খবরা-খবর
আরায় ‘‘বিজেপি হঠাও কৃষক বাঁচাও’’ মিছিল

ভোজপুর কৃষক আন্দোলনের স্রষ্টা এবং সামাজিক পরিবর্তনের সংগ্রামে অসামান্য ব্যক্তিত্ব কমরেড রামনরেশ রামের অষ্টম মৃত্যু বার্ষিকীতে ২৬ অক্টোবর ‘বিজেপি হঠাও, কৃষক বাঁচাও’ মিছিল সংগঠিত হয়। এই মিছিল উপলক্ষে বীর কুনওয়ার সিং স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয় জগদীশ মাস্টার-রামেশ্বর যাদব ময়দান।

হাজার হাজার কৃষক এই র্যামলিতে যোগ দেন এবং তাতে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, সারা ভারত কিষান সভার সম্পাদক হান্নান মোল্লা, সারা ভারত কিষান সংঘর্ষ সমবায় সমিতির নেতা যোগেন্দ্র যাদব এবং কিষান মহাসভার সাধারন সম্পাদক রাজারাম সিং।

আরায় সভা শুরুর আগে জনসংস্কৃতি মঞ্চের শিল্পীরা বিপ্লবী সঙ্গীত পরিবেশন করেন। গোরখা পাণ্ডে, রামতাজির মতো জনগণের কবি এবং অন্যান্যদের কবিতা আবৃত্তি করা হয়।

সভায় তার বক্তব্যে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, জনগণ যখন এই সরকারের আসল মুখ ও চরিত্রকে বুঝতে পারবে, তখন জনগণ অবশ্যই বিজয়ী হবেন। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কৃষকদের তাদের পথে বাধা বলে মনে করে। এই সরকার বুলেট ট্রেন নিয়ে সাত কাহন গায়, আর বুলডোজার চালিয়ে এবং বুলেট দিয়ে চূর্ণ করতে চায়। বুলেট ট্রেনের নাম নিয়ে কৃষকদের জমি নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে আজ বিজেপি বিরোধিতাকে তীব্রতর করে তোলাটা একান্ত জরুরি। কৃষকরা সর্বদাই বিপ্লবী আন্দোলনের মেরুদণ্ড হয়ে থেকেছেন — ১৮৫৫ সালের সিধু-কানুর নেতৃত্বে আদিবাসীদের সংগ্রাম, বীর কুনওয়ার সিং ও তার কমরেডদের নেতৃত্বে ১৮৫৭-র স্বাধীনতা সংগ্রাম, ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন, তেভাগা ও তেলেঙ্গানার কৃষক আন্দোলন, নকশালবাড়ির বিদ্রোহ, অথবা ভোজপুরের কৃষকদের সংগ্রাম, সমস্ত আন্দোলনেই কৃষকরা ছিলেন মূল শক্তি। বিধায়ক হওয়ার পর রামনরেশ রাম লাসাধিতে যে কিষান স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলেন (১৯৪২-এর কৃষকদের স্মৃতিতে) এবং ১৮৫৭ সালে জগদীশপুর ‘বলিদান কো সালাম’ নিয়ে তার সুগভীর আগ্রহ কৃষকদের সংগ্রাম ও শক্তিতে তার আশাবাদ ও আস্থার সাক্ষ্য বহন করে। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রায় কমরেড রাম নরেশ রাম এই মহান কৃষক সংগ্রামগুলির ঐতিহ্যকেই এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

কমরেড দীপঙ্কর বলেন, ২০১৪ সালে যে সরকারটা ক্ষমতায় আসে তা আমাদের দেশের কাছে বিপর্যয় হয়েই দেখা দেয়। আদানি-আম্বানিদের জন্য ব্যবসায়ি চুক্তি সম্পন্ন করার লক্ষ্যেই প্রধানমন্ত্রী মোদী বিদেশ ভ্রমন করছেন। রাফাল চুক্তি এই বিষয়টাকেই প্রতিপন্ন করেছে, যে দুর্নীতির কাছে অন্য সমস্ত দুর্নীতি ম্লান হয়ে যায় এবং যাতে মোদী সরসরি অপরাধী রূপে দেখা এবং দিচ্ছেন দেশের দুর্নীতি-বিরোধী আইন অনুযায়ী তার জেলে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই সরকার দেশের আইন-কানুনের কোনো তোয়াক্কাই করে না। আজ বুলডোজার শুধু খামার, মাঠ, কুঁড়ে ঘর, দোকান ও ছোট ব্যবসাকেই গুঁড়িয়ে দিচ্ছে না; বুলডোজার এখন আমাদের গনতন্ত্র ও স্বাধীনতাকেও চূর্ণ করছে। এই কারণেই আমরা বিজেপিকে হঠানোর কথা বলছি। এই বিপর্যয়ের মোকাবিলায় অবিলম্বে ঐক্য প্রচেষ্টা প্রয়োজন বলে তিনি অভিমত পোষণা করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের বিজেপির বিরুদ্ধে সিপিআই(এমএল), আরজেডি এবং অন্যান্য দলগুলির মধ্যে ঐক্য সম্ভাবনাকে বিচার করতে হবে। অত্যন্ত বিপজ্জনক সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি। গুটিকয়েক পুঁজিপতি গোটা দেশটাকে দখল করে নিয়েছে এবং তাদের সুবিধা করে দিতে বিজেপি সরকারগুলো করতে পারে না এমন কিছু নেই। কৃষকরা তাদের দাবিগুলো নিয়ে আন্দোলন করলে সরকার বলে টাকা নেই, অন্যদিকে পুঁজিপতিদের হাজার হাজার কোটি টাকা মুকুব করে দেওয়া হচ্ছে। বিজয় মাল্য এবং আরো অনেকে ব্যাঙ্ক থেকে বিপুল টাকা চুরি করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, আর সরকার তাদের পলায়নে সাহায্য করছে। দেশের আইনকে কাজ করতে দিলে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া এই সমস্ত লোকগুলোরই শাস্তি হবে।

দীপঙ্কর আরো বলেন, বিজেপিকে ছুঁড়ে ফেলার রায় বিহার দিয়েছিল। কিন্তু নীতীশ কুমার বিহারের জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। যাদের বিরুদ্ধে তিনি জনগণের কাছে রায় চাইলেন, তাদের হাত ধরেই তিনি আবার সরকার গড়লেন। জেডিইউ-বিজেপি জমানায় বিহারে মদের ছড়াছড়ি হয়েছিল, কিন্তু ক্ষমতায় এসে নীতীশ কুমার মদ নিষিদ্ধ করার ঘোষণা করেছিলেন। আসল সত্যিটা হল, বিহারে এখনও মদ ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত চলছে, কিন্তু মদ নিষিদ্ধ হওয়ার নামে সহস্রাধিক দরিদ্রকে জেলে পোরা হয়েছে। যতদিন বিজেপি সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, ততদিন বেকারি, কৃষকদের জমি, জল, সার, বীজ, বাড়ি, শিশুদের শিক্ষা, নারীদের নিরাপত্তা এবং বৃদ্ধ বয়সের পেনশন ইত্যাদি প্রশ্নের সমাধান জনগন দেখতে পাবেন না। বিজেপি এবং তার পেটোয়া পুঁজিপতিদের সুবিধার জন্য গোটা দেশ এবং দেশের জনগনকে ধ্বংস করা হচ্ছে। তারা কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর নারী, দলিত, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ঘটনা ভয়াবহ মাত্রায় বেড়ে গেছে। নীতীশ-মোদী জুড়ি বিহারে ক্ষমতা জবরদখল করার পর দলিত এবং নারীদের উপর আক্রমন বেড়ে চলেছে। এর কারন হল ওরা দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিনত করতে কোমর বেঁধেছে, যে হিন্দু রাষ্ট্র হবে মনুস্মৃতির উপর ভিত্তি করে। এই কারণেই বাবা সাহেব আম্বেদকর অনেক আগে হিন্দু রাষ্ট্রের বিপদ সম্পর্কে দেশকে সতর্ক করেছিলেন। ভীম সেনা প্রধান চন্দ্রশেখর রাবনের এনএসএ-র অধীনে এক বছর কারাবাসের উল্লেখ করে দীপঙ্কর বলেন, চন্দ্রশেখরকে দেশের নিরাপত্তার প্রতি বিপদ বলে গণ্য করা হচ্ছে কারন তিনি দলিতদের মর্যাদা ও সম্মানের প্রশ্ন তুলে ধরেছিলেন। হিন্দু রাষ্ট্রর নামে বিজেপি-আরএসএস দেশের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে, দেশকে ভাঙতে, ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর।

দীপঙ্কর বলেন, আমাদের দেশ একটি মাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের দেশ নয়। অনেক ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের কথাই আমাদের বলতে হবে। আমাদের দেশের সামনে যে বিপদ রয়েছে তার কথা কৃষকরা যে বুঝতে পারছেন সেটা জেনে আমরা উৎসাহিত হচ্ছি। এর আগের নির্বাচনে মুজাফ্ফরনগরের দাঙ্গা সংঘটিত করে বিজেপি বিপুল সুবিধা তুলেছিল, কিন্তু এবারের কৈরানা উপ-নির্বাচনে কৃষকরা জিন্নার ছবিকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন। কৃষকরা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন, জিন্না নয়, গান্নাই (আখ) তাঁদের ইস্যু এবং তাঁদের সাংসদ হিসাবে এক মুসলিম মহিলাকে নির্বাচিত করেছিলেন। তিনি জানান, জিগনেশ মেভানি ও তার সাথীরা গুজরাটে বিজেপির শক্তিকে অর্ধেকে এনে ফলেছেন; এবার হিন্দি বলয়ের জনগন বিজেপিকে মুছে দেবেন। তিনি জোরের সাথে বলেন, যারা কৃষকের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হবে, আগামী নির্বাচনে সেরকম প্রার্থীদেরই নির্বাচিত করতে হবে।

কমরেড হান্নান মোল্লা বলেন, কৃষকরা শুধ দু-একটি সমস্যারই সম্মুখীন নয়; গোটা কৃষি ক্ষেত্রই গভীর সংকটে নিমজ্জিত আর তার কারণ হল এই সরকারের কৃষক-বিরোধী নীতি। এই সরকারটা কর্পোরেট পন্থী। দরিদ্র বিরোধী, সংবিধানের বিরোধী। তিনি জোরের সাথে বলেন, কৃষক সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে এই কৃষক-বিরোধী সরকারকে হঠিয়ে দিতে হবে।

স্বরাজ অভিযানের নেতা যোগেন্দ্র যাদব বলেন, দেশের যেখানেই কৃষকরা তাঁদে অধিকারের জন্য লড়াই করেন, সেখানেই তাঁরা ভোজপুরের কৃষক আন্দোলনকে কৃষক সংগ্রামের এক দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন। বিজেপির প্রতারণা, নির্মমতা, মিথ্যাচার, লুট এবং খুনে চরিত্রকে উপলব্ধি করার আহ্বান তিনি কৃষকদের কাছে জানান এবং ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করে বিজেপি সরকারকে হটানোর আবেদনও রাখেন। তিনি আরো বলেন, এ দেশের ইতিহাসে মোদী সরকারই কৃষকদের সবচেয়ে বড় শত্রু রূপে দেখা দিয়েছে। তারা নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে ফসল কেনেনি। বিপরীতে ওরা ডিজেল, বীজ, সার এবং বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে, আর কৃষকের আয় দ্বিগুন হয়ে গেছে বলে মিথ্যা দাবি করছে। যে বীমা কোনভাবেই কৃষকদের সাহায্য করে না সেই ফসল বীমার নামে এই নিষ্ঠুর সকার বীমা কোম্পানিগুলোর ৪৭০ কোটি টাকা লাভের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। নিজেদের অধিকারের দাবিতে লড়াই করলে কৃষকদের গুলি করে মারা হচ্ছে, যেমন মারা হয়েছে মন্দসৌরে। তিনি সতর্ক করে বলেন, সরকার ধর্মীয় মেরুকরণ দিয়ে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে, কিন্তু তাকে তা করতে দেওয়া যাবে না।

আয়ারলা সভাপতি রামেশ্বর প্রসাদ মোদী সরকারকে কর্পোরেটপন্থী বলে অভিহিত করে বলেন, এই সরকার দরিদ্র, কৃষক, শ্রমিক এবং যুবকদের সঙ্গে নির্মমভাবে প্রতারণা করছে। ক্ষমতা থেকে তাদের অপসারিত করতে হবে। মিছিলেতে অংশগ্রহণকারী আরো কিছু নেতা স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ রূপায়নের দাবি জানান এবং কৃষক সংগঠনগুলি দিল্লীতে সংসদের সামনে ৩০-৩১ নভেম্বর যে প্রতিবাদ সমাবেশ সংগঠিত করবে তাতে যোগদানের আহ্বান কৃষকদের কাছে রাখেন।

সভা সমাপ্ত হওয়ার পর দীপঙ্কর ভট্টাচার্য রমেশ চন্দ্র প্রেক্ষাগৃহে (নগরি প্রচারিনি প্রেক্ষাগৃহ) সারা ভারত কিষান মহাসভার দু-দিনব্যাপী রাজ্য সম্মেলনের সূচনা করেন। তিনি সেখানে বলেন কৃষকদেরই আমাদের শ্রেণী সংগ্রামের কেন্দ্রীয় শক্তি করে তুলতে হবে; কেবলমাত্র তখনই আমরা কর্পোরেট পুঁজির ক্ষমতা এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারব। কৃষকদের ঐক্য সমাজ, অর্থনীতি এবং দেশের ছবিকে পাল্টে দিতে পারে। কিষান মহাসভার রাজ্য সম্মেলনের মঞ্চের নামকরণ করা হয় কৃষক নেতা কিষুন যাদব এবং রামাপতি যাদবের নামে। উদ্বোধনী অধিবেশনের পর বিদায়ী কমিটির রিপোর্ট পেশ করা হয় এবং তারপর ঐ রির্পোট নিয়ে আলোচনা হয় এবং প্রতিনিধিরা প্রস্তাব পেশ করেন।

খণ্ড-25
সংখ্যা-34