সম্পাদকীয়
ভোট বাগানোর নয়া তৃণমূলী কায়দা

আগামী লোকসভা নির্বাচনে ভোট বাগানোর উদ্দেশ্যে তৃণমূল কংগ্রেস নতুন কিছু কায়দা নিতে শুরু করেছে। এবারের পরিস্থিতিটাও আগের চেয়ে কঠিন। প্রতিষ্ঠান বিরোধী প্রত্যাঘাত ও নিজেদের মধ্যেকার গোষ্ঠী সংঘাত বেড়েছে, সামলানো কঠিন হচ্ছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে, তার আগে বেশ কিছু পৌর নির্বাচনে সন্ত্রাসের রাস্তা নিতে হয়েছিল, কারণ হাওয়া-ভোট চাওয়া-পাওয়ার দিদির 'লোকপ্রিয়তা'র দিন তেমন আর নেই। নির্বাচনী সন্ত্রাস চালানোকে কেন্দ্র করে অনেক নিন্দার ঝড়ও ওঠে। এখন তাই বিভিন্ন ভাষি, অংশ, সম্প্রদায় নিশানা করে নানা সমীকরণের নতুন কিছু কায়দা-কৌশলের পদক্ষেপ করছে তৃণমূল। যেমন, কলকাতা মহানগর ভিত্তিক হিন্দীভাষী মানুষদের প্রতিনিধিদের সাথে এক সভায় মুখ্যমন্ত্রী মিলিত হলেন। এর আগে গত বিধানসভা নির্বাচনে মাড়োয়ারি ও গুজরাটি সমাজের প্রতিনিধিবর্গের সাথে আলোচনার আসর বসিয়েছিলেন। এবার সেখানে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন হিন্দীভাষী জনতার সাথে ভাব জমানোর। কলকাতা থেকে রাজ্যে মেহনত-বসবাসরত মূলত বিহারী ও ঝাড়খন্ডী জনতাকে পাশে পাওয়ার আবেদন জানাতে, বিনিময়ে তাদের এখান থেকে উচ্ছেদ যাতে না হতে হয় তার সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি দিতে। দ্বিতীয়ত, 'কন্যাশ্রী' অনুদান প্রকল্পের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার গ্রহীতার পারিবারিক বার্ষিক আয়ের আর কোন সীমারেখার শর্ত রাখবে না। অর্থাৎ এই অর্থ এবার থেকে যে কোন আর্থিক শ্রেণীর কন্যারা পাবেন। ক্লাব কমিটি, পুজো কমিটিকে অনুদান প্রদানের জালে জড়িয়ে নেওয়া শুরু হয়ে গেছে। এবার প্রভাব বিস্তারের প্রয়াস সম্প্রসারিত হল কন্যাশ্রী অনুদানের ক্ষেত্রে। তৃণমূলের প্রসঙ্গত সবচেয়ে বড় টার্গেট হল সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়। এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বর্তমানে সবচেয়ে বেশী প্রভাব যদিও তৃণমূলের, তবু তার রাশ আলগা হতে শুরু করেছে। ক্ষোভের বিস্তৃতির জন্ম দিচ্ছে তৃণমূলেরই ক্ষমতাদম্ভী আচরণ। বিশেষ করে গ্রামীণ ক্ষেত্রে জমি, চাষ,পাট্টা, মজুরি, পঞ্চায়েতী দুর্নীতি ও স্বার্থসংঘাত; মফস্বল শহর ও শিল্পাঞ্চলে একদিকে সংখ্যালঘুদের বিজেপি-আর এস এস এর হামলা থেকে নিরাপত্তার ঠিকেদারি নেওয়ার বহিরঙ্গের প্রচার, অন্যদিকে তলায় তলায় হিন্দুত্বের শক্তিগুলোকে বিজেপি থেকে দূরে রাখার নামে—এমনকি হিন্দু আবেগ থেকে ভোট জোগারের উদ্দেশ্যে প্রশ্রয় দেওয়ার ঘটনা-প্রবণতা মুসলিম সমাজের একাংশকে তৃণমূল বিরোধী অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। এখন লোকসভা নির্বাচনের চিন্তায় বিক্ষুব্ধ মুসলিম প্রবণতা তৃণমূল নেত্রীর কপালে ভাঁজ ফেলছে। ঠিক নানা ন্যায়সঙ্গত কারণে যেমনটি ঘটেছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে। এবারের পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফলে তাদের ক্ষোভের প্রবণতা প্রতিফলিত হয়েছে। বিক্ষুব্ধ আদিবাসীদের মন ফেরাতে তৃণমূল পঞ্চায়েত বোর্ড গঠন উপলক্ষ্যে একদফা চেষ্টা চালালে কিছু নির্বাচিত সদস্য হয়ত কিছু রফার প্রতিশ্রুতি পেয়ে তৃণমূলের ঘরে ফিরেছেন, কিন্তু তাতে ক্ষুব্ধ আদিবাসীদের ব্যাপক অংশের ক্ষোভ প্রশমিত হয়ে গেছে বলে মনে হয় না।কারণ তারপর থেকে তেমন কোন পুনরুদ্ধারের কাজের খাতা তৃণমূল খুলতে পারেনি। মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভের আঁচ মেটাতে দলনেত্রী না বসলেও সময় নষ্ট না করে সুদূর ইউরোপ থেকে নির্দেশ দিয়েছেন দুই সংসদ প্রধান সুদীপ ও ডেরেককে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন প্রতিনিধিদের সাথে বসতে। সেইমতো প্রায় সাড়ে তিনশ সংখ্যালঘু প্রতিনিধির সাথে তৃণমূলের সাংসদ যুগলের একদফা বৈঠকও হয়েছে। তবে ঐ বৈঠকে আলোচিত সারাংশ বা লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে কি হল তা নিয়ে তৃণমূল কিছুই খোলসা করেনি। সংবাদজগতে যে খবর চাউর হয়েছে তা হল, তৃণমূল সম্পূর্ণ নতুন এক প্রশ্নের, এক নতুন দর কষাকষির সম্মুখীন। সেটা হল, এরাজ্যে সংখ্যালঘু ভোট যেখানে প্রায় ৩০ শতাংশের মতো, তাহলে লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন করার ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু প্রার্থী উপরোক্ত শতাংশ হওয়াই উচিত। তৃণমূল এই প্রশ্নের কি প্রত্যুত্তর দেবে তার ইঙ্গিত এখনও মেলেনি।

খণ্ড-25
সংখ্যা-31