জি ডি আগরওয়ালের মৃত্যু মোদীর ‘নমামি গঙ্গে’ প্রহসনকেই প্রতীয়মান করল

গত ১১ অক্টোবর চলে গেলেন পরিবেশবিদ জি ডি আগরওয়াল। সেটা ছিল তাঁর অনির্দিষ্ঠকালের অনশনের ১১১তম দিন। গঙ্গা যাতে অপ্রতিহতভাবে এবং নির্মল হয়ে বয়ে যেতে পারে তার জন্যই তিনি ঐ অনশন করছিলেন। গত কয়েক মাসে তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদীকে তিনটি চিঠি লিখেছিলেন, যেগুলোতে তিনি অবরুদ্ধ গঙ্গার পরিবেশগত সংকটের নিরসনে সুবিবেচিত ও সুনির্দিষ্ঠ দাবি জানিয়েছিলেন। এই দাবিগুলোর কয়েকটি উত্তরাখণ্ডের কিছু পরিবেশ সংগঠন এবং জন আন্দোলনও তুলে ধরেছিল। আগরওয়াল দাবি করেছিলেন, গঙ্গার শাখা নদীগুলোতে প্রস্তাবিত বা নির্মীয়মান সমস্ত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করা হোক, যে শাখা নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে অলকানন্দা, ধৌলিগঙ্গা, নন্দাকিনি, পিণ্ডারগঙ্গা এবং মন্দাকিনি। তিনি আরো দাবি জানিয়েছিলেন, গঙ্গার নদীবক্ষে সমস্ত ধরনের খনন কার্য সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করতে হবে। এই দাবিগুলো তোলার মধ্যে দিয়ে আগরওয়াল শক্তিশালী ব্যবসায়ী ও কর্পোরেট স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন যাদের আবাসন নির্মাণ, খনন ও পরিকাঠামো নির্মাণে বিপুল বাণিজ্যিক স্বার্থ জড়িত রয়েছে। তাঁর আগে আরো একজন স্বামী বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই সমস্ত বিষয়গুলির সমাধানে আরএসএস-বিজেপি এবং মোদী সরকারের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। স্বামী নিগমানন্দ গঙ্গার তীরে অবৈধ বালি খনন এবং খাদান কার্যকলাপ বন্ধের দাবিতে দীর্ঘদিন অনশনের পর ২০১১ সালে দেরাদুনে মারা যান। জানা যায়, কয়েকজন আরএসএস কর্মী খাদান ব্যবসার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল, আর তাই উত্তরাখণ্ডের বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার ঐ মুনাফাবাজিকে থামাতে কোনো আগ্রহই দেখায়নি।

আগরওয়াল মোদীকে শেষ চিঠিটি লেখেন এ বছরের ২৩ জুন যাতে তীব্র ভর্ৎসনা ছিল, তাঁর তীব্র ক্রোধ এবং হতাশা প্রকাশ পেয়েছিল। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, গঙ্গার সংকট নিরসনে মোদী সরকার “একটি পদক্ষেপও’’ নেয়নি। আরো বলেছিলেন, এর পরিবর্তে সরকার “কর্পোরেট ক্ষেত্র এবং কয়েকটি বাণিজ্যিক সংস্থার’’ স্বার্থই চরিতার্থ করেছে। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, এর আগে ইউপিএ জমানায় তাঁর অনশনের পরিপ্রেক্ষিতে সে সময়ের সরকার ভাগীরথী নদীর তীর বরাবর কয়েকটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করতে সম্মত হয়েছিল এবং গোমুখ থেকে উত্তরকাশি পর্যন্ত ১৩৫ কিলোমিটার ব্যাপী নদীর সম্মুখভাগকে পরিবেশ সংবেদনশীল এলাকা বলে ঘোষণা করেছিল। তাঁর বার্তা স্পষ্ঠ। এর আগের সরকারগুলো তাঁর কথা শুনতে বাধ্য হয়েছিল, আর এই সরকার গঙ্গানদীর প্রতি ভক্তিতে গদগদ হওয়ার ব্যাপারে সোচ্চার হলেও তাঁর দাবিগুলোকে অনমনীয়ভাবে অবজ্ঞা করে চলেছিল। আগরওয়ালের কোনো চিঠির জবাবই মোদী দেননি। বিজেপি নেত্রী উমা ভারতী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, কিন্তু তাঁর কোন দাবি মেনে নেওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ঠ প্রতিশ্রুতিই তিনি দেননি। আগরওয়ালের মর্মান্তিক মৃত্যু নরেন্দ্র মোদী এবং আরএসএস-বিজেপির ‘পরিবেশ সচেতনতা’ এবং ‘মা গঙ্গার’ জন্য বহু-বিজ্ঞাপিত উদ্বেগের ভয়াবহ এবং তমসাচ্ছন্ন প্রতীক হয়েই দেখা দিয়েছে। আগরওয়ালের মৃত্যু নানান দিক থেকেই মোদী জমানার প্রশাসনের মূল বৈশিষ্ট্যগুলোকে সামনে নিয়ে আসে : প্রকৃত ইস্যুগুলি নিয়ে “উদ্বেগকে’’ সোচ্চারে বিজ্ঞাপিত করা, উদ্বেগগুলোকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক বাগজাল বোনা এবং সেগুলোর সমাধান করতে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা।

২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে মোদী নিজেকে গঙ্গার এক বাধ্য সন্তান বলে ঘোষণা করেন, যে সন্তান তাকে নির্মল ও বিশুদ্ধ করতে ‘নিয়তি নির্দিষ্ঠ’। বিজেপির বিপুল বিজয়ের পর জনসমক্ষে আবির্ভূত হওয়ার প্রথম কয়েকটি অনুষ্ঠানের একটিতে তিনি বেনারসে একটি গঙ্গা আরতিও করেন। তিনি কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রকের নতুন নাম দেন “জলসম্পদ, নদী উন্নয়ন এবং গঙ্গা পুনরুজ্জীবন মন্ত্রক’’। দেশের সংকটাপন্ন সমস্ত নদীগুলির মধ্যে একটির বিশেষ পরিচর্যা পরিবেশবিদদের কাছে একটুও বিস্ময়ের সৃষ্টি করেনি। বেশ কিছুকাল ধরেই গঙ্গার “সুরক্ষা’’ সংঘের সাম্প্রদায়িক অভিযানের অন্যতম মূল অবলম্বন হয়ে এসেছে। হিন্দু পরিচিতির কেন্দ্রে থাকা গঙ্গাকে আর এস এস তাদের অনেক প্রচার কর্মসূচীরই সাংস্কৃতিক সম্বল করে তোলে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অশোক সিংঘাল ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে তেহেরি-বিরোধী আন্দোলনের সময় গঙ্গার সঙ্গে যে সুস্পষ্ঠ সংযোগের কথা বলেন তা আমরা যেন ভুলে না যাই : “আমি এখানে বাঁধের ভূকম্প প্রবণতা অথবা প্রকল্পের ব্যয়ের সাপেক্ষে সুবিধার কথা বলতে আসিনি। আমি গঙ্গত্ব সম্পর্কে বলছি। গঙ্গত্ব হল হিন্দুত্ব। হিন্দুত্ব হল রাষ্ট্রত্ব।’’ সংঘ পরিবারের কাছে গঙ্গা একটা রাজনৈতিক সম্বল মাত্র, হিন্দু রাষ্ট্রের বিষময় এবং একচেটিয়ার বৈশিষ্ঠপূর্ণ এজেণ্ডার জন্য সমর্থন জোগাড়ের এক ন্যক্কারজনক উপায়। জলসম্পদ মন্ত্রকের নতুন নামকরণ এবং গঙ্গাকে নির্মল করার নমামি গঙ্গে কর্মসূচীর শুরু (স্বভাবগত ঘটার সঙ্গে) এই বৃহত্তর রাজনৈতিক আখ্যানকেই প্রতীয়মান করে।

এইভাবে, রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর ছাড়া নমামি গঙ্গেতে আর কিছু কি আছে? মোদী সরকারের বিভিন্ন পরিবেশগত উদ্যোগ আসলে নমামি (প্রতি অভিবাদন) কর্পোরেট সমূহ, নমামি খনন এবং খাদান লবি! জল বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি হিমালয়ের পরিবেশের সর্বনাশ এবং গঙ্গার ধ্বংসসাধন করলেও একটি প্রকল্পকেও থামানোর কোনো চেষ্টাই হয়নি। বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি সরকারগুলো এবং কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেট জগতের স্যাঙ্গাৎদের তোষণ করে চলায় অবৈধ খনন এবং খাদান কার্যকলাপ অব্যাহতভাবে চলছে। ইতিমধ্যে, নমামি গঙ্গে প্রকল্পে ২০০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে, যার বেশিরভাগটাই যাচ্ছে পয়:প্রণালী প্রকল্পগুলির অনুমোদনে। মোদী যার নেতৃত্বে আছেন, সেই জাতীয় গঙ্গা পর্ষদ (এনসিজি) ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে গঠিত হওয়ার পর একবারও বৈঠক করেনি। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেছেন, নমামি গঙ্গে কর্মসূচীর অধীনে ১৮৭টি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে যার মধ্যে ৪৭টি প্রকল্প সম্পূর্ণ হয়েছে, আর বাকি প্রকল্পগুলি সম্পাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। দ্য ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গা অরুণ জেটলির এই দাবির বিরোধিতা করে জানিয়েছে, অনুমোদিত ৯৫টি প্রকল্পের মধ্য মাত্র ১৮টি সম্পূর্ণ হয়েছে। এই প্রকল্পে বরাদ্দ করা অর্থের অপব্যবহার এবং বেশ কিছু লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া এবং নির্দিষ্ঠ সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার জন্য কম্পট্রোলার এণ্ড অডিটর জেনারেল কেন্দ্রীয় সরকারের তীব্র ভর্ৎসনা করেছে।

পরিবেশগত বিষয়গুলিতে মোদী সরকারের নির্ভেজাল কপটতা তার মাত্রাধিক্য এবং কদর্যতা নিয়ে আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে। ঐ কপটতা নিয়ে সোচ্চার হওয়ার সময় দেশের জনগণের কাছে সমুপস্থিত। আমাদের নদীগুলো সাম্প্রদায়িক সমাবেশ এবং কর্পোরেটদের মুনাফাবাজির হাতিয়ার হয়ে উঠলে আমরা মুখবুজে চেয়ে থাকতে পারি না।

খণ্ড-25
সংখ্যা-33