বৈচিত্র্যহীনতা, শাস্তিহীনতা এবং অনৈক্যের মূর্তিগুলো
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়,
৬ নভেম্বর ২০১৮)

বিজেপি এবং মোদী সরকার দুর্নীতি এবং কেলেঙ্কারিতে ডুবে থাকায় এবং দেশের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, ক্ষেত্র এবং জনগণের ব্যাপক অংশ সংকটের কবলগ্রস্ত হওয়ায় ওরা জবাবদিহির দায়বদ্ধতাকে এড়াতে এবং রাজনৈতিক আলোচনার ধারাকে পাল্টানোর লক্ষ্যে ক্রমেই আরো বেশি করে বিভেদ সৃষ্টি এবং দৃষ্টিকে বিক্ষিপ্ত করার উপরই নির্ভরশীল হচ্ছে।

বিশ্বের দীর্ঘতম মূর্তি বলে জাহির করা ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলর ৫৯৭ ফুট উঁচু ‘ঐক্যের মূর্তি’ দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার মোদী সরকারের সাম্প্রতিকতম প্রয়াস রূপে দেখা দিয়েছে। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, মিথ্যাচার এবং নানান কেলেঙ্কারির পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের চোখে মোদী খাটো হয়ে ওঠায় তিনি বল্লবভাই প্যাটেলের নাম নিয়ে নিজেকে দীর্ঘতর রূপে প্রতীয়মান করতে চাইছেন।

মোদী বয়ানে প্যাটেল ছিলেন নেহরুর বিরোধী, নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের বিপরীতে তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধিত্ব করতেন। মোদী এবং বিজেপি যখন ‘ঐক্য’র কথা বলে তখন তারা একরূপতাকেই বোঝায়—অন্যভাবে বললে, সংখ্যাগুরুর দিক থেকে সমস্ত ভারতবাসীর উপর একই ধর্মবিশ্বাস, একই ভাষা এবং একই খাদ্যাভাস চাপিয়ে দেওয়া এবং এইভাবে বৈচিত্র্যকেই জাতীয়তা-বিরোধী এবং অনৈক্যের উৎস রূপে তুলে ধরা। বস্তুত, আরএসএস-এর কাছে ‘ঐক্য’র সংজ্ঞা হল এরকম—আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা নেতা গোলওয়ালকার তাঁর বাঞ্চ অব থটস রচনায় সুস্পষ্ট রূপে বলেন যে, আরএসএস-এর কাছে মুসলিম, খ্রিষ্টান এবং এমনকি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং শিখরাও হল বিভেদকামী ও সাম্প্রদায়িক, কেননা তারা নিজেদের হিন্দু বলতে অস্বীকার করে; আর হিন্দি ভাষাকে মেনে নিতে অস্বীকার করায় তামিল জনগণও হল বিভেদকামী!

প্যাটেলকে আত্মসাৎ করতে এবং তাঁর উত্তরাধিকারকে নেহরুর উত্তরাধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর মোদী এবং বিজেপির তৎপরতার মধ্যে অসততারই পরিচয় পাওয়া যায়। এ বিষয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই যে, নেহরু একটি চিঠিতে প্যাটেলকে ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁকে “মন্ত্রীসভার সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভ’’ রূপে অভিহিত করেন। এছাড়া, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হিসাবে আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করতে প্যাটেল কোনো দ্বিধা দেখাননি এবং একটি সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলেন, “সংঘের আপত্তিজনক এবং ক্ষতিকারক কার্যকলাপ কিন্তু অপ্রতিহতভাবেই চলেছে এবং সংঘের কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে হিংসার যে উন্মাদনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং উৎসাহিত করা হয়েছে, অনেক মানুষই তার শিকার হয়েছেন। এর সর্বশেষ এবং সবচেয়ে মূল্যবান শিকারটি হলেন স্বয়ং গান্ধিজি।’’ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে লেখা একটি চিঠিতেও প্যাটেল বলেন, “হিন্দু মহাসভার চরমপন্থী অংশটি যে ষড়যন্ত্রে (গান্ধিকে হত্যা করার) যুক্ত ছিল তা নিয়ে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই। আরএসএস-এর কার্যকলাপ সরকার এবং রাষ্ট্রের অস্তিত্বের কাছে সুস্পষ্ট বিপদ রূপে দেখা দিচ্ছে। আমাদের রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে, নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সত্ত্বেও ঐ সমস্ত কার্যকলাপের তীব্রতা কমেনি। বাস্তবিকই, সময় যত এগিয়েছে, আরএসএস চক্রগুলি ততই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং তাদের নাশকতামূলক কার্যকলাপকে বাড়িয়ে চলেছে।’’ প্যাটেল সরাসরি গোলওয়ালকারের কাছেও চিঠি লিখে বলেন, আরএসএস-এর ছড়ানো সাম্প্রদায়িক গরলের পরিণামে “দেশকে গান্ধিজির অমূল্য জীবনের ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে’’ যার পর “আরএসএস-এর লোকজন আনন্দ প্রকাশ করে এবং গান্ধিজির মৃত্যুর পর মিষ্টি বিলি করে।’’ প্যাটেল এবং নেহরুর মধ্যে যে মতভেদই থাক না কেন, আরএসএস যে সহিংস সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিভূ ছিল তার বিরোধিতায় তাঁরা দুজনে সুনিশ্চিত ভাবেই ঐক্যবদ্ধ ছিলেন এবং এই বিশ্বাসের অংশীদারও তাঁরা ছিলেন যে, এই বিষময় রাজনীতিই গান্ধির প্রাণ নিয়েছে।

২০১৯-এর নির্বাচনের অভিমুখে একমাত্র প্যাটেলের মূর্তিই ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে না। প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথও অযোধ্যায় প্যাটেলের মূর্তির চেয়ে আরও দীর্ঘ রামের মূর্তি বানানোর কথা ঘোষণা করা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন। মোদী এবং যোগী সরকারের যে ব্যর্থতাগুলো একেবারে প্রকট হয়ে উঠেছে, যেগুলোর পরিণামে ভারতে বেকারি, কৃষি ক্ষেত্রে দুর্দশা এবং দুর্নীতির সংকট চরমতম রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে সেগুলো থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই বিশালাকায় ঐ মূর্তিগুলো নিয়ে হৈ চৈ করা হচ্ছে।

প্যাটেলের সুউচ্চ মূর্তির জন্য সামাজিক মূল্য কত দিতে হচ্ছে? মূর্তি বানানোর খরচ হল ২৯৮৯ কোটি টাকা—ইণ্ডিয়াস্পেণ্ড সংস্থার মতে যে টাকা দিয়ে দুটো নতুন ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) ক্যাম্পাস, দুটো নতুন এআই আইএমএস ক্যাম্পাস, পাঁচটা ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (আইআইএম) ক্যাম্পাস বানানো যেত এবং ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) মঙ্গলগ্রহে ছ-বার যান পাঠাতে পারত। ঐ টাকা দিয়ে ৪০,১৯২ হেক্টর জমিতে সেচের ব্যবস্থা, ১৬২টা ছোটখাটো সেচ প্রকল্পের মেরামতি, সেগুলোকে নবরূপ দান এবং পুনরুজ্জীবন ঘটানো এবং ৪২৫টা ছোট চেক-বাঁধ বানানো যেত। মূর্তি নির্মাণ প্রকল্পের জন্য গুজরাটের নর্মদা জেলার ৭২টা গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হওয়া এবং কোনো ধরনের পুনর্বাসন না পাওয়া ৭৫ হাজার উপজাতি জনগণ মূর্তি উদ্বোধনের সময় প্রতিবাদ দেখিয়েছেন। গুজরাটের চারটি জেলার যে ১৫০০ কৃষক সনখেডার সর্দার চিনি কলে আখ বিক্রির দরুণ ১২ কোটি টাকা বকেয়া পাওনার বৃথাই প্রত্যাশায় রয়েছেন, তাঁরাও মূর্তি উদ্বোধনের সময় প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল, ‘ঐক্যের মূর্তি’ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মোদী সরকার বিরোধী পক্ষের একজন নেতাকেও আমন্ত্রণ জানায়নি—এবং এইভাবে ‘ঐক্য’ নিয়ে কথাবার্তাকেই তারা উপহাস করেছে। এই দেশের এতদিনের ইতিহাসে মোদী সরকারকেই সবচেয়ে বেশি অনৈক্য এবং বিভেদ সৃষ্টি করতে দেখা যাচ্ছে—যার ফলে সাম্প্রদায়িক হিংসা, গণপ্রহার এবং বিজেপি নেতাদের মুখনিঃসৃত ঘৃণার বচনের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। আর তাই ‘ঐক্যের মূর্তি’ নিয়ে মোদী সরকারের এই প্রচার প্রতারণার প্রয়াস ছাড়া অন্যকিছ নয়। মোদী সরকার এবং বিজেপি আবার নির্লজ্জভাবে শাস্তি এড়ানোর নজিরবিহীন জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত—মানবজাতির বিরুদ্ধে সংঘটিত জঘন্যতম অপরাধের দায়কে এড়াতে তারা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাচ্ছে। এর সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত হল সোহরাবুদ্দিন শেখ হত্যা মামলায় এক সাক্ষীর আদালতের কাছে দেওয়া সাক্ষ্য, যাতে তিনি ফাঁস করে দিয়েছেন যে, গুজরাটের পূর্বতন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হরেন পাণ্ড্যকে হত্যার জন্য গুজরাটের প্রাক্তন পুলিশ অফিসার ডি জি বানজারা তাঁর সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। কেউ কি এই কথাটা ভুলতে পারে যে, জেলে থাকার সময় বানজারা এক খোলা চিঠিতে মোদীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, বানজারা এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসাররা হত্যার যে সমস্ত অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে, তার সবই করা হয়েছে মোদীকে সুবিধা দিতে এবং তাঁর অনুচর অমিত শাহর নির্দেশে? একটা মূর্তি, তা যত লম্বাই হোক না কেন, কখনও কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত চুক্তিতে সংঘটিত একের পর এক নারকীয় হত্যাকাণ্ডকে ঢেকে দিতে পারে?

ভারতকে বিভাজিত করতে এবং ভারতের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লাগা ফ্যাসিস্ত শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়াটাই হবে ভারতের বহুবিচিত্র জনগণের পক্ষে ঐক্যের সবচেয়ে বড় আত্মঘোষণা।

খণ্ড-25
সংখ্যা-35