সম্পাদকীয়
অর্থশ্রাদ্ধের স্বেচ্ছাচারিতা ও অন্তর্নিহিত তাস

রাজ্যে এখন ব্রিজ ভাঙ্গছে, বাজার পুড়ছে, কিছু ক্ষতিপূরন আর তদন্তের নির্দেশ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পাড়ি দিয়েছেন সুদূর ইতালিতে। ইতিমধ্যে চিকাগো যাওয়ার মওকা এসেও ভেস্তে গেল এবং তার পেছনে থেকেছে নাকি কেন্দ্রের কলকাঠি , আবার সেটা প্রতিষ্ঠিত করার মতো কোন তথ্যপ্রমাণও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নেই। নিজেকে হিন্দু ধর্মের প্রবক্তা ও প্রচারক বিবেকানন্দের উত্তরসূরি হিসেবে প্রদর্শিত করতে ও সেই কায়দায় হিন্দুত্বের প্রচারক আরএসএস-বিজেপির সাথে টক্কর দিতে চিকাগো সফরের আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার ঘুঁটি তিনি সাজিয়েছিলেন। সেই আশায় ছাই পড়েছে। দফায় দফায় নানা ছুতোয় মুখ্যমন্ত্রী বেলুড় মঠের দ্বারস্থ হয়েছেন, মায়াকান্না শুনিয়েছেন চিকাগো যেতে না পারার আক্ষেপ শুনিয়ে, আশীর্বাদ চেয়েছেন, সে তো হিন্দু ভোটের কথা ভেবেই। তৃণমূল পড়েছে আতান্তরে। ফলে চমকের নতুন ফানুস ওড়াতে নতুন কিছু কসরত দেখানো দরকার হয়ে পড়ে। সেই উপলক্ষেই মুখ্যমন্ত্রীর ইউরোপ সফর। দেশী পুঁজির বিনিয়োগের পাত্তা মিলছে না, বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগ ধরে আনা নিশ্চিত না হোক, বিনিয়োগের মোহ তৈরি করতে প্রতিশ্রুতির বার্তা তৈরি করা দরকার, তার জন্য বিদেশ পাড়ি দেওয়ার কসরত দেখানোয় তৎপর হলেন মুখ্যমন্ত্রী।

কিন্তু বিদেশ যাওয়ার আগে দান-খয়রাতির যে চূড়ান্ত বিতর্কিত কাণ্ডটি ঘটিয়ে গেলেন তা হল, দুর্গাপূজা বাবদ পূজা কমিটি পিছু ১০ হাজার করে মোট ২৮ কোটি টাকা দানের ঘোষণা। প্রশ্ন হল, এই অধিকার তৃণমূল সরকার কোথা থেকে পেল? সরকার অজুহাত দেখাতে পারে এই দান সামাজিক উৎসবের মুখ চেয়ে। কিন্তু তা বললে মানা হবে কেন। এটা তো সাধারন অর্থে ধর্মীয় উৎসব, বিশেষত সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব, ধর্মীয় উৎসবে সরকারি কোষাগারের অর্থ বরাদ্দ হবে কেন? সরকার 'যুক্তি'র কারসাজির আশ্রয় নিয়ে বলতে পারে, সরকারি কর্মচারিদের তো অগ্রিম দেওয়া হয় শারদোৎসবে, পূজো কমিটিকে দান দিলে দোষ কোথায়। এই কূটযুক্তি ধোপে টেকে না। সরকারি কর্মচারিরা যাইই পেয়ে থাকেন সেটা তাদেরই মেহনতের দাম। সেটা হকের পাওয়া। পূজো অনুদানের তুলনা এক্ষেত্রে একেবারেই চলে না। যে ২৮ কোটি টাকা ধর্মোৎসবে ঢালার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল সেই পরিমান অর্থ তো জরুরি সামাজিক কল্যাণের ক্ষেত্রগুলোতে ব্যয় করা যেত। যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, একশ দিনের কাজের মজুরি, সরকারি কর্মচারিদের বকেয়া মহার্ঘভাতা, ভূপৃষ্ঠে সেচ খনন ইত্যাদি কতই তো অবহেলিত, বঞ্চিত, অভাব-অভিযোগের ক্ষেত্রগুলো রয়েছে। সেসব অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রের দিকে রাজ্য সরকারের মন নেই-কান নেই। তৃনমূলের এখন বিশেষ মাথাব্যথার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে হিন্দু ভোট। মনে রাখা প্রয়োজন 'সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের' রাজনীতি দিয়ে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলা করা যায় না, উচিত ধর্মাচরণের গনতান্ত্রিক অধিকারকে সুরক্ষা দেওয়া, ধর্মীয় হামলা থেকে সুরক্ষা দেওয়া, কিন্তু সরকারের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রাখা। ধর্মীয় আচার-আচরন, ধর্মীয় খাতে অর্থদান বা অন্যান্য উৎসাহদান থেকে কঠোরভাবে বিরত থাকা। দুর্গাপূজায় অর্থদানের পদক্ষেপ করে তৃণমূল সরকার নিজের ওপর ধর্মাশ্রয়ী হয়ে পড়ার প্রশ্নচিহ্ন লেপে দিল।

তৃণমূল এতদিন চাইত 'মা-মাটি-মানুষের' নামে ভোট, এখন তার নেত্রীর ছুপা ভাবনায় মাথাচারা দিচ্ছে সম্প্রদায়ভিত্তিক ভোটবাসনা। ঘাড়ের ওপর হিন্দুত্বের গরম শ্বাস ফেলছে বিজেপি- আরএসএস। তার মোকাবিলায় গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সাচ্চা রাস্তা পরিত্যাগ করে উপরন্তু গনতন্ত্রকে দমন ও পরোক্ষে ধর্মীয় ধুনো দেওয়া ভোট পাওয়ার বিপজ্জনক রাস্তা নিচ্ছে তৃণমূল। তাছাড়া বিজেপি-আরএসএস-এর জিগিরতোলা রামনবমী পালনের সাথে পাল্লা দিয়ে হনুমান পুজো-গণেশ পুজোয় বকলমে ইন্ধন যোগানোয় তৃণমূলের গূঢ় সক্রিয়তা এরাজ্যের পরিবেশকে ধর্মন্মোদনার আরও বিপদসঙ্কুল প্রতিকূল করে তুলছে।

খণ্ড-25
সংখ্যা-29