বাবরি মসজিদ ধ্বংসের তিরিশ বছর : ভারতের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের ওপর সংঘ বাহিনীর আক্রমণের ক্রমবিস্তার
War on India’s Diverse Culture and Secular Democracy

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর তিন দশক পূরণ হবে ২০২২’র ৬ ডিসেম্বর। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরপরই ১৯৪৯ সালের ২২-২৩ ডিসেম্বর রাতে মসজিদের ভেতর চুপিসারে রামলালার মূর্তি বসানোর মাধ্যমে যে টাইম বোমা স্থাপিত হয়েছিল, সেটাই ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের শেষ বেলায় প্রকাশ্য দিবালোকে বিস্ফারিত হল যখন উপস্থিত বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দের উৎসাহদানের প্রক্রিয়ায় এক দাঙ্গাবাজ জনতা মসজিদটাকে ধূলিসাৎ করল। আজকের ভারতে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের উত্থানের অনুসন্ধানে ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদরা কখনও নির্দিষ্ট কোনো মুহূর্তকে চিহ্নিত করতে আগ্রহী হলে সেই মুহূর্তটা তর্কাতীতভাবেই হবে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদের ধ্বংস। সেই ধ্বংসের পর থেকে ভারতে অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে। এক একটা দিন যাচ্ছে আর আমরা আরও সঠিক ভাবে বুঝতে পারছি যে, সংঘ-বিজেপি গোষ্ঠীর অযোধ্যা অভিযান ষোড়শ শতকের একটা মসজিদের ধ্বংস অথবা রামের পৌরাণিক জন্মভূমি বলে বিশ্বাস করা স্থানে চমকপ্রদ মন্দির নির্মাণের কোনো ব্যাপার ছিল না; সেটা ছিল ভারতের আসল ধারণাকে এবং ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক কাঠামোকে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দেওয়ার উদ্যোগ।

মসজিদ ধ্বংসের আগে এবং এমনকি পরেও আধিপত্যকারী ধারণাটা ছিল আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অযোধ্যা বিবাদের একটা সমাধান খুঁজে বার করা অথবা বিচার বিভাগের রায়কে মেনে নেওয়া। বিজেপি এরপর এই যুক্তিতে আদালতের রায়ের ধারণাকে মানতে অস্বীকার করল যে, ‘বিশ্বাসের’ বিষয়কে আইনি এক্তিয়ারের অধীন করা যাবে না। এটা অতএব বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয় যে, ধ্বংসের কর্মকাণ্ডটা এই প্রেক্ষিত থেকেই চালিত হয়েছিল, সেটা ছিল বিবাদের প্রেক্ষাপটটাকেই পাল্টে দেওয়ার পরিকল্পিত চক্রান্তমূলক কাজ। এর সিকি শতকেরও কিছু বেশি সময়ের পর বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় সুপ্রতিষ্ঠিত থাকার সময় সুপ্রিম কোর্ট কার্যত ধ্বংস-পরবর্তী পটভূমিকেই মান্যতা দিল, এবং সেটা তারা করল ধ্বংসের কাজটাকে আইনের শোচনীয় লঙ্ঘন বলে অভিহিত করার পরও যারা মসজিদটাকে ধূলিসাৎ করেছিল তাদের হাতেই ‘বিতর্কিত জমির’ মালিকানা তুলে দিয়ে। ধ্বংসকারীরা যা চেয়েছিল তারা তা পেল, আর ন্যায়বিচারের প্রত্যাশীরা পেল মসজিদ নির্মাণের জন্য পাঁচ একর বিকল্প জমির ‘ক্ষতিপূরণসুলভ’ প্রস্তাব। এর প্রায় তিনবছর পর সুপ্রিম কোর্ট এই ঘোষণা করে ধ্বংসকাণ্ড থেকে জারি হওয়া সমস্ত মামলাকে সমাপ্ত করে দিল যে, ঐ ইস্যুটার আর কোনও অস্তিত্বই নেই!

বিচার বিভাগের বাইরে নাগরিক সমাজের অনেক ব্যক্তিও এই আশা পোষণ করেছিলেন যে, বিতর্কিত জমি মন্দির নির্মাণের জন্য দিয়ে দিলে তা বিবাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ নিষ্পত্তি ঘটাবে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পুনর্মিলনের পথ প্রশস্ত করবে। সংসদ ১৯৯১ সালে যে আইন পাশ করেছিল তার থেকে বিশেষভাবে বাদ রাখা হয়েছিল অযোধ্যাকে, আর অন্য সমস্ত উপাসনা স্থলের যে চরিত্র স্বাধীনতার সময় ছিল তাকে অপরিবর্তিত রাখার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। সংঘ বাহিনী অবশ্য তাদের ভবিষ্যৎ মতলবকে গোপন করার কোনও চেষ্টা করল না — আর মাত্র দুটো স্থানের উল্লেখ করলে বলতে হয়, অযোধ্যার ছাঁচে ফেলার জন্য তাদের কাছে অপেক্ষা করছিল কাশী ও মথুরা। ২০২৪’র লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে রাম মন্দির উদ্বোধনের পরিস্থিতি নির্দিষ্ট হয়ে থাকার পাশাপাশি আমরা কাশী ও মথুরা নিয়ে লড়াইকে তীব্রতর করে তোলার উদ্যোগও দেখতে পাচ্ছি। অযোধ্যার ছাঁচ অনুসরণ করে সংঘ আদালতে মামলা ঠোকার সাথে বাস্তব ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সমাবেশকে সংযুক্ত করে আবারও এক দ্বিমুখী কৌশলের প্রয়োগ ঘটাচ্ছ।

মসজিদগুলোকে মন্দিরে পরিণত করার অভিপ্রায়ে সেগুলোর ওপর আরও আক্রমণ নামানোকে সক্ষম করতে আইনি পরিসর তৈরির লক্ষ্যে বিজেপি ১৯৯১ সালের উপাসনা স্থল আইনের আইনসিদ্ধতাকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে মোদী সরকারের জবাব জানতে চাওয়ায় এই আইনের ভবিষ্যত কী হতে যাচ্ছে — যে আইনটাকে সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যা রায় দিতে গিয়েও সমর্থন জানিয়েছিল — তা এখন কেউই বলতে পারবেন না। উত্তরপ্রদেশে কাশী ও মথুরার মতো সংঘবাহিনী মহিশুরের কাছে শ্রীরঙ্গপতনার জামিয়া মসজিদকেও নিশানা বানিয়েছে যেটা ছিল ১৭৯৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে টিপু সুলতানের যুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থল। মুসলিম শাসকদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মোগল ও মোগল-পরবর্তী যুগের সুপরিচিত কয়েকটি স্মৃতিসৌধকেও — যেগুলোর মধ্যে বিশ্বখ্যাত হেরিটেজ কেন্দ্র তাজমহল ও কুতবমিনারও রয়েছে — সংঘবাহিনী নিশানা বানাচ্ছে ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে এবং সারা ভারতকে গেরুয়া রঙে রাঙাতে।

অযোধ্যা বিতর্কের গোটা পথটা আমাদের এই সুস্পষ্ট শিক্ষা দিয়েছে যে সংঘবাহিনীর চালিয়ে যাওয়া সাংস্কৃতিক আগ্ৰাসনের সঙ্গে কোনও বোঝাপড়া হতে পারে না। বিজেপি আমাদের রামায়ণ ও মহাভারতের পৌরাণিক অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তারা ভারতের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ওপর বুলডোজার চালিয়ে তাকে আরএসএস লালিত গেরুয়া রঙে ছোপানো সমরূপী বস্তুতে পরিণত করতে চায়। ইতিহাস ও স্থাপত্যশৈলী থেকে দৈনন্দিন সংস্কৃতি ও রন্ধনবিদ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত ক্ষেত্র থেকে সমস্ত ইসলামিক চিহ্নকেই মুছে দেওয়াটাই তাদের অভিপ্রায়। আরএসএস’এর প্রচার করা তথাকথিত সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ আরএসএস ধারার হিন্দুত্ব বা হিন্দু আধিপত্য চাপিয়ে দেওয়া ভিন্ন অন্য কিছু নয়, যে আধিপত্য আবার মুসলিম সম্পর্কিত সমস্ত কিছুকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেওয়ার মধ্যেই থেমে থাকবে না; মনুস্মৃতিতে ব্যক্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী ও পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চাপিয়ে দিতে সম্যক প্রচেষ্টা তা চালাবে, যে মনুস্মৃতিকে আরএসএস ভারতের আদি ও অকৃত্রিম সংবিধান রূপে তুলে ধরেছিল। মনুস্মৃতি-অনুপ্রাণিত সমরূপতা আনার আরএসএস’এর প্রচেষ্টা ভারতের বৈচিত্র্যের ওপর এবং হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের মনগড়া গণ্ডিবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে বহু বিচিত্র চিত্রের মহাদেশীয় মাত্রার যে সমাহার হল ভারতবর্ষ তার ওপর চালানো এক সার্বিক যুদ্ধ। ২০২২’র ৬ ডিসেম্বর আবার বাবাসাহেব আম্বেদকরের মৃত্যুর ৬৬তম বার্ষিকী পূর্ণ হবে, যিনি ছিলেন ভারতীয় সংবিধান রচনার জন্য নির্ধারিত কমিটির চেয়ারম্যান এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম আইন ও বিচার মন্ত্রী। ভবিষ্যতকে দেখতে পাওয়ার দূরদৃষ্টি নিয়ে তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, “হিন্দুরাজ বাস্তব ঘটনা হয়ে উঠলে তা, সন্দেহাতীতভাবেই, এই দেশের কাছে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হয়ে দেখা দেবে।” তাঁর মৃত্যুর দু’মাস আগে আম্বেদকর হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে পাঁচ লক্ষ অনুগামীকে সঙ্গে নিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্ৰহণ করেন। আর সেটা তিনি করেছিলেন আরএসএস’এর সদর দফতর নাগপুরে অশোকা বিজয়াদশমীর দিন, যেদিন মহান অশোক যুদ্ধ ও হিংসাকে পরিত্যাগ করে শান্তি ও সমতার স্থাপনে বৌদ্ধ ধর্মকে গ্ৰহণ করেন, আর সেদিনটাকেই আরএসএস তাদের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে বেছে নেয় এবং অস্ত্র ও হিংসার আরাধনার মধ্যে দিয়ে উদযাপন করে। বিজেপি আজ নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ধর্ম অনুসরণের সংবিধান প্রদত্ত অধিকারটাকেই খর্ব করতে চাইছে। যে বিপর্যয় সম্পর্কে আম্বেদকর আমাদের সতর্ক করেছিলেন সেটাই আজ প্রকট হয়ে উঠেছে; আর চ্যালেঞ্জটা তাই হল এই বিপর্যয় সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি থেকে ভারতকে মুক্ত করা এবং সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে তুলে হিন্দুত্বর বুলডোজারকে প্রতিহত করা।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২২ নভেম্বর ২০২২)

খণ্ড-29
সংখ্যা-46