প্রতিবেদন
অস্থির অর্থনীতি, অন্ত:কলহে দীর্ণ ক্ষমতার প্রতিষ্ঠান মোদীর বিদায়ের লক্ষণ?

তবে কি আমরা ফের আরেকটি লাগামছাড়া আর্থিক সংকটের কবলে পড়তে চলেছি?

আইএমএফ তেমনই এক সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছে। আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে, আমেরিকার দৈত্যাকার ব্যাঙ্ক লেম্যান ব্রাদার্স সাব প্রাইম ঋণের সংকটে আপাদমস্তক জর্জরিত হয়ে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ল। আর তারই হাত ধরে, গোটা বিশ্ব জুড়ে নেমে এলো তীব্র ধস, আর্থিক মন্দা, যার প্রকোপ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিশ্ব অর্থনীতি। বেশ কিছু অর্থনীতিবিদ আজ যাকে ‘সেকুলার স্ট্যাগনেশন’ বলে আখ্যায়িত করছে। ওই ফিনান্সিয়াল সংকটের পর, বিশ্ব আরও একটি সংকটের দিকে বেশ দ্রুতগতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে। ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণ যা ছিল, তা আজ অনেকটাই বেড়ে গেছে। আর্থিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে সরকার বা বিভিন্ন দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্কগুলোর বেলাগাম আর্থিক আচরণের উপর যে লাগাম টানা দরকার ছিল, তা তারা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে আইএমএফ মনে করে। ভারতীয় মুদ্রা (টাকার)-র ক্রমাগত পতন, গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মহীনতা, ৭৮টির মতো বৃহৎ কর্পোরেশনগুলোর কল্পনাতীত পরিমাণে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করা—সব মিলিয়ে বলা যায়, ভারত এবারের সংকটে এক কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে, যার কাছে ২০০৮ নেহাতই নগণ্য।

ভারতীয় দেউলিয়া কোড (আইবিসি)-র আওতায় আসার পর বৃহত্তম ৭৮টি কোম্পানি ইতিমধ্যেই তাদের ঝাঁপি বন্ধ করার দিকে এগোচ্ছে। এর মধ্যে তো ২০টা সংস্থাকে এখনই দেউলিয়া ঘোষণা করে পুরোপুরি গুটিয়ে ফেলতে ন্যাশনাল কোম্পানি ল ট্রাইব্যুনালের কাছে পাঠানো হয়েছে। আরও ৩০টি সংস্থা, সবকটাই বিদ্যুৎ কোম্পানি, হাঁড়িকাঠে গলা বাড়িয়েছে, কারণ এলাহাবাদ হাইকোর্ট তাদের বাড়তি সময় দিতে রাজি হয়নি। এই সমস্ত সংস্থাগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ ১ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এদের মধ্যে রয়েছে তিনটি দৈত্যাকৃতি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থা— ৪,০০০ মেগাওয়াট সম্পন্ন টাটার কোস্টাল গুজরাট পাওয়ার, আদানি পাওয়ার, মুন্দ্রা ও এসার পাওয়ার। আরও ৯২টা সংস্থার কপালে এখনও বিরাট এক অনিশ্চয়তা ঝুলছে—ঋণ পরিশোধের জন্য তাদের হাতে রয়েছে মাত্র ১৮০ দিনের শেষ সময়সীমা। এর পাশাপাশি, গত বছরের তুলনায় ছোট ছোট সংস্থাগুলোর ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে যা ওই ক্ষেত্রগুলোতে নেমে আসা সংকটের ইঙ্গিতবাহী।

সেপ্টেম্বরে বৃদ্ধি পেয়েছে পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার। আগস্টে যা ছিল ৪.৫৩ শতাংশ তা একমাসের মধ্যে, অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে বেড়ে হয়েছ ৫.১৩ শতাংশ—গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই হার ছিল ৩.১৪ শতাংশ। এই বৃদ্ধি শিল্প ও বণ্ড বাজারের জন্য মোটেও শুভলক্ষণ নয়। কারণ, মূল্যবৃদ্ধি মাথা তুললে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমানোর দাওয়াই দিতে পারে না। বরং, মূল্য বৃদ্ধির লাগাম টানতে সুদের হার কিছুটা বৃদ্ধি করতে পারে। আর সেটা ঘটলে ঋণের খরচ বাড়ে। তখন ধাক্কা খেতে পারে বিনিয়োগ। প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। খুচরো বাজারেও বেড়েছে মূল্যবৃদ্ধির হার। সেপ্টেম্বরে এই হার ছুঁয়েছে ৩.৭৭ শতাংশ; আগস্টে যা ছিল ৩.৬৯ শতাংশ। এদিকে, অপ্রত্যাশিতভাবে কমে গিয়েছে রপ্তানি; সেপ্টেম্বরেই এর পরিমাণ কমেছে ২.১৫ শতাংশ। বিপরীতে, আমদানি বেড়েছে ১০.৪৫ শতাংশ, যার পরিণামে হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি। আরও শক্তিশালী হচ্ছে ডলার, মুখ থুবড়ে পড়ছে টাকার মূল্য এক নাগাড়ে। ভারতের মূলধনী বাজার প্রবলভাবে সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। অপরিশোধিত তেলের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি, পড়তে থাকা টাকার মূল্য, সরকারি হিসাবে জুন ত্রৈমাসিকের শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোতে অনাদায়ি ঋণের অঙ্ক আরও বেড়ে প্রায় ১২ লক্ষ কোটি টাকার দোরগোড়ায় পৌঁছানো এবং সম্প্রতি ইরানের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্তবর্তীকালীন নির্বাচন এবং ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে ভোট—সবকিছুরই মিলিত ফলাফল ভারতের শেয়ার বাজারে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে, ১-১৯ অক্টোবরের মধ্যে ভারতের মূলধনী বাজার থেকে ৩১,৯৭৭ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে বিদেশী লগ্নিকারী সংস্থাগুলি। এর মধ্যে তারা শেয়ার বেচেছে ১৯,৮১০ কোটি বণ্ড বিক্রি করেছে ১২,১৬৭ কোটি টাকার। ভারতের বাজার থেকে বিদেশী লগ্নিকারী সংস্থাগুলোর বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার প্রবণতা ক্রমাগত বাড়ছে। এর আগে, পুরো সেপ্টেম্বরে, শেয়ার ও ঋণপত্রের বাজার মিলিয়ে ভারত ছেড়েছিল প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার বিদেশী লগ্নি। আর, তারও আগে, জুলাই-আগস্টে সংস্থাগুলি ঢেলেছিল ৭,৪০০ কোটি টাকা। কিন্তু এত দ্রুত তালে, অক্টোবরে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার লগ্নি দেশান্তরী হয়ে যাওয়ায় বোঝাই যাচ্ছে যে বিদেশী লগ্নিকারীদের কাছে ভারত মোটেই আকর্ষণীয় গন্তব্যস্থল নয়। ‘অচ্ছে দিন’-এর মতোই, মোদীর জমানায় এফডিআই-কে দেশের মাটিতে টানার সমস্ত প্রচেষ্টাই চরম ব্যর্থতায় পর্যবসিত।

নয়া দিল্লীস্থিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক ফিনান্স অ্যাণ্ড পলিসির তরফ থেকে ‘এমপ্লয়মেন্ট, এডুকেশন অ্যাণ্ড দ্য স্টেট’ শিরোনামে এক অত্যন্ত গবেষণাধর্মী, তথ্যবহুল রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। ওই রিপোর্টে লেখক সুদীপ্ত মুণ্ডলে জানিয়েছেন, ২০১৫-১৬ সালে ৮৫ শতাংশ ভারতীয় শ্রমিক মাসে ১০,০০০ বা তার কম আয় করেছে। মাত্র ০.৫ শতাংশ শ্রমিক মাসে ৫০ হাজার বা তার অধিক উপার্জন করেছে। ভারতীয় লেবার ব্যুরোর ৫ম বার্ষিক কর্মসংস্থান-কর্মহীনতা সংক্রান্ত সমীক্ষায় ওই তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে যে, ভারতের সংখ্যাধিক শ্রমিক মাসে ২০ হাজার টাকা বা তার কম আয় করেন, আর ওই টাকায় কোনরকমে বেঁচেবর্তে দিন গুজরান করা যায়। ভদ্রস্থ জীবন ধারনের জন্য উক্ত রিপোর্ট মাসিক ৫০ হাজার টাকার এক মানদণ্ড হাজির করেছে। অস্তিত্বের এই বিপন্নতার মুখে ভারতের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকশ্রেণীকে কীভাবে আরও উৎপাদনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত করে এক ভদ্রস্থ শোভন জীবন যাপনে উত্তীর্ণ করা যায়—নীতিকারদের সামনে আজ এই চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়েছে।

এতদিন পর্যন্ত বামপন্থীরা, উদার অর্থনীতিবিদরা যে কথাগুলো বলে আসছিলেন, তারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট, ‘স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইণ্ডিয়া, ২০১৮’। সেখানে বলা হয়েছে, “কর্মহীনতার বিপদ লাগাতারভাবে বেড়ে চলেছে। বেশ কিছু বছর কর্মহীনতা ২-৩ শতাংশের মধ্যে আটকে থাকলেও ২০১৫-তে তা পৌঁছেছে ৫ শতাংশ হারে। আর তরুণদের মধ্যে এই কর্মহীনতা ব্যাপকভাবে বেড়ে ১৬ শতাংশে ঠেকেছে।’’ রিপোর্ট বলছে যে “গত ২০ বছরের মধ্যে বর্তমানে কর্মহীনতার হার সর্বোচ্চ। কর্মহীনতার হাত ধরে বিরাট মাত্রায় কমেছে মজুরির হার—৮২ শতাংশ পুরুষ এবং ৯২ শতাংশ মহিলা মাসে ১০ হাজার টাকার কম রোজগার করছে।’’

যে আর্থিক বৃদ্ধি বা জিডিপি বৃদ্ধিকে বামপন্থীরা বরাবরই প্রশ্ন করে এসেছে, ওই রিপোর্টে তারই সাক্ষ্য মেলে। সেখানে বলা হয়েছে, “জিডিপি বৃদ্ধি বিপরীতে ১ শতাংশেরও কম হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে। আমাদের দেশে নয়া উদার আর্থিক নীতির আগে, ১৯৭০-৮০-র দশকে যখন জিডিপি-র বৃদ্ধি ৩-৪ শতাংশ হারে বাড়ে, তখন কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি হয় বাৎসরিক ২ শতাংশ হারে। ১৯৯৪-৯৫-র পর শেষোক্তটি কমতে থাকে আর বর্তমানে জিডিপি বৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধির অনুপাত ০.১ শতাংশেরও কম!’’ ২০১৩ থেকে ২০১৫-র মধ্যে সমগ্র কর্মসংস্থানের ভেতর প্রকৃত অর্থে ৭০ লক্ষ চাকরি লোপাট হয়। আরও সাম্প্রতিক সময়ের তথ্য দেখাচ্ছে যে চূড়ান্ত এই অধোগতি ২০১৫-র পর অব্যাহত ছিল। ফলত যুবক ও উচ্চ শিক্ষিতের মধ্যে কর্মহীনতার হার সর্বকালের বেশি, ১৬ শতাংশে পৌঁছেছে! নতুন কলকারখানা বা উৎপাদনভিত্তিক শিল্প স্থাপন করলেই যে কর্মসংস্থান হয় না (যেমনটা আমাদের শাসকজোট শুনিয়ে আসে) তা ওই রিপোর্টেই প্রকাশিত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ১৯৮০-র আগে, (২০১৫-র মূল্যের উপর ভিত্তি করে) স্থায়ী পুঁজি খাতে ১ কোটি টাকা বিনিয়োগ হলে সংগঠিত উৎপাদনভিত্তিক সেক্টরে ৯০ পর্যন্ত কাজের সুযোগ হোত। কিন্তু ২০১০-র পর, তা কমে ১০-এ দাঁড়িয়েছে। ওই সমস্ত ক্ষেত্রে যে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির গল্প আমাদের ক্ষমতাসীন সরকার বা নীতিকাররা দেখায়, তা আসলে ঘটেছে কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের। বিপুল মাত্রায় কন্ট্রাক্ট-ট্রেনি-অ্যাপ্রেন্টিস প্রভৃতি নানান নামে ইনফর্মাল শ্রমিকদের সংখ্যাটা বেড়েই চলেছে, যারা স্থায়ী শ্রমিকদের কাজটাই করছে অত্যন্ত কম মজুরির বিনিময়ে, কোনরকম সামাজিক সুরক্ষা ছাড়াই। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে, অরক্ষিত এই ইনফর্ম্যাল শ্রমিকরা কাজ করছেন শ্রমকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।

আরও একটা বিষয় লক্ষণীয়। ক্রমাগত বেড়ে চলা উৎপাদনশীলতার সঙ্গে কিন্তু পাল্লা দিয়ে বাড়েনি মজুরি। বিগত তিন দশকে উৎপাদন শিল্পে উৎপাদনশীলতা বা প্রোডাক্টিভিটি ৬ গুণ বাড়লেও মজুরি বেড়েছে মাত্র ১.৫ গুণ! ভারতীয় অর্থনীতি নিদারুণভাবে লিঙ্গ বৈষম্যকে লালন করে চলেছে। মোদীর আমলে তা হাজির হয়েছে আরও তীব্রতা নিয়ে। উচ্চপদে মহিলাদের অবস্থান অতি নগণ্য। ২০১১ সালে উচ্চপদে মহিলাদের অবস্থান ছিল ১৩ শতাংশ যা ২০১৫-তে নেমে এসেছে মাত্র ৭ শতাংশে। সামগ্রিকভাবে পুরুষদের মজুরির তুলনায় মহিলারা পেয়ে থাকেন ৬৫ শতাংশ। বিশাল বেকার বাহিনী, গ্রামাঞ্চলে ১০০ দিনের কাজকে ক্রমে সংকুচিত করার ফলে মজুরির হারও কমছে। চর্তুদিক থেকে মোদীর আমলে অর্থনীতি চরম সংকটে, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও শাসন প্রণালীর অন্যতম স্তম্ভগুলো অন্ত:দ্বন্দ্বে লিপ্ত। মোদীর মৌনব্রত আরও দীর্ঘায়ত হচ্ছে। এটা কি মোদীর অন্তর্জলী যাত্রার ‘শুভারম্ভ’?

খণ্ড-25
সংখ্যা-35