দিল্লীর মালব্য নগরে মহম্মদ আজীম হত্যার তথ্যানুসন্ধান রিপোর

বছরের পর বছর মাদ্রাসার আবাসিকদের দায়ের করা হেনস্থার অভিযোগগুলিতে পুলিশ কোনও সক্রিয়তা দেখায়নি। ওয়াকফ বোর্ডের জমি ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সামাজিকভাবে একঘরে করে রাখার বিবাদের প্রতি সরকারের দীর্ঘ উদাসীনতার পরিণামে ৮ বছরের বালকের হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

সিপিআই(এমএল), সিপিআই(এম), আইসা ও গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির তথ্যানুসন্ধানী দলের রিপোর্ট হল:

২৫ অক্টোবর দিল্লীর মালব্য নগর এলাকায় মহম্মদ আজীম নামে আট বছর বয়সী এক বালক একদল নাবালকের গণপিটুনিতে খুন হয়েছে বলে অভিযোগ। আজীম মালব্য নগরের জামিয়া ফরিদিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করত। অতি দরিদ্র পরিবারের যে ৭০ জন ছাত্র মাদ্রাসায় পড়তো, আজীম ছিল তাদেরই একজন। দেশজুড়ে শাসক বিজেপি ও আরএসএসের নেটওয়ার্ক দ্বারা পরিকল্পিতভাবে মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়ানো ও ভীড়-হিংসার অজস্র ঘটনার প্রেক্ষাপটে আজীমের মৃত্যুসংবাদটা এলো। সিপিআই(এমএল), সিপিআই(এম), সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি ও আইসার একটি দল গত ২৬ অক্টোবর সেই মাদ্রাসা, যেখানে আজীম থাকত এবং সংলগ্ন বাল্মিকী কলোনি এলাকা পরিদর্শন করে। পরিদর্শক দলে ছিলেন- সেহবা, সুচেতা, কওয়ালপ্রীত, মাইমুনা মোলহা, কবিতা শর্মা, সুবীর মুখার্জী, সোমদুস্ত শর্মা, আব্দুল মান্নান সিদ্দিকী ও আবু মাজ। আমাদের টিম ঐ মাদ্রাসার পড়ুয়া বাচ্চাদের কয়েকজনের সাথে দেখা করে, যারা আজীমের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিল বলে জানিয়েছে। তাদের বিবরণ অনুযায়ী, ২৫ অক্টোবর সকালে কয়েকজন বালক মাদ্রাসা লাগোয়া পুরানো কবরস্থানে খেলা করছিল। পার্শ্বস্থ জেজে কলোনি বা বাল্মিকী কলোনির আরো কিছু ছেলে কবরস্থানের সামনে খেলছিল। বাজী ফাটানোর শব্দ শুনতে পেয়ে মাদ্রাসার বাচ্চা ছেলেরা কলোনির বাচ্চাদের কাছে গিয়ে বাজি ফাটাতে বারণ করলে দুই দল বালকের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। সেখানে পার্কিং করে রাখা একটি মোটরসাইকেলের উপর আজীমকে ছুঁড়ে ফেলা হয় এবং সাথে সাথেই সে নেতিয়ে পড়ে। এলাকা থেকে আমাদের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আজীমের হত্যার সাথে জড়িতদের সকলেই ছিল ১১-১৩ বছর বয়সী। কিন্তু মাদ্রাসার পড়ুয়াদের থেকে আরো জানা গেছে যে কয়েকজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন যারা ঐ আক্রমণ থামানোর কোনও চেষ্টাই করেননি।

আজীমের হত্যাকান্ডের পিছনে উক্ত মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত ঘৃণা ও উদ্বেগের একটা ইতিহাস রয়েছে। মাদ্রাসার ইমাম, আবাসিকরা এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত আশপাশের এলাকার মুসলিম মানুষজন আমাদের জানান যে, ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার ঐ মাদ্রাসার আবাসিকদের বিরক্ত করা, হেনস্থা করা ও প্ররোচনা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমন বহু ঘটনার দৃষ্টান্ত আছে। মাদ্রাসার সামনের খোলা জায়গায় আতসবাজি ছোঁড়া হয়েছে, এমনকি মাদ্রাসার সামনে প্রকাশ্যে মদের বোতল ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। এবিষয়ে আবাসিকরা বারবার পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও কোনও তদন্ত হয়নি বা এজাতীয় উদ্দেশ্যমূলক হেনস্থার ঘটনা বন্ধ করার কোনোপ্রকার উদ্যোগ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি। আমরা আরো জানতে পেরেছি যে, মাদ্রাসার নিকটবর্তী ঝুগ্গিটি, যেখানে বাচ্চাদের খাবার তৈরি হয়, সেটি গতবছর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনাটি সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়েছিল ও দিল্লী পুলিশ ঘটনাটি সম্পর্কে ভালোরকমই অবগত ছিল। মাদ্রাসা সংলগ্ন খোালা জায়গার জমিটি নিয়ে একটি বিবাদ রয়েছে। ইমামের বক্তব্য অনুযায়ী, জামিয়া ফরিদিয়া মাদ্রাসাটি একটি পুরোনো মাদ্রাসা যেটি ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। খোলা জমিটি ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি এবং মাদ্রাসার অন্তর্গত। কিন্তু জমিটি বছরের পর বছর ধরে বাল্মিকী কলোনির বাসিন্দারা ব্যবহার করেন। বাল্মিকী কলোনির শিশুরা ঐ মাঠে খেলাধুলা করে আর মাদ্রাসা ও কলোনির সংযোগকারী সংকীর্ণ রাস্তাটিতেও মানুষ যাতায়াত করেন। মাদ্রাসার আবাসিকরা মাদ্রাসার অন্তর্গত জমিটিকে বারংবার একটি বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘিরে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। চারপাশের এলাকা ও বিতর্কিত জমিটি নিয়ে চাপান-উতোর বাড়লেও সরকার ও প্রশাসনের তরফে বিষয়টি সমাধানের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, বরং মাদ্রাসার আবাসিকদের প্রতি ঘৃণা বাড়তে দেওয়া হয়েছে।

আমাদের তথ্যানুসন্ধানী দল লাগোয়া বাল্মীকি কলোনিতেও গিয়েছিল। এই জায়গাটিতে মূলত দিনমজুর পরিবারগুলির বসবাস। এই কলোনিটি ঝুপড়ি ও সংকীর্ণ, অন্ধকার গলি পরিপূর্ণ এলাকা। যখন ওখানে যাই তখন কলোনির বাসিন্দারা আজীমের মৃত্যুর বিষয়ে কথাবার্তা বলছিলেন। তাঁরা জানান যে, জমিসংক্রান্ত বিবাদটি দীর্ঘদিন চলছিল। তাদের বাচ্চারা ঐ খোলা জমিটিতে খেলত আর তাঁরাও মাদ্রাসা লাগোয়া রাস্তাটি এলাকার বাইরে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করতেন।

এটা খুবই দূর্ভাগ্যজনক ও ধিক্কারযোগ্য ব্যাপার যে দিল্লী পুলিশ দীর্ঘদিন ধরে মাদ্রাসার আবাসিকদের অভিযোগ পেয়েও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি ও জমি বিবাদের সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। দেশজুড়ে তীব্র সাম্প্রদায়িকতার আবহে যখন প্রতিদিন শাসক দল এবং আরএসএসের নেটওয়ার্ক দ্বারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো ও মাদ্রাসাগুলির সম্পর্কে মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছে তখন দিল্লী পুলিশ সেই ঘৃণার আবহাওয়াকে বাড়তে দিয়েছে। যে ঘটনার পরিণতিতে আজীমের মৃত্যু হল তা কেবলমাত্র একটি জমি সংক্রান্ত বিবাদের জন্য উদ্বেগজনক নয়, বরং এটা মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে ছকে বাঁধা নেতিবাচক তকমা দেওয়ার ও কালিমালিপ্ত করার ক্রমবর্ধমান ঘটনার দিকে নির্দেশ করে। ক্ষমতাসীনদের উদাসীনতা একটি ৮ বছরের শিশুর মৃত্যু ঘটালো যে শিশুটি মেওয়াটের একটি দরিদ্র মুসলিম পরিবার থেকে এসেছিল, যার মা বাবা দিনমজুরি করে পরিবারের অন্নসংস্থান করেন।

আমরা দিল্লী পুলিশের কার্যকর্তাদের শাস্তি দাবি করছি যারা মাদ্রাসার আবাসিকদের দায়ের করা হেনস্থা সংক্রান্ত অভিযোগগুলি দিনের পর দিন অগ্রাহ্য করেছে। মাদ্রাসা সংলগ্ন খোলা জমিটিকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত বিবাদ দ্রুততার সাথে সমাধান করা উচিত। ঐ জমিটিকে ওয়াকফ বোর্ডের জমি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। বাল্মিকী বা জেজে কলোনির শিশুদের খেলার জন্য উপযুক্ত মাঠ ও মানুষের চলাচলের প্রয়োজনীয় রাস্তা অবিলম্বে নির্মাণ করতে হবে।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক সম্প্রদায়কে অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উসকিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার আঁচে হাওয়া দিতে চাইবে গেরুয়া শিবির, এরকম যেকোনো প্রচেষ্টাকে আমাদের সমষ্টিগতভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।

খণ্ড-25
সংখ্যা-33