আজকের দেশব্রতী : ৪ আগস্ট ২০২২ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati-4-august-22

save the democracy_0

ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষে আমরা সশ্রদ্ধ সম্মান জানাচ্ছি সেই সকল স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মহান শহীদদের যাঁরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কব্জা থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলন ভারতকে সংবিধান স্বীকৃত সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র হিসাবে গঠনের লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদেরকে এক সমৃদ্ধ চিন্তাধারা ও লড়াইয়ের উত্তরাধিকার দিয়েছে। আজ আমরা এই সাধারণতন্ত্রের কাঠামো ও সাংবিধানিক ভিত্তির উপর এবং দেশের মিশ্র সংস্কৃতি, সামাজিক বিন্যাস, জনগণের জীবন-জীবিকা আর নাগরিকদের ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর এক অভূতপূর্ব আক্রমণ লক্ষ্য করছি। আমরা আবারও দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বল উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এবং সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সার্বভৌম ভারত গঠনের লড়াইকে আরো জোরদার করার শপথ নিচ্ছি।

save the democracy

গত ২ আগস্ট, ২০২২ ভারতের রাষ্ট্রপতি মাননীয়া দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে সিপিআইএমএল লিবারেশনের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।

মহাশয়া,

দেশের স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষ উদযাপনের জন্য প্রতিটি বাড়ির ছাদ থেকে তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলনের এক বিশেষ কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেছে ভারত সরকার। আমরা এটাও জেনেছি যে, ডাক ব্যবস্থার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সারা দেশে ২৫ টাকার বিনিময়ে এক একটি পতাকা সংগ্রহ করা যাবে। আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ, মারাত্মক মূল্যবৃদ্ধি ও আর্থিক সংকটে নাজেহাল খেটে খাওয়া মানুষের উপর জাতীয় পতাকা কেনার অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি না করে সরকার নিজে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে বিনামূল্যে জাতীয় পতাকা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিক।

মেশিনে তৈরি ও পলিয়েস্টার নির্মিত পতাকা ব্যবহারের ছাড়পত্র দেওয়ার লক্ষ্যে ভারতের পতাকাবিধিতে আনা কিছু সংশোধনীও আমরা লক্ষ্য করেছি। আমরা আশঙ্কা করছি যে, এই উদ্যোগ বিশাল পরিমাণ আমদানিকৃত পতাকা দেশে ঢোকার পথ প্রশস্ত করবে। আমরা আপনাকে এই পতাকাবিধি সংশোধনী ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এবং হাতে বোনা বা হাতে কাপড় কেটে বানানো পতাকা তৈরির জন্য খাদি ও গ্রামোদ্যোগ নেটওয়ার্কের উপর নির্ভর করার আবেদন জানাচ্ছি, যা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে খাদির ঐতিহাসিক ভূমিকা ও স্বদেশী আন্দোলনের ভাবাবেগের প্রতি বিশেষ সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি হয়ে উঠবে।

Anniversary of Charu Mazumder

এবারের ২৮ জুলাই কমরেড চারু মজুমদারের আত্মবলিদানের অর্ধশতক পূর্তিবার্ষিকী। ৫০ বছর আগে ভারতীয় রাষ্ট্র লালবাজার লকআপে বিপ্লবী নেতাকে হত্যা করে ভেবেছিল চারু মজুমদারের মৃত‍্যুর সাথে সাথে শেষ হয়ে গেল নকশালবাড়ি থেকে গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়া বিপ্লবী উত্থানের ঢেউ। কিন্তু পাঁচ দশক পর আজ যখন মোদী সরকার সবরকম প্রতিবাদ দমন করতে চায় তখনও তাঁকে প্রতিবাদীদের ওপর নিপীড়ন নামাতে আমদানি করতে হয় ‘আর্বান নকশাল’ শব্দবন্ধ। স্পষ্টতই, মৃত‍্যুর ৫০ বছর পরেও, নকশালবাড়ি ও চারু মজুমদার আতঙ্ক এখনও ভারতের শাসকদের তাড়া করে ফেরে। আজও ভারতবর্ষের শ্রমিক-কৃষক-ক্ষেতমজুর-ছাত্র-যুব-মহিলা-আদিবাসী-সংখ্যালঘু-জাতিসত্তা আন্দোলন তথা রাজনৈতিক বন্দীমুক্তির লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা কমরেড চারু মজুমদার।

পুরো রিপোর্ট

50th Martyrdom Anniversary of CM

২৮ জুলাই পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে সিপিআই(এমএল) গঠনের প্রথম সাধারণ সম্পাদক কমরেড চারু মজুমদারের ৫০তম শহীদ বার্ষিকী বিভিন্ন রূপে পালন করা হয়। পার্টির কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সংস্থা ‘লিবারেশন’ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে ‘তেভাগা-নকশালবাড়ি-চারু মজুমদার’। দিল্লীতে পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসে কমরেড চারু মজুমদারের আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান করেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য সহ অন্যান্য নেতা-নেত্রী-কর্মবৃন্দ।

পশ্চিমবঙ্গে কলকাতায় পার্টির রাজ্য অফিসে কমরেড চারু মজুমদারের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান সহ শহীদ বেদী প্রাঙ্গনে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এছাড়া কলকাতা ও জেলায় জেলায় পার্টি অফিসে ও অন্যত্র স্মরণ কর্মসূচি নেওয়া হয়।

এদিন রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে দুটি বড় কর্মসূচি সংগঠিত হয়। একটি শিলিগুড়িতে, অন্যটি কলকাতায়।

50th Martyrdom of Comrade Charu Mazumder

শিলিগুড়িতে এয়ার ভিউ মোড় থেকে এক সুসজ্জিত মিছিল হিলকার্ট রোড হয়ে বাঘাযতীন পার্ক হয়ে সুভাষপল্লী মোড়ে চারু মজুমদারের মূর্তির পাদদেশে শেষ হয়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল, রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, রাজ্য কমিটি সদস্য বাসুদেব বসু, দার্জিলিং জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ, জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক ভাস্কর দত্ত, আলিপুর জেলা সম্পাদক চঞ্চল দাস, কুচবিহার জেলা সম্পাদক মুকুল বর্মন সহ বিভিন্ন জেলা নেতৃবৃন্দ। মিছিল থেকে আওয়াজ ওঠে চারু মজুমদারের রাষ্ট্রীয় হেফাজতে হত্যার ৫০ বছর হল। আজও হত্যার বিচার হল না কেন? মিছিলে ফ্যাসিস্ট বিজেপির বুলডোজার রাজনীতি ও দেশজুড়ে এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ চলছে চলবে আওয়াজ ওঠে। দাবি ওঠে রাজ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি ও পরেশ অধিকারীকে বরখাস্ত করতে হবে। সুভাষপল্লীতে চারু মজুমদারের আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান করে নেতৃবৃন্দ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। পরে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম হলে এক কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মীসভায় মঞ্চে উপবিষ্ট নেতৃবৃন্দ ‘তেভাগা-নকশালবাড়ী-চারু মজুমদার’ নামে পুস্তিকাটি প্রদর্শিত হয়। কর্মীসভায় মোদী রাজের ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’এর বিপরীতে দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার আহ্বান জানানো হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন কার্তিক পাল, অভিজিৎ মজুমদার, পবিত্র সিংহ। সমগ্র কর্মসূচি পরিচালনা করেন বাসুদেব বসু।

50th Martyrdom Anniversary Celebration aisa

২৮ জুলাই কলকাতা আবার প্রত্যক্ষ করল লালঝান্ডার এক দৃপ্ত মিছিল, যে-মিছিল শিয়ালদহ রেল স্টেশনের সামনে থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় ধর্মতলায়। এইদিন সকালে দলীয় কার্যালয় এবং বিভিন্ন মহল্লায় পতাকা উত্তোলন ও শহীদ বেদীতে মাল্যদান কর্মসূচি পালন করে কলকাতার মিছিলে যোগ দেন হাওড়া, হুগলি, উত্তর চব্বিশ পরগণা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা এবং কলকাতার সাথীরা। নেতৃত্ব দেন পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য পার্থ ঘোষ, হাওড়া জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত, হুগলি জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার, উত্তর ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদক সুব্রত সেনগুপ্ত, কলকাতা জেলা সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী, ছিলেন রাজ্য কমিটির অন্যান্য সদস্যবৃন্দ। মিছিলের সামনে ছিল চারু মজুমদারের ছবি এবং লুঠ-সন্ত্রাস-বিদ্বেষ-দমনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শ্লোগান সমন্বিত ব্যানার, অন্ধকারে জেগে থাকা চোখের মানুষটির ছবি আর লালঝান্ডা নিয়ে মহিলারা, তার পিছনে লালে-লাল পতাকা হাতে বাকি পদাতিকেরা। সাংস্কৃতিক কর্মীদের বিপ্লবী গান, ছাত্রছাত্রীদের ছন্দবদ্ধ শ্লোগানে মুখরিত এই মিছিল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এগিয়েছে। রাস্তার দু’পাশের মানুষেরা দেখছেন ও শুনছেন মিছিল থেকে উঠে আসা তেভাগা নকশালবাড়ির বিপ্লবী কৃষক আন্দোলনের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার শপথ, ফ্যাসিবাদকে রোখার আহ্বান, শুনলেন সম্প্রতি পশ্চিমবাংলায় সামনে আসা দুর্নীতি দায়ে জড়িত মন্ত্রীদের বরখাস্তের দাবি। যাঁরা নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখেছেন তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে মিছিল থেকে ঐক্যের শ্লোগান ওঠে। ইতিমধ্যেই ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে বিধায়ক কেনাবেচা, কর্পোরেটদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার মতো দুর্নীতির কর্মকান্ডের পান্ডা বিজেপি! পোষ্য মিডিয়া আর পেটোয়া প্রশাসনের বদান্যতা উপভোগ করে বিজেপি। একইসময়ে বিজেপির কর্মসূচি থাকায় পথের যানজটের ফেরে আমাদের পার্টির মিছিলের নির্দ্ধারিত পথ কিছুটা ঘুরপথে পরিবর্তিত হয় — মিছিলে অংশগ্রহণকারী মজা করে বললেও বিপ্লবের পথ তো সত্যিই আঁকা বাঁকা!

দু’ঘন্টার মতো পথ হেঁটে ধর্মতলায় মিছিল পৌঁছানোর পর এক সংক্ষিপ্ত সভা করা হয়। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের সাথীরা। বক্তব্য রাখেন পার্থ ঘোষ। মিছিল চলাকালীন জানা যায় তৃণমূল মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জিকে মন্ত্রীসভা থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। পার্থ ঘোষ বলেন, এই বরখাস্ত মমতা ব্যানার্জির কোনো সততার পরিচয় নয়, দীর্ঘদিন ধরে ঘটে চলা এই দুর্নীতির দায়ভার মমতা ব্যানার্জিকে নিতে হবে। পার্থ ঘোষ আরও বলেন ৫০ বছর আগে চারু মজুমদারের হত্যার আজও বিচার হয়নি। চারু মজুমদার জনগণের ক্ষমতায় আস্থা রাখতেন। দেশজুড়ে ফ্যাসিষ্ট শক্তির মোকাবিলায় এবং এরাজ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত শক্তির বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করার অদম্য চেষ্টার জানান দিয়ে গেলো এবারের ২৮ জুলাই !

Collective resistance of rural workers

গত ১৬ মে দিল্লীতে ‘জাতীয় গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প’ বিষয়ক একটি সর্বভারতীয় কনভেনশনে সামিল হয়েছিল ভারতের কৃষিক্ষেত্রে মজুর ও অন্যান্য গ্রামীণ শ্রমিকদের ৫টি সর্বভারতীয় সংগঠন। নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির এই সময়পর্বে কর্মহীনতা ও মজুরি সংকোচনের আঘাত যখন মেহনতিদের উপর নেমে আসছে, ঠিক সেই সময় কেন্দ্রীয় সরকার ও অধিকাংশ রাজ্য সরকার কর্মসংস্থানের সংকোচন করছে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিতেও। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নীতিগত নয়া পরিবর্তন গ্রামীণ মেহনতিদের আরও বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ৫টি সংগঠন এআইএডব্লিউইউ, পিবিকেএমএস, আয়ারলা, এআইএসকেএস এবং বিকেএমইউ স্থির করে, ১ আগস্ট  ‘জাতীয় গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প’ সংক্রান্ত অব্যবস্থা সহ কৃষিমজুরদের জীবন-জীবিকার সংকটকে সামনে তুলে ধরতে দেশজুড়ে মেহনতিদের বিক্ষোভ সংগঠিত হবে।

পরবর্তীতে ৮ জুলাই এই রাজ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উদ্দেশ্য, ১ আগস্টের কর্মসূচি এবং পরবর্তীতে সংযুক্ত আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। রাজ্যের কর্মসূচিতে সামিল হয় আরও একটি সংগঠন ‘পশ্চিমবঙ্গ খেতমজুর সমিতি’। ১ আগস্ট রাজ্য জুড়ে হাজার হাজার গ্রামীণ খেটে খাওয়া মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে পথে নামেন। সর্বত্র শ্রমজীবি মহিলাদের অংশগ্রহণ ও অগ্রণী ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। গ্রামীণ শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার দিশায় এই কর্মসূচি ছিল এক জোরালো পদক্ষেপ।

পুরো রিপোর্ট

rural workers across the country

গত ১ আগস্ট এরাজ্যের হুগলি, নদীয়া, জলপাইগুড়ি, উত্তর ২৪ পরগণা, বাঁকুড়া জেলায় গ্রামীণ মেহনতিদের সংগঠনগুলির যৌথ আন্দোলন গড়ে ওঠে। এছাড়াও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, হাওড়া এবং বর্ধমান জেলায় আয়ারলা স্বাধীন প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করে।

বাঁকুড়া জেলায় জেলাশাসকের কাছে প্রতিনিধি ডেপুটেশনে সামিল ছিল ৫টি সংগঠনের প্রতিনিধিরা। আয়ারলার পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন আয়ারলা জাতীয় কার্যকরী কমিটি সদস্য বাবলু ব্যানার্জী। পরে শহরের ভাদুল মোড়ে যৌথ পথসভা সংগঠিত হয়। আয়ারলার পক্ষে বক্তব্য রাখেন কমরেড বাবলু ব্যানার্জী। জলপাইগুড়ি শহরে সদর বিডিও দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয় সংযুক্ত কিষান সভার ব্যানারে। এই উদ্যোগে এফবির সংগঠন ছাড়া অন্য সংগঠনগুলি সামিল হয়। এছাড়াও সামিল ছিলেন সিপিআই(এমএল) রেডস্টার সংগঠনের সাথীরা।

Collective resistance of rural workers jalpaiguri

আয়ারলার পক্ষে নেতৃত্বে ছিলেন আয়ারলা জাতীয় কার্যকরী কমিটি সদস্য শ্যামল ভৌমিক ছাড়াও রাজ্য কমিটি সদস্য হিমাংশু মজুমদার, জেলানেতা প্রদীপ দেবগুপ্ত, প্রশান্ত ভৌমিক প্রমুখ। এখানে বকেয়া মজুরি প্রশ্নে বিডিওকে ঘেরাও করা হলে তিনি এই বকেয়া মজুরি প্রাপকদের চিহ্নিত করা ও পরবর্তী উদ্যোগে সহায়তার আশ্বাস দেন। জবকার্ড যাতে জবকার্ড হোল্ডারদের হাতেই থাকে, এজন্য সার্কুলার করার প্রতিশ্রুতি দেন। নদীয়া জেলায় কৃষ্ণনগর জেলাশাসক দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। সভায় আয়ারলার পক্ষে বক্তব্য রাখেন নদীয়া জেলা আয়ারলা নেতা কমরেড আনসারুল হক। এছাড়াও সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটি সদস্য জীবন কবিরাজ বক্তব্য রাখেন। জেলাশাসকের কাছে ডেপুটেশনে অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন আয়ারলা জাতীয় কার্যকরী কমিটি সদস্য কমরেড প্রদীপ দত্তগুপ্ত। এখানে সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের সমর্থকদের বড় সংখ্যায় উপস্থিতি ছিল। উত্তর ২৪ পরগণার গাইঘাটা বাজারে সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন এবং আয়ারলা সহ ৩টি মেহনতি সংগঠনের যৌথ মিছিল সংগঠিত হয়। পরবর্তীতে গাইঘাটা থানার সামনে পথসভা সংগঠিত হয়। আয়ারলার পক্ষে নেতৃত্বে ছিলেন আয়ারলা জেলা সম্পাদক অজয় বসাক ছাড়াও আয়ারলা রাজ্য সংগঠক বাবুনি মজুমদার, এলাকার আয়ারলা সংগঠক কমরেড কমল কর্মকার, বাচ্চু বিশ্বাস প্রমুখ।

হুগলির ধনেখালি ও পোলবা দাদপুর ব্লকে যৌথ আন্দোলন সংগঠিত হয়। পোলবা দাদপুরের পুইনান বাজারে যৌথ মিছিলে সামিল হন আয়ারলা পোলবা দাদপুর ব্লক সম্পাদক গোপাল রায়, গোস্বামী মালিপাড়া পঞ্চায়েত সম্পাদক সাধন মাল। পথসভায় বক্তব্য রাখেন জেলার কৃষক নেতা তপন বটব্যাল।

ধনেখালি বাজারে সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন এবং আয়ারলা যৌথভাবে এক উদ্দীপনাময় মিছিল সংগঠিত করে। মিছিল শেষে এক সংক্ষিপ্ত পথসভায় বক্তব্য রাখেন খেতমজুর ইউনিয়নের জেলা নেত্রী কমরেড বন্যা টুডু এবং আয়ারলা নেত্রী কমরেড শ্রাবণী মালিক। মিছিলের বিশেষ আকর্ষণ ছিল অসংখ্য হাতে তুলে ধরা দাবি সম্বলিত হোর্ডিং।

মিছিলের আগে আয়ারলা স্বাধীন উদ্যোগে ধনেখালি বিডিও দপ্তরের সামনে মনরেগা সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তারও পূর্বে আদিবাসী বর্গাদারদের অধিকার রক্ষার দাবিতে ভূমি দপ্তরের সামনে জঙ্গি মেজাজে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন আয়ারলা সদস্যরা। নেতৃত্ব দেন আয়ারলা রাজ্য কমিটি সদস্য শৈলেন মাজি, ব্লক নেতা অমিয় দাস, জয়দেব বাগ, আর ওয়াই এ রাজ্য নেতা সজল দে এবং আয়ারলা রাজ্য সম্পাদক সজল অধিকারী প্রমুখ।

আয়ারলা স্বাধীন উদ্যোগে মিছিল সংগঠিত করে পূর্ব বর্ধমানের ইসলামপুর বাজারে। মিছিল শেষে ইসলামপুর চৌমাথায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কুশপুত্তলিকা পোড়ান সংগঠনের সদস্যরা। নেতৃত্বে ছিলেন আয়ারলা রাজ্য সভাপতি সজল পাল ছাড়াও আয়ারলা পূর্ব বর্ধমান জেলা সম্পাদক আনসারুল আমান মণ্ডল।

হাওড়া জেলার বাগনান ব্লকের বাঙালপুর হাটুড়িয়া স্নানের ঘাট এলাকায় আয়ারলা স্বাধীন উদ্যোগে পথসভা সংগঠিত করে। এই সভায় বক্তব্য রাখেন রাজ্য আয়ারলা নেতা নবীন সামন্ত, দিলিপ দে সহ অন্যরা।

দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বজবজ এলাকায় তিনটি পঞ্চায়েতের সামনে ১০০ দিনের কাজ, বাস্তু পাট্টা, আবাস যোজনায় ঘর, মেহনতিদের বিনামূল্যে ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। পঞ্চায়েতগুলি ছিল দূর্গাপুর, মায়াপুর ও নিশ্চিন্তপুর গ্রাম পঞ্চায়েত। নেতৃত্বে ছিলেন আয়ারলা রাজ্য কমিটি সদস্য ইন্দ্রজিৎ দত্ত, আয়ারলা জাতীয় কার্যকরী কমিটি সদস্য দেবযানী গোস্বামী এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটি সদস্যা কাজল দত্ত। এছাড়াও ছিলেন ব্লক আয়ারলা নেত্রী কমরেড মমতাজ এবং কমরেড শ্যামসুন্দর গোস্বামী, আশুতোষ মালিক প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।

Must answer_0

মুখ্যমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিসভার পুনর্বিন্যাসের প্রাক সভায় বলেছেন, সবাই সাবধান, দল এবং সরকারের মানসম্মান নষ্ট হয় এমন কোনো কাজ করবেন না, এবার থেকে সবার ওপর তাঁর নজরদারী থাকবে। এখন কথা হল, এ জাতীয় কথাবার্তা মানুষের কাছে বারবার অন্তঃসারশূন্য প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে।

দুর্নীতির নষ্টামী তৃণমূল ক্ষমতায় আসার প্রায় পরপর থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। সারদাকে বিজ্ঞাপিত করতে তৃণমূলের ডাকাবুকো নেতা থেকে শুরু করে দলঘনিষ্ট বুদ্ধিজীবী মায় মিডিয়ার তাঁবেদার লোকজন পর্যন্ত উঠেপড়ে লেগেছিল। সারদা থেকে নারদ কেলেঙ্কারীতে হাতে গোনা ক'জন নেতা-মন্ত্রী কেস খেয়েছেন, কেউ কেউ হাজতবাস করেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর ভাবমূর্তিতেও কালি লেগেছে, সারদার চিটফান্ডের টাকায় মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা ছবি কিনতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে, নারদের টাকা খাওয়ার ভিডিও এখনও সত্য প্রমাণ না হলেও মিথ্যা প্রমাণ হয়ে যায়নি। মুখ্যমন্ত্রী সারদার কেলেঙ্কারীর প্রকৃত সত্যানুসন্ধানের চ্যালেঞ্জ নিতে পারেননি, আশ্রয় নিয়েছিলেন ধূর্তামীর, সরকারের টাকায় চিটফান্ড ক্ষতিপূরণ দেওয়া শুরু করার পেছনে কোনো মমতার লেশমাত্র ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল ঐ কেলেঙ্কারির সাথে শাসকদলের কোনো সম্পর্ক না থাকার প্রসাধনী প্রলেপ দিতে। হ্যাঁ, তারপরেও মমতা সরকার ২০১৬-তে শাসন ক্ষমতায় ফিরেছিল। কিন্তু তার কিছু বিশেষ অনিবার্য পরিপ্রেক্ষিত ছিল, কয়েক দশকের বামফ্রন্টের পতন হয়েছে, তার পাঁচ বছরের ব্যবধানে তৃণমূলের সামনে অন্য কোনো শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না, থাকলে মুশকিল হোত, কিন্তু তার মানে এটা প্রমাণ হয়ে যায়নি যে তৃণমূল ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে গিয়েছিল। দুর্নীতির লাগাতার অভিযোগ হিসাবে “তোলাবাজি” ধিক্কার প্রথম থেকেই উঠে আসছে। তারপরে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে যে তৃণমূল ক্ষমতায় ফিরতে পেরেছে তার পেছনে এক গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল বাংলার বুকে ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার প্রবল রণধ্বনি।

আজকের উন্মোচিত শতকোটি টাকার পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি অল্পদিনে হয়নি। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর গোপন মজুত থেকে এমনও বেনামী সম্পত্তির দলিল উদ্ধার হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে যার সময়টা ২০১২ সাল। অর্থাৎ ক্ষমতায় আসার পরপরই। এবং এই অপার দুর্নীতি নিছক ‘অপা’র সুপরিকল্পিত হতে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ গাঢ় হচ্ছে এর নেটওয়ার্ক বিশাল। নিচের তলায় তার কিছু কিছু আড়কাঠির তথ্যও সামনে আসছে। মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রীসভা, তৃণমূল দল, পুলিশ-প্রশাসন কর্তৃপক্ষ, কোনো পক্ষই এর দায় থেকে নিস্তার পেতে পারেন না। একটা সরকার ‘পরিবর্তন’ নিয়ে আাসার ভঙ্গীসর্বস্বতা দেখিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, আর আজ সেই সরকারের ছত্রছায়ায় কোটি কোটি টাকার বেআইনি লুটের কারবার ধরা পড়ছে। এর জবাব দিতেই হবে।

The historic struggle of the youth

টিএমসি নেতা পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ সহকারী এক অভিনেত্রীর দুটো ফ্ল্যাট থেকে নগদে ও সোনায় ৫০ কোটি টাকারও বেশি বাজেয়াপ্ত হওয়ার চমকপ্রদ ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে আরও একবার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। পশ্চিম বাংলায় স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক বেনিয়ম ও নির্লজ্জ কারচুপির পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশের পরিণামেই এই অর্থ-উদ্ধার, তারপর মন্ত্রীর গ্ৰেপ্তারি এবং শেষে মন্ত্রীর অপসারন। আর আদালতের এই রায় এসেছে বঞ্চিত প্রতারিত কর্মপ্রার্থীদের দীর্ঘ নাছোড়বান্দা আন্দোলন। গ্ৰেপ্তার হওয়া মন্ত্রী ও তাঁর সহযোগীদের নিয়েই যখন প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম এই ইস্যুটার খবরাখবর করছে, আমাদের তখন সর্বপ্রথম গুরুত্ব দিতে হবে বঞ্চনার কবলে পড়া এইসব হবু শিক্ষকদের ন্যায়বিচার লাভের ওপর, যাঁরা এই দুর্নীতির প্রত্যক্ষ শিকার।

ছ-বছর আগে পশ্চিম বাংলার স্কুল সার্ভিস কমিশন নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর জন্য শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে রাজ্য স্তরের এক সিলেকশন টেস্ট নিয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় হল, ২০১৭’র নভেম্বর এবং ২০১৮’র মার্চে প্রকাশিত ফলাফলে প্রার্থীদের প্রাপ্ত নম্বর ও মেধা তালিকায় স্থান উল্লিখিত হল না, প্রার্থীরা পাশ করেছে কি করেনি এটুকুই শুধু জানানো হল। আদালতের চাপে পরবর্তীতে মেধা তালিকায় কার স্থান কত তা প্রকাশ করা হলেও নিয়োগ মেধা তালিকা অনুসারে হল না। দেখা গেল যে, মেধা তালিকায় স্থান না হলেও ভালো প্রশাসনিক যোগাযোগ থাকা প্রার্থীরা চাকরি পেল; একটা দৃষ্টান্তের উল্লেখ করতে হলে বলা যায় আরেক মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে এইভাবে চাকরি পেয়েছিলেন। বঞ্চিত প্রার্থীরা ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতা প্রেস ক্লাব ময়দানে অনির্দিষ্টকালের অনশন প্রতিবাদ শুরু করলেন এবং তখন থেকেই এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুরু হল দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন।

অনশন আন্দোলন এক মাস চলার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেখা করে সমস্ত অসংগতি শুধরে নেওয়া এবং মেধা তালিকা অনুসারে সবার দ্রুত নিয়োগের আশ্বাস দেন। একটা কমিটি তৈরি হয় এবং ২৮ মার্চ অনশন আন্দোলন তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু বঞ্চিত প্রার্থীরা আবারও ধাক্কা খেলেন যখন তাঁদেরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অরত্যন্ত স্থুলভাবে ভঙ্গ করল সরকার। ফলে প্রতিবাদ আবার শুরু হল, এবং তার সঙ্গে এবার শুরু হল আইনি লড়াই। আর নেমে এল পুলিশি নিপীড়ন। তবু, প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা এবং অতিমারি ও বিধানসভা নির্বাচন জনিত বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও আন্দোলন চলতে থাকল। যোগ্যতা অর্জন সত্ত্বেও বঞ্চনার শিকার হওয়া যুবক-যুবতীদের লাগাতার দৃঢ় সংগ্ৰাম পরিশেষে উন্মোচিত করল, হাইকোর্ট যাকে আখ্যায়িত করেছে, “হিমশৈলের ভাসমান চুড়া”।

West Bengal for work and justice

এই উন্মোচন পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের অপশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভকে আবার জাগিয়ে তুলেছে। বিজেপি পশ্চিম বাংলার ঘোলা জলে মাছ ধরার সুস্পষ্ট সুযোগ পেয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয় যে, মহারাষ্ট্রের পর পশ্চিমবঙ্গ ও সংলগ্ন ঝাড়খণ্ড বিজেপির ক্ষমতা-হাতানোর অস্ত্র ‘অপারেশন লোটাস অভিযানের’ বিশেষ নিশানা। ইতিমধ্যেই ঝাড়খণ্ডের তিন কংগ্রেস বিধায়ক গাড়িতে প্রচুর টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় হাওড়া জেলায় ধরা পড়েছেন, আর চিত্র তারকা থেকে বিজেপির ব্র্যাণ্ড অ্যামব্যাসাডারে পরিণত হওয়া মিঠুন চক্রবর্তী দাবি করছেন যে অন্তত পক্ষে ৩৮ জন তৃণমূল বিধায়ক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আধিপত্যকারী টিআরপি-হাতানো মিডিয়া যখন রগরগে কেচ্ছাকাহিনীর সোনার খনি খুঁজে পেয়েছে এবং বিজেপি যখন তার ঘোড়া কেনাবেচার ফন্দিফিকিরে মেতে রয়েছে, তখন কাজ ও ন্যায়বিচারের জন্য যুবক-যুবতীদের আন্দোলনকে তার এজেণ্ডার প্রতি অবিচল থাকতে হবে এবং বামেদের এই গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে পরিপূর্ণ সমর্থন জানাতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী এখনও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে প্রকাশ্যে কোনো আলোচনা করেননি, তবে তৃণমূল কংগ্রেস নেতা অভিষেক ব্যানার্জি নিজের পছন্দসই কিছু প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছেন এবং এইভাবে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে গুরুতর সন্দেহের সৃষ্টি করেছেন।

কর্মপ্রত্যাশী যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চনা করে নিয়োগ-দুর্নীতি এবং যোগ্য ছাত্রছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার ভর্তি কেলেঙ্কারি আজকের ভারতে এক ন্যক্কারজনক বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে এই ধরনের দুর্নীতিগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে এবং প্রতিবাদ-বিক্ষোভগুলোকে নৃশংসভাবে দমন করা হচ্ছে। মধ্যপ্রদেশের কুখ্যাত ব্যাপম কেলেঙ্কারি এমন একটা আতঙ্কজনক দৃষ্টান্ত যেখানে ন্যায় বিচার লাভের প্রয়াসকে দমন করতে বহু ব্যক্তিকে একেবারে জানে মেরে দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনকারী যুবক-যুবতী এবং পশ্চিমবঙ্গের সুবিচারকামী জনগণকে এই কৃতিত্ব দিতে হবে যে, তাঁরা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির উন্মোচন ঘটিয়েছেন এবং ন্যায়বিচারের আন্দোলনকে আজকের এই সন্ধিক্ষণে পৌঁছে দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের আন্দোলনরত যুবক-যুবতীদের প্রতি সকল শুভিবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে সর্বাত্মক সমর্থন জানাতে হবে যাতে তাঁরা এই ঘৃণ্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং বাংলার তরুণ প্রজন্মের অধিকার ও স্বপ্নকে সুব্যবস্থিতভাবে ধ্বংস করার বিরুদ্ধে প্রশ্নাতীত বিজয় অর্জন করতে পারেন।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২ আগস্ট ২০২২)

cried the Tet passers-by

মুখ্যমন্ত্রী নীরবতা ভাঙুন

৩০ জুলাই দুপুর থেকে কয়েকশো টেট উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রী অবস্থান বিক্ষোভ করছিলেন। হাইকোর্টের বিচারপতিও বলছেন, ঘরে বসে থাকলে বা মোমবাতি মিছিল করলে হবে না। চাকরি পেতে হলে আন্দোলন করতে হবে। অথচ ক্যামাক স্ট্রীটে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের গ্রেফতার করল পুলিশ।

এই পরিস্থিতিতেও মুখ্যমন্ত্রী নীরব। মুখ্যমন্ত্রীর নীরবতা ভাঙার জন্য গণআন্দোলন জোরদার করার পাশাপাশি এসএসসি, টেট উত্তীর্ণদের নিয়োগ শুরু করার জন্য রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেবার জন্য কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন জানিয়ে ই-মেল করলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার।

আমরা আশা করি, দীর্ঘদিন ধরে ন্যায্য অধিকারের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের পাশে এসে দাঁড়াবে আদালত।

No moreNcried the Tet passers-by_0

লাগাতার ধর্ণা-অবস্থানরত এসএসসি ও টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মেধা তালিকাভুক্ত চাকরি প্রার্থীদের দ্রুত নিয়োগপত্র দিতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে আদালতের নির্দেশ জারির জন্য আবেদন জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতির উদ্দেশ্যে গত ৩০ জুলাই ২০২২ সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের তরফ থেকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার।

ঐ চিঠিতে বলা হয়েছে, “আমরা সিপিআই(এমএল) লিবারেশন পার্টির রাজ্য কমিটি গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, রাজ্যের হবু শিক্ষকরা আজ রাস্তার ফুটপাতে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি চালাচ্ছেন। এ প্রশ্নে কলকাতা হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ এবং পদক্ষেপ চাকরি প্রার্থী তথা রাজ্যবাসীর মনে বিচারালয় সম্পর্কে আস্থা সৃষ্টি করেছে।

আমরা এটাও লক্ষ্য করেছি রাজ্য সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে আদালতে মামলা চলার কারণে বা আদালতের নির্দেশ না থাকায় ১৭ হাজার শূন্যপদ থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না।

আমরা যতদূর জানি শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির তদন্ত ও তার বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে আদালত যুগান্তকারী ভুমিকা গ্রহণ করেছেন। নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার কোনো নির্দেশ আদালত দেননি।

এমতাবস্থায়, আমরা সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটি তথা পশ্চিবাংলার মানুষের পক্ষ থেকে আপনার কাছে বিনীত আবেদন জানাচ্ছি এসএসসি, টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মেধা তালিকাভুক্ত চাকরি প্রার্থীদের দ্রুত নিয়োগপত্র দিতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে নির্দেশ জারি করুন।

আশাকরি আমাদের আবেদনটিকে সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করবেন এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।”

No more_2

আইনিজীবী দিবাকর ভট্টাচার্য ও মানবাধিকার কর্মী অম্লান ভট্টাচার্য এক সংবাদ বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন যে,

কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে তাঁরা লিখিতভাবে বিনীত আবেদন জানিয়েছেন এসএসসি ও টেট উত্তীর্ণ মেধা তালিকাভুক্ত চাকরি প্রার্থীদের দ্রুত নিয়োগ পত্র দেওয়ার বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে যেন আদালত নির্দেশ জারি করে। চিঠিতে “অল ইন্ডিয়া লইয়ার্স এ্যাসোসিয়েশন ফর জাস্টিস(আইলাজ) এবং পিউপিলস্ ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিস(পিইউসিএল) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি” গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত করে চিঠিতে তাঁরা লিখেছেন,

শিক্ষক নিয়োগে দূর্নীতির তদন্ত ও তার বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে আদালত আজ যুগান্তকারী ভুমিকা গ্রহণ করেছেন এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার কোনো নির্দেশ আদালত দেননি। এমতাবস্থায়, জনমানসে বিভ্রান্তি দূর করতে এসএসসি ও টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মেধা তালিকাভুক্ত চাকরি প্রার্থীদের দ্রুত নিয়োগপত্র দিতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে আদালত নির্দেশ জারি করুন।

অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরুদ্ধে সংযুক্ত কিষান মোর্চার ডাকে ৭ আগস্ট কলকাতায় মৌলালি রামলীলা পার্ক থেকে লেনিন মূর্তির পাদদেশ পর্যন্ত মিছিল। ছাত্রছাত্রী, তরুণ প্রজন্ম, অবসরপ্রাপ্ত সেনা জওয়ান সম্প্রদায় ও মহিলাদের সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা।

Saroj Dutta's Martyr's Day

কার্জন পার্কের মূর্তির সামনে জমায়েত ও এসএসসি যুব-ছাত্র ধর্নামঞ্চে সংহতি সমাবেশ

পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের আহ্বানে, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, বিপ্লবী যুব আ্যসোসিয়েশন, অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস আ্যসোসিয়েশন ও শহীদ কমরেড সরোজ দত্ত-র প্রতি শ্রদ্ধাশীল সমস্ত সাথী-বন্ধুরা বেলা ১-৩০ মিনিটে শহীদ কমরেড সরোজ দত্ত-র মূর্তিতে মাল্যদান ও শ্রদ্ধাঞ্জলী অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে বেলা ৩-৩০ মিনিটে এসএসসি ধর্ণামঞ্চে উপস্থিত হবেন আন্দোলনকারী যুবছাত্রদের সংহতি জানাতে।

Congratulating Draupadi Murmu

এমন এক সময়ে দেশবাসী একজন আদিবাসী মহিলাকে সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে পেল যখন আদিবাসীদের সংবিধান-স্বীকৃত ও বহু লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে গড়ে তোলা অধিকারগুলিকে দ্রুত কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। মাননীয়া দ্রৌপদি মুর্মুকে অভিনন্দন জানানোর সাথে সাথে আদিবাসীদের অবস্থা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে যে, তিনি তাঁর হাতে যেটুকু ক্ষমতা আছে তা প্রয়োগ করে আদিবাসীদের ওপর নেমে আসা নানাবিধ প্রাতিষ্ঠানিক হামলাকে রুখতে সচেষ্ট হবেন।

সামনেই আছে নতুন ‘বন সংরক্ষণ আইন ২০২২’। বহু সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে পাস হওয়া ‘বনাধিকার আইন ২০০৬’-কে অকেজো করে দেবে নতুন বন সংরক্ষণ আইন। অরণ্যভূমি ও সম্পদের ওপর আদিবাসী সমাজের স্বাভাবিক অধিকারের স্বীকৃতি অনেকাংশে নাকচ হয়ে যাবে, অরণ্যকেন্দ্রীক আদিবাসী গ্রামের গ্রামসভাকে যে সর্বোচ্চ স্বায়ত্ব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল সেটাও আর কর্যকর থাকবে না। ফলত কর্পোরেট হাউসগুলো আরও অবাধে উচ্ছেদ করবে আদিবাসী গ্রামগুলিকে। আদিবাসী সংঘর্ষ মোর্চার পক্ষ থেকে মাননীয়া দ্রৌপদি মুর্মুকে অভিনন্দন জানিয়ে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল থাকাকালীন তিনি সিএনটি ও এসপিটি আইনের সংশোধনীতে সই না করে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে তাঁর হাত দিয়ে কোনও অন্যায় কাজ সম্পন্ন হবে না। কেন্দ্রের আনা নতুন বন সংরক্ষণ আইনসহ সমস্ত আদিবাসী বিরোধী সংশোধনীর ক্ষেত্রেও তাঁর কাছে এই সদর্থক ভূমিকা প্রত্যাশা করা হয়। দ্রৌপদি মুর্মুর সাথে সাক্ষাৎ করে একই দাবি তুলেছেন ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহলের প্রতিনিধিরাও। একই সাথে দাবি করা হয়েছে বনাধিকার আইনকে আরও ব্যাপক ও কঠোরভাবে কার্যকর করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহনের। ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবসে জাতীয় ছুটি ঘোষণার দাবি করা হয়।

উঠে এসেছে সমতলের সমস্ত আদিবাসী- প্রধান এলাকাকে পঞ্চম তপশীলভূক্ত করে ‘পেশা’ আইন লাগু করার দাবি। আসামের কার্বি আদিবাসীদের জন্য সংবিধান স্বীকৃত স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের দাবিও এসেছে। আদিবাসীদের ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্নও উঠে এসেছে। আদিবাসী সংঘর্ষমোর্চার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, হিন্দু ও অন্য সংগঠিত ধর্ম থেকে আদিবাসীদের ধর্ম-সংস্কৃতি আলাদা হওয়া সত্বেও রাষ্ট্রের কাছে তার স্বীকৃতি নাই। অন্যদিকে খ্রিষ্টান মিশনারিদের দিকে আঙুল তুলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের পরিবেশ তৈরি করা হয়। এই অন্যায়ের অবসান ঘটানোর আবেদন জানানো হয় নতুন রাষ্ট্রপতির কাছে। আবেদন জানানো হয়েছে আদিবাসীদের জন্য শিক্ষা, জমি, চিকিৎসা ও আবাসনের ন্যুনতম প্রাপ্য সুযোগগুলি নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রপতি যেন সচেষ্ট হন।

Cooks Movement

হুগলির পোলবা-দাদপুর ব্লকের পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধনকর্মী (মিড-ডে-মিল) ইউনিয়নের সদস্যরা ২৮ জুলাই বিডিও-কে ডেপুটেশন দিলেন। স্কুলে সময়মতো রান্না করা, ছাত্রদের খাওয়ানো, বাসন মাজা, রান্না ঘর পরিষ্কার করা — সব কাজ সেরে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাঁরা ঠিক বিকেল তিনটের মধ্যে পৌঁছে যান বিডিও অফিসে। মূল দাবি ছিল, শাসক দলের দাদাদের নানা অজুহাতে (রান্না খারাপ হচ্ছে, ষাট বছর হয়ে গেছে আর কাজ করতে পারছোনা ইত্যাদি) ছাঁটাই করার চক্রান্ত হুমকির অবসান এবং কর্মক্ষেত্রে অন্যান্য সমস্যার সমাধান।

পঞ্চায়েত নির্বাচন যত কাছে আসছে ভোটব্যাঙ্ক ভরাতে কর্মরত কর্মীদের হটিয়ে দলের লোক নিযুক্ত করার বদমাইশি বাড়ছে সর্বত্র। অথচ সরকারি সার্কুলার বলছে উপযুক্ত কারণ বা প্রমাণ ছাড়া কাউকে ছাঁটাই করা যাবেনা। স্কুল এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের নোটিশ অনুযায়ী মিড-ডে-মিল প্রকল্পের যাবতীয় দেখভাল করবেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক বা টিচার ইনচার্জ। স্কুল কর্তৃপক্ষ কিন্তু কর্মীদের সম্পর্কে চট করে কোনো অভিযোগ আনেন না। বাইরে থেকে চাপ সৃষ্টি করা হয়, আর কর্মীরাও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন।

যৎসামান্য ভাতায় দুর্মূল্যের বাজারে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তাই তাঁরা দাবি তুলেছেন প্রত্যেক রন্ধনকর্মীকে একশো দিন কাজের জব কার্ড বিডিওকেই দিতে হবে কারণ এলাকার পঞ্চায়েতের বক্তব্য রন্ধনকর্মীরা নাকি সরকারি কর্মচারী (কী নির্লজ্জ রসিকতা — ১,৫০০ টাকায় এবং বিনা নিয়োগপত্রে সরকারি কর্মচারী!) তাই তাঁদের এই প্রকল্পে কাজ দেওয়া যাবে না। মিড-ডে-মিল আধিকারিক বলেন, এরকম কোনো বিধি-নিষেধ সরকারের নেই। প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, রন্ধন কর্মীদের একশো দিন কাজের সাথে যুক্ত করা হবে যদিও এখনো তা ফাঁপা প্রতিশ্রুতি রয়ে গেছে।

লকডাউনের আগে ও পরে জেলা প্রশাসন থেকে এই ব্লকের রন্ধন কর্মীদের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল বিডিও অফিসে (রান্না শেখানো, ছাত্রদের পরিচর্যা কিভাবে করা হবে, পরিছন্নতা ইত্যাদি)। সেইসঙ্গে ঘোষণা করা হয়েছিল ট্রেনিং প্রাপ্তদের ৫০০ টাকা ও সার্টিফিকেট দেওয়া হবে কিন্তু এখনো তা দেওয়া হয়নি। দ্রুত সেগুলো মিটিয়ে দেওয়ার দাবি রাখা হয়। ভাতা বৃদ্ধি, দশ মাস নয় বারো মাসের ভাতা, সরকারি কর্মচারী স্বীকৃতি, উপযুক্ত কারণ ছাড়া ছাটাই বন্ধ করা, দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ, ইএসআই ও‌ পেনশন ইত্যাদি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় আনতে হবে — এই দাবিগুলোও তোলা হয়।

রন্ধনকর্মীদের সমস্ত দাবি এবং সমস্যাগুলো বিডিও ন্যায়সঙ্গত বলে মেনে নেন। প্রতিশ্রুতি দেন, ওনার পক্ষে যেসব দাবি পূরণ করা সম্ভব সে বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন। উপস্থিত সমস্ত প্রতিনিধিদের সাথে দীর্ঘ সময় নিয়ে আন্তরিকতার সাথে আলোচনা করেন। আধিকারিকরাও তাঁদের যথাসাধ্য সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেন। প্রতিনিধিরা বলেন তিন মাস পর আমরা আবার আসবো। আধিকারিকরা বলেন অবশ্যই, এই ফলো-আপটা খুব জরুরি।

বিডিওতে ডেপুটেশন ও অফিসের বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শনে‌‌র পর বিভিন্ন দাবিতে প্ল্যাকাড হাতে এলাকায় মিছিল করা হয়, মিছিল থেকে শ্লোগান ওঠে রান্নার গ্যাস সহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে,‌ দুর্নীতিগ্রস্ত প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী‌ পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারি‌র বরখাস্ত ও এসএসসি এবং টেট প্রার্থীদের নিয়োগে দুর্নীতির প্রতিবাদে। সমগ্র কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন সবিতা পাখিরা, সন্ধ্যা দাস, পম্পা আদক ও জেলা সভানেত্রী চৈতালি সেন।

ডেপুটেশনে ভালো সাড়া পেয়ে এবং বাইরে বিক্ষোভ ও মিছিলে পথচলতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরে রন্ধনকর্মীরা যথেষ্ট উৎসাহিত হন। তাঁরা উপলব্ধি করেন, এআইসিসিটিইউ’র সংযুক্ত (অ্যাফিলিয়েটেড) ইউনিয়নের পতাকাতলে জেলা ও রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ধারাবাহিকভাবে বেশি বেশি কর্মীকে সামিল করে আন্দোলন চালিয়ে গিয়েই আমাদের ন্যায়সংগত দাবি আদায় করা সম্ভব।

Women-employment continues to shrink_0

ভারতের ২ কোটি মহিলা কর্মসংস্থান থেকে দূরে, ৫০ শতাংশের বেশি মহিলা চাকরি চাইছেন না, উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে। সিএমআইই (সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি) মুম্বাইয়ের একটি বেসরকারি সংস্থার রিপোর্ট বলছে, ৯০ কোটি মহিলাদের মধ্যে ৫০ শতাংশ মহিলা বলছেন, দেশে বৈধ চাকরি না থাকার দরুণ মহিলারা চাকরি চায় না, উপযুক্ত চাকরির অভাবে হতাশাও বেড়েছে।

২০১৭ থেকে ২০২২’র মধ্যে ২ কোটি মহিলা অদৃশ্য হয়ে গেলেন কাজ থেকে, ৯ শতাংশ কাজ ছেড়ে দিলেন উপযুক্ত কাজ বা পদমর্যাদা না পাওয়াতে। ঠিক এই সময় কর্মক্ষমতার হার নিচে নেমে যায় ৪৬ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে। কমবয়সীদের ক্ষেত্রে চাকরি পাওয়া রীতিমতো দুস্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে, বেকারত্ব ক্রমশ উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে।

হরিয়ানাতে বেকারত্বের হার মার্চে ছিল ২৬.৭ শতাংশ, রাজস্থানে ও জম্মু-কাশ্মীরে ২৫ শতাংশ, বিহারে ১৪.৪ শতাংশ, ত্রিপুরাতে ১৪.১ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গে ৫.৬ শতাংশ। মহিলারা ব্যাপক মাত্রায় কাজহারা হয়েছেন। জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ মহিলারা অর্থনীতিতে মাত্র ১৮ শতাংশ অবদান রাখেন, যা বিশ্বের গড় থেকে অর্ধেকেরও কম।

সিএমআইই’র সাথে সেন্টার ফর ইকনমিক ডেটা অ্যান্ড অ্যানালিসিস’এর যৌথ রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতীয় মহিলাদের কর্মসংস্থান ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। কোভিডের আগে ও পরে ভারতের জাতীয় গড় অনুযায়ী ২০২১ সালে নারীদের কর্মসংস্থান ছিল ২০১৯’র তুলনায় ৬.৪ শতাংশ কম। শহরাঞ্চলে মহিলাদের কর্মসংস্থান ২০১৯’র তুলনায় ২২.১ শতাংশ কমে যায়। ২০১৯-২০২০’র তুলনায় ২০২১ সালে মহিলাদের কাজ খোঁজার তাগিদ দারুণভাবে নিচের দিকে নেমে যায়।

পরিসংখ্যান বলে, তামিলনাডু, গোয়া, জম্মু-কাশ্মীর ও পঞ্জাব — এই চারটি রাজ্যে মহিলাদের মাসিক কর্মসংস্থানের হার ৫০ শতাংশের বেশি হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে।

২০১৯ সালে প্রায় ৯৫ লক্ষ মহিলা প্রতি মাসে কাজের খোঁজ করলেও ২০২০ সালে তা নেমে দাঁড়ায় ৮৩ লক্ষে আর ২০২১এ আরও অনেকটা নেমে যায় ৬০ লক্ষ ৫২ হাজারে। গ্রাম ও শহরে একই ধারা লক্ষ্য করা যায়।

পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (২০১৭-১৮) যা ২০১৯ সালের জুন মাসে প্রকাশিত হয়, তার থেকে জানা যাচ্ছে যে মহিলাদের কাজের বাজার থেকে উৎখাত হওয়াটা অকল্পনীয় হারে বেড়েছে। কর্মপ্রত্যাশীদের সংখ্যা নিরন্তর বেড়ে চললেও নরেন্দ্র মোদী সরকার তাদের চাকরি দিতে পারছে না। ২০২০ সালের ম্যাকিনসে গ্লোবাল ইন্সটিটিউটের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক জাতীয় আয়কে ৮-৮.৫ শতাংশ হারে বাড়াতে ভারতের অন্তত ৯ কোটি নন-ফার্ম কাজ দরকার।

সিএমআইই’র রিপোর্ট আরও দেখিয়েছে, বিগত তিন বছরে বেকারত্বের হারও ৮ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করলেও ২০২০ সালের এপ্রিল-মে মাসে প্রথম লকডাউনে তা একলাফে বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ শতাংশে। তারপর এই হার একটু কমলেও ২০২১ সালের মে মাসে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় তা আবার বেড়ে ১৫ শতাংশে পৌঁছায়।

আর্থিক বৃদ্ধি ঘটাতে হলে মহিলাদের কর্মসংস্থানের হার অনেক বাড়াতে হবে, তারজন্য রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে সেইমতো পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে, যা নিদারুনভাবে অনুপস্থিত। মহিলাদের কর্মসংস্থানের বিশেষ দাবিকে সামনে রেখে রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে।

- স্বপ্না চক্রবর্তী

the victims of Malipanchghara

গত ২৪ জুলাই সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের হাওড়া জেলা কমিটির পক্ষ থেকে একটি টীম মালিপাঁচঘড়ার গজানন বস্তিতে বিষমদে মৃতদের পরিবারের সাথে কথা বলে স্থানীয় থানায় গিয়ে বিভিন্ন দাবি পেশ করে। ২৯ জুলাই সেই অনুসন্ধান টীমের রিপোর্টের ভিত্তিতে ও মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের সমস্যার কিছুটা সমাধানের জন্যে প্রয়োজনীয় কিছু দাবি নিয়ে হাওড়া জেলাশাসকের দপ্তরে স্মারকলিপি জমা দিতে যায় একটি প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধিদলে ছিলেন হাওড়া জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত সহ কল্যাণী গোস্বামী, এ কে গুপ্তা ও অঙ্কিত মজুমদার।

প্রথমে জেলাশাসক মুক্তা আর্য তার দপ্তরের কর্মচারীর মারফত আমাদের ডেপুটেশন গ্রহণের জন্যে লোক পাঠালে প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে তা নাকচ করে জেলাশাসকের অনুপস্থিতিতে অতিরিক্ত জেলাশাসক কিংবা সচিবদের সাথে দেখা করে ডেপুটেশন জমা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রতিনিধিদলের অনড় অবস্থানের কথা জেলাশাসক জানতে পেরে জেলার শিক্ষা সচিবকে ডেপুটেশন গ্রহণ করার নির্দেশ দেন।

ঘটনাচক্রে মূল মূল দাবির দুটো দাবি শিক্ষা সচিবের আওতাধীন হওয়ায় তিনি কথা দেন যে বিষমদে মৃতব্যক্তির অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের শিক্ষার দায়িত্ব জেলা প্রশাসন নেবে এবং সেই পরিবারের মহিলাদের জেলার স্বনির্ভর প্রকল্পের আওতায় এনে রোজগারের ব্যবস্থা করবেন। বাকি দাবি নিয়ে তিনি জেলাশাসক মুক্তা আর্যের বিবেচনার জন্যে তারসাথে দেখা করবেন বলেন।

তাঁকে প্রতিনিধিদল পরিস্কার জানিয়ে এসেছে যে আগামী ১৫ দিনে কাজ না হলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার পরিজন নিয়ে ডিএম অফিসের সামনে হাজির হবে ও বৃহত্তর আন্দোলন সংগঠিত করা হবে।

RSS has no place for thought

এম এস গোলওয়ালকর তাঁর ‘চিন্তন গঙ্গা’ গ্রন্থে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলেন। এতকাল বাদে ভারতীয় জনতা পার্টি গোলয়ালকরের সেই ইচ্ছাপূরণ করল। এই যুক্তরাষ্ট্রীয় সার্বভৌম কাঠামোকে ভেঙে ফেলার অন্যতম অভিনব পন্থা হল ‘গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স’ অর্থাৎ জিএসটি প্রণয়ন। জনতাকে বোঝানো হল জিএসটি এক বিপুল অর্থনৈতিক সংস্কার। যেমন নোটবন্দীর ক্ষেত্রে ঘটেছিল। কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায় জিএসটি আদপে রাজ্যগুলির অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা নিমেষে ছিনিয়ে নিল এবং রাজ্যগুলি তাদের বরাদ্দের ন্যুনতম ভাগের জন্যে এখন কেন্দ্রের দয়া দাক্ষিণ্যের শিকার। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে খর্ব করে দিয়ে আমাদের ভারতীয় সংবিধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য দিকটি পঙ্গু করে দেওয়া হল। এবং অত্যন্ত সন্তর্পণে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে আঘাত হানল ওরা। খুব অবাক হওয়ারও কিছু নেই। এই গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং সার্বভৌম সংবিধান থাকলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) এবং বিজেপি তাদের প্রক্রিয়া প্রণয়ন করবেই বা কী করে! এ যে তাদের প্রায় একশো বছরের অপেক্ষা! যার সূচনা হয়েছে গোলওয়ালকরের আগে কেবি হেডগেওয়ারের হাত দিয়ে। তাদের আরেকটি জোরদার পদক্ষেপ হল হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা। এই সব কটা পদক্ষেপ হল বহুত্ববাদ বিরোধী তাদের মূল ভারতীয় অস্মিতা-  এক রাষ্ট্র, এক ভাষা, এক জাতি, এক নেতার সার্থক রুপায়ন।  

শিক্ষাক্ষেত্রেও গল্পটা একই। বরং আরো ভয়ঙ্কর। ইতিহাস এবং শিক্ষা এই দুটি ক্ষেত্রে আরএসএসের বরাবর আগ্রহ ও উৎসাহ। হবে নাই বা কেন। ওখানেই তো বীজ বপনের মহা সুযোগ। পাঠ্যপুস্তকগুলোয় তারা চায় নিজেদের এজেন্ডার ইতিহাসে ভরপুর করে দিতে। যেমন, ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইতে টিপু সুলতানকে খাটো করে দেখাতে লেখা হয়েছে ‘টিপু সুলতান ফরাসীদের সাহায্য নিয়ে ইংরেজদের যুদ্ধে পরাস্ত করেছে’। কিন্তু টিপু সুলতানের সময়ে যে গুটি পোকা (রেশম) চাষের সূচনা, ভূমি সংস্কার, কৃষি ঋণ, টাঁকশাল তৈরি হয়েছিল সেসব বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রায় তিনশো বছর ভারত শাসন করা মুঘলদের বহিঃশত্রু রূপে দেখাতেও তারা মরিয়া।

সিবিএসসি বোর্ডের ইতিহাসের বইয়ে মেলে তার নানা নিদর্শন। যেমন কর্ণাটক সরকারের অষ্টম শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্য বইয়ের একটি চ্যাপ্টার ‘রাইজ অব নিউ রেলিজিওন’ (নূতন ধর্মের আবির্ভাব), যেখানে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মকে দুটি নূতন ধর্ম হিসেবে দেখানো হচ্ছে, দুটি ধর্মকেই পাঠ্য বইটিতে মূল হিন্দু ধর্মের দুটি সম্প্রদায় হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। এই সবর্ণ হিন্দু দলের পক্ষে হজম করা সম্ভব হচ্ছে না যে বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম এবং শিখ ধর্ম ভারত ভূমির তিনটি সত্যিকারের ধর্ম যারা চতুর্বর্ণ প্রথা নিষিদ্ধ করেছিল।

স্কুলের পাঠ্য বই সংশোধন প্রক্রিয়াটি নতুন কারণ এর পূর্বে নিজেদের শাখার বাইরে তারা এসব বাস্তবায়িত করতে পারেনি। তবে চেষ্টা শুরু হয়েছে বিজেপির আগের জমানার সরকার থেকেই। ১৯৯৮ সালে বিজেপি যখন প্রথমবারের জন্যে ক্ষমতায় এলো তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মুরলী মনোহর যোশী তখন ‘পৌরহিত্য’ এবং ‘আচার- অনুষ্ঠান’ স্কুল পঠনপাঠনে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল পুত্রের কামনায় ‘পুত্রেষ্ঠী যজ্ঞ’। তাঁর সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে জ্যোতির্বিদ্যার বদলে জ্যোতিষবিদ্যা পড়ানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। যদিও তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

এইসব ভিত্তিহীন বিষয় শিশু মনকে মূর্খতার দিকে ঠেলে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করে না। গেরুয়া শিবিরের গুরু গোলওয়ালকর চাইতেন না কিশোর মনের বিস্তার হোক, তারা বুদ্ধি, মেধা প্রয়োগ করে বিচার করতে শিখুক, সমালোচনা করতে শিখুক। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবকের মুখ্য প্রতিনিধি ভাজপা সরকার গত আট বছর প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে ক্ষমতায় এসে সেই কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করছে। সম্প্রতি সিবিএসসি ক্লাস টেনের পাঠ্যসূচি থেকে বেশ কিছু বিষয় সম্পূর্ণ বাদ গেছে যেমন গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, কৃষিতে বিশ্বায়নের প্রভাব, গণ আন্দোলন এবং সাম্প্রদায়িকতা। গেরুয়া শিবিরের শিক্ষা সংস্কৃতির সংস্থা ‘ন্যাস’ বর্তমানে অতীব প্রভাবশালী। তারা সিলেবাস তৈরির প্রতিষ্ঠান এনসিইআরটি-কে চাপ দিচ্ছে বহু বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত না করতে যার মধ্যে অন্যতম হল ২০০২’র গুজরাত দাঙ্গা। এটাই তাদের চাতুরী। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে না বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, জ্যোতিরাও ফুলে, সাবিত্রীবাই ফুলে, রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনদের কথা। জানবে না জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নানা ভাবাদর্শের বহু সংগ্রামীদের কথা যাদের রক্তঢালা সংগ্রামে দেশ স্বাধীন হয়েছে।

আরো কত দূর, আরো কতভাবে প্রকৃত ইতিহাস মুছে তাদের মনমতো বানানো ইতিহাস লেখা হবে, আমরা সত্যিই জানি না! তবে এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতেই দেখা যাবে হেডগেওয়ারকে বলা হবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জনক এবং দামোদর সাভারকর হয়ে যাবেন জাতীয় নায়ক যাকে অনেক কালই ‘বীর’ ভূষণে ভূষিত করা হয়েছে, যিনি আসলে আটবার ব্রিটিশ সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন এবং গান্ধী হত্যার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী। নাথুরাম গডসেই বা বাদ যাবেন কেন! হয়ত স্কুলপাঠ্যে বলা হবে তার জন্যেই রক্ষা পেয়েছিল ভারতীয় হিন্দুরা!

এই গৈরিকরণের শেষ কোথায় কে জানে!

- অভিষেক রায়

Universal Equitable Education

সর্বজনীন সমমানের শিক্ষা-প্রশ্নটা দৃষ্টিভঙ্গীর, ধনী-নির্ধন সকল পড়ুয়াকে সমভাবে দেখা না দেখার শহরগুলির, বিশেষত কলকাতা, হাওড়া, শিলিগুড়ি, আসানসোল, দুর্গাপুরের মতো শহরগুলির বিদ্যালয়গুলির দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলিতে (যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের সরকার বেতন দেয় এবং স্কুল সার্ভিস কমিশন বা প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের মাধ্যমে নিয়োগ করে) পড়ুয়াদের সংখ্যা কমছে। বহু বিদ্যালয় পড়ুয়াদের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলির অধিকাংশেই পড়ার জন্য আকুতি বাড়ছে, বহু পড়ুয়া ভর্তি হতে গিয়ে নিরাশ হচ্ছে। সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে পড়ুয়াদের বেতন নেই, অন্যান্য খরচও কম, শিক্ষিকা শিক্ষকরাও বহুবিধ যাচাই’এর মধ্য দিয়ে পরীক্ষিত হয়ে নিযুক্ত হন, তাঁদের বেতন ও অবসরের পরে পেনশন সরকার নির্ধারিত বেতন কাঠামো অনুযায়ী হয়। বিপরীতে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিতে বেতন অনেকগুণ বেশি, সাথে অন্যান্য খরচও প্রচুর, শিক্ষিকা শিক্ষকরা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পছন্দমত নিযুক্ত হন, তাঁদের বেতন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো বেতনক্রম মেনে হয় না, অবসরের পরে কোথাও কোথাও পেনশন পাওয়া গেলেও তা সরকারি বিদ্যালয়ের তুলনায় নগণ্য। এছাড়া, যত দামি বিদ্যালয় তত বেশি খরচ প্রাইভেট টিউশনের জন্য। বোঝা যায়না, নাম করা বেসরকারি বিদ্যালয়ে কী এমন ভালো পঠনপাঠন হয় যে, বেশি খরচের প্রাইভেট টিউশন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে।

যাই হোক, উপরের অনুচ্ছেদে কখনো বাণিজ্যিক বিদ্যালয় লেখা হয়নি, সচেতনভাবেই হয়নি। কারণ, আমাদের দেশে মুনাফার জন্য বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা যায়না। কিন্তু সকলেই জানে যে, ওই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই মুনাফা করে থাকে। সাধারণত, সোসাইটি বা ট্রাস্টের দ্বারা প্রতিষ্ঠানগুলি খোলা হয়, যে সোসাইটি বা ট্রাস্ট কোনো কোম্পানির দ্বারা গঠিত হয়। কোম্পানি প্রতিষ্ঠানগুলির সম্পত্তির মালিক হয় ও সেগুলি ব্যবহারের জন্য প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে অর্থ আদায় করে ও মুনাফা করে। ফলে ঘুরপথে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই বিদ্যালয়গুলি খোলা হয়ে থাকে। সম্প্রতি প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়ে হইচই পড়ে গেছে। যে পরিমাণ অর্থ নগদে দেখা গেছে তার কয়েকগুণ নিশ্চয়ই এখনো লুকোনো আছে, যা ভবিষ্যতে দেখা যেতেও পারে নাও পারে। লক্ষ্যণীয় ‘উন্নত’ শিক্ষা প্রদানকারী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির গঠনের মধ্যেই লুকোছাপা রয়েছে। সেগুলি ‘মুনাফার জন্য নয়’, কিন্তু মোটা অঙ্কের বেতন পড়ুয়াদের কাছ থেকে নেয়। মুনাফাও করে। ফলে, অনুমোদন পাওয়ার জন্য ক্ষমতাবান ‘শিক্ষামন্ত্রী’কে খুশি করা তাঁদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।

A Question of Attitude_0

বহুদিন ধরেই শিক্ষাখাতে জিডিপি’র ৬ শতাংশ বরাদ্দের কথা শুনে আসছি আমরা। শিগগিরি আমরা নাকি ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হব। এখন তা ৩.২ ট্রিলিয়ন ডলার। ফলে শিক্ষাখাতে ব্যয় হওয়া উচিৎ ১৯,২০০ কোটি ডলার বা ১৫,৩৬,০০০ কোটি টাকা। হচ্ছে তার অর্ধেকেরও কম, ৭ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২১-২২ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য ভিত্তিক আভ্যন্তরীণ উৎপন্নের পরিমাণ ১৫.১১ লক্ষ কোটি টাকা। ৬ শতাংশ হিসেবে শিক্ষাখাতে ব্যয় হওয়া উচিৎ ৯১ হাজার কোটি টাকা। ২০২১-২২ সালের সংশোধিত হিসেব অনুসারে ব্যয় করা হয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা, ৪৩ শতাংশের মতো। কেবল তুলনার জন্য চিনের শিক্ষাখাতে ব্যয়ের পরিমাণকে দেখা যেতে পারে। চিনে শিক্ষাখাতে ২০২১ সালে সরকারি ব্যয় হয়েছিল ৩.৭৬ ট্রিলিয়ন য়ুয়ান, যা ৪৪ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। চিনের জনসংখ্যা ভারতের থেকে সামান্যই বেশি। ফলে চিনে মাথাপিছু শিক্ষাখাতে ব্যয় ভারতের থেকে ৬ গুণের বেশি। পশ্চিমী দেশগুলির মাথাপিছু ব্যয়ের কথা বলে নিজেদের লজ্জা না দেওয়াই ভালো। এই পরিসংখ্যান থেকে এদেশে শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাই যাচ্ছে।

চিনের মতো যদি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে বাধ্য করা যেত শিক্ষাখাতে অনুরূপ ব্যয় করতে তাহলে দেশের সর্বসাধারণের শিক্ষার মান কত ভালো হতে পারত। অতটা না ভেবে যদি জিডিপি’র ৬ শতাংশ হিসেবে ওই ব্যয় ১৫ লক্ষ কোটি টাকাও হত, তাহলেও অন্তত গ্রাম শহরের সাধারণ বিত্তের বা গরিব ঘরের পড়ুয়াদের উন্নত শিক্ষার পরিকাঠামো তৈরি করা সম্ভব হত। কেবল তাই নয়, চিনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বার্ষিক বেতন গড়ে ১৭৭ হাজার চিনা য়ুয়ান যা ভারতীয় টাকার অঙ্কে প্রায় ২১ লক্ষ টাকা। সামগ্রিক শিক্ষকদের গড় বেতন ভারতীয় টাকার অঙ্কে ৩০ লক্ষ টাকা। গড় বেতনের দিক দিয়ে এদেশের প্রাথমিক শিক্ষকরা চিনের তুলনায় ৯ ভাগের ১ ভাগ পেয়ে থাকেন। কেবল তাই নয়, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনের ক্ষেত্রে ভারতীয় শিক্ষকদের গড় বেতন প্রাথমিক শিক্ষকদের তুলনায় ৬ গুণ, চিনে তা আড়াইগুণ। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বেতন বৈষম্যও কম।

A Question of Attitude

যদি এদেশে ধনী নির্ধন নির্বিশেষে সবার জন্য সমমানের শিক্ষার বন্দোবস্ত করার আন্তরিক ইচ্ছে সরকারগুলির থাকে, তাহলে

১) পুরো বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে সরকারি করা সর্বোত্তম উপায়। যদি তা না করা যায়, তাহলেও সরকারি বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষেই পাঠক্রমকে সমাপ্ত ও কেবল শ্রেণিকক্ষেই পড়াশোনা বাধ্যতামূলক করে সরকারি বিদ্যালয়গুলিকে সর্বোত্তম করে তুলতে হবে। অবশ্যই পড়ুয়া শিশুদের নিকটবর্তী বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা আবশ্যিক করতে হবে। কোনোমতেই সরকারি বিদ্যালয়ের মধ্যে অভিভাবকরা বাছাবাছি করতে পারবেন না।

২) কেবল মিড-ডে-মিলের মতো যেনতেন প্রকারের খাবার নয়, সকল পড়ুয়াকে বিদ্যালয়ে থাকাকালীন সুস্বাদু বৈচিত্রপূর্ণ আকর্ষণীয় কিন্তু স্বাস্থ্যকর সুষম খাবার দিতে হবে।

৩) আগেই বলেছি, পাঠক্রম তৈরির বিষয়ে শিক্ষকদের গুরুত্ব সর্বোচ্চ, তদনুসারে পাঠক্রম তৈরি করতে হবে। এবং শিক্ষকদের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকাঠামো যোগান দিতে হবে সরকারকে। উপযুক্ত বিদ্যালয় ভবন, শ্রেণিকক্ষ, গ্রন্থাগার, প্রসাধন কক্ষ, শৌচাগার, কম্পুটার, যন্ত্রপাতি, ল্যাবরেটরি, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের সীমা মেনে চলা-এসবই পরিকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত।

৪) সকল শিক্ষক শিক্ষিকাকেই বিদ্যালয়ের সন্নিকটে থাকার সুচারু বন্দোবস্ত করতে হবে সরকারকে। কেবল শিক্ষিকা-শিক্ষকের প্রয়োজনে বা তাগিদে বিদ্যালয় পরিবর্তন চলবেনা।

৫) শিক্ষিকা-শিক্ষকদের দায়িত্বশীল করতে হবে শ্রেণিকক্ষেই পাঠ সমাপন করাতে।

৬) শিক্ষিকা-শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সার্বিক স্বচ্ছতা রাখতে হবে। তাছাড়া নিয়োগের সময়ে শিক্ষিকা-শিক্ষকদের ওয়াকিবহাল করতে হবে যে, শ্রেণিকক্ষের সমস্ত পড়ুয়াদের সর্বোত্তম শিক্ষণের দায়িত্ব তাঁদের।

৭) শিক্ষিকা-শিক্ষকদের সঙ্গে অন্য সংগঠিত ক্ষেত্রের সমস্তরের কর্মীদের মধ্যে ও বিভিন্ন স্তরের শিক্ষিকা-শিক্ষকদের মধ্যে বেতন বৈষম্য দূর করতে হবে।

৮) সর্বোপরি সরকারি শিক্ষাকে সম্পূর্ণ অবৈতনিক কিন্তু সর্বোচ্চ মানের হতে হবে।

অবশ্যই এসব করতে সরকারকে প্রভূত অর্থ ব্যয় করতে হবে। শিক্ষাখাতে জিডিপি’র ৬ শতাংশ ব্যয় করলে সেই ব্যয়ের অনেকটাই করা সম্ভব। জিডিপি নিরপেক্ষভাবে সকলের জন্য উন্নত সর্বোচ্চমানের শিক্ষাকে যদি সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়, তাহলে সেই অনুযায়ী শিক্ষাখাতে ব্যয় করতে হবে।

আসলে প্রশ্নটা দৃষ্টিভঙ্গীর, ধনী-নির্ধন সকল পড়ুয়াকে সমভাবে দেখা না দেখার।

- অমিত দাশগুপ্ত

Bengal in Quit India movement_1

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কথা জাতীয় কংগ্রেস ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই তার প্রায় সমস্ত নেতৃত্বকে ব্রিটিশ সরকার গ্রেপ্তার করে। কিন্তু আন্দোলন তা সত্ত্বেও দুর্বার গতিতে এগিয়েছিল মূলত স্থানীয় স্তরের হাজার হাজার নেতা কর্মীর স্বতঃস্ফূর্ত লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে। বাংলার আন্দোলনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ছাত্রছাত্রী ও শ্রমিকশ্রেণী বিভিন্ন জেলাতেই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ব্যবসায়ী, পুরসভার জনপ্রতিনিধি সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষও এতে সামিল হয়েছিলেন। জনগণের মধ্যে এক অভূতপূর্ব আবেগ ও উত্তেজনা সর্বত্রই দেখা গিয়েছিল।

কলকাতায় ছাত্র-যুবদের সাথে পুলিশের সংঘাত চলে। ১৭ অগস্ট হাওড়া শিল্পাঞ্চলের নানা কারখানায় শ্রমিকেরা ধর্মঘটে সামিল হন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভারত জুট মিল, ইন্ডিয়া মেশিনারি ফ্যাক্টরি, হাওড়া জুট মিল, অনন্তরাম চ্যাটার্জী অ্যান্ড কোম্পানি, বিজয় বার্ন কোম্পানি, গেস্টকিন উইলিয়াম লিমিটেড, ফকিরদাস মিস্ত্রি অ্যান্ড কোম্পানি, কে দাস অ্যান্ড কোম্পানি ইত্যাদি। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কর্মীরাও ধর্মঘটে যোগ দেন। আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হাওড়ার নানা জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন চলে।

আন্দোলন ঘোষণার পরপরই হুগলির বিভিন্ন প্রথম সারির নেতা গ্রেপ্তার হয়ে যান। ১৭ আগস্ট চুঁচুড়াতে, ২৯ আগস্ট, ৫ সেপ্টেম্বর ও ১৪ সেপ্টেম্বর শ্রীরামপুরে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্রছাত্রীরাও এই ধর্মঘটগুলিতে সামিল ছিলেন। শ্রীরামপুরের দশ জন ও চুঁচুড়ার আট জন সহ হুগলির বিভিন্ন মিউনিসিপ্যালিটির বেশ কয়েকজন কমিশনার আন্দোলনের সমর্থনে তাঁদের পদ থেকে ইস্তফা দেন। ২৭ আগস্ট থেকে কয়েকদিন হুগলির বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করেন। হুগলি কটন মিল, রামপুরিয়া কটন মিল, বঙ্গলক্ষী কটন মিল, বঙ্গেশ্বরী কটন মিল, হিন্দুস্তান বেল্টিং ওয়ার্কস, বেঙ্গল বেল্টিং ওয়ার্কস এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। হুগলি জেলার আন্দোলন সংগঠনে কংগ্রেসের পাশাপাশি ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা ও কর্মীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জ্যোতিষ ঘোষ, অশোক ঘোষ, জয়পাল দাস, সমর সোম, শচীন সোম, রমেশ পাল, হরিনারায়ণ চন্দ প্রমুখ। এই জেলায় সোশ্যালিস্ট পার্টির কর্মীরাও বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন। রেললাইন ধ্বংস, ইউনিয়ন বোর্ডের নথিপত্র পোড়ানো, ডাকঘরের কাগজপত্রতে আগুন দেওয়া, টেলিফোন লাইন কাটার মতো নানা নাশকতামূলক পদ্ধতিতে তাঁরা এখানে আন্দোলন জারি রাখেন। সামরিক বাহিনীর জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশকে বিশেষ বাধার সম্মুখীন হতে হয়, পুলিশি দমনপীড়নও প্রবল হয়ে ওঠে। পুলিশ নানা জায়গাতেই মিছিলের ওপর গুলি চালায়।

নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরই ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সবচেয়ে সক্রিয় ছিল। এছাড়া রানাঘাট, শান্তিপুর ও নবদ্বীপেও বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছিল। নদীয়া জেলার বিভিন্ন গ্রামীণ অঞ্চলে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মাঝদিয়া, টুঙ্গি, মুড়াগাছা, করিমপুর ইত্যাদি।

বর্ধমান জেলায় অন্যান্য অনেক জেলার মতোই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন দিনে ধর্মঘট পালিত হয়। ১৩, ১৬, ১৭ ও ১৮ আগস্ট বর্ধমান শহরে ধর্মঘট হয়েছিল। ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর ধর্মঘট হয় কালনাতে। ১২ অগস্ট থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর – একমাস কাটোয়াতে একটানা ছাত্র ধর্মঘট হয়েছিল। জেলার নানা জায়গায় ডাকঘর পুড়িয়ে, পিকেটিং করে জনগণ বিক্ষোভ দেখায়। কালনা, জামালপুর, ভান্ডারহাটি, পালাসান, কাশীয়ারা, উচালন, মণ্ডলগ্রাম, কুসুমগ্রাম, বেরুগ্রাম, রায়না প্রভৃতি জায়গায় ডাকঘর ধ্বংস করা হয়েছিল।

বাঁকুড়ায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সাঁওতালরা বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। বাঁকুড়া শহর ও পাত্রশায়রে অনেকগুলি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তালডেংরা, সিমলাপাল, রায়পুর, সোনামুখী, জয়পুর, কোটালপুর, ইন্দাস, সারেঙ্গার ডাকঘরে আগুন দেওয়া হয়। ৪২ এর ৮ অক্টোবর বিষ্ণুপুর বিমান অবতরণ কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ ছিল অত্যন্ত সাহসী ও ব্যতিক্রমী এক ঘটনা।

বীরভূমের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মহিলাদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। মায়া ঘোষ, ঊষা হাজরা, সবিতা হাজরা, অপরাজিতা চট্টোপাধ্যায়, মণিপ্রভা মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। এখানেও আদিবাসী সাঁওতালরা আন্দোলনে বিশেষ সক্রিয় ছিল। ২৯ আগস্ট তারা বোলপুর রেলস্টেশনের ওপর আক্রমণ শানিয়েছিল। এই জেলায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন আরসিপিআই দলের নেতা পান্নালাল দাশগুপ্ত। বোলপুর, দুবরাজপুর, হেতমপুর, রামপুরহাট, মল্লারপুর প্রভৃতি জায়গায় আন্দোলন ছিল জোরদার।

পুরুলিয়া জেলার আন্দোলন সংগঠনের কাজে ছিলেন চুনারাম মাহাতো, গোবিন্দ মাহাতো, গিরিশ মাহাতো, হেম মাহাতো, মগন মাহাতো, মণ্ডল মাহাতো, ভীম মাহাতো, মথন মাহাতো, ধনু মাহাতো, জনার্দন মাহাতো, প্রাণকৃষ্ণ মাহাতো, রামু শবর, লক্ষণ শবর, ছামু শবর প্রমুখ জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষেরা। বান্দোয়ানে ভজহরি মাহাতো এবং কুশধ্বজ মাহাতোর নেতৃত্ব কয়েক হাজার ভূমিজ, খেড়িয়া, মাহাতো, শবর, সাঁওতাল প্রমুখ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ সাহসের সঙ্গে সামরিক ট্রাক ঘিরে ফেলে তার ওপরেও হামলা চালায়। আদ্রা, বলরামপুর, বেড়ো, ঝালদা, রঘুনাথপুর, হুড়া, পুঞ্চা প্রভৃতি পুরুলিয়ার উত্তরাংশে ও জেলার দক্ষিণাংশ জুড়ে এই আন্দোলন চলেছিল। সরকারী রিপোর্ট জানাচ্ছে পুরুলিয়া থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের জন্য পুলিশ ৪৫২ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল।

মুর্শিদাবাদ জেলায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন জাতীয় কংগ্রেস, আরএসপি ও ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতৃবৃন্দ। এই জেলাতেও বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন দিনে আলাদা আলাদাভাবে ধর্মঘট পালিত হয়েছিল। ৪২ সালের ১১, ১৫, ১৬ আগস্ট ও ৬ সেপ্টেম্বর বহরমপুরে ছাত্রদের উদ্যোগে ধর্মঘট হয়। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ মহাবিদ্যালয়ের ছাত্ররা এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। জিয়াগঞ্জে মিছিল ও কান্দীতে পিকেটিং সংগঠিত হয়েছিল। খাগড়াতেও প্রতিবাদ হয়। রেল ব্যবস্থাকে বিঘ্নিত করার বিভিন্ন উদ্যোগ বিভিন্ন সময়ে নেওয়া হয়েছিল। জিয়াগঞ্জে অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দলের কর্মকাণ্ড ছিল বেশ সক্রিয়। এটি এই অঞ্চলে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিকাশে বিশেষ সহায়তা করেছিল। এই দুই বিপ্লবী গোষ্ঠীর যে সমস্ত নেতারা এই আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন কমল পাণ্ডে, মনোরঞ্জন ভাস্কর, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, দুর্গাপদ সিংহ, জগদানন্দ বাজপেয়ী, অভিরঞ্জন সাহা, কালীনারায়ণ সিংহ প্রমুখ। এখানকার আন্দোলনে তিন মহিলার বিশেষ ভূমিকা ছিল। তাঁরা হলেন মৃণাল দেবী, মণিমালা দেবী ও চুন্নু কুমারী পাণ্ডে। বেলডাঙাতেও আন্দোলন ছড়িয়েছিল। এখানকার আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন জগন্নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নৃসিংহ সাহা, বিমলপদ হালদার, কালীশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, অতুল হাজরা প্রমুখ।

Bengal in Quit India movement_0

মেদিনীপুর জেলা ও তমলুক জাতীয় সরকার

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল মেদিনীপুর জেলা। তমলুক মহকুমা ও কাঁথি মহকুমাতে আন্দোলন সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছিল। ঝাড়গ্রাম মহকুমার আন্দোলনে আদিবাসী সমাজের বিশেষ ভূমিকা ছিল। কাঁথি মহকুমার খেজুরি, পটাশপুর, ভগবানপুর, কাঁথি, এগরা, রামনগর থানা এলাকাগুলিতে আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৪ সেপ্টেম্বর কাঁথি শহরে দশ হাজার লোকের বিশাল মিছিল হয়েছিল। কাঁথি শহরের বাজার একটানা তিন সপ্তাহ বন্ধ ছিল। ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জনগণ খেজুরি থানায় আক্রমণ চালিয়ে থানাটিকে ভস্মীভূত ও ধ্বংস করে। এই অভিযানে প্রাত সাত হাজার মানুষ সামিল হয়েছিলেন। থানা ধ্বংসের পর আক্রমণ শানানো হয় রেজিস্ট্রি অফিস, সাব রেজিস্ট্রি অফিস, বিভিন্ন পোস্ট অফিসে। রাস্তা কাটা, টেলিগ্রাফ পোস্ট উপড়ে ফেলা, টেলিগ্রাফের তার কাটা, পুল ও কালভার্ট ধ্বংস ইত্যাদির মাধ্যমে প্রশাসনকে বিচ্ছিন্ন করার একাধিক সচেতন প্রয়াস নেওয়া হয়। ১ সেপ্টেম্বর থেকে কাঁথি মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চলে ৫০০ সেনা মোতায়েন করে ব্রিটিশ সরকার।

তমলুকে আন্দোলন সংগঠনে সতীশ সামন্ত ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পরেই তমলুকের বিশিষ্ট নেতা সুশীলকুমার ধাড়ার পরিকল্পনা অনুসারে বিদ্যুৎবাহিনী ও ভগিনী সেনা গঠিত হয়েছিল। বিদ্যুৎ বাহিনীতে প্রায় পাঁচ হাজার সদস্য ছিলেন। সোভিয়েত রেড আর্মির প্রভাব এর মধ্যে ছিল।

'৪২-র ১৪ সেপ্টেম্বরের এক সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে ২৯ সেপ্টেম্বর তমলুকে গণ প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করার কথা হয়েছিল। তার আগেই তমলুককে আশপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার কাজ শুরু হয়ে যায় রাস্তা কাটা, টেলিফোন টেলিগ্রাফ লাইন বিচ্ছিন্ন করা, টেলিগ্রাফের পোস্ট ভাঙা, কালভার্ট, পুল ধ্বংস করা, কোশি ও হুগলি নদীর খেয়া ধ্বংস করা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে।

২৯ সেপ্টেম্বর তমলুক থানা ধ্বংস করার জন্য বিকেলের দিকে রওনা দেয় ৫ টি আলাদা রাস্তা দিয়ে পঞ্চাশ হাজার জনতার বিশাল উদ্দীপ্ত মিছিল। পুলিশ মিছিলের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। মোট দশজন শহীদ হন। এনাদের একজন ছিলেন ৭৩ বছরের মাতঙ্গিনী হাজরা। অভিযান চলে মহিষাদল থানা দখলের উদ্দেশ্যেও। এখানেও অন্তত দশহাজার মানুষ মিছিলে সামিল ছিলেন। এই মিছিলের ওপরেও পুলিশ গুলি চালায়। অনেকে হতাহত হন। এঁদের মধ্যে ছিলেন শেখ সুরা ও শেখ আলির মতো মুসলিম যুবকেরাও। মুসলিম লীগের নির্দেশ অমান্য করেই এখানে মুসলিমরা আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। সুতাহাটা থানাতেও অভিযান হয়েছিল এবং সেটি দখল করে নেওয়া সম্ভব হয়।

তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার, যা ১৯৪২ এর ১৭ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় ও দীর্ঘদিন স্বাধীনভাবে টিঁকে থাকে, তা স্বতন্ত্র এক নিবন্ধে বিস্তারিতভাবে আলোচনাযোগ্য। এই সরকারের মুখপত্র বিপ্লবীর প্রতিটি সংখ্যাই আন্দোলন সংক্রান্ত ইতিহাস রচনার মূল্যবান দলিল। রাধাকৃষ্ণ বাড়ি তাঁর লেখা তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার বইতে এই আন্দোলনের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। আমরা সে সংক্রান্ত আলোচনা এখানে করলাম না। বাদ রইলো উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের জেলাগুলিতে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয়তা নিয়ে আলোচনা, করা হবে সেইসব ফিরে দেখা আলোচনাও।

– সৌভিক ঘোষাল

Hate destroys its creator_0

দেবানুর মহাদেবা রচিত পুস্তিকা ‘আরএসএস : তার গভীরতা ও ব্যাপ্তি’ কর্নাটকে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। কর্নাটকে হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলোর আগ্ৰাসন এখন তার শিখরে পৌঁছেছে। হিজাব, আজান, পাঠ্যপুস্তকে পাঠ্যক্রমের পরিবর্তন, ইত্যাদি ইস্যুগুলোকে ধরে তারা আক্রমণাত্মক মুসলিম-বিরোধী প্রচার লাগাতার চালিয়ে আসছে।

রাজ্যের বিজেপি সরকার একটা অর্ডিন্যান্স জারি করেছে — ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষা আইন ২০২২’। অধ্যাদেশের নামটা যে অর্থ ব্যক্ত করে, এর নিহিত উদ্দেশ্য ঠিক তার বিপরীত — অধ্যাদেশে ধর্মান্তরণকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে, এবং বিশেষভাবে নিশানা বানানো হয়েছে হিন্দু নারীর ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম পুরুষকে বিবাহ করার ঘটনাকে।

১৯৭০’র দশকে জনপ্রিয় দলিত লেখকদের যে প্রজন্ম আত্মপ্রকাশ করে, দেবানুর মহাদেবা তার অন্যতম। তিনি দলিত সংঘর্ষ সমিতিরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। সাহিত্য ক্ষেত্রে এবং রাজনৈতিক সক্রিয়তায় তিনি বিপুল অবদান রেখেছেন। তিনি পদ্মশ্রী পুরস্কারের মতো মার্যাদাও পেয়েছেন। তিনি কর্নাটকের বিবেক স্বরূপ। এই পরিপ্রেক্ষিত এবং দৃষ্টিকোণ থেকেই আলোচ্য পুস্তিকাটির বিচার করতে হবে।

পুস্তিকাটি মাত্র ৬৪ পৃষ্ঠার যেটিকে হাতে নিয়ে গড়গড় করে পড়ে ফেলা যায়। দেবানুর মহাদেবা জানিয়েছেন, এই পুস্তিকাটি রচনার উদ্দেশ্য হল আরএসএস’এর প্রকৃত চরিত্রকে উন্মোচিত করা এবং সাধারণ জনগণকে আলোকিত করা। আরএসএস’এর চরিত্রের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্যকে ধরেই তিনি এটা করতে চেয়েছেন। আলোচনার জন্য তিনি মূলত ভিডিসাভারকার, গুরুজি গোলওয়ালকার ও হেডগেওয়ার’এর লেখাগুলিকেই বেছে নিয়েছেন। গোলওয়ালকারের মতে ‘মনুস্মৃতিকে’ই ভারতের সংবিধান হতে হবে, যদিও এই অভিমতটির প্রথম প্রস্তাবনা সাভারকারেরই। গোলওয়ালকার বলেছেন, ‘মনুস্মৃতি’র বিপরীতে আম্বেদকার রচিত সংবিধান বিশ্বের সংবিধানগুলো থেকে চয়ন করা, আর ‘মনুস্মৃতি’ হল ব্রাহ্মণ্যবাদী ধারণায় জাতি ও লিঙ্গের স্তরতন্ত্রের আইনি শাস্ত্র। এক পতাকা, এক নেতা, এক মতাদর্শের ধারণাই হল আরএসএস’এর অনুপ্রেরণার উৎস। গুরুজি গোলওয়ালকারের ধারণায় নাজি জার্মানি হল ‘জাতিগত অস্মিতার’ সর্বোচ্চ রূপ। আর তাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিলীন হয়ে যেতে হবে সংখ্যাগুরুদের সঙ্গে, আর তাদের দয়াতেই বাঁচতে হবে।

দেবানুর মহাদেবা জানাচ্ছেন, গোলওলাকারের লেখা ‘দ্য বাঞ্চ অব থটস’ গ্ৰন্থে তিনটে ভয়ানক ধারণা আছে।

(ক) ঋগবেদের পুরষাসুক্তা, ঈশ্বরের দেহধারণ এবং ভগবৎ গীতার প্রচার।
(খ) ‘চতুরবর্ণ’কে (জাতি প্রথার স্তরবিন্যাস) মেনে চলা এবং আম্বেদকার রচিত সংবিধানের প্রত্যাখ্যান।
(গ) আর্য শ্রেষ্ঠত্বের মহিমা প্রতিষ্ঠা।

দেবানুর মহাদেবা টিপু সুলতান শাসন সম্বন্ধে মিথ্যাচার ছড়ানো এবং হিন্দু-বিরোধী রাজা রূপে তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারের প্রসঙ্গেরও অবতারণা করেছেন। লেখক বলছেন, বিজেপি-আরএসএস গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করতে চায়। আরএসএস তার শত-শত প্রকাশ্য সংগঠনের মধ্যে দিয়ে সারা দেশেই বিস্তার লাভ করেছে। আরএসএস তার ক্যাডারদের মানুষ হিসেবে নয়, বরং আজ্ঞাবহ রোবোট রূপে প্রশিক্ষিত করে।

বিজেপি-আরএসএস কেন্দ্রে এবং অনেক রাজ্যেই রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করছে। তারা ১৯৭৭ সালে চুপিসারে জনতা পার্টির মধ্যে ঢুকে পড়ে আরএসএস’এর সদস্যপদ পরিত্যাগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এরপর তারা দেশের সর্বপ্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। তারা পাকিস্তানকে স্থায়ী শত্রু হিসাবে তুলে ধরে এবং দেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে থাকে। এই কাজের মধ্যে দিয়ে তারা দেশের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে, যে দেশ অর্থাৎ, ভারত ছিল বহুত্ববাদী সংস্কৃতির মিলন ক্ষেত্র।

বিজেপি-আরএসএস সরকার ‘মনুস্মৃতি’র বাস্তবায়নের জন্য কূটকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। ওরা দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সম্পূর্ণ বিরোধী। জিএসটি এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এক বড় আঘাত। হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের বিস্তারের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাতেও পরিবর্তন সাধন করা হচ্ছে। এক ভাষা, এক মহিমময় ধর্ম এবং এক নেতা — এই অভিপ্রায়ের বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হল আরএসএস’এর গোপন এজেন্ডা। যে সাভারকার ব্রিটিশ সরকারের কাছে মার্জনা ভিক্ষার চিঠি লিখেছিলেন, তাঁর মহিমা কীর্তন করা হচ্ছে, গডসেকেও গৌরবময় করে তোলা হচ্ছে।

আগামী নির্বাচনে বিজেপিকে পরাস্ত করার কৌশলও দেবানুর মহাদেবা সামনে এনেছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোর অধিক দায়িত্বকে স্মরণ করানো হয়েছে। ‘চতুরবর্ণ’ রূপায়ণের প্রচেষ্টায় আরএসএস’এর মিথ্যামোহ সৃষ্টির উন্মোচনের উপরও তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। বিজেপি-বিরোধী শক্তিগুলোকে বিনত হওয়ার এবং আত্মগরিমা ত্যাগের পরামর্শও তিনি দিয়েছেন। এই লক্ষ্যে পৌঁছনোর বহু পথই রয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় বিজেপি-বিরোধী সমস্ত শক্তিকে নিয়ে একটা জোট বা যুক্তমোর্চা গড়ে তুলতে হবে। সকলকেই এটা মনে রাখতে হবে যে, “ঘৃণা তার স্রষ্টাকেই ধ্বংস করে”।

তাঁর এই লেখায় দেবানুর মহাদেবা উপদেশ দেওয়ার পথে যাননি; বিপরীতে, তিনি সরল ভাষায় তাঁর ভাবনাকে বিধৃত করেছেন যাতে সবাই বুঝতে পারে তিনি কি বলতে চাইছেন। তিনি নিজেই একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হওয়ায় জনগণের কাছে তাঁর চিন্তাভাবনার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। আর এটাই আলোড়ন ওঠার কারণ।

- ডঃ ভি লক্ষ্মীনারায়
(লিবারেশন, আগস্ট ২০২২ সংখ্যা থেকে)

under BJP rule

বিজেপি কাস্ট সেন্সাসে রাজি নয়। বিজেপি শুধু সংরক্ষণ-বিরোধীই নয়, দলিত এবং অন্যান্য পশ্চাদপদ শ্রেণীর মানুষদের ন্যায্য অধিকার প্রদানেও তাদের অনীহা। দলিত, নারী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগণই বিজেপির আক্রমণের আসল নিশানা। বিজেপি জমানায় দেশের অর্থনীতি ধুঁকছে। দ্রব্যমূল্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। দেশে বিরাজ করছে এক অঘোষিত কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী ও সর্বব্যাপ্ত জরুরি অবস্থা। গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো ধারাবাহিক দমনের মুখে। যে মানবাধিকার কর্মীরা ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করছেন, তাঁদের জেলে পোরা হচ্ছে। বিহারে বিজেপি ফুলওয়ারিশরিফ এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে কালি ছিটিয়ে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। বিজেপি বিহারে এখন বলছে যে, উন্নয়নের ইস্যুতে তারা ২০২৪-এর নির্বাচনে জয়ী হবে। কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় বসার পর থেকেই তো ভারতের ধ্বংসের নতুন পর্যায় এলো। আদানি ও আম্বানির হাত দিয়ে কর্পোরেট লুটের সমস্ত রাস্তাই খুলে দেওয়া হয়েছে। যে রেল ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি কাজের জোগান দিত, তারও বেসরকারিকরণ করা হয়েছে ও হচ্ছে। সেনাবাহিনীতে নিয়োগকেও ঠিকা কাজে পরিণত করে বিজেপি দেশের নিরাপত্তাকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। আদিবাসী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুববাহিনী এবং ছোটো ব্যবসায়ী– বিজেপি জমানায় দুর্দশা ও ধ্বংস ছাড়া এদের আর কিছু জোটেনি।

Comrade Ravida left with a red dream

৯২ বছর বয়সে পার্টির বর্ষীয়ান সদস্য কমরেড রবি মুখোপাধ্যায় প্রয়াত হয়েছেন মঙ্গলবার, ১ আগস্ট। কোভিড জয় করলেও দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন, কষ্ট পাচ্ছিলেন বার্ধক্যজনিত রোগে।

৩ আগস্ট ক্রিকরো পার্টি অফিসে তাঁর মরদেহে ফুলমালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল সহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ। ছিলেন রবিদার দুই পুত্র সুমিত ও সন্দীপ, পুত্রবধু সোমা ও  অন্যান্য বন্ধুরা। আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে, মিছিল সহকারে এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে রবিদার মৃতদেহ দান করা হয়।

তাঁর জ্যাঠা ছিলেন অনুশীলন দলের বিপ্লবী। আর দাদু ছিলেন জমিদার। কুলীন বংশের এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই রবিদার বেড়ে ওঠা। অধুনা বাংলাদেশের কনকসার গ্রামে, নিজের মামাবাড়িতে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায়, দুর্ভিক্ষ পীড়িত বাংলাদেশ থাকতে না পেরে, বাবাকে হারিয়ে, মা-দুই ছোট ভাই আর একমাত্র বোনকে নিয়ে এপারে চলে আসেন। প্রথমে নেতাজির ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগ দেন, কলকাতায় গান্ধী এবং নেহরুর জনসভায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। সেখান থেকে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ছত্রছায়ায় আসেন, পার্টি সদস্যপদ লাভ করেন। রাজনৈতিক কাজের হাতে খড়ি হয় শ্রমিকদের নিয়ে। একইসঙ্গে শুরু করেন পণ্ডিত যশরাজের কাছে মার্গ সংগীতের তালিম নেওয়া। সেই চর্চার সূত্রে পার্টির সাংস্কৃতিক শাখায় জড়িয়ে পড়েন। এস ইউ সির শিবদাস ঘোষের সঙ্গে কিছুদিন টিটাগর জুট মিলে যৌথভাবে ট্রেড ইউনিয়নের কাজ করেন। পার্টি ভাগের সময় সিপিআই থেকে যোগ দেন সিপিএমে। তারপর ঘটে নকশালবাড়ি, আর তার ভিত্তিতে রবিদার ধ্যানজ্ঞান হয় নতুন পার্টি, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই(এমএল)। কাজ করতেন ডালহৌসি অফিসপাড়া ইউনিটে। পুলিশের নজরে পড়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে বাধ্য হন। সেখান থেকে আন্দোলনের ঝটিকা কেন্দ্র গ্রামাঞ্চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি ছেড়ে সর্বক্ষণের কর্মী হন।

তারপর সংগ্রামে ধাক্কা নেমে আসার পর নানা কারণে রবিদার পার্টি জীবনে সাময়িক বিচ্ছিন্নতা আসে। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে ফের মার্গ সঙ্গীতেই ফিরে আসার চেষ্টা করেন মন ভালো রাখতে। না, সেদিকে বেশিদিন মন টেঁকেনি। ১৯৮০-র দশক আইপিএফের হাত ধরে নতুন করে ফিরে আসেন রাজনৈতিক জীবনে। নিজেকে যুক্ত করেন সিপিআইএমএল (লিবারেশন)-এর সঙ্গে । তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাননি, সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-জড়তা ঝেড়ে ফেলে সক্রিয় হলেন সংগ্রাম ও সংগঠন গড়ে তোলার কাজে। চুক্তিবদ্ধ কর্মচারীদের ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে জেনারেল ইন্সিওরেন্স কোম্পানিতে ঐতিহাসিক আন্দোলন গড়ে তোলা, শেষপর্যন্ত কর্তৃপক্ষকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করা – কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারিদের মধ্যে পার্টির গণভিত বাড়াতে সাহায্য করেছিল।

সংগ্রামী বামপন্থী রাজনীতির লোক হলেও পাড়ায়, এলাকায় রবি মুখোপাধ্যায়ের একটা সামাজিক পরিচিতি ছিল। নাগরিক আন্দোলন, জলাশয় বাঁচানোর আন্দোলন, সমবায় আন্দোলন, ক্লাব সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আন্তরিক উদ্যোগ নিতেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে অবাধে মিশে যেতে পারতেন। ব্যবহারে বিনয়ী, রসিক, মিশুকে, আড্ডাবাজ কিন্তু রাজনৈতিক অবস্থানে অবিচল রবিদা ছিলেন আমাদের আজীবন পার্টি সদস্য। শেষ জীবনে বার্ধক্যজনিত দূরারোগ্য ব্যাধির যন্ত্রণা ভুলতেন আতসকাঁচ দিয়ে দেশব্রতী পড়ে। খুব কাছ থেকে একাধিকবার কমরেড চারু মজুমদার, কমরেড সরোজ দত্তদের সান্নিধ্য পাওয়া প্রজন্মের একজন ছিলেন রবিদা।

বড় দুর্দিনে চলে গেলেন। রেখে গেলেন পরিবার-পরিজন, বৃহত্তর পরিবার-সম প্রিয় পার্টি আর লাল টুকটুকে স্বপ্ন।

কমরেড রবি মুখোপাধ্যায় লাল সেলাম।

===

খণ্ড-29
সংখ্যা-30