প্রতিবেদন
প্রান্তিক জীবনের চেতনায় ঘা পড়ছে!
marginal life is falling

শ্রমজীবী মানুষের এক উটকো বস্তি। বৃহত্তর কলকাতার উপকণ্ঠে এক মুমূর্ষু শিল্পাঞ্চলের এক প্রান্তে। প্রায়ই টানা হ্যাঁচড়া চলে। সরকারি জমি। কোনও প্রজেক্টের জন্যে নির্দিষ্ট। সেইখানে পেটের তাগিদে গ্রাম-ছাড়া মানুষেরা মাথা গোঁজার আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে।

আগে তো অনেক বড় বসতি ছিল। মস্ত দিঘিতে মাছ ধরে, বিশাল জমিতে চাষবাস করে ছানা-পোনা নিয়ে ভালোই কাটছিল গা ঘেঁষাঘেঁষি বেশ কয়েক ঘর হিন্দু মুসলমান পরিবারের। ক্রমশ টনক নড়ে সরকারি বাবুদের। তারও আগে শাসকের পোষা বাহুবলীদের। এরপর উঠে যাওয়ার জন্যে মিহি-মোটা হুমকি, বারে বারে। তারপর একদিন সত্যিই বিরাট পুলিশবাহিনী, লোক-লস্কর নিয়ে সরকারি বাবুরা এসে জমি জরীপ করে ঘিরে দিয়ে গেল। খানিকটা ছাড় থাকল, উঠে যাওয়ার ফরমানও থাকল। জমি ভরাট করতে মিউনিসিপ্যালিটির ময়লা ফেলার লরি ঢুকতে লাগল। মরা কুকুর বেড়াল পর্যন্ত ফেলে যেতে লাগল। দুর্গন্ধে নাড়ি উল্টে আসে। চান করার পুকুরটার জল দূষিত হয়ে গেল। চুলকানি খোস পাঁচুড়া হতে লাগল। পুরো নরক! বিশেষ করে বর্ষাকালে। যাদের উপায় আছে, অন্য জায়গায় চলে গেল। হতদরিদ্র ক'টি মুসলিম পরিবার এক কোণে গাঁদি মেরে কোনোক্রমে পড়ে আছে। নাছোড় বান্দা পেটের টানে। ক্ষীণ আশাও আছে, সরকার যদি পুনর্বাসনের কোন ব্যবস্থা করে।

বস্তিটাকে পরিচারিকা পল্লী বললে খারাপ শোনায়, কিন্তু কার্যত মহিলারাই সেখানে সবচেয়ে গতিশীল, সক্রিয় অংশ। ঐ মহল্লায় খুব স্বাভাবিকভাবেই পুর তদারকিতে কোনো পানীয় জল সরবরাহ, নিকাশি ব্যবস্থা, আবর্জনা নিষ্কাশন বা শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। এই অত্যাবশ্যক পুর পরিষেবা না থাকার অসুবিধা আর কষ্ট মেয়েদেরই বেশি পোয়াতে হয়, বলাই বাহুল্য। উদয়াস্ত পরের বাড়ি খাটার ফাঁকে ফাঁকেই তাদের নিজেদের বেআব্রু শ্রীহীন গৃহস্থালিটাকেও গতিশীল রাখতে হয়। তারা বড় রাস্তা পেরিয়ে জল আনে, কাঠ কাটে, শেষ বাজারে ভ্যান থেকে সবজি, কখনও সখনও মাছ কেনে, চুলো ধরিয়ে রান্না করে। বাচ্চার নড়া ধরে টানতে টানতে ইশকুলে দিয়ে আসে। প্রাইভেট টিউটর খোঁজে, 'গার্জেন কল' হলে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে। কাজের বাড়ির টিভি-র খবরে কান রাখে। সরকারি প্রকল্পের খবর নেয়। কাগজপত্র যোগাড় করে, পুরুষ দের তাগাদা দেয়। মাঝে এনআরসি-র হিড়িক উঠল। হাড় হিম করা আতঙ্কে এদিক ওদিক দৌড়ে নাভিঃশ্বাস উঠল ভোটার কার্ড, আধার কার্ড যোগাড় করতে গিয়ে। মুস্কিল হল, উটকো বস্তির বেড়া-প্লাস্টিকের ঘরে দিন কাটানো মানুষগুলোর তো ঠিকানাই নেই! কারও কারও অবশ্য দেশের ঠিকানা আছে। সবাই প্রায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার মানুষ। এদিক ওদিক যাহোক করে নথি যোগাড় করতে কাল ঘাম ছুটল। তখনকার মতো বিপদ কাটলেও ভয়টা থেকেই গেল।

কন্যাশ্রীর জন্যে মেয়ের গার্জেন হয়ে টিপ ছাপ দিয়ে ব্যাঙ্কের বই খোলা — সে ও মায়েরা। এরপর খাদ্যসাথী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, দুয়ারে সরকারের জন্যে দেশে ফোন করে তারিখ জেনে কাজের বাড়ি থেকে ছুটি নিয়ে দেশে গিয়ে লাইনে দাঁড়ানো-সে ও মেয়েরা। মহল্লায় কারও কিছু হলে মেয়েরাই চেঁচামেচি করে লোকজন ডেকে হাসপাতালে পাঠায়। মহল্লায় বাহুবলীদের চেলা-শাগরেদদের আনাগোনা চলে। একটা ঘরে তারা চুরির মালপত্র রাখে, মদ গাঁজা খায়। মার পিট চেঁচামেচি করে, রাতভর হুল্লোড় করে মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। কখনও পুলিশ আসে। কিন্তু অপরাধীদের ধরে না, বরং কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে তাকেই তুলে নিয়ে যায়। কিছুদিন আগে এক ড্রাইভার ঝামেলা মেটাতে গিয়ে বেদম মার খেয়েছে দুষ্কৃতীদের হাতে। তারপর পুলিশ তাকেই ধরে নিয়ে গেছে। এমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে মেয়েরা জোরালো প্রতিবাদ করতে না পারলেও, চুপ থাকেনি। মাঝখানে দু'একটি মেয়েও নিখোঁজ হয়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে রাগে ফুটলেও, লোকজন প্রকাশ্যে তেমন প্রতিবাদের সাহস পায় না। কারণ পুলিশকে পাশে না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর উচ্ছেদের হুমকি। এসবের বিরুদ্ধে চোখ কান খোলা রেখেই চলতে হয় মেয়েদের। ছেলে মেয়েদের ঐ কুসংসর্গ থেকে আড়াল করার মরিয়া চেষ্টাও চালাতে হয়। বিশেষ করে ঘরে যার বাড়ন্ত গড়নের মেয়ে সেই মায়ের তো মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়। কোনোরকমে ধার দেনা করে মেয়েকে পরের ঘরে না পাঠানো অবধি শান্তি নেই। এইজন্যে নাবালিকা বিয়ের সংখ্যা বাড়ছে। বিয়ে দিয়েও আরেক সমস্যা। সেখানেও মেয়েকে লাঞ্ছনা গঞ্জনা মারধর সহ্য করতে হয়। ঝামেলা মেটাতে ক'দিন পর পর ছুটতে হয়।

পুরুষরা সংসার নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না। কেউ ভ্যান চালায়, কেউ ক্যাজুয়াল সাফাই কর্মী। কেউ বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুরোনো আসবাব কিনে দোকানে বেচে। কেউ রাজমিস্ত্রির যোগাড়ের কাজ করে। কেউ গাড়ি চালায়। এছাড়া গাছ কাটা, ঘর ছাওয়া-যখন যেমন কাজ পাওয়া যায় করে। কেউ আবার কষ্টার্জিত পয়সা মদ আর জুয়ায় উড়িয়ে দেয়।

হাতের কাছে বড় হাসপাতালটা থাকায় বিনা পয়সায় চিকিৎসা মেলে , কিন্তু নানা পরীক্ষা, ওষুধপত্র সব বাইরে থেকে নিজেদের খরচে ব্যবস্থা করতে হয়। কিছুদিন আগেও অবশ্য মিলতো। নানা অব্যবস্থা হাসপাতালে। ডাক্তার কম , কর্মী কম, মেশিন খারাপ — এসব অজুহাতে নাকাল হতে হয় লম্বা লাইনে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় থাকা রোগীদের। সাধারণ মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেটও এখন অমিল। কথায় কথায় অন্য হাসপাতালে 'রেফার' করে, এদিকে নামে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল। তবে গরিব মানুষের বিরাট ভরসা এই হাসপাতালই। বহু রোগের নিরাময়ও হচ্ছে ডাক্তারদের সুচিকিৎসায়।

লক্ষণীয় বিষয় হল, নিজেরা অধিকাংশই নিরক্ষর হলেও ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার দরজায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে মায়েদের ক্লান্তিহীন তৎপরতা। নিজেদের বিন্দু বিন্দু রক্ত-ঘামে অর্জিত পয়সা তারা 'প্রাইভেট' পড়াতে খরচা করে, অনেকাংশে হয়তো বৃথাই। জহুরা বিবির ছোট ছেলেটার এবার সাত ক্লাসে ওঠার কথা। কিন্তু তার পড়াশুনোর অবস্থা খুব খারাপ। হতাশ জহুরা বলে "ও কেলাসে উঠলেও আমি মাস্টারকে বলব আগের কেলাসেই রেখে দিতে। পেরাইভেট পড়ায় যে মাস্টার, সে বলেছে — ও কিছুই পারে না।" আগেও একবার পুরোনো ক্লাসেই রেখে দিয়েছিল। তবে হতাশ হলেও হাল ছাড়েনি। মাস কয়েক আগে নিজে গুরুতর অসুস্থ হয়েছিল। ওষুধ এখনও চলছে। ওষুধ, ছেলের প্রাইভেট পড়ার খরচে জোর দড়ি টানাটানি চলে। তবুও দু'টোই বজায় রাখতে হবে মনে করে দিনের পর দিন আলুভাতে ভাতই বেড়ে দিতে হয় বাড়ন্ত নাবালক ছেলে, সদ্য প্রসূতি বৌমাসহ সবার পাতে। ক্বচিৎ মাছ বা মাংস বা ডিম। অপুষ্টির কালো ছায়া পরিবার জুড়ে। মিড-ডে-মিল-এও তো শুধু ভাত সবজি। কখনও সয়াবিন। ডিম তো বহুদিন বন্ধ।

এত নেতির মধ্যে দু'একটা ঘটনা যেন গাঢ় অন্ধকারে এক রূপোলি ঝিলিক। জহুরার কাছে জানা গেল শুভঙ্কর বলে যে ছেলেটি ওদের ক'টা বাচ্চাকে পড়ায় সে নিজে এক কলেজ ছাত্র। ছেলের খোঁজ করতে একদিন এক মা দু'স্টপেজ দূরে শুভঙ্করের বাড়ি গিয়েছিল। সেও ঝুপড়ি ঘর। মাস্টারের মা তাকে এক কাপ চা না খাইয়ে ছাড়েনি। খুব কম বয়েসে স্বামী তাকে ছেড়ে আবার বিয়ে করে। নিরুপায় হয়ে যোগাড়ের কাজ ধরে ছেলেকে মানুষ করেছে। এখনও তাতেই পেট চলে। ছেলে ভোরে উঠে বাড়ি বাড়ি কাগজ দিয়ে, টিউশন পড়িয়ে কলেজ চলে যায়। ফেরার পথে রহিমদের পড়িয়ে বাড়ি ফেরে। কিন্তু জহুরারা এখনও পর্যন্ত একটা ভালো জায়গা তাকে দিতে পারেনি পড়ানোর জন্যে। একটা ভাঙাচোরা ঘরে মাস্টারের মোবাইলের টর্চের আলোয় পড়াশুনো চলেছে কিছদিন। অগত্যা মাস্টার নগদ তিন হাজার টাকা শামসুলকে দিয়ে বলেছিল ঘর বানিয়ে দিতে। লোকটার সব ভালো কিন্তু ভীষণ জুয়াড়ি। সব টাকা উড়িয়ে আরও টাকা চেয়ে নিয়েছে। ঘর এখনও হয়নি। অধীর আগ্রহে থাকা মায়েরা রোজই শামসুলকে বকাবকি করে, তাড়া লাগায়, "বেচারার রক্ত জল করা টাকাগুলো ফেরত দাও, নয়তো ঘর বানাও। আমাদের বাচ্চাদের ঠিকমতো পড়াশুনো হচ্ছে না।" সায়রার বর তিনটে বাচ্চা রেখে ওকে ছেড়ে আবার বিয়ে করেছে। পাশেই ঘর বানিয়ে নতুন বৌ নিয়ে থাকে। মাঝে মাঝেই ঝগড়া ঝাঁটি হত। সায়রা পুরোনো বরকে মনে প্রাণে ঘেন্না করে। তার হুমকির জবাবে পাল্টা গলা চড়িয়ে বলেছে "তোর মত দু'নম্বরি কামাই না, সৎ পথে গতর খাটিয়ে খাই রে! আর ছেলেদের খাওয়াই পরাই। পড়াশুনোও শিখোবো। — আর আমার কিছু হলে, সবাইকে বলা আছে, তোকেও কেউ ছাড়বে না।" দাঁতে দাঁত চেপে সত্যিই তিনছেলেকেই ও পড়াচ্ছে।

আমিনার ছোট মেয়ে সালমার শ্বশুরবাড়ি বসিরহাটের গ্রামে। ওখানে বাড়িতেই প্রসব হয়। মানুষ বহুদূরের হাসপাতাল যায় না। সহজে যাবার উপায়ও নেই। শুনেই সন্তানসম্ভবা মেয়েকে আমিনা একরকম জোর করেই নিজের কাছে নিয়ে আসে। বেয়ানের রাগ আর বাঁকা কথাকে পাত্তা না দিয়েই। নিজের বড় ছেলটা বাড়িতে হওয়ায় তার জন্মের কোন কাগজ ছিল না। তাই নিয়ে কম ভুগতে হয়েছে! এনআরসি-র নামে ভয়ে ছেলেটা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। পরে বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে আধার কার্ড বানিয়েছে। তাছাড়া নাবালিকা মেয়ে, প্রথম প্রসব। বাড়িতে প্রসবের ঝুঁকি নেওয়া যায়? ঘরের কাছে এতবড় হাসপাতাল থাকতে? আমিনা হাসপাতালে মেয়ের কার্ড করিয়েছিল। সেদিন হাসতে হাসতে বললো, "পরের বাড়ি খেটে খাই, জমি জিরেত তো নেই। নাতনিকে তার নানির মত রূপোর বালা দিতে পারি নি। কিন্তু আসল জিনিষটা করিয়ে দিয়েচি, জন্ম সাট্টিফিকেট!"

চেতনায় ঘা পড়ছে। সালমা, আমিনা, শবনমদের। কাজের জন্যে বাইরে বেরিয়ে তারা চলমান জীবন থেকে ঠোক্কর খেয়ে অনেক কিছু জানছে, বুঝছে, শিখছে। এখন তাদের কাছে খুব নির্দিষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে পরিবার , সমাজ, রাষ্ট্রের কাছে তাদের প্রাপ্য কী কী অধিকার-মর্যাদা, যা থেকে তারা আজও বঞ্চিত শুধু নয়, প্রতারিতও। সেটা নিয়ে চর্চা করার দায়িত্ব সঠিক রাজনৈতিক দিশা ও পরিকল্পনা সম্পন্ন নারী সংগঠনের। তারপর কীভাবে অধিকারের লড়াই লড়তে হবে, তারা নিজেরাই ঠিক করে নেবে। শাহীন বাগের দাদীরা যেমন লড়েছিলেন! কৃষাণীরা যেমন লড়েছিলেন! ইরানী মেয়েরা যেমন লড়ছেন!

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-46