শ্রদ্ধা ওয়াকারের হত্যা : বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, মেয়েদের উপর বাড়তে থাকা হিংসার প্রতিফলন
Murder of Shraddha Walker

“প্রতি ৩ জনের মধ্যে একজন ভারতীয় মেয়ে অন্তরঙ্গ সঙ্গীর দ্বারা হিংসার শিকার।” (এনএফএইচএস-৫ সমীক্ষা)

“এই মেয়েদের মধ্যে মাত্র ১৪ শতাংশ তাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্কের হিংসা থেকে বেরোনোর জন্য সাহায্য চেয়ে উঠতে পারেন।” (এনএফএইচএস-৪ সমীক্ষা)

“মহিলাদের বিরুদ্ধে হিংসার ৩,৫৭,৬৭১টি অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে ২০২১ সালে। এরমধ্যে ১,৩৭,৯৫৬টি ঘটনার অভিযুক্ত মহিলার বিবাহিত সঙ্গী বা আত্মীয়।” (এনসিআরবি ২০২১)

“২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে মেয়েদের উপর হওয়া হিংসার ৫০ শতাংশের বেশি ঘটনায় অপরাধী নিগৃহীতার অন্তরঙ্গ সঙ্গী বা পরিবারের সদস্য।” (ইউএন সমীক্ষা)

সম্প্রতি শ্রদ্ধা ওয়াকার নামের এক ২৬ বছরের দিল্লী নিবাসী তরুণীকে হত্যা করে তার মৃতদেহকে কেটে কেটে ছড়িয়ে দিয়েছে শ্রদ্ধার অন্তরঙ্গ সঙ্গী আফতাব পুনাওয়ালা। এই ঘটনার নৃশংসতার চর্চা অলিগলি, গৃহকোণে ও ফোনের পর্দায় চলেছে। সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে ঘটনার বীভৎসতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণের সাথে পরিচিত কমবেশি সকলেই। শ্রদ্ধার ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে ঘটনার তদন্ত দ্রুত শেষ করা ও অপরাধীর কঠোরতম শাস্তি সুনিশ্চিত করা আশু প্রয়োজন। কিন্তু, শ্রদ্ধার ন্যায়বিচারের জন্য এটুকু যথেষ্ট নয়। আমাদের দেশে লাখো মেয়ে শ্রদ্ধার মতই অন্তরঙ্গ সাথী, পরিবার, পরিজনের দ্বারা হিংসার শিকার (এনসিআরবি ২০২১ তথ্যানুযায়ী)। ভারতে মেয়েদের উপর ঘটা হিংসার মোট ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষেত্রে অপরাধী নিপীড়িতার নিকটতম আত্মীয়, আর অপরাধের ঘটনাস্থল নিভৃত গৃহকোণ। প্রসঙ্গত, এই নভেম্বর মাসের ২১ তারিখ, উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে প্রিন্স যাদব নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে খুন করে, শরীর কুপিয়ে ফেলার অপরাধে। নভেম্বরের ১২ তারিখ, উত্তরপ্রদেশ নিবাসী, কুলদীপ সিং যাদব তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। দিল্লীতে, ৩৫ বছরের এক যুবক, তার ‘স্ত্রী’র সাথে মতবিরোধ হওয়ার কারণে, মহিলাকে গলা টিপে খুন করেছে। শ্রদ্ধার ঘটনাকে একটি বিরল, বিচ্ছিন্ন হিংসার মুহূর্ত হিসাবে না দেখে প্রয়োজন এই হিংসার সামগ্রিক বাস্তবতাকে বোঝা ও প্রতিহত করার রাস্তা খোঁজা।

অন্তরঙ্গ সম্পর্কে চুড়ান্ত হিংসা একদিনে ঘটেনা, বরং জীবনের রোজনামচায় মিশে থাকে হিংসাগুলি। ২০২০ সালে মুম্বইতে থাকাকালীন শ্রদ্ধা তার প্রতিবেশীর সাথে আফতাবের বিরুদ্ধে স্থানীয় তিলুঞ্জ থানায় অভিযোগ জানাতে গেছিলেন। দীর্ঘ ৬ মাস তার প্রেমিকের হাতে মার খাওয়ার পর শ্রদ্ধা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আফতাবের হাতে প্রাণ হারানোর আশংকার উল্লেখও ছিল তার অভিযোগপত্রে। কিছুদিন পর তিনি অভিযোগ তুলে নেন, থানায় লিখিত জমা দেন, “আমাদের মধ্যে আর কোনো ঝগড়া নেই”। এরপরেও শরীরে গুরুতর আঘাত নিয়ে শ্রদ্ধা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশের কাছে আর কোনো অভিযোগ জমা পরেনি। শ্রদ্ধা ফিরে গিয়েছিলেন তার প্রেমিকের কাছে। অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসার শিকার মানুষদের বারবার তাদের নিগ্রহকারীদের কাছে ফিরে যেতে দেখা যায়। অনেক সময় আইনের দারস্থ হওয়ার বদলে চুপ থাকার পন্থা বেছে নেন ভুক্তভুগীরা। এই ধরনের হিংসাকে প্রতিহত করার রাস্তা বড়োই জটিল, কারণ এক্ষেত্রে যে গায়ে হাত তোলে, সেই আদর করে, যে হুমকি দেয়, সে ক্ষমাও চায়, যে লাথি মারে, সে কাছেও ডাকে। বাংলায় একটা প্রচলিত প্রবাদ আছে, “শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে।” এটি অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসার সারকথা। সোহাগকে ঢাল করে, যার উপর হিংসা হয় তাকেই অপরাধবোধে ভোগানো হয়। শাসন ও ভালোবাসা শব্দ দুটি পরস্পর বিরোধী কিন্তু তার সহাবস্থানকেই স্বাভাবিক বলে চিনতে শিখি আমরা। পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সামাজিক বৈষম্যে ভর দিয়ে ভালোবাসার আঙিনায় বাসা বেঁধে থাকে হিংসা। ভালোবাসার থেকে হিংসাকে আলাদা করতে গিয়ে বারবার নিগৃহীতারা হোঁচট খায়, গুমড়ে মরে, সন্দেহ করে নিজের অভিজ্ঞতাকেই, জড়াতে থাকে হিংসার আবর্তে। সেই কারণে, পারিবারিক ও অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসার বিভিন্ন ঘটনাকে যুগলের মধ্যে প্রেমের ঝগড়া, পারিবারিক কোন্দলের নাম দেওয়া হয়। অনেক সময়, বিবাহিত মেয়েরা হিংসার সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইলেও, তাদের পরিবার মানিয়ে নিতে বলে, কারণ ডিভোর্সী মেয়েদের সমাজ ‘ভালো’ চোখে দেখে না। আবার প্রগতিশীল সমাজে, নিগৃহীতা হিংসার সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে তাকে দুর্বল, নির্ভরশীল ইত্যাদি তকমা দেওয়া হয়। এই পন্থায় নিগৃহীতা আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার বদলে হীনমন্যতায় ভোগেন। অনেকসময়, এই হীনমন্যতাবোধ থেকে বা অন্যের মতামতে আহত হওয়ার শঙ্কায়, নিগৃহীতা হিংসার ঘটনাগুলি লোকাতে থাকে।

এনএফএইচএস-৫ সমীক্ষায় অংশ নেওয়া মহিলাদের মধ্যে ৩০ শতাংশ বলেছেন, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে, যেমন, রান্নায় ভুল করলে, স্বামীর চাহিদামত যৌন পরিষেবা দিতে না পারলে, বাচ্চা ও পরিবারের যত্নে ত্রুটি হলে, মার খাওয়া স্বাভাবিক। তাই মার খেতে খেতে মরে গেলেও দোষ বর্তায় মৃত মেয়েটির আচরণের উপর। যেমন, শ্রদ্ধার হত্যার ঘটনার বিষয় মন্তব্য করতে গিয়ে, কৌশল কিশোর (আবাসন ও নগর বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী), অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসার দায় চাপিয়ে দেন সেই মেয়েদের উপর যারা বিয়ের বদলে ‘লিভ ইন’ সম্পর্ক বেছে নেন। সামাজিক মাধ্যমে শ্রদ্ধার হত্যার প্রসঙ্গে একের পর এক টুইট, পোস্ট, কমেন্টে তুলোধনা চলে শ্রদ্ধার চরিত্রের, কারণ তিনি ‘অন্য’ ধর্মের পুরুষের সাথে প্রেম করেছিলেন।

অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসা রুখতে করণীয়

১) অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসা, গৃহহিংসার ঘটনা‍কে আড়াল না করে, আপনার স্বজন পরিসরে হিংসার পরিস্থিতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন, অবমাননাকর সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে নিগৃহীতাকে উৎসাহ দিন, পাশে থাকুন, যাতে প্রাণহানির আগে হিংসাকে থামানো সম্ভব হয়।

মনে রাখুন, অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসা/গৃহহিংসার ভুক্তভুগীরা অনেক সময় পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে যেতে চাননা। নিগ্রহকারীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে অনেক ভুক্তভুগীর দীর্ঘ সময় লাগে। এক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি, নিগৃহীতার উপর নিজের মতামত না চাপিয়ে, তার কথা শোনা, যোগাযোগে থাকা, তার সিদ্ধান্তকে সম্মান করা। এভাবে, নিগৃহীতা আপনাকে বিশ্বাস করে নিজের উপর হওয়া হিংসার বিষয় অবগত করবে৷ যে তথ্যের সাহায্যে, চুড়ান্ত হিংসা বা প্রাণহানি আটকানো যেতে পারে।

২) গৃহহিংসা ও অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসার নিগৃহীতাদের স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে, সরকারের হস্তক্ষেপ (যেমন সরকারী আশ্রয় কেন্দ্র, পরিষেবা) দাবি করুন।

এই মুহূর্তে, গৃহহিংসার নিপীড়ীতাদের জন্য সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাদের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ও হেল্পলাইনগুলি টাকার অভাবে ধুঁকছে। গৃহহিংসা বিরোধী আইনের আওতায় নিয়োজিত গৃহহিংসা প্রতিরোধ বিষয়ক অফিসারের কাঁধে অনেক কেস সামলানোর দায়িত্ব, অথচ তাদের জরুরি প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো প্রদান করার প্রচেষ্টা নেই সরকারের তরফ থেকে। উপরন্তু, সরকারী আশ্রয় কেন্দ্রগুলির পরিবেশ জেলের মত, যেখানে নিপীড়িতাদের সুরক্ষিত বোধ করানো, বা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে সাহায্য করার বদলে বন্দী ও অপরাধীদের মতন আচরণ করা হয়।

৩) আন্ত-জাতি, আন্ত-ধর্মীয়, লিভ ইন সম্পর্কে থাকা মহিলাদের বিচ্ছিন্ন করবেন না। এই ধরণের সম্পর্কে হিংসার শিকার হওয়া মেয়েদের জন্য সাহায্য চাওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাজ ও পরিবারের কাছে এরা একঘরে হয়ে যান। এমনকি, পরিবারের রক্ষণশীল আচরণের কারণে অনেক মেয়েরা বিপদের কথা বলতে কুন্ঠা বোধ করেন, পরিবারের থেকে কলঙ্ক, আঘাত পাওয়ার ভয়।

৪) অন্তরঙ্গ সম্পর্কে হিংসা বিষয়টি নিয়ে জ্ঞাত হন, নিজ পরিসরে চর্চা করুন, সচেতনতা বাড়ান — কারণ এই মুহুর্তে বিশ্বজুড়ে মেয়েদের উপর সবচেয়ে বেশী হিংসা স্বজন, পরিজনের দ্বারা ঘটছে।

৫) ‘লাভজিহাদ’এর মতো সাম্প্রদায়িক প্রচারকে রুখে দিন, যা মেয়েদের উপর পারিবারিক ও সামাজিক হিংসার রাস্তা মজবুত করে।

সম্প্রতি আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা, গুজরাত নির্বাচনের প্রচারে, শ্রদ্ধা ওয়াকারের হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে, লাভ জিহাদ বিরোধী আইন, অর্থাৎ, আন্ত-ধর্মীয় বিয়ে রুখতে আইন প্রণয়নের পক্ষে সওয়াল করেছেন। শ্রদ্ধার হত্যার ঘটনা চাউড় হওয়ার পর থেকেই ঘটনায় অভিযুক্তের ধর্ম-পরিচয়কে তুলে ধরে নিজেদের বিদ্বেষ ছড়ানোর কর্মসূচীতে হাওয়া দিচ্ছে হিন্দুত্ববাদী ব্রিগেড। ‘লাভ জিহাদ’ অর্থাৎ আন্ত-ধর্মীয়, আন্ত-জাতি বিবাহের অপরাধীকরণের ডাক দিয়ে, বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় ইউটিউব ভিডিও আপ্লোড করা হয়েছে। শুধুমাত্র একটি ঘটনাকে, ধর্মীয় পরিচয়ের নিরিখে বাছাই করে, তুলে ধরে আসলে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ও গৃহহিংসা জনিত ঘটনার আধিক্য, লাখো নিগৃহীতা ও সমাজের উপর এই ধরনের হিংসার প্রভাবকে আড়াল করার চেষ্টা চলছে। লাভ জিহাদের প্রচার আসলে মেয়েদের স্বনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষাকে দুরমুশ করে সেই পিতৃতান্ত্রিক, মনুবাদী মানসিকতার হাত শক্ত করছে, যে মানসিকতা গৃহহিংসাকে টিকিয়ে রাখে।

পরিশেষে বলি, অন্তরঙ্গ হিংসা রোখা এবং সরকার ও আইন আদালতকে দায়বদ্ধ করার দায়িত্ব শুধুমাত্র নারী আন্দোলনের কর্মী বা নারীবাদীদের নয়, গণআন্দোলনের কর্মী, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, সচেতন নাগরিক — প্রত্যেকের এই কর্মকান্ডে ভূমিকা নেওয়া আবশ্যক ও প্রয়োজনীয়। আসুন, অন্তরঙ্গ হিংসা রুখতে সক্রিয় হই আমরা কারণ, এই হিংসা যতটা ব্যাক্তিগত, ততটাই সামাজিক।

ঋণ স্বীকার :
১) কবিতা কৃষ্ণান, নারীবাদী রাজনৈতিক কর্মী, ফেসবুক পোস্ট
২) দ্য কুইন্ট, ইন্সটাগ্রাম পেজ
৩) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৯ নভেম্বর ২০২২, সম্পাদকীয়

খণ্ড-29
সংখ্যা-46