২০২২’র সংবিধান দিবস : সংবিধানকে ওলটপালট করে দেওয়ার সংঘ-বিজেপি’র অভিযানকে পরাস্ত করুন
Constitution day 2022

সংবিধানের স্পিরিট ও মূল্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ কতটা জরুরি ও বিশাল মাত্রার হয়ে উঠেছে, ২০২২’র সংবিধান দিবস তাকে আরও একবার সামনে নিয়ে এল। দুটো ভরসা-জাগানো নিদর্শন আমরা দেখলাম। যার একটাতে জেলে প্রায় এক হাজার দিন কাটানোর পর অধ্যাপক আনন্দ তেলতুম্বডে তাঁর জামিন লাভের নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ জারির এনআইএ’র প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে জেল থেকে জামিনে মুক্তি লাভ করলেন। আর দ্বিতীয় ঘটনায় আমরা কৃষিকে রক্ষা এবং তাদের উৎপাদিত সমস্ত শস্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির অধিকার রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কৃষকদের সারা দেশে আন্দোলনে শামিল হতে দেখলাম। ‘আমরা ভারতের জনগণ’ — ন্যায় ও গণতন্ত্র লাভের লক্ষ্যে এই আত্মঘোষণাই হল আধুনিক ভারতের প্রকৃত সাংবিধানিক স্পিরিট।

তবে, জনগণ গণতন্ত্র রক্ষায় আত্মঘোষণা করলেও সংবিধান বর্তমানের সরকার ও সংঘ বাহিনীর হাতে লাগাতার আক্রমণের মুখে পড়ছে। সংবিধান-ভিত্তিক শাসনের কেন্দ্রে থাকা প্রশাসন বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা ও কার্যধারার বিভাজনের নীতিকে এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোর সততাকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে এক উন্মত্ত স্বেচ্ছাচারী প্রশাসনিক বিভাগ, এবং তা করছে সংবিধানের বিপর্যয় ঘটাতে ও বিরোধিতা-মুক্ত একদলীয় শাসন চাপিয়ে দিতে।

সুপ্রিম কোর্ট তাদের সাম্প্রতিক কিছু পর্যবেক্ষণে প্রশাসনের লাগামহীন স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছে। কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক আলাপ আলোচনা বা সংসদীয় অনুমোদন ছাড়াই যে বিমুদ্রাকরণ করা হয়েছিল, তার ছ’বছর পর সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে সে সম্পর্কে চলা শুনানিতে সরকারের পাশকাটানো জবাব সুস্পষ্টরূপে দেখিয়ে দিচ্ছে যে বিচার বিভাগীয় কোনো অনুসন্ধিৎসায় তারা কতটা শঙ্কিত। তথাকথিত দুর্বল অংশের কোটা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের খণ্ডিত রায়ে সংখ্যালঘু অভিমত ঐ কোটাকে সংবিধানের স্পিরিটের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন রূপে অভিহিত করেছে।

সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে চলা শুনানিতে নির্বাচন কমিশনকে পথভ্রষ্ট করা ও তার প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতার অবনতি ঘটানোর সরকারের অভিপ্রায় উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। এই বিষয় নিয়ে আবেদনের শুনানি যখন চলছিল, সরকার সে সময়ই চূড়ান্ত ধৃষ্টতা দেখিয়ে বিতর্কিত পদক্ষেপে এক নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ করে। সরকার ভোটাধিকারের সাংবিধানিক মর্যাদা নিয়েও সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে বিতর্ক বাধায়; সরকার বলে যে এটা আইন বলে বিধিবদ্ধ অধিকার, আর সুপ্রিম কোর্ট এর প্রত্যুত্তরে সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলে যে, অনধিকারের মাপকাঠিকে সম্প্রসারিত করে জনগণকে ভোটদান থেকে বিরত করতে তারা পারে না। ভোটাধিকারকে সাংবিধানিক অধিকারের বদলে আইনি অধিকার রূপে গণ্য করার এই প্রয়াস নাগরিকদের কোনো অংশকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রস্তাবনা কিনা, তা অবশ্য কেউ নির্দষ্ট ভাবে বলতে পারবেন না।

বম্বে হাইকোর্ট পণ্ডিত ব্যক্তি ও লেখক আনন্দ তেলতুম্বডের জামিন মঞ্জুর করলে তার বিরুদ্ধে এনআইএ’র আবেদন জানানোটা মোদী সরকারের মানবাধিকারের চরম অবমাননারই আর একটা নিদর্শন হয়ে দেখা দিচ্ছে। চাইলেই বিরোধী মতের ধারক যেকোনো ব্যক্তিকে মামলায় জড়িয়ে জেলে পুরতে এনআইএ ও ইউএপিএ মোদী সরকারের হাতে এক সুবিধাজনক জুড়ি হয়ে উঠেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে এক ভিডিও বৈঠকে মোদী সম্প্রতি ‘কলম-চালিত নকশালদের’ বিরুদ্ধে যে মন্তব্য করেছেন তাতে আরও অনেক বিরোধী মতের নাগরিকদের গ্ৰেপ্তারির ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। আদালত যেখানে বিবেক সম্পন্ন বন্দিদের বেকসুর খালাস দিচ্ছে বা তাদের জামিন মঞ্জুর করছে, সংঘ বাহিনী ও মোদী সরকার তখন বিবেকবান বন্দিদের মুক্তির দাবি জানানোয় ন্যায়বিচার-প্রয়াসীদেরও মামলায় জড়িত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রসঙ্গত, সুপ্রিম কোর্ট আয়োজিত সংবিধান দিবসের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদি মুর্মু তাঁর বক্তব্যের শেষে স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্যে ভারতীয় জেলগুলোর গাদাগাদি অবস্থা ও সেখানে বন্দিদের দশার দিকে বিচার বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, যে বন্দিরা বিশেষভাবে এসছে প্রতিকূল সামাজিক পৃষ্ঠভূমি থেকে এবং বছরের পর বছর জেলে পচছে।

প্রণালীবদ্ধ ভাবে সংবিধানের স্পিরিট ও বীক্ষার ক্ষয় ঘটানোয় সংবিধানের ওপর আক্রমনই আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আমরা কখনই বিস্মৃত হতে পারি না যে, আরএসএস শুধু যে স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনো অবদান রাখেনি তাই নয়, স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে উদ্ভূত সংবিধান ও তেরঙা জাতীয় পতাকাকেও তারা অনুমোদন করেনি, বিপরীতে তারা মনুস্মৃতিকেই ভারতের সংবিধান এবং গেরুয়া ঝান্ডাকে জাতীয় পতাকা করার পক্ষে খোলাখুলি মত পোষণ করেছিল। বিজেপি এখন ক্ষমতায় থাকায় তারা নিজেদের স্বাধীনতা আন্দোলন, সংবিধান ও জাতীয় পতাকার চ্যাম্পিয়ন রূপে জাহির করতে চায়, তবে সেটা শুধু স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের এবং সংবিধানের স্পিরিট ও বীক্ষার নিরন্তর বিকৃতি সাধনের মধ্যে দিয়েই। অধিকারের চেয়ে কর্তব্যের ওপর অগ্ৰাধিকার প্রদান করে মোদী সংবিধানের ভোল পাল্টানোর এই প্রয়াসে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সংবিধান দিবসে তাঁর বক্তৃতায় মোদী আগামী পঁচিশ বছরকে কর্তব্যকাল বা কর্তব্যের যুগ রূপে ব্যাখ্যা করতে সক্রিয় হন।

মোদী ভারতকে গণতন্ত্রের জননী বলে অভিহিত করেছেন; তাঁর এই নবাবিষ্কৃত বুলির অনুসরণে সরকার এখন ইতিহাস গবেষণার ভারতীয় কাউন্সিলের প্রকাশ করা একটা ধারণাগত নোটকে কেন্দ্র করে এক সুসমন্বিত প্রচার নামিয়েছে যে নোটে ভারতের সংবিধানকে ‘হিন্দু রাজনৈতিক তত্ত্বের’, ‘২০০০ বছরের নানান বিজাতীয় সংস্কৃতি ও জাতিগোষ্ঠীর আগ্ৰাসনের মুখে হিন্দু সংস্কৃতি ও সভ্যতার’ ফসল বলে গণ্য করা হয়েছে। ভারতীয় সংবিধান যে উপনিবেশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন এবং প্রতিষ্ঠানিক জাতিগত স্তরবিন্যাস ও লিঙ্গগত অবিচারকে ছিন্ন করে সামাজিক ন্যায় ও সমতার অন্বেষণ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল, এই নোট, উদ্ভবের সেই প্রকৃত প্রক্রিয়া ও পরিপ্রেক্ষিতটাকেই ধৃষ্টতার সঙ্গে নাকচ করে। এটা আম্বেদকরের সংবিধানকে ওলটপালট করে দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়। মোদী সরকারের হাতে খেলার বস্তুতে পর্যবসিত হওয়া থেকে সংবিধানকে রক্ষা করতে হবে।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৯ নভেম্বর ২০২২)

খণ্ড-29
সংখ্যা-46