বিবৃতি
সিপিআই(এমএল) পলিটব্যুরোর ঘোষণা

গত ৭-৮ সেপ্টেম্বর উত্তর ২৪ পরগণা জেলা কমিটির অফিসে সিপিআই(এমএল) পলিটব্যুরোর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের শুরুতে পার্টির প্রয়াত নেতা কমরেড ডি পি বক্সী, সাংবাদিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রবক্তা কুলদীপ নায়ার, সিপিআই(এম)-এর প্রাক্তন বিহার সম্পাদক বিজয় কান্ত ঠাকুর এবং বিহারের প্রবীণ সিপিআই (এম) নেতা কৃষ্ণকান্ত সিং, কলকাতার প্রবীণ সিপিআই(এমএল) কর্মী কমরেড পরিতোষ ভট্টাচার্য এবং পূর্ববর্তী পলিটব্যুরোর বৈঠকের পরবর্তী পর্যায়ে প্রয়াত ও অন্যান্য কমরেডদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। কেরলের বন্যা এবং কলকাতায় ভেঙে পড়া মাঝেরহাট সেতু যাদের প্রাণ নিয়েছে পলিটব্যুরো তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। পলিটব্যুরোর বৈঠকের আলোচনার সারসংক্ষেপ এবং গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ নিচে দেওয়া হল :

কেরলের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ অভিযান

কেরলের ভয়াবহ বন্যায় কেন্দ্রীয় সরকার যে চূড়ান্ত নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়েছে এবং সঙ্ঘবাহিনী যে কদর্য সাম্প্রদায়িক ও সংস্কারাচ্ছন্ন প্রচার চালিয়েছে, পলিটব্যুরো তাকে ধিক্কার জানিয়েছে। কেরলের কমরেডরা অত্যন্ত তৎপরতার সাথে যে উদ্ধার ও ত্রাণের উদ্যোগ নিয়েছেন তার জন্য পলিটব্যুরো তাঁদের অভিনন্দন জানিয়েছে। কেরলের বন্যা বিদ্ধস্ত জনগণের জন্য সার্বিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বানে অধিকাংশ রাজ্যের কমরেডরাই গুরুত্বের সাথে সাড়া দিয়েছেন। তামিলনাড়ুর কমরেডরা দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা গ্রহণ করেছেন এবং কেরলের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ অভিযানে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা তুলেছেন। একটি মাত্র ইউনিয়নের (কোঅপটেক্স-এর শ্রমিকরা) ও শত শত সদস্যরা একদিনের বেতন দানের মধ্যে দিয়ে ৫ লক্ষ টাকা তোলেন। বন্যা ত্রাণের সহয়তায় কন্যাকুমারির কমরেডরা এক ভ্যান ভর্তি জিনিসপত্র পাঠান। বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবাংলা, উড়িষ্যা এবং অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্য কমিটিগুলিও ১০ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে। যে অর্থ তোলা হয়েছে তার একটা অংশ কেরলের মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করা হয়েছে এবং বাকিটা পার্টির নিজস্ব পরিচালিত ত্রাণ সহায়তা অভিযানে কেরলের কমরেডরা ব্যয় করছেন।

মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীদের উপর হামলা

মোদি সরকার এবং বিজেপি পরিচালিত বিভিন্ন রাজ্য সরকার মানবাধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে যে সুপরিকল্পিত আক্রমন নামিয়েছে, পলিটব্যুরো তাকে তীব্র ধিক্কার জানিয়েছে। একদিকে ভীমা কোরেগাঁও-তে দলিতদের উপর নৃশংস আক্রমণের জন্য প্রকৃতই দায়ী শক্তিগুলোকে রাষ্ট্র রক্ষা করছে। অন্যদিকে, দেশের মানবাধিকার আন্দোলনের সুপরিচিত কর্মীদের 'শহুরে নকশাল' বলে ছাপ মেরে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হত্যার তথাকথিত এক মেকি চক্রান্তে ফাঁসিয়ে তাদের বিরুদ্ধে এক বিদ্বেষপূর্ণ ডাইনি খোঁজ অভিযান শুরু হয়েছে। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে গণতন্ত্রপন্থী শক্তিগুলো দেশব্যাপী যে প্রতিবাদ সংগঠিত করেছে এবং সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করে গ্রেপ্তারিগুলোকে যে আটকে দিয়েছে এবং বিরোধিতার কণ্ঠরোধকে 'গণতন্ত্রের সেফটি ভাল্বকে বিপন্ন করে তোলা' বলে অভিহিত করেছে, পলিটব্যুরো তাকে স্বাগত জানিয়েছে। প্রতিবাদী এই সমস্ত শক্তিগুলোর কাছে পৌঁছে আমাদের গণতন্ত্রের আওয়াজকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে।

নাগরিক পঞ্জি এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল

নাগরিক পঞ্জির (এনআরসি) চূড়ান্ত খসড়া থেকে আসামে বসবাসকারি বহু সংখ্যক মানুষের নাম বাদ যাওয়ার বিষয়টাকে পলিটব্যুরো অত্যন্ত আপত্তিজনক বলে মনে করছে। নাম বাদ যাওয়া এই ৪০ লক্ষ মানুষের ব্যপক সংখ্যাধিকই আসাম সহ বিভিন্ন রাজ্যের ভারতীয় নাগরিক বলে জানা গেছে, যাঁরা কয়েক দশক ধরে আসামে বসবাস ও কাজ করছেন। অন্যায়ভাবে নাম বাদ যাওয়ার ত্রুটিকে দ্রুত সংশোধন করার ওপর জোর না দিয়ে বিজেপি পঞ্জি বার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নাম বাদ যাওয়া মানুষদের অনুপ্রবেশকারি বলে ছাপ মেরেছে এবং অন্যান্য রাজ্যেও, বিশেষভাবে পশ্চিমবাংলায় এনআরসি-কে সম্প্রসারিত করার প্রচার শুরু করেছে। আগামী নির্বাচনের আগে তীব্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটানোর লক্ষ্যে এনআরসি-কে যে এক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের চেষ্টা হচ্ছে, তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। এটা জনগণের মধ্যে ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে এবং সারাদেশের ব্যাপক সংখ্যাধিক জনগণের সামনে জীবিকা, স্বাধীনতা ও মর্যাদার যে বুনিয়াদি এজেন্ডা রয়েছে, তাকে বিপথগামী করতে ও চেপে দিতে চাইছে। বিজেপি নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের গাজর ঝুলিয়ে এনআরসি সৃষ্ট উদ্বেগকে প্রশমিত করতে চাইছে। নাগরিকত্ব ইস্যুটির সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটানো ছাড়াও এটা প্রতারণারও এক সুস্পষ্ট পদক্ষেপ। উদ্বাস্তু এবং অভিবাসী যে জনগণ মাঝেমধ্যে ভারতে বসতি স্থাপন করেন, নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি কখনোই তাদের ভোগ করা বঞ্চনা এবং প্রত্যাখ্যানের বাস্তবতার সমাধান হতে পারে না। নাগরিকত্ব কর্পোরেট লুণ্ঠন, অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং গণতন্ত্র হরণের বিপন্নতা থেকে জনগনকে রক্ষা করতে পারেনি। জনগণের বুনিয়াদি ইস্যুগুলির উপর জোর দেওয়াটাকে বজায় রাখার পাশাপাশি আমাদের সাহসের সাথে এনআরসি এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে বিজেপির বিভেদ সৃষ্টিকারি এবং প্রতারণামূলক চক্রান্তকে উন্মোচিত ও তার বিরোধিতা করতে হবে।

নির্বাচনী প্রস্তুতি

নির্বাচন এগিয়ে আসায় বিজেপি অনেক বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আমাদের সর্তকতা জারি রাখতে হবে এবং সংঘ বাহিনীর যে কোনো চক্রান্তকে অঙ্কুরেই বিনাশ করতে হবে। ভোটার তালিকা থেকে প্রতিষ্ঠিত বিজেপি বিরোধী ভোটারদের নাম বড় আকারে বাদ দেওয়ার প্রণালীবদ্ধ প্রয়াস চলছে। ভোটার তালিকায় সাম্প্রতিক তথ্য যুক্ত করার যে কাজ চলছে তার উপর আমাদের নজর রাখতে হবে এবং আমাদের পক্ষে ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন সমস্ত ভোটারদের নাম তালিকায় থাকাটা সুনিশ্চিত করতে হবে। বিহারে নির্বাচনী বোঝাপড়ার সম্ভাবনা এখনও অস্পষ্টই রয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ঝাড়খন্ডের কোডারমা কেন্দ্র থেকে আমরা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলাম। বাবুলাল মারান্ডি এই কেন্দ্র দাঁড়ানোর জন্য জেদাজেদি করছেন। ফলে, বিভিন্ন বিরোধী দলের মধ্যে বোঝাপড়ার সামনে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। বৃহত্তর ভিত্তিতে আসন সমঝোতার চূড়ান্ত সম্ভাবনা সম্পর্কে মন খোলা রেখেও নিজেদের স্বাধীন প্রস্তুতির উপর আমাদের সার্বিক মনোনিবেশ করতে হবে। বৃহত্তর কোনো বোঝাপড়া না হলে যে গুটিকয়েক আসনে আমাদের অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে তার একটা তালিকা পলিটব্যুরো প্রস্তুত করেছে। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যগুলোতে পরবর্তী পর্যায়ের যে বিধানসভা নির্বাচনগুলো হতে চলেছে তা ২০১৯-এর বড় লড়াইয়ের প্রস্তুতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই রাজ্যগুলোতে সমস্ত আসনে বিজেপিকে পরাজিত করার লক্ষ্যে সার্বিক প্রচার চালানোর পাশাপাশি সম্ভব হলে অন্যান্য বাম দলগুলোর সঙ্গে আসন সমঝোতা করে বেছে নেওয়া কয়েকটি আসনে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারি।

র‍্যালি, প্রচার এবং সেই সম্পর্কিত উদ্যোগ

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং রাফাল দুর্নীতির বিরুদ্ধে ডাকা ১০ সেপ্টেম্বর সাধারন ধর্মঘটে সার্বিক অংশগ্রহণের আহ্বান পলিটব্যুরো জানিয়েছিল। ২৭ সেপ্টেম্বর পাটনায় রাজ্যস্তরের একটা র‍্যালির পরিকল্পনা করা হয়েছে। ঝাড়খন্ডে ৮ অক্টোবর কোডারমা কেন্দ্রভিত্তিক একটা র‍্যালি অনুষ্ঠিত হবে, তার আগে গোটা ক্ষেত্রজুড়ে পদযাত্রা সংগঠিত হবে। দুদিন ধরে সারা ভারত শ্রমিক ধর্মঘট ছাড়াও (ট্রেড ইউনিয়নগুলোর জাতীয় কনভেনশনের পর যার দিন ঘোষিত হবে) নভেম্বর মাসে দিল্লিতে দুটো বড় র‍্যালি যৌথভাবে সংগঠিত হবে বলে ঠিক হয়েছে; ৩ নভেম্বর সংগঠিত হবে কর্মসংস্থানের প্রশ্নে যুব র‍্যালি এবং ২৮-৩০ নভেম্বর সংগঠিত হবে কৃষক-কৃষি শ্রমিক র‍্যালি। উভয় র‍্যালিতেই আমাদের সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। বিহারে নভেম্বরের মাঝামাঝি আয়ারলা তার পরবর্তী জাতীয় কনভেনশন অনুষ্ঠিত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এআইসিসিটিইউ-র উদ্যোগে দিল্লিতে ১৬ নভেম্বর সাফাই কর্মীদের জাতীয় কনভেনশন অনুষ্ঠিত হবে। রেলের একটি ফেডারেশনের সহযোগিতায় রেলে কর্মরত আমাদের কমরেডরা জাতীয় স্তরের একটি ফেডারেশন শুরু করতে যাচ্ছেন। আমাদের কাজের সমস্ত ক্ষেত্রে এই নতুন সংগঠনটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পার্টির রাজ্য কমিটিগুলিকে অবশ্যই রেলের কমরেডদের সহায়তা করতে হবে।

কমরেড নাগভূষণ এবং কমরেড বিনোদ মিশ্রের ২০তম মৃত্যু বার্ষিকী

এই বছর কমরেড নাগভূষণ এবং কমরেড বিনোদ মিশ্রের ২০তম মৃত্যু বার্ষিকী। যথাযথ পরিকল্পনা সহকারে এই দিন দুটি আমাদের পালন করতে হবে। ভুবনেশ্বরে ৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে ফ্যাসি-বিরোধী কনভেনশন এবং ১৮ ডিসেম্বর উপযুক্ত একটি স্থানে বিনোদ মিশ্রের মূর্তি স্থাপন করা হবে।

খণ্ড-25
সংখ্যা-29