাত্র-মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল ভালো মাত্রায়। দোষীদের গ্রেপ্তার করার দাবি জানানোর সাথে সাথে তৃণমূল সরকারকে ধিক্কার জানানো হয়। উলুবেড়িয়া মহকুমা শাসক দপ্তরের গেটের সামনে সমাবেশিত হয়ে দীর্ঘক্ষণ সভা চলে। সমাবেশ থেকে পাঁচ জনের প্রতিনিধিদল পার্টির হাওড়া জেলা সম্পাদকের নেতৃত্বে মহকুমা শাসকের সাথে দেখা করে তার হাতে স্মারকলিপি তুলে দেয়। প্রতিনিধিদলে ছিলেন আইসার রাজ্য সম্পাদক স্বর্ণেন্দু মিত্র ও পার্টির রাজ্য কমিটির নেত্রী কল্যাণী গোস্বামী, জেলার মহিলা ও ছাত্র সংগঠক যথাক্রমে সেরিনা সেখ ও অঙ্কিত মজুমদার।

মহকুমা শাসককে ঘটনাকেন্দ্রীক প্রশ্ন করা হলেও তার কোনো সুস্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি। এর প্রতিবাদে সভায় বিস্তারিতভাবে বক্তব্য রাখা হয়। সভায় রাজ্য কমিটির বর্ষীয়ান মীনা পাল, জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত, শহীদ ছাত্র আনিসের বন্ধু ওহায়িদ, এন এন ব্যানার্জি, অঙ্কিত মজুমদার প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সভা পরিচালনা করেন নিলাশিস বসু। আনিসের হত্যাকারীরা শাস্তি না পাওয়া পর্যন্ত লড়াই জারি থাকবে — এই অঙ্গীকারের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় সভা।

আনিস হত্যার বিরুদ্ধে নাগরিক মিছিল

আনিস খানের হত্যার বিরুদ্ধে, দোষীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে বেলঘরিয়ায় ২৩ ফেব্রুয়ারি নাগরিক মিছিল হয়। বেলঘরিয়া স্টেশন থেকে মিছিল শুরু হয়ে কালচারাল মোর, নন্দন নগর বাজার হয়ে স্টেশনে শেষ হয়, প্রায় চার কিলোমিটার পথ পরিক্রমা করে।

আনিস হত্যার বিরুদ্ধে আইসার দাবি

২২ ফেব্রুয়ারি এক প্রেস বিবৃতিতে এআইএসএ (আইসা) জানিয়েছে, আনিস খান হত্যার বিরুদ্ধে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ডাকে মহাকরণ অভিযানে তৃণমূল সরকারের পুলিশের ব্যাপক লাঠিচার্জ ও ছাত্রীদের ওপরেও পুরুষ পুলিশ কর্মীদের আক্রমণকে ধিক্কার! আইসা কর্মী সায়ন্তন ও অর্পণ সহ শতাধিক ছাত্রছাত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা অবিলম্বে তাদের মুক্তির দাবি জানাচ্ছি।

against police terror

শিলিগুড়ি

২২ ফেব্রুয়ারি, রাজ্যর শাসক দলের মদতে নরেন্দ্রপুর থানায়, দেউচা-পাঁচামীতে পুলিশী সন্ত্রাস সর্বোপরি এনআরসি, এনপিআর, সিএএ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আনিস খানের হত্যার প্রতিবাদে এবং আনিস খানের মৃত্যুতে পরিবারের একজন সদস্যকে রেখে কমিটি তৈরি করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিতে শিলিগুড়িতে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। মিছিল শেষে গোষ্টপালের মূর্তির সামনে এসে বক্তব্য রাখেন দলের রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার এবং জেলাসদস্যা জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ, জেলা সদস্য মোজাম্মেল হক, মুক্তি সরকার, মীরা চতুর্বেদী, শাশ্বতী সেনগুপ্ত, শিলিগুড়ি লোকাল সদস্য রুবী সেনগুপ্ত, রজত বর্ম, প্রলয় চতুর্বেদী প্রমুখ।

আসানসোল

২২ ফেব্রুয়ারি আসানসোলে রবীন্দ্র ভবনের সামনে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আনিসের হত্যার বিরুদ্ধে ও বীরভূমের দেউচা-পাঁচামীতে প্রস্তাবিত কয়লা খনি প্রকল্প বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারী গ্রামবাসী এবং এই আন্দোলন পক্ষে দাঁড়ানো ও তাকে সাহায্য করার জন্য যেসব সংগঠন পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের তৃণমূল কংগ্রেসের মদতপুষ্ট গুন্ডাবাহিনী ও পুলিশ যৌথভাবে আক্রমণ নামিয়ে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করছে। এর প্রতিবাদে আসানসোলে রবীন্দ্র ভবনের সামনে এক প্রতিবাদীসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন দলিত ও সংখ্যালঘু মঞ্চের পক্ষে স্বপন দাস, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে সোমনাথ চ্যাটার্জি, স্বদেশ চ্যাটার্জি ও প্রদীপ ব্যানার্জি।

 Progressive Women's Association in Calcutta

১২ ফেব্রুয়ারি সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির ২৯তম প্রতিষ্ঠা দিবস পালিত হয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়, তার রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছিল এই পত্রিকার গত সংখ্যায়। ন্যায়, স্বাধীনতা ও সমতার লড়াইয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমিতির ভূমিকা গ্রহণ ও আজকের দিনে এই লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করা হয়। আওয়াজ তোলা হয় জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মেয়েদের উপর মৌলবাদী ও রাষ্ট্রীয় হামলা বন্ধ কর। কলকাতায় ঐদিন যাদবপুর ৮বি বাসষ্ট্যান্ডে পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। দেশজোড়া আইপোয়ার দাবিগুচ্ছ ও হিন্দুত্ববাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে আইপোয়া’র লড়াইকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে এই রাজ্যের সাম্প্রতিক নরেন্দ্রপুর থানায় আইপোয়া এবং আইসা কর্মীদের উপর পুলিশী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। অবিলম্বে দোষী পুলিশ অফিসার ও পুলিশ কর্মচারিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করা হয়। সভার শুরুতে সঙ্গীত পরিবেশন করেন সাথী স্বপন চক্রবর্ত্তী। বক্তব্য রাখেন আইপোয়া’র পক্ষ থেকে চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী, স্নিগ্ধা বসু, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটি সদস্য অমিত দাশগুপ্ত, ডব্লিউএসএস’এর নিশা বিশ্বাস এবং গণআন্দোলনের সমাজকর্মী সৌরভ রায় চৌধুরী ও তমাল চক্রবর্তী। সমগ্র কর্মসূচি পরিচালনা করেন আইপোয়া’র রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্ত।

Hijab Wearing Muslim Women Students

হাজার হাজার নারীবাদী, গণতান্ত্রিক গোষ্ঠী, সংগঠন, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী এবং সমাজের বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিত্বরা — মুসলমান ছাত্রীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে তাঁদের বর্জনের যে অপচেষ্টা চলছে তাকে ধিক্কার জানিয়েছেন একসুরে। তাঁরা জোরের সঙ্গে বলেছেন, হিজাব একটা অজুহাত মাত্র, আসলে মুসলিম মহিলাদের ওপর পৃথকীকরণ (অ্যাপাটাইড) চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আর এটা করা হচ্ছে হিন্দু আধিপত্যবাদীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে।

একটি বিবৃতি যাতে হাজার হাজার ব্যক্তি স্বাক্ষর করেছেন এবং বিবৃতির বয়ানে বলা হয়েছে তাঁরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন সংবিধান অনুযায়ী স্কুল ও কলেজে বহুত্ববাদের শিক্ষাই দেওয়া হয়। অভিন্নতা কখনই নয়।

এই বিবৃতিটি স্বাক্ষর করেছেন ১৫টি রাজ্যের ১৩০টির বেশি সংগঠন। এদের মধ্যে রয়েছে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান উইমেন, বেবাক কালেকটিভ, সহেলী উইমেনস রিসোর্স সেন্টার, আওয়াজ-ই-নিজওয়ান, ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অফ পিপলস মুভমেন্টস, ফোরাম এগেইন্সট অপ্রেশন অফ উইমেন, পিইউসিএল, দলিত উইমেন্স কালেক্টিভ, ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ দলিত উইমেন, উইমেন এগেইনস্ট সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স অ্যান্ড স্টেট রিপ্রেশন এবং ফেমিনিস্ট ইন রেসিস্ট্যান্স।

স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন, কবিতা কৃষ্ণাণ, মরিয়ম ধাওয়ালে, অ্যানি রাজা, অরুণা রায়, রাধিকা ভেমুলা, মানুজা প্রদীপ, সফুরা জারগার, হাসিনা খান, অজিতা রাও, খালিদা পরভীন, উমা চক্রবর্তী, সুজাথা সুরেপল্লী, বৃন্দা গ্রোভার, ভার্জিনিয়া সালদানহা, সতনাম কৌর, সাধনা আর্য, চয়নিকা শাহ, পৌষালি বসাক, নিবেদিতা মেনন, সুসী থারু, প্রভাত পট্টনায়ক, রাধিকা সিংহ, অমৃতা চাছি এবং অন্যান্যরা।

Hijab Wearing Muslim Women

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মুসলিম ছাত্রীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে হিজাব পরিধান এবং তাঁদের পৃথকীকরণ সম্পর্কে নারীবাদী, গণতান্ত্রিক সংগঠন এবং বিভিন্ন ব্যক্তিত্বদের বক্তব্য হল

১) কর্ণাটকের উপকূল অঞ্চলের শিক্ষালয়ে ক্লাসে ও ক্যাম্পাসে হিজাব নিষিদ্ধ করা এবং অন্যান্য রাজ্যেও তা নিষিদ্ধ করার হুমকি একটি ঘৃণ্য অপরাধ। হিন্দু আধিপত্যবাদীরা মুসলিমদের গণপেটাই, পৃথকীকরণ, বয়কট করছে নানা অছিলায় — যেমন, গোমাংস খাওয়া, তাদের যৌথ প্রার্থনা, আজান দেওয়া, টুপি পরা, উর্দু ভাষা ইত্যাদির জন্য। এরসঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে মুসলিম মহিলাদের হিজাব পরিধান, তাঁদের অনলাইনে নিলামে তোলা এবং যৌন ও প্রজননদাসী হিসাবে কুপ্রচার চালানো।

২) কর্ণাটকের মান্ড্যতে গেরুয়াধারীরা একজন হিজাব পরিহিতা মহিলাকে ঘিরে ধরে হেনস্থা করছে এই ভিডিওটি একটি সতর্কতামূলক নিদর্শন এই কারণে যে হিজাবকে অজুহাত করে কত সহজে মুসলিম মহিলাদের ওপর আক্রমণ নামানো যায়।

৩) আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি সংবিধান অনুযায়ী স্কুল ও কলেজে বহুত্ববাদের শিক্ষাই দেওয়া হয়। অভিন্নতা কখনই নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘ইউনিফর্ম’এর মাধ্যমে ছাত্রীছাত্রদের শ্রেণী পার্থক্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্যতার লঘুকরণ করা হয়। আমাদের দেশ বহুত্ববাদী এবং এখানে ইউনিফর্ম কখনই অভিন্ন সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পরিচালিত নয়। এই কারণে শিখদের ক্লাসে পাগড়ি পরার অনুমতি দেওয়ার সাথে সাথে পুলিশে ও সেনাবাহিনীতেও পাগড়ি পরার অনুমতি দেওয়া হয়। এইজন্য হিন্দু ছাত্রীছাত্ররা বিন্দি/পোট্টু/তিলক/বিভূতি পরেন তাঁদের স্কুল বা কলেজের ইউনিফর্মের সাথে কোন মন্তব্য বা বিতর্ক ছাড়া। একইভাবে মুসলিম ছাত্রীরা তাঁদের ইউনিফর্মের সাথে হিজাব অবশ্যই পরবেন।

৪) উদুপি’র অন্তত একটি কলেজের রুলবুকে মুসলিম মহিলাদের তাঁদের ইউনিফর্মের সাথে খাপ খায় এরকম রংয়ের হিজাব পরার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শুধু হিজাবের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই নিয়ে গন্ডগোল হচ্ছে তা নয়। হিন্দু আধিপত্যবাদীরা গেরুয়া পরে প্রদর্শন করছে যাতে হিজাবকে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু গেরুয়া কাপড় বা হিজাবকে নিষিদ্ধ করাটা সঠিক সমাধান নয় কারণ কিছু মুসলিম মহিলা হিজাব পরেন তাই গেরুয়া কাপড় পরে হিন্দুত্ববাদীরা হিজাব নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে সমস্ত মুসলিম মহিলাদের হুমকির বার্তা দিতে চেয়েছে।

৫) হিজাব পরিহিতা ছাত্রীদের আলাদা ক্লাসরুমে বসানো বা তাঁদের পছন্দমতো অন্য কলেজে বা মুসলিম পরিচালিত কলেজে চলে যাওয়ার জন্য আদেশ করা ‘পৃথকীকরণ’ ছাড়া অন্য কিছু নয়। ২০০৮ থেকে হিন্দু আধিপত্যবাদীরা কর্ণাটকের উপকূল অঞ্চলে পৃথকীকরণ কায়েমের জন্য হিংস্রতার আশ্রয় নিয়েছে। তারা হিন্দু এবং মুসলিম ছাত্রীছাত্রদের বন্ধুত্ব, ভালোবাসার বিরোধিতা করছে। স্মরণ করুন এই আক্রমণের সাথে সাথে তারা হিন্দু মহিলাদের — যাঁরা পাবে যান, পশ্চিমী পোশাক পরেন, মুসলিম ছেলেদের সাথে প্রেম, বিবাহ করেন তাঁদের ওপরেও হিংস্র আক্রমণ করে। এই হিন্দু আধিপত্যবাদী অপরাধীদের রয়েছে ইসলাম বিদ্বেষী ঘৃণা যার সাথে যুক্ত হয়েছে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের মহিলাদের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক ঘৃণা।

৬) আমরা আতঙ্কিত এই কারণে যে, কর্ণাটকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিজাব পরিহিতা মুসলিম মহিলার ফোন রেকর্ড তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন — কোনও সন্ত্রাসবাদী দলের সাথে তাঁর যোগাযোগ আছে কিনা। মুসলিমদের সন্ত্রাসবাদী ও চক্রান্তকারী হিসাবে সহজেই অপরাধী বানিয়ে অভিযুক্ত করা হয় কেবলমাত্র পক্ষপাতমূলক নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বা অন্য কোনও পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে। আর এখন মুসলিম মহিলারা হিজাব পরলে চক্রান্তকারী বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে  — যেখানে দেশে অগণিত হিন্দু, শিখ সমাজের মহিলারা একইভাবে, একই কারণে মাথা ঢাকেন এবং দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি তাঁদের মাথা ঢাকতেন কোনও মন্তব্য বা বিতর্ক ছাড়া।

৭) বালিকা এবং তরুণী ছাত্রীরা পোশাকের জন্য যেন হেনস্থা বা শাস্তির মুখোমুখি না হয়ে শিক্ষা অর্জন করতে পারে। শিক্ষালয়গুলি যেন ছাত্রীছাত্রদের পোশাকের দিকে নজর না দিয়ে তাদের বুদ্ধিবৃত্তির দিকে নজর দেন। কোনও ছাত্রীকে হিজাব, জিনস্ বা খাটো পোশাকের জন্য কলেজে ঢুকতে না দিলে আমরা তাদের পাশে থাকবো।

৮) মুসলিম মহিলারা হিজাব পরুন বা নাই পরুন আমরা তাঁদের বিস্তৃত অধিকারসহ মর্যাদা দেব ও সংহতি জানাব। কর্ণাটকের মুসলিম ছাত্রীরা তাঁদের সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে হিজাব পরেন তাই এই প্রতিনিধিত্বকারীতাকে সম্মান জানানো উচিত।

৯) মহিলারা কি পরবেন, তা কতটা খোলামেলা হবে এটা নির্ভর করছে তাঁদের পছন্দের ওপর। এটা শালীনতা বা অশালীনতার মাপকাঠি কখনই হতে পারে না। এটা সমস্ত ধরণের ধর্মীয় অনুশীলনে পিতৃতান্ত্রিকতার চাপানো ফরমান। মহিলাদের সম্মান রক্ষার্থে কোন পোশাক পরা উচিত তার ফরমান না দিয়ে বরং তাঁরা যাই পরুন না কেন তাঁদের সম্মান দেখানো উচিত। আপনি যদি মনে করেন কোনও মহিলা নিজেকে যেন বেশি উন্মুক্ত করছেন বা হিন্দু/মুসলিম/খ্রিস্টান/শিখ ধর্মমত অনুযায়ী পোশাক পরেননি তাহলে সমস্যাটা আপনার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর এবং সঠিক জ্ঞানের অভাব। নারীবাদী ও গণতান্ত্রিক নীতির মধ্যেই নিহিত থাকে প্রত্যেক মহিলাদের প্রতি সম্মান জানানো কারণ প্রত্যেক মহিলা পুরুষতান্ত্রিকতাকে কিভাবে মোকাবিলা করবেন তা নিজেই ঠিক করেন এবং তাঁর বিশ্বাসের সাথে যে অনুশীলন খাপ খায় তা গ্রহণ করেন এবং বাকিগুলি বর্জন করেন।

১০) মান্ড্যতে একজন মুসলিম মহিলাকে যে সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গরা হেনস্থা করেছে আমরা তাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ দাবি করছি। হিজাব পরিহিতা মহিলাদের হুমকি দেওয়ার প্রচেষ্টা বন্ধ করার জন্য আমরা সারাদেশের রাজ্য সরকারগুলির প্রতি আবেদন করছি তাঁরা যেন পুলিশ ও জনগণকে এব্যাপারে সতর্ক করেন। আমরা কর্ণাটকের মুসলিম ছাত্রীদের সাহসকে সেলাম জানাই যাঁরা তাদের মর্যাদা ও অধিকারের জন্য রাষ্ট্রের মদতপুষ্ট হিন্দু আধিপত্যবাদী গুন্ডাদের হুমকি উপেক্ষা করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা এই ছাত্রীদের থেকে শুনে আনন্দিত হয়েছি যে তাঁদের অনেক হিন্দু এবং খ্রিস্টান বন্ধু-বান্ধবী এই আন্দোলনকে সমর্থন করছেন। আমরা বলছি, সারা দেশের ছাত্রীছাত্রদের এবং মহিলাদের ওপর নারীবিদ্বেষী ও ইসলামবিদ্বেষী ‘পোশাক বিধি’ জোর করে চাপানোর যে কোন চেষ্টার বিরোধিতা করুন।

What girls will wear

কর্ণাটকের উদিপি জেলায় একটি সরকার পরিচালিত স্কুলে শুরু হওয়া হিজাব-ব্যান এখন ছড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য রাজ্যেও। হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন শক্তিগুলি (বিজেপি’র ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ সহ) সরকারি স্কুলে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরার উপর নিষেধাজ্ঞা আনার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি স্কুলের ইউনিফর্মের রঙের হিজাব পরলেও মুসলিম মেয়েরা পড়াশোনা করতে সরকারি স্কুলে ঢুকতে পারবে না — এই দাবিতে বিভিন্ন স্কুলে চলছে গেরুয়া তাণ্ডব। যার জেরে কার্যত নাকাবন্দী চলছে স্কুল, ক্ললেজ প্রাঙ্গণে। বিজেপি চালিত কর্ণাটক সরকারের নির্দেশে সরকারি স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষ হিজাব-ব্যানের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত মেয়েদের মাফিনামা ছাড়া স্কুলে ঢুকতে দিচ্ছেন না। সম্প্রতি, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সামনে এসেছে যে স্কুলের বাইরে বোরখা খুলে স্কুলে ঢুকতে বাধ্য হচ্ছেন শিক্ষিকারাও।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধর্ম-নিরপেক্ষতা বজায় রাখার দোহাই দিয়ে ছাত্রীদের ঘিরে হেনস্থা ও হুমকির উদ্দেশ্যে এক দঙ্গল উগ্র পুরুষের কুৎসিত তাণ্ডব চলতে পারে! কিন্তু তাদের হিন্দুত্ববাদী ‘জয় শ্রীরাম’ চিৎকারের মুখে মুসকানের সাহসী দৃপ্ত প্রতিরোধ ‘দোষের’ হয়ে যায়! তাই সন্ত্রাসবাদীদের সাথে মেয়েটির ‘যোগাযোগ’ আছে কিনা খতিয়ে দেখতে তদন্তের নির্দেশ দিল কর্ণাটক সরকার! মুসলিমবিদ্বেষের প্রকাশ্য আস্ফালন দেশ দেখছে বিজেপি’র শাসনকালে। বিফ-ব্যান, মব-লিঞ্চিং, সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে উর্দু ভাষার অপসারণ, শিশুদের পাঠ্যসূচির গৈরিকীকরণ, ইতিহাসের মিথ্যাকথন, ঘর-ওয়াপসি, লাভ-জিহাদ ক্যাম্পেন, মুসলিম সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে গোদী-মিডিয়ার ধারাবাহিক প্রচার, প্রকাশ্য জনসভায় মুসলিম নিধনের ডাক দেওয়া, জনসমক্ষে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রার্থনা, উৎসব, ধর্ম পালনের অধিকারে বাধা দেওয়া, মুসলিম মানুষদের ধর্মচর্চার কেন্দ্রগুলি যেমন মসজিদ, মাজারের জায়গায় মন্দির তৈরির হুঙ্কার দেওয়া — বিজেপি ক্ষমতায় থাকাকালীন এই তালিকা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এই তালিকায় নবতম সংযোজন হিজাব-ব্যান।

পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে, এবিভিপি সহ গেরুয়া-বাহিনী হঠাৎ মুসলিম মেয়েদের পর্দা-প্রথা থেকে ‘মুক্ত’ করতে এই উন্মাদনা কেন? যে গেরুয়াধারী দল, মেয়েদের পোশাক, পড়াশোনা, বন্ধু বা সাথী বেছে নেওয়ার অর্থাৎ মেয়েদের স্বায়ত্ততার প্রশ্নে লাগাতার আঘাত হেনেছে, হেনে চলেছে, তারাই আজ পিতৃতন্ত্র বিরোধিতার ঢালে শিক্ষাক্ষেত্রের গৈরিকীকরণে ব্রতী হয়েছে। হিজাব বা পর্দা-প্রথা পিতৃতন্ত্রের আরোপিত — একথা নতুন নয়। স্বাধীনতার বহুদিন আগে থেকে মুসলিম সমাজের মধ্যে থেকে বেগম রোকেয়ার মতো প্রগতিশীল নারীবাদীরা পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন, আজও তুলছেন। এই মুহূর্তে হিজাবের পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাথে মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের বহু মেয়ের পরিচিতি ও পরিধানের অঙ্গ হিজাব। ঠিক যেভাবে দেশের একদা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল মাথায় আঁচল বা ঘোমটা দিয়ে দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব করে এসেছেন। ধর্মীয় পরিধান বা অলংকার যেমন শিখেদের পাগড়ী, হিন্দুদের সিঁদুর, মঙ্গলসূত্র বা খ্রিস্ট্রানদের ক্রস চিহ্ন বহন — ভারতের বিবিধের সংস্কৃতি’র পরিচায়ক। বিভিন্ন ধর্মীয় পরিধানের মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে হিজাবের উপর বিশেষ নিষেধাজ্ঞা আদপে মুসলিমবিদ্বেষের শিকড়কে প্রাতিষ্ঠানিক শীলমোহর দেওয়ার কৌশল মাত্র।

What girls will wear girls will decide

হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ ভারতে, হিজাব পরিধানের জন্য কলঙ্কের অংশীদার হওয়া ও বিচ্ছিন্নতার শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা শোনা যায় মুসলিম মেয়েদের মুখে। যদিও এই বিচ্ছিন্নতাকে রাষ্ট্রীয় ও প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি দেওয়ার নজির দেখা যায়নি আগে। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের শাসনকালে মুসলিম-বিদ্বেষের প্রাতিষ্ঠানিকতার পরাকাষ্ঠা সম্পূর্ণ হয় যখন কর্ণাটক হাইকোর্ট, শিক্ষাক্ষেত্রে গেরুয়া-বাহিনীর তাণ্ডব ও স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে কোনো রায় পৌঁছাতে না পারলেও, স্কুলে হিজাব পরে আসার উপর আইনি নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ভারতীয় সংবিধানের ২৫(১) ধারা/অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকের স্বাধীন চেতনার এবং স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন, অনুশীলন এবং প্রচারের সমান অধিকার রয়েছে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে তাণ্ডব চালিয়ে পোশাক অভ্যাসের সমতা রক্ষার নামে, উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলি অন্যের ধর্ম পালন ও অনুশীলনের অধিকারকে কেড়ে নিতে চাইছে। সাথে ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ (ভারতের ভূখণ্ডের মধ্যে, ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের বৈষম্য না করে, প্রতিটি ব্যক্তিকে রাষ্ট্র আইনের সমান সুরক্ষা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ) ও অনুচ্ছেদ ২১(১) (জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থান নির্বিশেষে শিক্ষার মৌলিক অধিকার) দ্বারা বর্ণিত সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকারগুলির লঙ্ঘন হচ্ছে হিজাব-ব্যানের মাধ্যমে। স্বেচ্ছায় হিজাব পরিধান বা স্বাধীন ধর্মীয় অনুশীলনের মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে শিক্ষার অধিকারকে। শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে — মুসলিম মেয়েদের বেছে নিতে হবে যেকোনো একটি। জাতীয় শিক্ষা নীতি ‘এনইপি’র মধ্য দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রের বেসরকারিকরণের রাস্তা পরিষ্কার হয়েছে। অন্যদিকে ধর্মের ভিত্তিতে শিক্ষাক্ষেত্রে পৃথকীকরণ (অর্থাৎ আলাদা ক্লাস-রুম, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান) লাগু করে শিক্ষার গৈরিকীকরণ সম্পূর্ণ করতে চায় বিজেপি।

মনে রাখতে হবে, ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর ফ্যাসিবাদী পথের সামনে প্রতিরোধে দাঁড়াচ্ছেন ভারতের মেয়েরা। ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মুসলিম মেয়েরা। ফ্যাসিবাদের বিরোধিতায় মুসলিম মেয়েরা রুখে দাঁড়ালেই জুটেছে ধর্ষণ ও খুনের হুমকি। গিট-হাব প্ল্যাটফর্মে ‘সুল্লি ডিল’, ‘বুল্লী বাই’ নামে অনলাইন নিলাম বা রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে বছরের পর বছর কারারুদ্ধ রাখা, হেনস্থার বিরুদ্ধে লড়ছেন ভারতের মুসলিম মেয়েরা। আজ তাদের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকারগুলির উপর আক্রমণ শানাচ্ছে ফ্যাসিবাদী শাসক। জনস্বার্থ রক্ষা করার নামে গেরুয়া সন্ত্রাস ও ধর্মীয় পোশাক পরার স্বাধীনতাকে কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত চালাচ্ছে বিজেপি। নীতি-পুলিশী করে মেয়েদের পোশাকের উপর ফতোয়া চাপিয়ে দেওয়া মৌলবাদী শক্তিগুলির রাজনীতি অতি পরিচিত। গেরুয়া বাহিনী যে নীতি-পুলিশীকে হাতিয়ার করে আজ মুসলিম মেয়েদের স্বাধিকার খর্ব করছে কাল সেই আঘাত নামাবে আপামর ভারতীয় নারীর স্বায়ত্ততায়।

পৃথকীকরণের রাজনীতিকে রুখে দিয়ে মুসলিম মেয়েদের স্বায়ত্ততা ও সাংবিধানিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়াতে হবে আমাদের। ফ্যাসিবাদ ও পিতৃতন্ত্রের যৌথ আক্রমণকে রুখে দিয়ে নারীর স্বায়ত্ততা ও স্বাধিকারের প্রশ্নকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা আজ আবশ্যক।

- সম্প্রীতি মুখার্জি

War of Liberation

১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ভারত রাষ্ট্রের বাইরে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষার জন্য পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম-বরকতেরা। ভারত রাষ্ট্রের মধ্যে ১৯৬১ সালের ১৯ মে বরাক উপত্যকায় বহু তরুণ প্রাণ মাতৃভাষার জন্য শহীদ হয়েছিল। ১৯৭২ ও ১৯৮৬ সালে আরও তিন তরুণ প্রাণ আত্মবলিদান দেয় সেখানে। দুটো ক্ষেত্রেই মাতৃভাষার নাম বাংলা। চাপিয়ে দেওয়া ভাষা যথাক্রমে উর্দু ও অসমিয়া। তারও আগে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন মানুষ। এইসব লড়াই নিছক ভাষার লড়াই নয়, বরং আধিপত্যবাদের লড়াই।

ঢাকাতে ভাষা বিক্ষোভ শুরু ১৯৪৭ সালেই। আন্দোলন দানা বাঁধে ১৯৪৮’র মার্চে। চরম প্রকাশ ঘটে ১৯৫২-তে। এদেশে স্বাধীনতার পর পরই বাংলা ভাষা অসমে আধিপত্যবাদের শিকার হয়। ১৯৪৭ সালে মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলই, রাজ্যপাল আকবর হায়দারি, সাংসদ নীলমণি ফুকনরা চেষ্টা করতে লাগলেন, কীভাবে বাংলা ভাষাকে সরিয়ে দিয়ে অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করা যায়। তারই জেরে ১৯৬০ সালে অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ঘোষণা করার প্রস্তাব নেওয়া হয়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বাঙালিরা আক্রান্ত হন। প্রায় এক থেকে দেড়লক্ষ বাঙালি অসম ছাড়তে বাধ্য হন। ন’জন বাঙালি নিহত হন। অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চলিহা পুনরায় প্রস্তাব আনেন অসমিয়া হবে অসমের একমাত্র সরকারি ভাষা। এসবের বিরোধিতা চলতে থাকে, মূলত বাঙালিরাই করেন। ওদিকে পূর্ব বাংলা উত্তাল হয়েছে, বহু মানুষ শহিদ হয়েছেন। পরের দশকে ঈশান বাংলার শিলচরে ১১ জনকে অসম সরকারের পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। সে সব ইতিহাস।

২১ ফেব্রুয়ারি কিংবা ১৯ মে, কেন এই পুরনো ইতিহাস ঘাঁটি আমরা? কেনই বা আত্মবলিদানকে স্মরণ করি? সেকি শুধু বাংলা ভাষার জন্য? পুরনো ইতিহাস মনে করতে হয়, আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদকে বোঝার জন্য। স্বাধীনতার পর অসমে যে ‘এনআরসি’ হয়েছিল তাতে দেখা যায় বহু এলাকায় তা কার্যকরি করা হয়নি যেখানে যেখানে অসমিয়াভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। এমন ‘ছোট্ট’ ঘটনায় বোঝা যাবে, আধিপত্যবাদের স্বরূপ ও রাজনীতির কদর্য রূপ। আত্মবলিদান স্মরণ করা হয় এই কারণে যে তাঁরা শাসকের রক্তচক্ষুকে ভয় পাননি, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করেছেন, নিরস্ত্র সংগ্রাম কিন্তু বীরের লড়াই। কোন ভাষার জন্য লড়েছিলেন তাঁরা, তা একটি নিছক তথ্যমাত্র। ঘটনা হল, তাঁরা লড়েছিলেন মাতৃভাষার জন্য, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন।

মাতৃভাষা সহজাত। অন্য ভাষা অর্জন করতে হয়। দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষায় মানুষ মনের ভাব মাতৃভাষার মতো ব্যক্ত করতে পারে না। তাছাড়া সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষরা একটিমাত্র ভাষা জানেন, তা হল তাঁর মাতৃভাষা। উর্দুকে বা অসমিয়াকে একমাত্র সরকারি ভাষা করলে বাঙালি রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়বে। ওই ভাষার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রাষ্ট্রের আদেশনামা পড়তে পারবেন না, বুঝতে পারবেন না; সরকারি চাকরির পরীক্ষায় উর্দুভাষী ও অসমিয়াদের থেকে পিছিয়ে পড়বেন তাঁরা। মাতৃভাষা কেড়ে নিলে জীবনের প্রায় সব দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে। এ হল শাসিতের উপর শাসকের চরম আক্রমণ। সাদা চোখে এই আধিপত্য বোঝা সহজ নয়। যেমন সাঁওতালরা বাংলার আধিপত্য মেনে নিয়েছেন, বাধ্য হয়েছেন। ভাষাগোষ্ঠীর সংখ্যালঘুরা গরিষ্ঠের শাসন মেনে নেয়। পূর্ব পাকিস্তানে কিন্তু বাঙালি সংখ্যালঘু ছিল না, উর্দুভাষী ছিল হাতেগোনা। বাঙালিদের অধিকার উর্দিপরা উর্দুভাষী শাসক মেনে নিতে চায়নি। মজার কথা, পশ্চিম পাকিস্তানেও উর্দুভাষী ছিল হাতেগোনা। বেশিরভাগই পঞ্জাবি, পাশ্তো, সিন্ধি, সরাইকি ইত্যাদিতে কথা বলতেন। এদিকে অসমেও বাঙালি ছিল সংখ্যাগুরু। দুই দেশেই শাসক চেয়েছিল বাংলার জায়গায় যথাক্রমে উর্দু ও অসমিয়া চালু করতে, শাসকের কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থ করতে। বাঙালিদের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিতে। আর তারজন্য চাই শাসিতের মাতৃভাষার উপর আঘাত হানা। ঠিক তাই করা হয়েছিল।

আমাদের জীবনের সমস্ত কিছু তিনটি জিনিসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় — ভাষা, চিন্তন ও জগৎ। ভাষা ছাড়া আমরা চিন্তা করতে পারিনা। মাতৃভাষায় আমরা চিন্তা করি, কল্পনা করি, স্বপ্ন দেখি। ভাষা ছাড়া চিন্তন অসম্ভব। চিন্তনের একটি মূল জায়গা হল জগৎ বা ওয়ার্ল্ড। ভাষার উপর আঘাত হানতে পারলে চিন্তার জায়গাকে ক্ষতবিক্ষত করা সম্ভব হবে আর সেটা সম্ভব হলে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জগতকে বুঝতে পারবে না মানুষ। উৎপাদন ব্যবস্থায় সে বিনা প্রশ্নে ক্রীতদাসের মতো পরিশ্রম করবে। চিন্তার জগতে সে পঙ্গু হয়ে পড়বে। উৎপাদন সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করবে না। শাসিত ও শোষিত হবে বিনা প্রশ্নে।

ভাষার এই সংগ্রাম শুধু বাঙালিদের একচেটিয়া, এরকম মনে হতে পারে। না। তামিল, কন্নড়, মালয়ালম, কোঙ্কনি ভাষা নিজেদের অধিকারের জন্য দশকের পর দশক আন্দোলন করেছেন। সংবিধানে স্বীকৃত ভাষার তকমা পেতে মৈথিলি, কোঙ্কনির বহু সময় লেগেছে। সাঁওতালিকে জনজাতি ভাষার মর্যাদা দিতেও দেরি করা হয়েছে অনেক। ২০০৩ সালে বোড়ো, ডোগরি, মৈথিলির সঙ্গে সাঁওতালি সংবিধানের অষ্টম তফশিলের অন্তর্ভুক্ত হয় ও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে।
 
২১ ফেব্রুয়ারি, সারা দুনিয়ার মাতৃভাষা দিবস। ক’মাস পর আসবে ১৯ মে। ভাষার এই যুদ্ধসমূহ হল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই। শাসকের দৃশ্য-অদৃশ্য শেকল কাটার সংগ্রাম। আর তার নাম ‘মুক্তিযুদ্ধ’। এ দেশেও বাজারের ভাষা, চাকরির ভাষা, ব্যবসার ভাষা হিসাবে একটি ভাষাকে শাসক বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছে। আদিবাসিদের ভাষাও একই ‘যুক্তি’তে বিলয়ের মুখে। ভাষার এই আধিপত্যবাদ রুখতে, শেকল কেটে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে স্মরণ করি পৃথিবীর সব শহীদ ভাষারোহীকে, শ্রদ্ধায় ও চিন্তায়।

- শামিম আহমেদ

flying Vijayaketan in the hands of the youth

পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের দ্বাদশতম সম্মেলন

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের দ্বাদশতম সম্মেলন অত্যন্ত সফলতার সাথে সমাপ্ত হয়েছে। এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায় মৌলালি যুবকেন্দ্রের শঙ্খ ঘোষ নগরে, যূথিকা রায়-অমিতাভ সরকার সভাগৃহে। মঞ্চের নামকরণ হয় পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি ও বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী প্রবীর বল ও সবার ভালোবাসার ও দায়িত্বশীল সংগঠক গায়ক অমিতাভ দে (ফুচকন) উভয়ের নামে। ‘কাণ্ডির’এর শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে “শত শহিদের রক্তে রাঙা পতাকা আজ আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি” শুনতে শুনতে সভাস্থল সংহত হয়ে উঠতে থাকে। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট নাট্যকার অভিনেতা ও সুপণ্ডিত শ্রী তীর্থকংর চন্দ মহাশয়। শহীদবেদীতে মাল্যদান ও তাঁদের স্মৃতিতে নীরবতা পালনের মধ্যে দিয়ে সভার কাজ শুরু হয়। শ্রী চন্দ তার উদ্বোধনী ভাষণে বর্তমান সরকারি সংস্কৃতিকে বিচ্ছিন্নতার সংস্কৃতি হিসাবে তুলে ধরেন। ভাষাজনিত বিচ্ছিন্নতার কথায় বরাক উপত্যকার ১১ জন শহীদ মহিলাকে স্মরণ করেন। শিল্প, থিয়েটার ইত্যাদির ভাষা নিয়ে আলোচনার সাথে সাথে স্কুলে কার্ড নামক এক সন্ত্রাসময় খেলার উল্লেখ উঠে আসে। এই ভয়ংকর বিচ্ছিন্নতাবোধকে সংস্কৃতি দিয়ে কীভাবে দূর করা যায় সে বিষয়ে তিনি এক গভীর ও মনোগ্রাহী আলোচনার সূত্রপাত করেন। সুমেলী চক্রবর্তীর “জননী গো কাঁদো, আরও কাঁদো তুমি শত শহীদের মা” সুললিত গানে “আমরা তো আছি বেঁচে”র ভরসা ছড়িয়ে পড়ে।

বিদায়ী সম্পাদক নীতীশ রায় খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেন। প্রতিবেদনের উপরে প্রতিনিধিরা বেশকিছু গঠনমূলক পরামর্শ দেন। তীর্থংকর চন্দর কথার রেশ ধরে পশ্চিম বর্ধমানের কৃশানু ভট্টাচার্য বলেন, ছবি বা লেখা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যা মানুষ বুঝতে পারে। যেমন, শিল্পী রবি বর্মা ঠাকুর দেবতাদের ছবি এঁকে নিচুজাতের মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। কারণ মন্দিরে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ঈঙ্গিত সংস্থার দীপক চক্রবর্তী মুখের কুভাষা কীভাবে বন্ধ করা যায় তা নিয়ে ভাবতে বলেন। তিনি আরও বলেন যে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে বিগতদিনের বামপন্থীদের গৌরবোজ্জ্বল প্রয়োগ শিল্পকলাগুলিকে স্মরণ করতে হবে। বারাসাত অন্যমনের তপন কাহালি বলেন, “লকডাউনে আমরা অনেক মানুষকে হারিয়েছি। সংস্কৃতিকে যেন না হারাই। গণসঙ্গীতের পাশাপাশি বাউল, লোকশিল্প, ছৌনাচ এগুলোকেও নিতে হবে, নিতে হবে গ্রাম পরিক্রমার উদ্যোগও।” বজবজের ‘চলার পথে’র সাবীর শেখ (রাজা) গঠনতন্ত্রে উল্লেখিত ‘মিটিংগুলিতে পঞ্চাশ শতাংশ উপস্থিত হলে মিটিং মান্যতা পাবে’র বদলে উপস্থিতি এক-তৃতীয়াংশ করার পরামর্শ দেন। এছাড়াও, মধ্যমগ্রাম শাখার অজয় সাহা, কবি গোপাল স্যাটিয়ার সহ আরও কয়েকজন মতামত রাখেন।

অতিথিদের মধ্যে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপংকর ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন। তিনি সংক্ষিপ্ত ভাষণে বিজেপি কোনোভাবেই যাতে বাংলাকে তাদের ল্যাবরেটরিতে পরিণত করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকার আবেদন জানান। সেক্ষেত্রে সৃজন, প্রতিরোধ ও সংহতির সংস্কৃতিকে শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত করার বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তাও ব্যখ্যা করেন। সামনে পার্টির একাদশ পার্টি কংগ্রেস ও রাজ্য সম্মেলন আছে। সেই লক্ষ্যে গান ছবি পোস্টার তৈরি করার আবেদনও জানান।

লেখক, গবেষক ও নবান্ন পত্রিকার বন্ধু নিত্যানন্দ ঘোষ অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, নবজাগরণের মনীষীদের পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত। যেমন রাজা রামমোহন বৃটেনে বসেই ভারতের কৃষকদের কর মকুবের দাবি তুলেছিলেন। নারীদের সুরক্ষার বিষয় নিয়েও তিনি সক্রিয় ছিলেন।

দীর্ঘ আলোচনার মাঝে মাঝে সদস্য সদস্যারা তাদের গান কবিতা সম্মিলিত আবৃত্তি দিয়ে সভাকে সর্বসময় প্রাণোচ্ছল করে রাখেন। সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকে মীরা চতুর্বেদী ও কলকাতার সায়ন-অয়ন্তিকার লালন গীতিতে মুগ্ধ গোটা সভা। বরিষ্ঠ গীতিকার সুরকার ও গায়ক প্রণব মুখোপাধ্যায় (রাঙা মামা) তাঁর নিজের গানে “বাংলা ভাষায় কথা বলি মোরা/ বাংলাতেই গান/ বাংলা মোদের মাতৃভাষা/ অমৃত সমান” আজও সাবলীল। আর ছোট্ট মেয়ে মেহুলীর কণ্ঠে “সবকটা জানালা খুলে দাও না, আমি গাইবো বিজয়ের গান” চোখে জল এনে দেয়। একই রকম উদাত্ত কন্ঠে বিশ্বরূপ আর রাজা সভাকে চনমনে করে দেন। বালীর ঈঙ্গিতের সাথীরাও সুন্দর গাইলেন। কবিতা পাঠ করলেন কৌনিক সেন। মধ্যমগ্রাম শাখার সমবেত আবৃত্তি পরিবেশনায় পরিবেশ মথিত হয়ে গেল। সভায় তরুণ যুবদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। মোট উপস্থিতি ১০১ জন। উত্তরবঙ্গ, দুই ২৪ পরগণা, হাওড়া, হুগলি, পশ্চিম বর্ধমান ও কলকাতা থেকে ১৬টি সংগঠনের ৬০ জন, ব্যক্তিগতভাবে ৩০ জন ও ১১ জন অতিথি উপস্থিত ছিলেন।

একগুচ্ছ কর্মসূচি ও সবার সমর্থন নিয়ে খসড়া প্রতিবেদন গৃহীত হয়। ৫৮ জনের রাজ্য কাউন্সিল ও ১৯ জনের (৮ জন তরুণ-যুব বয়সের) কার্যকরী সমিতি তৈরি হয়। দেবাশীষ চক্রবর্তী পুনরায় সভাপতি পদে মনোনীত হন। সম্পাদক মনোনীত হন ‘অগ্নিবীণা’র সংগঠক ও বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী শ্রী সরিৎ চক্রবর্তী (বাবলি)। বিদায়ী সম্পাদক শ্রী নীতীশ রায় তার বিদায়ী ভাষণে বয়ষ্ক সাথীদের অবদান স্বীকার করে তরুণদের দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানান। নতুন সম্পাদক শ্রী সরিৎ চক্রবর্তী আবেগঘন গানে ও কথায় পেছনের সাথীদের সামনে টেনে আনার ও যারা বিভিন্নভাবে মূল সংগঠন থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন তাদের সংগঠনে নিয়ে আসার কথা বলেন। সভার শেষে আনিস খানের নৃশংস হত্যার নিন্দা করে হত্যার বিচারের দাবি তোলা হয়। সবশেষে সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক গানের মধ্যে দিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

Yogi Adityanath Sarkar was pushed

যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন, তিনি সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ নেবেন। সরকারি সম্পদের তথাকথিত ক্ষতিকে ফিকির বানিয়ে জরিমানা আদায়ও কি সেই প্রতিশোধের অঙ্গ হয়েছিল? কয়েকদিন আগে, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের একটা রায় যেন এই বিষয়টাকেই প্রতিপাদিত করল। জরিমানা আদায়ের গোটা প্রক্রিয়াটাকেই অবৈধ ঘোষণার আবেদন জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন সমাজ আন্দোলনের কর্মী পারভেজ টিটু। বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় এবং সূর্যকান্তর বেঞ্চ তাঁদের রায়ে বলেন, আন্দোলনকারীদের থেকে জরিমানা আদায় বৈধ পথে হয়নি, আর তাই সেই অর্থ যাদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে তাদের ফেরত দিতে হবে। বিচারপতিরা তাঁদের রায়ে বললেন, “চূড়ান্ত বিচারে, রাষ্ট্রের সম্পদকে রক্ষা করতেই হবে। কিন্তু এরই সাথে একটা বিচারবিভাগীয় ফোরামকেই তার পরিচালনা করতে হবে যাতে যথাযথ প্রক্রিয়া সুনিশ্চিত হয়। এটাই হল আমাদের দুটো রায়ের মোদ্দা কথা।” অর্থাৎ, জরিমানা আদায় করতে গিয়ে ২০০৯ ও ২০১৮ সালে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের দুটো রায়ে যোগী প্রশাসন কোনো গুরুত্বই দেয়নি। রায় দুটোতে সুস্পষ্টরূপে বলা ছিল, জরিমানা আদায় আইনি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে করতে হবে, আমলাদের জরিমানা আদায় প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখতে হবে। কিন্তু মোদী প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা শাসকরা জরিমানা আদায়ের নোটিশ ছেড়েছেন, আদায় প্রক্রিয়ায় সক্রিয় হয়েছেন।

মামলার নথিপত্র খতিয়ে দেখার পর বেঞ্চের বিচারপতিদের ধারণা হয় যে, জরিমানা আদায় করতে গিয়ে উত্তরপ্রদেশ সরকার নিজেই “অভিযাগকারী, বিচারক এবং মামলার আইনি পরিচালক” হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে, গোটা ব্যাপারটায় নিরপেক্ষতা না থাকা এবং প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারের সম্ভাবনাই প্রবল ছিল। আর বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার বাস্তব ব্যাপারটাতো ছিলই। প্রত্যাশিতভাবেই, মামলার এর আগের শুনানিতে ১১ ফেব্রুয়ারি বিচারপতিরা উত্তরপ্রদেশ সরকারের প্রতিনিধি অতিরিক্ত অ্যাডভোকেট জেনারেলকে বলেন, “হয় আপনারা এই জরিমানা প্রক্রিয়া বাতিল করবেন, আর তা না হলে আমরা এই আদালত দ্বারা তৈরি আইনের লঙ্ঘন হয়েছে বলে সেগুলো খারিজ করে দেব।” এই নির্দেশের পরিণাম স্বরূপ উত্তরপ্রদেশ সরকার ২৭৪টা মামলা তুলে নেয়। এবং সেগুলোকে নতুন গঠিত সাংবিধানিক ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তরিত করা হয়েছে বলে আদালতকে জানায়। অর্থাৎ, যাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে তাদের রেহাই না দেওয়ার অভিপ্রায়ে রাজ্য সরকার ‘সাংবিধানিক ট্রাইব্যুনাল’ প্রসঙ্গের অবতারণা করে। আদালতের কাছে উত্তরপ্রদেশ সরকারের প্রতিনিধি নিবেদন করেন যে, জরিমানা হিসাবে আদায় করা টাকা হয়েছে ‘বহু কোটি’ আর তা ফেরানো রাজ্য সরকারের পক্ষে অসুবিধাজনকই হবে। কিন্তু বিচারপতিরা রাজ্য সরকারের অনৈতিকতা সম্পর্কে এবং আদায় করা জরিমানা ফেরানোর ব্যাপারে এতটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে, রাজ্য সরকারের প্রতিনিধির মিনতিকে খারিজ করে বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, “নাগরিকদের সম্পত্তি যখন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, এবং সরকারের যে নির্দেশ অনুসারে ঐ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তা বাতিল করা হয়েছে, আমরা তখন কি বলতে পারি যে, নির্দেশগুলো বাতিল হয়ে গেলেও বাজেয়াপ্ত হওয়াটা চলতে থাকবে? আপনারা যখন নির্দেশগুলো প্রত্যাহারের ন্যায্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমরা তখন বলতে পারি না যে বাজেয়াপ্ত হওয়াটা অব্যাহত থাকবে।”

মামলার শুনানির সময় বিচারপতিরা যখন বলেন যে, ‘বিচারকোচিত মানসিকতার’ তত্ত্বাবধানেই জরিমানা আদায় প্রক্রিয়া পরিচালিত করতে হবে, তখন তা আমাদের বিবেচনাকে গোটা প্রক্রিয়াটার আইনসিদ্ধতার মধ্যে নিবদ্ধ না রেখে তার ন্যায়নিষ্ঠতার অনুসন্ধানেও আগ্ৰহী করে তোলে। আমাদের জিজ্ঞাসাকে নিয়ে যায় এই প্রশ্নগুলোর দিকে — যাদের কাছে নোটিস পাঠিয়ে জরিমানা আদায় করা হয়েছিল তাঁরা কি সত্যই অপরাধী ছিলেন? তাঁদের হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের প্রকৃতই কোনো ক্ষতি কি হয়েছিল? নোটিশ প্রাপকদের মধ্যে সবাই কি প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন? জরিমানা আদায়ের তৎপরতার মধ্যে প্রশাসনিক প্রতিহিংসার কোনো স্পৃহা কি সক্রিয় ছিল?

সিএএ বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল ২০১৯’র শেষ দিকে। সে সময় উত্তরপ্রদেশের প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলোর পর্যালোচনা দেখাচ্ছে, যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসন এই আন্দোলনের মোকাবিলায় পৈশাচিক দমন নামিয়েছিল, পুলিশকে লেলিয়ে দিয়েছিল প্রতিবাদকারীদের ওপর। পুলিশী দমনের পরিণতি কি হয়েছিল তা জাহির করতে সে সময় মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের সচিবালয় থেকে করা একটা টুইট জানিয়েছিল, “প্রত্যেক দাঙ্গাকারীই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক বিক্ষোভকারী হতভম্ব হয়ে গেছে। যোগী আদিত্যনাথ সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ায় প্রত্যেকেই চুপ মেরে গেছে। যাই করা হোক না কেন, যারা সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করছে তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকেই ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে। প্রতিটি সহিংস বিক্ষোভকারীকেই কাঁদতে হবে, কেননা উত্তরপ্রদেশে যোগী সরকার রয়েছে।” মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের এই টুইটে সে সময়ের বাস্তব পরিস্থিতির, পুলিশী নির্মমতার প্রতিফলন ঘটেছিল। সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে অস্তিত্বহীন করা হয়েছিল। সে সময়ের একটা তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অন্তত ৩২৭টা এফআইআর দায়ের হয়েছিল, অপরাধ নিবারণের অজুহাতে ৫,৫৫৮ জনকে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছিল। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল, যাতে মারা গিয়েছিল অন্তত ২৩ জন। রাজ্য সরকার পুলিশের গুলিতে এত মৃত্যুর কথা অস্বীকার করলেও তথ্যানুসন্ধানী কমিটির রিপোর্ট পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর তথ্যকেই প্রতিষ্ঠিত করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথও এই সমস্ত মৃত্যু সম্পর্কে বলেছিলেন, “কেউ যদি মৃত্যুর ইচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসে তাহলে সেই ব্যক্তি বেঁচে থাকবে কী করে।” প্রতিবাদকারীদের ঘরে ঢুকে পুলিশ তাদের সম্পদের ধ্বংসে মেতে উঠেছিল। প্রতিবাদীদের ধাওয়া করে হিন্দু মহল্লার দিকে নিয়ে গিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের উদ্দেশ্যে জনৈক পুলিশ অফিসারের আহ্বান ছিল, “আমরা হিন্দু, তোমরাও হিন্দু, ওদের মারো”। আর, মুসলিমদের ছবি দেওয়া পোস্টারে সারা রাজ্যকে ছেয়ে দেওয়া হয়েছিল, পোস্টারের ছবি দেখে মুসলিমদের অনুসন্ধান দিতে পারলে পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। আদালতের নির্দেশে সেই সমস্ত পোস্টার অবশ্য পরে আদিত্যনাথ প্রশাসনকে সরিয়ে নিতে হয়।

এ হল সিএএ’র বিরুদ্ধে আন্দোলনের মোকাবিলায় মুসলিম-বিরোধী রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের সংক্ষিপ্ত আলেখ্য। তবে, জরিমানা আদায়কে কেন্দ্র করেও চলেছিল চরম স্বেচ্ছাচার, শুধু মুসলিম নাম পেয়েই নোটিশ পাঠানো হয়েছিল, তারা আন্দোলনে বা সহিংস কার্যকলাপে যুক্ত ছিল কিনা তা বিবেচিত হয়নি। যাদের গৃহবন্দী করা হয়েছিল, রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ ধ্বংসের কোনো সুযোগ যাদের ছিল না, তাদের কাছেও জরিমানা জমা করার নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। পারভেজ টিটু তাঁর আবেদনপত্রে জানিয়েছেন, যাদের নামে নোটিশ গিয়েছিল তাঁদের মধ্যে ছিলেন ছ’বছর আগে মারা যাওয়া ৯৪ বছর বয়স্ক এবং দীর্ঘদিন রোগে ভুগতে থাকা ৯০ বছরের বেশি বয়স্ক দুজন মানুষ। পারভেজ টিটুর আইনজীবী নীলোফার খান আদালতে জানিয়েছেন, “রিকশাচালক, সব্জি বিক্রেতা এবং মুরগির মাংসের দোকানদাররাও অন্যায়ের শিকার হয়েছেন এবং তাঁদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। … নিজেদের ঠেলাগাড়ি বিক্রি করে তাঁদের রাষ্ট্রের চাপানো ক্ষতিপূরণ মেটাতে হয়েছে।” জরিমানা আদায়ে কেমন স্বেচ্ছাচার চালানো হয়েছে সে সম্পর্কে নিজের মতামত পেশ করে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মার্কাণ্ডেয় কাটজু ‘দ্য ওয়্যার’ ওয়েব পত্রিকায় ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি একটা নিবন্ধে জানিয়েছেন, “মোরাদাবাদের শাহেনশাহ, সেখানকার জেলা শাসক রাকেশ সিং কবি ইমরান প্রতাপগড়ির ওপর চাপিয়েছেন ১.০৫ কোটি টাকার জরিমানা এবং তা মোরাদাবাদের ইদগাহতে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকার জন্য। এই জরিমানার হিসাব কষা হয়েছে ইদগাহের প্রতিবাদ স্থলে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর নিয়োগে দৈনিক খরচের ভিত্তিতে।” ঐ নিবন্ধে শ্রীযুক্ত কাটজু আরো জানিয়েছেন, মুজাফ্ফরনগরের জেলাশাসক ৬৭টা দোকান বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন যেগুলোর মালিক নাকি সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীরা। কিন্তু কোন আইনের বলে এবং কিসের ভিত্তিতে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে, এবং নিজেদের বক্তব্য পেশের কোনো সুযোগ তাদের দেওয়া হয়েছিল কিনা তা প্রশাসনের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে না। জরিমানা আদায়ে চালানো স্বৈরাচারিতার নিদর্শন স্বরূপ এখানে আর মাত্র একটা ঘটনারই উল্লেখ করা যাক। লক্ষ্ণৌয়ের হজরতগঞ্জের পরিবর্তন চকে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের জন্য অভিযুক্ত করে নোটিশটা পাঠিয়েছিলেন অতিরিক্ত জেলা শাসক কে পি সিং। নোটিশে ২৮ জন সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীর নাম ছিল, এবং তাঁদের ৩০ দিনের মধ্যে ৬৩ লক্ষ টাকা জমা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। যাঁদের নামে নোটিস গিয়েছিল তাঁদের মধ্যে ছিলেন ৭৭ বছরের অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার এস আর দারাপুরি এবং সমাজ আন্দোলনের কর্মী ৭৩ বছর বয়স্ক মহম্মদ সোয়েব যাঁরা সে সময় গৃহবন্দী ছিলেন।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা যোগী আদিত্যনাথ সরকারের একটা স্বৈরাচারী পীড়নকে অবৈধতার অভিযোগে বিদ্ধ করে ন্যায়বিচারকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। ওপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, যারা প্রতিবাদে অংশ নেয়নি, কোনো সহিংস কার্যকলাপে এবং সরকারি সম্পদের ধ্বংসে যুক্ত ছিল না, যারা গৃহবন্দী ছিল, তাদেরও সম্পদ ধ্বংসে অভিযুক্ত করে নোটিশ পাঠিয়ে তাদের কাছ থেকে জোরজবরদস্তি জরিমানা আদায় করা হয়েছে। জরিমানা আদায় যে প্রতিশোধ গ্ৰহণের স্পৃহা থেকেই চালানো হয়েছিল, সিএএ বিরোধী আন্দোলনের মোকাবিলা যে নির্ভেজাল হিন্দুত্ববাদী আগ্ৰাসনে পরিণত হয়েছিল, তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকতে পারেনা। তবে, আইনি আদালতে ধাক্কার সাথে জনতার আদালতে ধাক্কাটাও অত্যন্ত জরুরি। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের জনগণ মোদী-যোগীদের পরাজয় ঘটিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের জোরালো ধাক্কা দিতে পারেন কিনা তার দিকে আমরা সাগ্ৰহে তাকিয়ে থাকব।

- জয়দীপ মিত্র

Narendrapur police station

(থানা হেফাজত-জেল হেফাজত থেকে ফিরে লিখলেন সৌমী জানা)

রাত তখন কত হবে — সাড়ে আটটা। থানার বিল্ডিং’এ পেল্লাই একটা বিয়েবাড়ি। চকমকে জামাকাপড় পরে ঘুরছে, উঠছে, নামছে। তাদের সামনে আমাদের বেধড়ক পেটানোর সময় পুলিশকে চরম অশ্রাব্য ভাষায় বলতে শুনেছি ৮৫,০০০ টাকা দিয়ে লোকে বিয়েবাড়ি ভাড়া করবে আর এই ‘....’ বুদ্ধিজীবীরা বাইরে হিজড়াগিরি করবে (হিজরাগিরি মানে আমাদের গান, স্লোগান)। ওদিকে আমাদের ৬ জন সাথী বাকস্বাধীনতার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে একদফা চরম নির্যাতিত হয়ে থানায় প্রহর গুনছে। আর আমরা ততোধিক চিন্তায় বাইরে অপেক্ষা করছি কখন বেরোবে, কখন দেখব ওদের, বুকে জড়িয়ে ধরব। চায়ের দোকানে প্রত্যেকের কয়েকবার ঢুঁ মারা হয়ে গেছে, তখনও বুঝিনি ওখানেও নিজেদের লোক ছেড়ে রেখেছে নরেন্দ্রপুর থানার পুলিশ, আমরা কি বলছি কি করছি সব নখদর্পণে রাখার জন্য। বাড়ছিল রাত।

সাথীরা উপরে বসেছিলেন। ডিটেইন করা সাথীদের মুক্তির কাজ চলছিল। উপরে খোঁজ নিতে যেতেই কনস্টেবল খুব খারাপভাবে বললেন কতজন আসতে হবে, আছে তো লোক, বললাম এভাবে কথা বলছেন কেন! আমরা তো ঢুকিনি, আপনাদের কথামত ৩ জনই তো গেছেন। তখনও একদফা খারাপ ব্যবহার করল আবার, কথা না বাড়িয়ে নিচে নেমে এলাম বাকিরা।

এরপর অনেক টালবাহানা করে ছাড়া হয় সাথীদের পিআর বন্ডে। ওরা নিচে নামতে তাদের স্বাগত জানিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরি আমরা। স্লোগান দেওয়া হয় ‘কমরেড লাল সেলাম’। এতেই নাকি বিয়ে বাড়ির বিশাল অসুবিধা হয়ে যায়! জামিন পাওয়ার পর ওসি আমাদের নির্যাতনের সাফাই দিতে এই একটাই ‘যুক্তি’ দেখাতে পেরেছে — আর বলেছে আমরা নাকি পুলিশকে মেরে রাস্তায় শুইয়ে দিয়েছি। যাই হোক, হঠাৎ করে পুলিশ ফোর্স নেমে আসে, মুক্তি পাওয়া সাথীদের বুকে ধাক্কা দেওয়া শুরু করে, তুই-তোকারি শুরু করে। আমরা জিজ্ঞেস করি, গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন, এভাবে কথা বলছেন কেন? থানার সেকেন্ড অফিসার (‘মেজো বাবু’) হঠাৎ করে বলে ওঠেন, দেখবি কী করতে পারি! এই মার সবকটাকে, পেটা পেটা। তখনি আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ বাহিনী। চোখের সামনে নিজেদের সাথীদের রক্তাক্ত হতে দেখি, জড়িয়ে ধরে বাঁচানোর চেষ্টা করি, বেধড়ক পেটানো শুরু করে কতগুলো জানোয়ার পুরুষ পুলিশ, আমার একটা পা টেনে ধরে নির্দেশ দেওয়া হয় মাঝখানে মানে যৌনাঙ্গে মারতে। বারংবার বিভিন্নভাবে মহিলা সাথীদের প্রতি এই নির্দেশই দেওয়া চলে, সাথে অশ্রাব্য গালিগালাজ, যা লেখা যায় না, মেয়েদেরকে শরীর, যৌনাঙ্গ নিয়ে অশ্রাব্য লেখার অযোগ্য ভাষায় চলে আক্রমণ। ওই অবস্থাতেও আমরা বারবার জিজ্ঞেস করি, মহিলা পুলিশ কোথায়? আমাদের মাটিতে ফেলে আরও পেটাতে পেটাতে এক পুলিশ কর্মী বলেন, “একি, ছেলে না মেয়ে, কোথায় মারব বুকে না নীচে”! এক সাথীর মাথা গাড়ির চাকার নিচে ঠেসে ধরা হয়, পেছন থেকে ঠেলতে থাকেন দু’জন পুলিশ, তাকে বাঁচাতে গেলে চলে নির্যাতন, মারের মধ্যেই চোখের সামনে দেখি আকাশ, রুদ্র, মুজতবা সহ সাথীদের সিঁড়ি দিয়ে ঘষতে ঘষতে উপরে তিনতলায় তুলছে, তাদের জাত গায়ের রং নিয়ে চলছে আক্রমণ, চলছে মহিলা বিরোধী অশ্রাব্য গালিগালাজ। একজনকে ক্রমাগত পেটে বুকে ফেলে মারা হচ্ছিল যার সুগার, লিভারের অসুখ, চুল ধরে ঘষতে ঘষতে তোলে তাকেও, রাস্তার মধ্যেই বুট দিয়ে চেপে ধরা হয় সাথীদের মাথা। আমরা ধরতে গেলে ক্রমাগত লাথি ও লাঠি দিয়ে পেটানো চলে আমাদের, সব করে পুরুষ পুলিশ। এরমধ্যেই নামে দুজন মহিলা অফিসার, তারা আসতে আর একদফা আমাদের মহিলাদের মারধর চলে, একইভাবে ঘষতে ঘষতে তিনতলায় তোলা হয়। আমরা বারবার একটাই কথা জিজ্ঞেস করেছি — কী অপরাধ আমাদের? কেন মারা হচ্ছে? উত্তর পাইনি আমরা, বদলে শুধু ঝাঁপিয়ে পড়ছিল উর্দি পরা একদল হায় না।

February 7 is the night of that horrible torture

মনে পড়ছে সেদিন লকআপে অত্যাচারের কথা। মেরে মেরে প্রায় মৃত করে দেওয়া হয়েছিল। দেওয়া হয়নি ওষুধ, জল, স্যানিটারি ন্যাপকিন। চারিদিক নিঝুম হয়ে আসছিল, আর ততোধিক ক্ষত তৈরি হচ্ছিল আমাদের শরীরে, কান্নার স্বর যেন আর বেরোচ্ছিল না। আর একটা পর্যায়ে, মনে হচ্ছিল মৃত্যু আসুক, ঘুমাই একটু, আক্ষেপ হচ্ছিল শুধু কমরেডদের যদি একবার বলতে পারতাম — লড়াই যেন না থামে। আর ছিল মাথা উঁচু করে থাকার দৃঢ়তা।

খুব আক্ষেপ হচ্ছিল সেদিন কেন পারছি না আমার সাথীদের বাঁচাতে, রাগ হচ্ছিল আধো হুঁশেও। ঘষতে ঘষতে তুলেছিল তিন তলায়। তুলেই বয়স্ক সাথী মলয়কে ক্রমাগত পেটানো হয়, ধরে আটকাতে গেলে শুরু হয় আমাদের উপর নির্যাতন, পুরুষ পুলিশদের। তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয় একপ্রকার আমাদের উপর, ক্রমাগত লাঠি-লাথি চলতে থাকে। রাতের নিস্তব্ধতায় যেন আঁচড় কেটে যাচ্ছিল অত্যাচারের সেই নৃশংসতা। পাশের ঘরে ‘মেজবাবু’র ক্রমাগত নির্দেশ মার না থামানোর। আর সঙ্গে চলছিল পুরুষ পুলিশদের জামা তুলে আমাদের দিকে যৌনগন্ধী মর্ষকামী ইঙ্গিত। ওই অবস্থাতেও প্রশ্ন করেছিলাম একবার তো বলুন কেন মারছেন? আমার ইউটিআই’এর ট্রিটমেন্ট চলছিল, তাই বলি পেটে বুকে আর যৌনাঙ্গে প্লিজ মারবেন না, আমার ট্রিটমেন্ট চলছে। তারপর থেকে যতগুলো মার মেরেছে সব মুখ বুক পেট আর যৌনাঙ্গের দিকে। আর সঙ্গে বারংবার একই উক্তি — মাথা নিচু করবি কিনা বল, চুপ করবি কিনা বল, গুলি করে দেব। সাথীরা একই উত্তর দিয়েছে, সোচ্চারে বলেছে করুন গুলি, মারুন কত মারবেন। চাওয়া হয়েছিল ফোনের পাসওয়ার্ড। দেয়নি কেউ। এটা বলেই যে ফোন আমাদের ব্যক্তিগত। এরপর আমার উপর আরও বাড়ে নির্যাতন। ক্রমাগত লাথি মারা হয় বুকে, পেটে, পুরুষ ও মহিলা পুলিশ সবাই। টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয় মহিলা সেলে, যেখানে সিসি টিভি লাগানো। মহিলা সাথীরা প্রস্রাব করতে চাইলে তাদের বাধ্য করা হয় ওই সেলে সিসিটিভি আওতার মধ্যেই তা করতে। সারারাত ওভাবেই মানুষ থাকার অযোগ্য একটা সেলে ফেলে রাখা হয় আমাদের। বাইরে থানার মধ্যে চলতে থাকে আসর, দুই একজন ছাড়া সবাই দেখি হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরে ফেলেছে, একজন যিনি চা ইত্যাদি দেন তিনি ছাড়া কোনও মহিলা নেই, আইটেম সং চলছে জোরে। মোটামুটি পিকনিক পরিবেশ। জানি না কোথায় ছিলেন আমাদের ভারপ্রাপ্ত থাকা মহিলা পুলিশ অফিসার। মাঝরাতে এই তীব্র অত্যাচারের দরুণ শুরু হয় আমার তীব্র যন্ত্রণা, বাড়ে ইউটিআই। সেই অবস্থায় ফুটবল খেলার ভঙ্গিতে পুরুষ পুলিশরা এসে সার্কাস দেখার মতো দেখতে শুরু করে, ইউটিআই হয়েছে বলার পরও কেউ বলে আমি নেশা করি, নেশার জিনিস পাচ্ছি না বলে এরকম হচ্ছে, কেউ বলে ওকে গ্যাসের ওষুধ দে, নাটক করছে পালিয়ে যাবে বলে। শেষে চোখ দাঁড়িয়ে যাবার অবস্থায় একজন পুরুষ পুলিশ কর্মী আমায় সেল থেকে টেনে বের করে, জিজ্ঞেস করে কী নেশা করি, তখন সেল থেকে সাথী বর্ষা চেঁচিয়ে ওদের বোঝাতে থাকে ইউটিআই কী। অত বড় থানায় কেউ জানে না কী ইউটিআই। আবার ঘষতে ঘষতে নামানো হয় নিচে, নির্দেশ দেওয়া হয় আমায় শুতে না দিতে, ধরে রাখতে। জুতো পরতে চাইলে বলে ক্রিমিনালরা জুতো পরে না। হসপিটালের সামনে গাড়ি নামিয়ে টানতে টানতে ঢোকানো হয় কোভিড ওয়ার্ডে, খুলে নেওয়া হয় মাস্ক। প্রশ্ন করি এটা তো কোভিড ওয়ার্ড, বদলে আবার চড় বসানো হয় গালে। অবাক হই সত্যি, প্রায় মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও খানিক হেসেই ফেলি, বলি এতদিন ধরে মেডিকেল কেস করছেন জানেন না কোনটা কোভিড আর কোনটা ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড। জানতাম মারবে আবার, কিন্তু কী করি এটাই যে শিক্ষা লড়ে যাওয়ার। হসপিটালে ওষুধ না থাকায় একইভাবে টেনে টেনে নিয়ে যায় বারুইপুর হসপিটালে। একই জিনিস করে সেখানেও।

এতক্ষণে এসে পৌঁছায় আমাদের দায়িত্বে থাকা মহিলা পুলিশ। এসে নার্সকে একপ্রকার জোর করে, অতো ভালো করে কিছু করার দরকার নেই। এরপর যেভাবে ইনজেকশন দেওয়া হয় আর চ্যানেল করা হয় মনে হচ্ছিল মৃত্যু আসুক এবার। কিন্তু মাথা নোয়ায়নি কেউ তখনও। বারবার একই কথা খালি বলা হচ্ছিল — এই তো আরও মারছি, কী করতে পারবি আমাদের। মাথা উঁচু করেই হেসেছিলাম আমরা। মানুষ হয়ে আজ্ঞাবহ যন্ত্রে যারা পরিণত হয় তাদের জন্য করুণাই হয় আমার। ক্যাথিটার করার কথা বলেছিল ডাক্তার, ধমকানি খেয়ে আর বোধহয় সাহস করেনি আমার চিকিৎসা করার। আমার সামনেই ডাক্তারকে লিখতে বলা হয় যে লিখুন ও ‘ফিট’। প্রসঙ্গত বলি, যেসব মেডিকেল রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে তার প্রতিটা ফেক। আমাদের কোনও মেডিকেলই করা হয়নি। থানা লকআপে ফিরে এসে দেখি সেলে কুঁকড়ে শুয়ে আছে বর্ষা। আসতেই কোলে এসে মাথা রাখল — সৌমিদি খুব ভয় করছিল, এরা যেভাবে কথা বলছিল তুমি যাওয়ার পর ওরা রেপ করতে পারে জানো। ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মনে পড়ছিল কত কথা। বোধহয় ব্যাথায় যন্ত্রনায় ঘোর লেগেছিল, দেখছিলাম লাল টকটকে একটা সূর্য। আর ধর্মনিরপেক্ষ থানায় সকাল বেলা চলতে থাকে গীতা, হনুমান চালিশা। হ্যাঁ, নরেন্দ্রপুর থানাতেই।

- সৌমী জানা

Surjit Sengupta

“আমি যখন কিশোর তখন আমার বাড়ির দরজার গোড়ায় প্রায় চোখের সামনে খুন হয়ে যান স্বপ্ন দেখা এক বিপ্লবী বামপন্থী কর্মী। গোটা জীবন জুড়ে সেই রক্তের স্রোত মিশে গিয়েছিল আমার ফুটবলে, আমার জীবন চেতনায়”, এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন ফুটবলার সুরজিত সেনগুপ্ত। বিক্ষুব্ধ সময়ের অভিঘাত এইভাবেই বুঝি ছড়িয়ে যায়। ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সময়ে যে ময়দানে গোপনে হত্যা করা হয়েছে সিন্ধু-চেতনায় বলীয়ান বর্ষীয়ান বিপ্লবী সরোজ দত্তকে, প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে তরুণ নাট্যকর্মী প্রবীর দত্তকে, সেই ময়দানে সেই রক্তস্রোত আর চেতনায় জারিত এক ফুটবলার ফুটবল শিল্পে মুগ্ধ করছে এমন এক প্রজন্মকে, যাঁদের মনে দেশ ছেড়ে আসার দগদগে স্মৃতি, অনেকে ঘর ছেড়েছে দেশকে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে, কেউ বেকার, কেউ বা ভবঘুরে বা অন্যকিছু।

শুধু বাঙালিরাই নয়, সারা দেশের মানুষ দু’চোখের মুগ্ধতা নিয়ে দেখেছে ডান প্রান্ত দিয়ে ছুটে চলা, তারপর সেন্টার, যা থেকে কখনও শ্যাম থাপার পা, কখনও রঞ্জিত মুখার্জির মাথা ছুঁয়ে বল চলেছে জালের দিকে, আর সাত-আনা দশ-আনার গ্যালারিতে জীবনের নানা ক্ষেত্রে অপমানিত, অত্যাচারীত মানুষগুলো জয়ের স্বপ্ন দেখছে, সমস্বরে আওয়াজ তুলছে ... গো-ও-ও-ল !

মহসিন কলেজে পড়ার সময় থেকেই বিশুর (সুরজিতের ডাক নাম) ফুটবলে নামডাক হওয়া শুরু, টেনিস বলের ক্রিকেট টুর্নামেন্টেও ব্যাটার হিসেবে বিলক্ষণ সুখ্যাতি ছিল তার। পরবর্তীকালে কোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় দলের বিরুদ্ধে কর্ণার থেকে বাঁক নেওয়া শটের সরাসরি গোলে ঢুকে যাওয়া কিংবা সন্তোষ ট্রফিতে পরপর দু’দিন বাংলার লড়ে জয়লাভতো ফুটবলের গল্পকথায় স্থায়ী আসন লাভ করেছে। কিন্তু ফুটবল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সুরজিত সেনগুপ্ত নিজে যাঁর কথা বহুবার বলেছেন তিনি হলেন ভোলাদা (অশ্বিনী বরাট)। ব্রাঞ্চ স্কুলের মাঠে তাঁরই কোচিং থেকে উঠে এসেছেন সুরজিত সেনগুপ্ত, ভোলাদার প্রিয়তম শিষ্য ছিলেন সুরজিত। স্থায়ীভাবে কলকাতায় আসার পরও যখনই হুগলিতে আসতেন তখন ভোলাদার সাথে দেখা করতে আসাটা ছিল আবশ্যিক আর সাথে থাকত কোচিং-এর দুঃস্থ ছেলেদের জন্য বুট কিংবা অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। যখন খেলার পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেছেন তখন ভোলাদার কিংবা মফস্বলের অন্যান্য কোচিং-এর দুঃস্থ কিন্তু প্রতিভাবান ফুটবলারদের কথা লিখেছেন। হুগলির ফুটবল জগতে পরিচিত মৎসজীবী পরিবারের ছেলে শান্তনু বলছিল, “আমার কিংবা চর্মকারের ছেলে বাবুলালের কথা লেখার সময় আমাদের আর্থিক দুরবস্থার কথাও লিখেছিলেন তিনি, যাতে আমাদের সাহায্যের জন্য মানুষ এগিয়ে আসেন”। এহেন মানুষ ফুটবলারদের স্বার্থরক্ষার জন্য ফুটবলার ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন গড়ে তোলার মূল কারিগরই হবেন। কর্মকর্তাদের বিরোধিতা করে একঝাঁক ফুটবলারকে নিয়ে ইষ্টবেঙ্গল ক্লাব ছেড়ে ফুটবল মাঠে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন সুরজিত সেনগুপ্ত। নাগরিকের অধিকার হরণের প্রতিবাদে সহমন চেয়ে আবেদন জানালে যুবচেতনাকে নিরাশ করতেন না।

ব্যক্তি মানুষ যেমন আকাশে, আলোতে, ধূলায়, ঘাসে মুক্তি অনুভব করেন তেমনি সমষ্টিগতভাবে মুক্তির জন্য চলে এক অবিরাম লড়াই। সেই লড়াইয়ের খেলা গড়িয়ে চলে অতিরিক্ত সময়ে। লড়াইয়েও থাকে স্বপ্ন, থাকে স্মৃতি। সেই স্মৃতির সত্তরে সুরজিত সেনগুপ্ত, সুভাষ ভৌমিকরা থাকেন। স্মৃতির আকাশে উলগানাথনের সাথে জায়গা বদল করা সুরজিত বাম প্রান্ত থেকে ভাসিয়ে দেন বল, উদ্বেলিত গ্যালারি, উদ্বেলিত জনতা। ফুটবল আর জীবন কোথাও মিশে যায়। মিশিয়ে দেন, মিশে থাকেন, মিশে থাকবেন সুরজিত সেনগুপ্ত!

- ভিয়েত

Comrade Molina Bhattacharya

আমরা হারালাম আমাদের সকলের প্রিয় বৌদি কমরেড মলিনা ভট্টাচার্যকে। ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কমরেড মলিনা ভট্টাচার্য পূর্ব বর্ধমান জেলার সদর ১নং ব্লকের ভান্ডারডিহি গ্রামে নিজের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। তিনি রেখে গেলেন তাঁর একমাত্র পুত্র কল্যাণ ভট্টাচার্য ও স্বামী কমরেড অন্নদাপ্রসাদ ভট্টাচার্য সহ আত্মীয় স্বজন ও গুণমুগ্ধ পার্টি কমরেডদের। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই বাম আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সংগঠক এবং সিপিআই(এম) কর্মী ছিলেন। ৯০’র দশকে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাথে যুক্ত হন। বলাবাহুল্য, সেই থেকে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন। সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পূর্ব বর্ধমান জেলা সভানেত্রী ছিলেন। তিনি পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে ছিলেন অসীম ধৈর্য্যশীল, কঠোর পরিশ্রমী, সদাহাস্যময় মানবিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। কমরেড ও জনগণের সাথে সব সময়ই দরদী ও মধুর ব্যবহার করতেন। তাঁর মৃত্যুতে পার্টি ও পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি হল। পূর্ব বর্ধমান জেলা কমিটি এই কমরেডের মৃত্যুতে শোকাহত এবং তাঁর পরিবারও শুভানুধ্যায়ীদের শোকের অংশীদার এবং এই কমরেডের জীবন আদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান রাখছে।

কমরেড মলিনা ভট্টাচার্য লালসেলাম। কমরেডের স্মৃতি অবিনশ্বর হোক।

rally against anish murder

== সমাপ্ত ==

খণ্ড-29
সংখ্যা-8