সম্পাদকীয়
পরিস্থিতি সম্পর্কে সজাগ থাকুন পরিবর্তনে সক্রিয় হোন

প্রতিবেশী অসম রাজ্যে বিজেপি শাসনে এনআরসি প্রয়োগ সমস্তরকমের ধ্বংসাত্মক পরিবেশ সৃষ্টি করছে। লক্ষ লক্ষ অ-অসমীয়াভাষী জনতাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বিতাড়নের তালিকায়, হাজার হাজার প্রধানত মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজনকে আটকে রাখা হয়েছে ‘বিদেশী’ সন্দেহে ডিটিসি ক্যাম্পে। এই দ্বৈত পলিসির অতর্কিত আক্রমণ প্রবল বিতর্ক ও বিরোধিতারও সম্মুখীন হচ্ছে অসমের ঘরে-বাইরে, বিশেষত অসমের বাঙালি সমাজে ও পশ্চিমবঙ্গে, যেহেতু বাংলাভাষীরাই সবচেয়ে আক্রান্ত, আর তাদের এক উল্লেখযোগ্য অংশের শিকড় রয়েছে উত্তরবঙ্গের সীমান্ত জেলাগুলিতে। তবে জাতিবিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক সারবস্তুর নিশানায় রয়েছে হিন্দীভাষী সহ অপরাপর ভাষাভাষী মায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েরা লোকেরা। এক অগণতান্ত্রিক অবস্থান, পলিসি ও পদক্ষেপকে ‘যুক্তিসঙ্গত’ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়ে বিজেপির সোনোয়াল সরকারকে সময় নেওয়া ঘোষণা করতে হয়েছে। তবে তাতে হত্যা-আত্মহত্যা-সন্ত্রস্ত হওয়ার অনিবার্যতা রোধ হচ্ছে না। বিষপ্রবাহ চলছেই। আর সেই বিষের আগুনে ঘি ঢালছে কেন্দ্রের ও অসমের বিজেপি মন্ত্রী ও নেতারা। অসম থেকে নির্বাচিত বিজেপি সাংসদ ও রেল মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী রাজেন গোঁহাই সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আওয়াজ তুলেছেন অসমের অধিকাংশ জেলা মুসলিমপ্রধান হয়ে যাচ্ছে! এদিক থেকে বাংলার বিজেপি রাজ্য সভাপতি কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অসম মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে খোলা আবেদন রেখেছেন অসমে যেন বাঙালি হিন্দুদের রক্ষা করা হয়! বিজেপি উপরন্তু অপেক্ষায় নয়া নাগরিকত্ব সংশোধনীর বিল পাশ করানোর উদ্দেশ্যে। আশু উদ্দেশ্য আগামী লোকসভা নির্বাচন। বিজেপির প্রয়োজন ওখানে অসমীয়া হিন্দু আর এখানে বাঙালি হিন্দু সংহতকরণের রাজনীতি ও ভোট।

বঙ্গরাজ্যের তৃণমূল ও মমতা সরকার একটা অবস্থান নিয়েছে বটে, এনআরসি-র ও অপেক্ষামান ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে’র বিরোধিতার, তবে সেটা মৌলিক নীতিগত ভিত্তিতে নয়, ভোটদখল সর্বস্বতার খাস প্রয়োজনবাদী স্বার্থে। তৃণমূল দলনেত্রী-মুখ্যমন্ত্রী প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছেন তিনসুকিয়ার হতাহতের শিকার হওয়া অঞ্চলে, তারা সবকিছু পরিদর্শন করে দাবিও করেছেন সংঘটিত হচ্ছে বিদ্বেষ-বিভাজনে মানুষক্ষ্যাপানো ব্যাপক হিংসার ঘৃণ্য অপরাধ। আর বার্তা দিচ্ছেন, যে কোনো মূল্যে এনআরসি-র বিরোধিতার, আর তথাকথিত পঞ্জিকরণে বাতিলের শিকার হওয়া বাঙালি বা যে কোনো ভাষাভাষী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা জবরদস্তি অসম থেকে বিতাড়িত হলে তাদের আশ্রয় দিতে বাংলার দরজা দরাজ রাখার। এই আপাতচারিতায় হয়ত মনে হতে পারে কাদা নেই, কিন্তু তৃণমূলকে যদি এরাজ্যের আরসির সামনে দাঁড় করানো হয় তবে উন্মোচিত হয় দ্বিচারিতা নয়কি? মৌলিক নীতিগত মানদণ্ডের বিচারে?

তৃণমূল জমানা এরাজ্যকে বিরোধীশূন্য করার অভিযানে উন্মত্ত। সমস্ত রকমের প্রাতিষ্ঠানিক নির্বাচনী গণতন্ত্র, শাসকের দলতন্ত্রের বিরুদ্ধাচরণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিরোধিতার সভা-সমাবেশের ও আন্দোলনের গণতান্ত্রিক অধিকার, এমনকি বিরুদ্ধতার সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা—সবকিছুর ওপর চলছে আক্রমণ। ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে বিজেপি অভিযান চালাচ্ছে গোটা দেশকে বিরোধীশূন্য করতে। তৃণমূলও ঠিক সেটাই চাইছে তার রাজত্বে স্বৈরাচার কায়েম করতে, যা কিনা আবার খাল কেটে ডেকে আনছে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পরিত্রাতা’র ছদ্মবেশধারী বিজেপিকে। বিজেপির সাথে তৃণমূলের ‘পার্থক্য-দ্বন্দ্ব-সংঘাত’-ক্ষেত্র এখানে কেবল এরকমই। তাই দেশের শত্রু বিজেপির বিরোধিতায় তৃণমূলকে, আর রাজ্যের চক্ষুশূল তৃণমূলের বিরোধিতায় বিজেপিকে সূচ্যগ্র জমি ছাড়ার সুযোগ দেওয়া যায় না। এই চেতনে সচেতন হতে হবে। চ্যালেঞ্জ নিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। বাংলার বিরাজমান নির্দিষ্ট পরিবেশ-পরিস্থিতিতে এই প্রকৃত যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবসম্মত আগুয়ান ভূমিকা পালনে অবিরত থাকতে হবে বামপন্থী শক্তিগুলিকে।

খণ্ড-25
সংখ্যা-34